নারীর শক্তির প্রতীক দেবী দুর্গা

Published : 13 August 2011, 02:33 PM
Updated : 21 Oct 2015, 01:31 PM

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী যেখানে কোমল, ক্ষমতাহীন, যৌনতার প্রতীক সেখানে 'শক্তি-রূপেন সংস্থিতা' দেবী দুর্গার মহিষাসুর-মর্দিনী প্রতিমা স্মরণ করিয়ে দেয় আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজের নারী-নেতৃত্বের কথা। প্রকৃতির অপরিমেয় শক্তি এবং নারীর সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা ছিল আদিম মানব সমাজের কাছে বিস্ময়। তাই প্রাচীন সমাজগুলোতে মাতৃদেবীর পূজাই ছিল প্রধান। দেবীদের মাহাত্ম্যসূচক পৌরাণিক আখ্যানগুলো মাতৃতন্ত্রের অবশেষরূপে সমাজে টিকে ছিল বহুকাল।

পরবর্তীতে পুরুষতন্ত্র যত শক্তিশালী হয়েছে তত পুরুষ দেবতারা ক্ষমতা লাভ করেছেন এবং প্রধান দেবীরা চলে গেছেন দ্বিতীয় অবস্থানে; কখনও প্রধান দেবতার স্ত্রী, কখনও কন্যারূপে। সুমেরিয়া, মিশর, গ্রিস, প্রাচীন ভারত– সর্বত্রই এটি ঘটেছে।

দেবী দুর্গা পরমা প্রকৃতিরূপে পূজিত হয়েছেন ভারতীয় এবং মূলত বাঙালি সমাজে। তবে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে অবাঙালিরা ভিন্ন ভিন্ন নামে দুর্গাপূজা করেন। যেমন, কাশ্মীর ও দাক্ষিণাত্যে অম্বা ও অম্বিকা, গুজরাটে হিঙ্গুলা ও রুদ্রাণী, কান্যকুব্জে কল্যাণী, মিথিলায় উমা, কুমারিকায় কন্যাকুমারীর পূজা প্রচলিত।

দুর্গা আদ্যাশক্তি মহামায়া এবং নারীরূপে বিশ্বের পরম শক্তির প্রকাশ। মহিষ-মর্দিনী, শূলিনী, পার্বতী, কালিকা, ভারতী, অম্বিকা, গিরিজা, বৈষ্ণবী, কৌমারি, বাহারী, চণ্ডী, লক্ষ্মী, উমা, হৈমবতী, কমলা, শিবাণী, যোগনিদ্রা প্রভৃতি নামে ও রূপে বিভিন্নভাবে তার পূজা হয়ে থাকে। দেবী বন্দনার স্তোত্রের দিকে একটু চোখ ফেরালে দেখতে পারি, 'মাতৃরূপে', 'পিতৃরূপে', 'শক্তিরূপে', 'শান্তিরূপে', 'বিদ্যারূপে' আবির্ভূত এক মহাশক্তির আরাধনা করা হচ্ছে এখানে। 'দেবী ভাগবত', 'মার্কণ্ডেয় চণ্ডী' ও 'কালিকা পুরাণ' অনুসারে জানা যায়, পুরাকালে অসুরদের প্রধান, মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করেন। ব্রহ্মার বরে তিনি ছিলেন পুরুষের অবধ্য। তাই বিষ্ণুর পরামর্শে দেবতাদের সম্মিলিত তেজে পরম শক্তি নারীরূপে আবির্ভূত হন দুর্গা। সব দেবতা নিজের নিজের অস্ত্র ও তেজ এই দেবীকে দেন।

এই শক্তি নিয়ে দুর্গা মহিষাসুরকে তিনবার বধ করেন। প্রথম বার অষ্টাদশভুজা উগ্রচণ্ডারূপে; দ্বিতীয় ও তৃতীয় বার দশভুজা দুর্গারূপে। এর আগে, পুরাকালে দুর্গ বা দুর্গম নামে অসুর বধ করেছিলেন বলে এবং জীবের দুর্গতি নাশ করেন বলে তার নাম 'দুর্গা'।

দেবী দুর্গার উপাখ্যান আরও পাওয়া যায় 'কালীবিলাসতন্ত্র', 'মহাভাগবত', 'বৃহন্নন্দিকেশ্বরপুরাণ', 'দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী', 'দুর্গোৎসববিবেক', 'দুর্গোৎসবতত্ত্ব' ইত্যাদি বইতে। দেবী-পূজার মূল উৎস হচ্ছে সনাতন ধর্মের আদি শাস্ত্র, বেদ। অভৃশ্য ঋষির কন্যা ব্রহ্মবাদিনী বাক সর্বপ্রথম তার অতীন্দ্র ধ্যাননেত্রে আবিস্কার করেন দেবীসূক্ত। এই দেবীসূক্তই হচ্ছে মাতৃবন্দনার মঙ্গলসূত্র। তার মানে দেবীসূক্তের আবিস্কারও করেন একজন নারী।

পুরান অনুসারে রাজ্যহারা রাজা সুরথ রাজ্য ফিরে পাবার জন্য বসন্তকালে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন। তাই এ পূজার নাম হয় 'বাসন্তী পুজা'। রামচন্দ্র রাবণবধের জন্য শরৎকালে দেবীর পূজা করেন। অকালে পূজা করেন বলে এর নাম হয় 'অকালবোধন'। শারদীয়া দুর্গাপূজাই তখন থেকে বেশি প্রচলিত হয়। রাজাহারা যুধিষ্ঠির বিপদনাশ ও রাজ্য ফিরে পাবার জন্য দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন বলে মহাভারতে উল্লেখ রয়েছে। সবগুলো ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, যুদ্ধজয় ও বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য দেবীর পূজা হয়েছে। দেবী দুর্গা তাই জয়-প্রদায়নকারী ও দুর্গতিনাশিনী।

রাঢ়, বঙ্গ, সমতট, পুণ্ড্র, হরিকেলসহ সমগ্র বঙ্গদেশে (পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গ মিলে) আবহমানকাল থেকে মাতৃদেবীর পূজা প্রচলিত ছিল। কখনও স্থানীয় অনার্য দেবীরূপে, কখনও আর্যদেবী রূপে বিভিন্ন নামে নারীশক্তির আরাধনা হয়েছে। তবে শারদীয় দুর্গাপূজার বর্তমান যে রূপ আমরা দেখি তার বিকাশ মধ্যযুগে। বলা হয়ে থাকে, রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণ এবং নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় জাঁকজমকের সঙ্গে দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন। কিন্তু তার আগে, দশম ও একাদশ শতকেও বাংলায় দুর্গাপূজা প্রচলিত ছিল বলে গবেষকরা অনুমান করেন।

বাঙালির দুর্গাপূজায় দেবী দুর্গার সঙ্গে থাকেন তার কন্যা বিদ্যাদেবী সরস্বতী, ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মী, পুত্র সিদ্ধিদাতা গণেশ ও বীর কার্তিক। মাথার উপরে শায়িত থাকেন স্বামী মহাদেব। পায়ের নিচে বাহন হিসেবে থাকে সিংহ। দেবীর হাতে ধরা ত্রিশূলবিদ্ধ অবস্থায় থাকে মরণোন্মুখ অসুর। দেবী সাত্ত্বিক, সিংহ রাজসিক ও অসুর তামসিক শক্তির প্রতীক।

বাঙালির দুর্গাপূজার একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হল, দুর্গার মতো শক্তিময়ী, অস্ত্রধারী ও জগদ্ধাত্রী দেবীকে কন্যারূপে ও মাতৃরূপে কল্পনা করা। বাঙালির দুর্গা যেন তার একান্ত ঘরের মেয়েটি যে শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছুদিনের জন্য ছেলেমেয়ে নিয়ে বাবার বাড়ি বেড়াতে এসেছে। পরম শক্তির সংহারক ও ভীতিকর রূপের পরিবর্তে তাকে আপনজনের মতো কোমল রূপে দেখা, ভয়ের বদলে তাকে স্নেহ ও ভক্তি করার মধ্য দিয়ে উপাসনায় উৎসবের যে রূপবদল সেটা বাঙালির একান্ত নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতিগতভাবে বাঙালি মারমুখী ও যুদ্ধংদেহী মনোভাবের নয়। পলিমাটির মতো তার স্বভাব নম্র। পার্বত্য নদীর মতো খরস্রোতা নয়, বরং মোহনায় বিস্তৃত হয়ে কল্যাণীরূপে প্রবাহিত এদেশের নদীর মতোই বাঙালি ধীরলয়ে প্রবাহিত, উদাসী।

শরৎ-হেমন্তে ফসল তোলার সময় আবহমানকাল থেকেই এ জনপদে উৎসবের রীতি ছিল। সে উৎসবেরই একটি অংশ শারদীয় পূজা। ফসল তোলার সময় বাবা-মায়ের ঘরে বেড়াতে আসে প্রিয় কন্যা। সঙ্গে আসে তার স্বামী ও ছেলেমেয়েরা। দেবী দুর্গার পূজা রূপ পায় বাঙালির গৃহস্থ পরিবারের মিলনোৎসবে।

পূজামণ্ডপগুলোতে যে ঐতিহ্যবাহী চেহারায় প্রতিমা দেখা যায় তার দশহাতে অস্ত্র, বাহন হিসেবে সিংহ এবং পায়ের নিচে অসুর থাকলেও দেবীর মুখ সুন্দর ও কোমল। এই দেবী পরিপূর্ণভাবে বাঙালি নারী। আর্যদের মতো তার চুল সোনালি নয়, বরং অনাযর্সুলভ কালো ও কুঞ্চিত। তার শাড়ি বাঙালি ঢঙয়ে পরা; কণ্ঠহার, কঙ্কণ, চন্দ্রহারসহ অলংকারগুলো প্রাচীন বাংলায় প্রচলিত অলংকারের প্রতিরূপ। তিনি ত্রিনয়না বটে, তবে তার দীঘল কালো চোখ ও মুখাবয়ব চিরন্তন বাঙালি নারীর। বাঙালি নারীও দেবীরই প্রতিরূপ। দশভুজা দেবীর মতোই বাঙালি নারী ঘরে-বাইরে সব কাজ সামলে চলেন।

আশ্বিনের শুক্লা ষষ্ঠী থেকে শুক্লা নবমী পর্যন্ত দেবী দুর্গার পূজা হয়ে থাকে। দেবীর সঙ্গে যুক্ত হন আসুরিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্যা-বিজ্ঞানদায়িনী দেবী সরস্বতী, সর্বৈশ্বর্য প্রদায়িনী দেবী লক্ষ্মী, সর্বসিদ্ধিদাতা গণেশ, বলরূপী কার্তিক এবং ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন ত্যাগ ও বৈরাগ্যের প্রতীক মহাদেব। ফলে একই সঙ্গে শক্তি, জ্ঞান, ঐশ্বর্য, সিদ্ধি, বল ও বৈরাগ্যের সমাবেশ হয়।

দুর্গাপূজা সকলের। কারণ সব বর্ণের মানুষ এ পূজায় অংশ নিতে পারে। দেবীকে স্নান করাতে যে বিভিন্ন প্রকার মাটির প্রয়োজন হয় তার মধ্যে এমনকি বেশ্যাদ্বার-মৃত্তিকাও রয়েছে। এর অর্থ, সমাজের সকল শ্রেণির সকল স্তরের সকল পেশার মানুষ যেন এখানে অংশ নিতে পারে তা নিশ্চিত করা। দুর্গাপূজা যেমন হতে পারে কোনো পরিবারের বা ব্যক্তিগত, তেমনি হতে পারে বারোয়ারি বা সর্বজনীন। তার মানে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ সমষ্টিগতভাবে এ পূজা করতে পারে। আর বাংলাদেশে পুজামণ্ডপে তো যেতে দেখা যায় সব ধর্মের মানুষকেই। অন্য ধর্মের মানুষরা পূজার উদ্দেশ্যে মণ্ডপে যান না বটে, কিন্তু উৎসবে অংশ নেওয়ার সামাজিক প্রেরণা থেকেই তারা যান নিঃসন্দেহে।

পরমত ও পরধর্মসহিষ্ণুতা আমাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। বাঙালির মুখেই প্রথম উচ্চারিত হয়েছে 'সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই'। বাংলাদেশের সব ধর্মের মানুষ যেমন ঈদ ও মহরমের মেলায় আনন্দ করেন, তেমনি অংশ নেন শারদীয় উৎসবের দশোহরা মেলায়, চড়কে কিংবা বারুণীর মেলায়, রাসপূণির্মায় ও দোলোৎসবে।

ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবগুলোর সময় মানুষের উপর যে হামলা ও অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো ঘটে তা বাঙালির চিরন্তন সহিষ্ণুতার ঐতিহ্যের পরিপন্থী ও সাংঘর্ষিক। এগুলো আমাদের ঐতিহ্যের মূলধারা নয়|। আমাদের ঐতিহ্য হল বৈষ্ণব ও সুফীবাদ, নাথপন্থা, বাউলদের মানবপ্রেমের ও সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শ। আমরা নিজের নিজের ধর্মে নিষ্ঠাবান হয়েও সকল ধর্মের সম্মান করার ঐতিহ্য ধারণ করি।

শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালির সামাজিক উৎসব। এ উৎসব মিশে আছে শরতের শিউলি আর ছাতিম ফুলের সৌরভে, কাশবনের শুভ্রতায়, শারদীয় আকাশের নীলে। মানবমনের ভিতরে যে অসুর বাস করে তার বিনাশ করার মাধ্যমেই মহাশক্তির জয়। জ্ঞান, বিদ্যা, মানসিক ঐশ্বর্য, বল ও বৈরাগ্যের মাধ্যমেই অসুর বিনাশ করে জগতের দুর্গতিনাশ করা সম্ভব। দুর্গোৎসব এই অসুর বিনাশের প্রতীক।

শিশু ও নারীর বিরুদ্ধে হিংস্র থাবা মেলে ধেয়ে আসা অসুর বিনাশ করেই সার্থক হোক দুর্গোৎসব। নারীর উপর নির্যাতনকারী অসুর-রূপ অপশক্তির বিরুদ্ধে জয়ী হোক শুভশক্তি। সকল বাঙালি নারীর মধ্যে জেগে উঠুক অসুর-বিনাসিনীর পরম শক্তি।

যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন সংস্থিতা
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ