সুন্দরবনের বাঘ: ছদ্মবেশী শিকারী ও বিষটোপের আখ্যান

এম এ আজিজ
Published : 21 June 2021, 01:06 PM
Updated : 18 Oct 2015, 06:29 AM

'বাঘের চাপায় ভ্যানচালকের মৃত্যু'–- এমন একটি খবর প্রকাশিত হয় ২১ আগস্ট দেশের প্রায় প্রতিটি দৈনিকে। শিরোনামটি দেখে খবরের বিষয়বস্তু বুঝতে কিছুটা সময় লাগে। এতদিন জেনে এসেছি, বাঘের থাবায় সুন্দরবনে প্রায়ই হতভাগ্য বনজীবীরা মারা যায়। এই প্রথম জানা গেল, ঢাকা শহরেও বাঘের নিচে 'চাপা' পড়ে মানুষ মরতে পারে! পৃথিবীর 'আবাসযোগ্য শহরের' তালিকা তৈরি করতে একদিন হয়তো 'ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট' একেও একটি প্যারামিটার হিসেবে বিবেচনায় নিতে পারে।

বাঘের ভাস্কর্যের নিচে চাপা পড়ে একজন দিনমজুর ভ্যানচালকের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে বেদনাহত হয়েছি। বিষয়টি এমন যে, বাঘ মানেই ভয়ংকর, সেটি জীবন্তই হোক কিংবা 'মৃত'। সুতরাং বাঘ শুধুমাত্র সুন্দরবনেই বিপদজনক নয়, রাজধানী ঢাকা শহরেও আমাদের উপর হামলে পড়তে পারে। একে বাঁচিয়ে রেখে কী লাভ!

প্রবন্ধটির বিষয়বস্তুর সঙ্গে প্রারম্ভিকা কিছুটা বেমানান। তবে ধারণা করি, সচেতন পাঠকমহল সূচনাপর্বটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আছেন। তাই এ বিষয়ে বিস্তারিত না গিয়ে শিরোনোমে নজর দেওয়া সমীচীন মনে করছি।

অতিসম্প্রতি সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের জনসংখ্যা সমীক্ষায় ১০৬টি বাঘের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ বন বিভাগ দুবছরেরও বেশি সময় ধরে 'ক্যামেরা ট্র্যাপ' পদ্ধতিতে বাঘের ছবি ধারণ করে এই সংখ্যা প্রকাশ করেছে। অনেক দেরিতে হলেও সুন্দরবনে বাঘের উপর বিজ্ঞানসম্মত একটি জরিপ আমরা পেয়েছি। এ জন্য বন বিভাগকে সাধুবাদ জানাই।

কিন্তু জরিপে যে ফলাফল আমার পেয়েছি সেটি মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়, বরং অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এতে আমাদের সুন্দরবনে দীর্ঘমেয়াদে বাঘ টিকে থাকবে কিনা সে রকম একটি চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। ২০০৪ সালের 'পায়ের ছাপ' গণনায় সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪১৯টি বলা হয়েছিল। সেটিও বন বিভাগ করেছিল। অতঃপর ২০০৯ সালে 'জিপিএস কলার' দ্বারা বাঘ গণনায় সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৩৫০-৫০০টি থাকতে পারে বলা হয়। গবেষণাটি বিজ্ঞানসম্মত হলেও সরকারিভাবে বাঘের সংখ্যা ৪১৯টি বলা হত। বর্তমানে বাঘের সংখ্যা ১০০এর কাছাকাছি নেমে আসায় ২০০৪ সালের পরিসংখ্যানটি 'অতিরঞ্জিত ছিল' বলে ক্যামেরা জরিপের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।

২০০৪ সালের সংখ্যাটি ত্রুটিপূর্ণ বলে বাঘের বর্তমান মহাসংকটময় অবস্থা এড়িয়ে যাবার বা অস্বীকার করার সুযোগ বোধকরি নেই। বৈজ্ঞানিকভাবে ২০০৪ সালের জরিপটি তেমন স্বীকৃত না হলেও এটি বলা যাবে না যে, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১৪ বছর আগে যা ছিল সেখান থেকে বর্তমানে খুব একটা নিচে নামেনি। সত্যিকার অর্থে, সুন্দরবনে বাঘের সার্বিক অবস্থা যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে সবচেয়ে খারাপ। এটা মেনে নিয়েই সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বাঘ ও সুন্দরবন রক্ষায় অতীতের প্রকল্পগুলোর কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করার সময় এখন এসেছে। ব্যর্থতা ও অসফলতাগুলো চিহ্নিত করে কীভাবে তা শোধরানো যায় তা বিবেচনায় নিয়ে ভবিষ্যতে ফলপ্রসূ প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে।

২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে সুন্দরবনে জিন-ভিত্তিক বাঘের সংখ্যা নির্ণয়ের একটি গবেষণাকাজের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বন ও বাঘ-সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে অল্পবিস্তর অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে। এ সময়ে অর্ধশতাধিক গবেষকের সমন্বয়ে গঠিত পাঁচটি সার্ভে দলের সঙ্গে বনের প্রায় অর্ধেক অঞ্চলে হেঁটেছি। দীর্ঘ সময় সেখানে অবস্থান করতে গিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীনও হতে হয়েছে। আবার মাঠ-পর্যায়ে নানাভাবে সহযোগিতা করেছে বন বিভাগ, কোস্টগার্ড, বিজিবি ও বনজীবীরা। জলদস্যুদের কবলে পড়েছি বেশ কবার, কিন্তু গবেষক হওয়ায় কারণে ছাড়াও পেয়েছি। বলা যায়, সুন্দরবনের সকল ধরনের অংশীজন, যেমন, জেলে, বাওয়ালি, মৌয়াল, কাঁকড়া-শিকারী, প্রান্তিক জেলে, মহাজনী জেলে, এমনকি চোরা-শিকারীর সঙ্গেও সাক্ষাতের সুযোগ ঘটেছে। তখন সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বন বিভাগের বিভিন্ন ক্যাম্প বা স্টেশনের দৈন্যদশা যেমন প্রত্যক্ষ করেছি, তেমনি সেখানে দায়িত্ব পালনরত কর্মকর্তাদের মানবেতর জীবনযাপনের দুর্ভোগও নজর এড়ায়নি।

একজন বাঘ গবেষকের অভিজ্ঞতালব্ধ পর্যবেক্ষণ বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণে কোনো প্রকার কাজে আসতে পারে কিনা সেটি ভেবেছি। সে তাগিদ থেকেই কিছু পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাবনা তুলে ধরছি।

পর্যবেক্ষণ

সুন্দরবনে বাঘের বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে প্রধান দুটি হুমকি বিদ্যমান রয়েছে। প্রথমটি হল, চোরা-শিকার। দ্বিতীয়টি হল, বাঘের প্রধান খাদ্য চিত্রা হরিণ শিকার।

বাঘ শিকারের সঙ্গে মাঠপর্যায়ে সরাসরি জড়িত রয়েছে স্থানীয় চোরাশিকারীরা। দ্বিতীয় পর্যায়ে স্থানীয় ও আঞ্চলিক চোরাকারবারীরা বাঘের চামড়া ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেশের বাইরে পাচারের কাজ করে। কিন্তু হরিণ শিকার সাধারণত দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের রসনা-বিলাসের জন্যই স্থানীয় সংঘবদ্ধ শিকারীরা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। বনের প্রান্তিক কিছু বিশেষ জনগোষ্ঠী ছাড়াও দেশের অন্যান্য এলাকার মানুষও হরিণের মাংস খেয়ে থাকে।

গবেষণালব্ধ তেমন কোনো তথ্য না থাকায় সাধারণভাবে এটি মনে করা হয় যে, জলদস্যুরাই মূলত সুন্দরবনে বাঘ শিকার করছে। আসলে বিষয়টি আরও জটিল। তবে শিকারের কোনো কোনো পর্যায়ে তারা এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকে। মূলত তাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে ও সহযোগিতাতেই বাঘ শিকার হচ্ছে।

বাঘ ও হরিণের মূল শিকারী কিন্তু কিছু ছদ্মবেশী মাছ ও কাঁকড়া-জেলে। এরা সংঘবদ্ধ শিকারী, জেলে সেজে সুন্দরবনে প্রবেশ করে। উল্লেখ্য, সুন্দরবনে রয়েছে নানা ধরনের জেলে। কেউ মাছ ধরে, কেউ কাঁকড়া শিকার করে, কেউ আবার গলদার পোনা ধরে। কোনো কোনো জেলে মহাজনের নৌকায় দৈনিক মজুরিতে কাজ করে। এরা মূলত সুন্দরবনের গভীরে বা দূরবর্তী অঞ্চলে মাছ বা কাঁকড়া ধরতে যায়। কারণ, মহাজনরা বনে প্রবেশের প্রয়োজনীয় 'পাস-পারমিট' এবং 'পার্টি' 'ম্যানেজ' করতে পারদর্শী। এই মহাজন-ভিত্তিক জেলেরা সাধারণত দশ-বারটি ছোট বা মাঝারি নৌকায় কোনো নির্দিষ্ট এলাকা বেছে নেয়। মাছের ব্যবসায়ী হলে মহাজন দুয়েকদিন পর পর তার অধীনে থাকা প্রতিটি নৌকা থেকে মাছ সংগ্রহ করে আড়তে বিক্রি করতে নিয়ে যায়। তারা মূলত ইঞ্জিতচালিত ট্রলারে করে রাতের বেলা চলাচল করে। কাঁকড়া বা বড়শি জেলেদের প্রতিদিন আড়তে না গেলেও চলে।

আরেক ধরনের জেলে আছে যারা এই মহাজনী প্রথার বাইরে। এরা নিতান্তই বনজীবী, সুন্দরবন-সংলগ্ন গ্রামে বসবাসকারী দরিদ্র জনগোষ্ঠী। এরা পেটে-ভাতে চলে। দলবেঁধে কাঁকড়া ধরে। সপ্তাহান্তে আড়তে এনে বিক্রি করে। এই দ্বিতীয় শ্রেণির জেলেরা সাধারণত বাঘ শিকার করে না। মাঝে-মধ্যে হরিণ শিকার করে থাকে; তবে সেটি বিত্রিুর জন্য নয়, বনে অবস্থানকালে নিজেরা খাওয়ার জন্য।

সংঘবদ্ধ কিছু শিকারী ছাড়াও কিছু কিছু মহাজনী জেলে বাঘ ও হরিণ শিকারের সঙ্গে জড়িত। মহাজনের অধীনে থাকা জেলেদের অধিকাংশ মাছ ধরলেও, কেউ কেউ হরিণ ও বাঘ শিকার করে। মহাজন তার ইঞ্জিনচালিত নৌকায় বাঘের চামড়া, হাড় ও দাঁত এবং হরিণের চামড়া-ছাড়ানো মাংস চোরাকারবারীর কাছে পৌঁছে দেয়। স্থানীয় জলদস্যু বা পার্টিকে নিয়মিত বখরা পরিশোধ করায় মহাজন ওই এলাকায় নির্বিঘ্নে বাঘ ও হরিণ শিকার করতে পারে।

অনেক ক্ষেত্রে, স্থানীয় স্টেশন বা ফাঁড়ির কর্মকর্তারাও এই জলদস্যুদের কাছে অসহায়। যেমন, পুষ্পকাঠি কিংবা লতাবেকি স্টেশন এমনই দুর্গম এলাকায় অবস্থিত যে সেখানে কর্তব্যরত কর্মকর্তারা এলাকা কাঁপিয়ে বেড়ানো জলদস্যুদের বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটিও করতে পারেন না। জলদস্যুদের কাছে যে ধরনের অস্ত্র ও জলযান আছে, ওই ফাঁড়িতে তার কোনো নমুনাও নেই। হলদেবুনিয়া কিংবা মান্দারবাড়িয়াতে দীর্ঘদিন ধরে কোনো বনফাঁড়িও নেই। যেমনটি নেই ডিঙ্গিমারিতে। তেমন কোনো নজরদারির না থাকায় ওসব অঞলে জলদস্যু এবং জেলে-বেশী শিকারীরা তাদের রাজত্ব কায়েম করেছে।

শিকারীরা বাঘ ও হরিণ শিকার করতে বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেয়। হরিণ-শিকারীরা ব্যবহার করে নানা ধরনের ফাঁদ। এর মধ্যে রয়েছে সিটকা, ফাঁস কিংবা দাওন-ফাঁদ। অন্যদিকে, বাঘ-শিকারীরা ব্যবহার করে বিষটোপ। অত্যন্ত সহজলভ্য এই বিষটোপের কাঁচামাল। প্রথমে এরা ফাঁদ দিয়ে হরিণ শিকার করে। এরপর মৃত হরিণের সঙ্গে বিশ মিশিয়ে বিষটোপ তৈরি করে। সুন্দরবনের বাঘ প্রধানত কীটনাশক-মিশ্রিত এই বিষটোপ ব্যবহার করে মারা হচ্ছে। এই কীটনাশক হল দানাদার ফুরাডন। সুন্দরবনে এর ব্যবহারের প্রকোপ এবং বিভিন্ন দেশে বন্যপ্রাণি হত্যায় ফুরাডনের কালো ইতিহাস থাকায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরছি।

ফুরাডন একটি বিষাক্ত কার্বামেট জাতীয় কীটনাশক। ১৯৬৭ সালে আমেরিকার ফুড অ্যান্ড মেশিনারি কর্পোরেশন নামক কোম্পানি এটি তৈরি করে। সারা পৃথিবীতে এটি দ্রুত বিস্তার লাভ করে বহুল ব্যবহৃত কীটনাশকের তালিকায় চলে আসে। রাসায়নিকভাবে এটি কার্বোফুরান নামে পরিচিত হলেও বাজারে এটি ফুরাডন নামে বিক্রি হয়। এটি আমাদের কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের এমন কোনো অঞ্চল নেই যেখানে ফুরাডন পাওয়া যাবে না। সুন্দরবন-সংলগ্ন প্রত্যন্ত গ্রামগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়, স্থানীয় সকল কীটনাশকের দোকানে এটি পাওয়া যায়।

কিছুটা উচ্চমূল্যের এই দানাদার কীটনাশক সহজলভ্য করতে খুচরা দোকানিরা ছোট ছোট পলিথিন প্যাকেটে বিক্রি করে। সুন্দরবনে এর ব্যবহার তুলনামূলকভাবে নতুন। তবে আফ্রিকা ও ইউরোপে বন্যপ্রাণি শিকারে এর ব্যবহারের ইতিহাস পুরনো। ফুরাডন ব্যবহার করে যে সকল বন্যপ্রাণি শিকার করা হয় তার তালিকাও বেশ বড়। এর মধ্যে মূলত মাংসাশী বা মৃতভোজী প্রাণিরাই বেশি। সিংহ, চিতা, হায়েনা, শকুন, নানা প্রজাতির শিকারী পাখি এই কীটনাশকের নির্মম শিকারে পরিণত হচ্ছে। বহু দেশে এটি ব্যবহার করে বন্যপ্রাণি হত্যা কিংবা শিকারের নির্মম ইতিহাস রয়েছে।

প্রস্তাবনা

এক.

সুন্দরবনে যে কোনো মূল্যে বাঘ শিকার বন্ধ করতে হবে। বিষটোপ ব্যবহার এখনই থামাতে হবে। খুব বেশি সময় আমাদের হাতে নেই। চরম সর্বনাশ হওয়ার আগেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বন্যপ্রাণির অধিক সুরক্ষার জন্য সুন্দরবনে তিনটি বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্য সৃষ্টি করা হয়েছে এবং সম্মিল্লিতভাবে এই তিনটি অভয়ারণ্য এলাকাকে ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো 'বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা' ঘোষণা করে। উদ্বেগের বিষয় হল, এই অভয়ারণ্য অঞ্চলে বাঘ ও হরিণের চোরাশিকার বনের অন্যান্য অংশের চেয়ে বেশিমাত্রায় ঘটছে। চোরাশিকার বন্ধ করতে হলে শুধু কাগজে নয়, অভয়ারণ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বন্যপ্রাণি (প্রটেকশন) (সিকিউরিটি) আইন ২০১২এর সংশ্লিষ্ট ধারা-উপধারা মাঠপর্যায়ে কার্যকর করতে হবে।

প্রাসঙ্গিক একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা ভালো। বাঘ সংরক্ষণ করতে হলে শুধুমাত্র এই তিনটি আলাদা অভয়ারণ্য এলাকা সংরক্ষণ করে খুব একটা লাভ হবে না। এ জন্য সমগ্র সুন্দরবনকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

দুই.

ফুরাডন নামের নির্মম কিন্তু সুলভ অস্ত্রটি বাঘ-শিকারীরা অবলীলায় ব্যবহার করছে। বাঘ-সম্পর্কিত কোনো গবেষণায় বা বাঘ সংরক্ষণ নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের কাছে ফুরাডন ব্যবহারের বিষয়টি এখনও তেমন গুরুত্ব পায়নি। এর অন্যতম কারণ হল, সুন্দরবনে বাঘ শিকারের প্রক্রিয়াটি ইতোপূর্বে অজানাই ছিল। তাছাড়া, এ ধরনের গবেষণা অত্যন্ত জটিল, ঝুকিপূর্ণ ও বিপদজনকও বটে।

ফুরাডনের প্রকোপ শুধুমাত্র বাঘ হত্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। অনেক নন-টার্গেট বন্যপ্রাণিও এতে অবাধে মারা পড়ছে। চোরাশিকারীরা যখন বাঘের জন্য বিষটোপ রেখে আসে তখন অন্যান্য মাংশাসী ও মৃতভোজী বন্যপ্রাণিও সেটি ভক্ষণ করে থাকে। এমনও দেখা গেছে, বিষটোপের কয়েক মিটারের মধ্যেই অসংখ্য বন্যপ্রাণি মরে পড়ে আছে। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা সত্যিই কঠিন।

শুধুমাত্র বন্যপ্রাণি হত্যায় এটি ব্যবহারের কারণে ইতোমধ্যে আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ফুরাডন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আফ্রিকার অনেক দেশে এটি নিষিদ্ধ হবার প্রক্রিয়ায় আছে। সুতরাং সুন্দরবনে যে কটি বাঘ এখনও বেঁচে আছে, তাদের টিকিয়ে রাখতে হলে ফুরাডন এখনই নিষিদ্ধ করতে হবে।

তিন.

বনরক্ষীদের টহল জোরদার করতে হবে। বর্তমানে যে প্রক্রিয়ায় এবং মাত্রায় টহল দেওয়া হয় তা অপর্যাপ্ত, অকার্যকর। সকাল-বিকাল শুধুমাত্র ক্যাম্পের আশেপাশে টহল দিয়ে চোরাশিকারী নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। অনেক স্টেশন ও ক্যাম্প কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপে জেনেছি, টহলের জন্য ট্রলারের পর্যাপ্ত জ্বালানি দেওয়া হয় না। অনেক ক্যাম্পে টহল বোট নেই; আবার বোট থাকলে চালক নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় স্টাফও নেই।

তবে বন বিভাগ প্রযুক্তি ও সক্ষমতার দিক থেকে এখন অনেক এগিয়েছে। সেখানে অনেক চৌকস ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রয়েছেন। বাঘ সংরক্ষণের উপর অনেক কর্মকর্তা বিদেশে লাগসই প্রযুক্তি-নির্ভর প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ জনবল সুন্দরবনে নিয়োজিত করতে হবে। টহল সরঞ্জামও আগের চেয়ে বেশ ভালো। এখন প্রয়োজন এ সকল সক্ষমতা কার্যকর ও ফলপ্রসূ টহল ব্যবস্থা বাস্তবায়নে ব্যবহার করা।

এ জন্য দুটি বিষয় অত্যন্ত জরুরি: বনে হেঁটে টহল দেওয়া এবং সে জন্য ছোট ছোট নদী বা খাল ব্যবহার। সব সময় সম্ভব না হলেও স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতে সপ্তাহে অন্তত একবার হেঁটে টহল দিতে হবে। তাতে চোরাশিকারীদের পেতে রাখা হরিণের ফাঁদ ও বাঘের বিষটোপ ধ্বংস করা সম্ভব, যা ট্রলারে টহল দিয়ে কখনও সম্ভব হয় না। চোরাশিকারীরা সাধারণত ছোট ছোট খালে ছদ্মবেশ ধারণ করে শিকারের জন্য ওঁত পেতে অপেক্ষা করে।

চার.

অতিসত্বর বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে 'সুন্দরবন টাইগারস টাস্কফোর্স' গঠন করতে হবে। বিদ্যমান বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও আমাদের চৌকস নৌবাহিনী কিংবা কোস্টগার্ডের সমন্বয়ে এমন একটি টাস্কফোর্স গঠিত হতে পারে। এর মূল কাজ হবে সুন্দরবনের সকল অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসা। বিশেষ করে, জলদস্যুদের মূল উৎপাটন করা। এরা বাঘ ও হরিণ শিকারের হোতা। এরা বন-নির্ভর অতিদরিদ্র জেলে-বাওয়ালি-মাওয়ালির রক্ত শোষণ করে তাদের জীবনশক্তি প্রায় নিঃশেষ করে ফেলেছে। এদের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত রয়েছে ডাঙায় বাস করা অদৃশ্য সুবিধাভোগীরাও। জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণ করা গেলে এদের আশ্রয়ে থাকা চোরাশিকারীদের দমন কঠিন হবে না।

পাঁচ.

সুন্দরবন থেকে সকল ধরনের সম্পদ আহরণ সাময়িক সময়ের জন্য হলেও বন্ধ করতে হবে। এতে তাৎক্ষণিকভাবে দুটি প্রধান লাভ হবে: সুন্দরবনে জেলে না থাকলে জলদস্যু বা পার্টির আয়-রোজগার বন্ধ হবে। ফলে এক সময় তারা বাধ্য হবে বন ছাড়তে। কারণ, এই জেলে-বাওয়ালিরাই তাদের কাঁচা টাকা আয়ের মূল উৎস। অন্যদিকে, কিছু কিছু মহাজনী জেলে বখরার পরিবর্তে জলদস্যুদের নিয়মিত খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহ করে থাকে। দ্বিতীয় লাভ হবে বাঘ ও হরিণের। সুন্দরবনে কোনো মানুষ প্রবেশ করতে না পারলে হরিণ ও বাঘ শিকার বন্ধ হবে।

সুন্দরবন থেকে সম্পদ আহরণ বন্ধ করতে প্রধানত দুটি বাধা বিদ্যমান:

প্রথমত, স্থানীয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী মূলত সুন্দরবনের সম্পদের উপর বেঁচে আছে; তাদের বিকল্প জীবিকায়নের অভাব বা অপর্যাপ্ততা রয়েছে।

দ্বিতীয়ত, সুন্দরবন-ভিত্তিক কাঁকড়া ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা স্থানীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরাট চালিকাশক্তি। এরাও সংকটে পড়বে। অসংখ্য বনজীবী এবং এদের ঘিরে গড়ে ওঠা ব্যবসায়ীরা সুন্দরবনের বড় দুই অংশীজন। তাই সম্পদ আহরণ বন্ধ করতে হলে এই দুই অংশীদারকে আস্থায় আনতে হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীরা এ প্রস্তাব ভালোভাবে গ্রহণ করবে না। ফলে এটি বাস্তবায়ন করতে হলে তাদেরও বিবেচনায় নেওয়া দরকার।

ছয়.

সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বর্তমানে বেশ কটি নৌ বা কার্গো পথ চালু রয়েছে। একটি বলেশ্বর থেকে শরণখোলা দিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করে বিভিন্ন পথে ঘুরে মংলায় এসে পৌঁছে। এ পথে আমরা ইতোমধ্যে পরপর কয়েকটি কার্গো দুর্ঘটনা ঘটতে দেখেছি। যার কারণে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম ইতোমধ্যে হুমকির মধ্যে পড়েছে। প্রধান নৌপথটি সম্ভবত পশুর নদী ধরে মংলা বা খুলনার পথে যাতায়াত করে। আরও একটি পথে কার্গো বা বড় নৌযান চলাচল করে যেটি রায়মঙ্গল নদী পার হয়ে কাঁচিকাটা বিজিবি ক্যাম্পের পাশ দিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করে। অতঃপর আড়পাঙ্গাসিয়া হয়ে বিভিন্ন পথ ঘুরে চালনা বা খুলনায় পৌঁছে। এটি প্রধানত ভারত থেকে মালামাল বহনকারী কার্গো বা নৌযানগুলো ব্যবহার করছে।

বন রক্ষা করতে হলে নৌপথগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা ছাড়া উপায় নেই। বিশেষ করে সাতক্ষীরা ও শরণখোলা রেঞ্জের আওতার নৌপথ দুটি এখনই বন্ধ করতে হবে।

বাঘের সংখ্যার বিচারে সুন্দরবন পৃথিবীর প্রধান পাঁচটি অঞ্চলের একটি। বাঘ ছাড়াও সুন্দরবন রক্ষার জোর-প্রচেষ্টার পেছনে অনেক যৌক্তিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা যায়। সুন্দরবন বাংলাদেশের মোট বনাঞ্চলের ৪০ ভাগ। এই বাদাবন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষকে সিডর-আইলার কবল থেকে রক্ষা করেছে। এটি বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের বৃহত্তম আতুঁড়ঘর। হাজার হাজার মেট্রিক টন পলিমাটি বহন ও ধারণ করে নতুন নতুন চরবনের সৃষ্টি করছে এ বন। তাছাড়া এটি প্রতি বছর যে পরিমাণ 'ইকোসিস্টেম সার্ভিস' প্রদান করে তার আর্থিক মূল্য প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার।

বাঘ বাঁচলে সুন্দরবন বাঁচবে। সুন্দরবন বাঁচলে উপরোক্ত 'ইকোসিস্টেম সার্ভিস' আমরা অব্যাহতভাবে পাব, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার সুনিশ্চিত হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাত্র কদিন আগে জাতিসংঘের 'চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ' পুরষ্কার গ্রহণ করলেন। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় অর্জন এবং এর মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষায় আমাদের দায়-দায়িত্ব বেড়ে গেল। তিনি বাঘ সংরক্ষণের ব্যাপারে সংবেদনশীল। আর সে জন্যই ২০১০ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে উপস্থিত থেকে সুন্দরবন তথা পৃথিবীতে বাঘ টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে বাংলাদেশের অঙ্গীকারের কথা ব্যক্ত করেছিলেন।

বিভিন্ন দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিবিদদের উপস্থিতিতে রাশিয়ার ওই সম্মেলনে ২০২২ সালের মধ্যে পৃথিবীতে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার কথা বলা হয়। পরিতাপের বিষয় হল, ২০১৫ সালের বাঘ জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমপক্ষে কয়েক গুণ হ্রাস পেয়েছে। অথচ ভারতে ২০০৬ সালের জরিপের তুলনায় ২০১৪ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা ৫৮ শতাংশ বেড়েছে।

আমাদের জাতীয় পশু বাঘের এই সংকটাপন্ন অবস্থা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই ওয়াকিবহাল আছেন। আমরা বিশ্বাস করি, তাঁর সুচিন্তিত দিকনির্দেশনা সুন্দরবনের ক্রান্তিকাল উত্তরণে সহায়তা করবে।

এম এ আজিজ: সহযোগী অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টের পিএইচডি শিক্ষার্থী।