মিনার ঘটনার জন্য দায়ী কে

মহিবুল ইজদানী খান
Published : 16 Oct 2015, 03:00 AM
Updated : 16 Oct 2015, 03:00 AM

হজ্জের সকল কাজ পবিত্র মক্কার অদূরে মিনা ও তার আশেপাশে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যেমন মুজদালিফা, আরাফাত, জামারাত সবই মিনা থেকে খুব একটা দূরে নয়। এই কারণে অনেকেই পায়ে হেঁটে স্থানগুলো পরিবর্তন করে থাকেন।

হজ্জের শুরুতে প্রথমেই যেতে হয় মিনায়। সেখানে অবস্থানের পর আরাফাতের ময়দানে পুরো দিন অতিবাহিত করে মাগরেবের পূর্বে মুজদালিফায় সারা রাত ইবাদতের জন্য অবস্থান করতে হয়। মিনার নিকটে মুজদালিফায় খোলা আকাশের নিচে ইবাদত করার মধ্য দিয়ে হাজীরা এক রাত অতিবাহিত করেন। আবার কেউ কেউ কয়েক রাকাত নামাজ পরে খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়ে পড়েন।

সকালে ফজরের নামাজের পরপরই মুজদালিফা থেকে মিনায় তাঁবুতে চলে আসতে হয়। এই সময় অনেকে সরাসরি তাঁবুতে না ফিরে শয়তানকে পাথর মারার জন্য জামারাতের উদ্দেশে রওয়ানা দিয়ে থাকেন। তবে সাধারণত সকলেই মিনায় এসে তাঁবুতে বিশ্রাম নিয়ে তারপর জামারাতের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন।

আমরা যারা এবার স্টকহল্মের সেন্ট্রাল মসজিদের অধীনে হজ্জ করতে গিয়েছিলাম তাদের জামারাতের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার সময় নির্ধারণ করা হয় সকাল দশটায়। অর্থাৎ মুজদালিফায় খোলা আকাশের নিচে ফজরের নামাজ শেষ করে আমরা মিনার উদ্দেশে বাসে করে রওয়ানা দিই।

২৩ সেপ্টেম্বর মুজদালিফায় সারারাত কাটিয়ে ২৪ সেপ্টেম্বর সকাল দশটায় মিনা থেকে পায়ে হেঁটে জামারাতের উদ্দেশে যাচ্ছিলাম আমরা। আমাদের মতোই অন্যান্য দলও একই পথের পথিক। লক্ষ লক্ষ হাজী একই সময় একই সঙ্গে চলছেন জামারাতের উদ্দেশে। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে পথে পথে দাঁড়িয়ে রয়েছে শান্তিরক্ষা বাহিনী। এটা একটা চলমান পথ। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি গন্তব্যস্থলে পৌঁছেন, আপনাকে চলার মধ্যেই থাকতে হবে। কারণ আপনার পেছনে রয়েছে আরও লক্ষ লক্ষ হাজীদের পদাচরণা। থামলেই বিপদ। এ জন্য শান্তিরক্ষা বাহিনী সব সময় আপনাকে হেঁটে চলার তাগাদা দিবে।

বর্তমানে হাজীদের সুবিধার্থে সৌদি সরকার জামারাতকে কয়েকটি ফ্লোরে বিভক্ত করেছে। দুর্ঘটনার সময় আমরা খুব সম্ভবত ছিলাম দুই নম্বর ফ্লোরে। দুর্ঘটনাটি সকাল ৮ থেকে ১০ টার মধ্যে ঘটেছে। আল-অ্যারাবিয়া নিউজ চ্যানেলের মতে, দুর্ঘটনাটা ঘটেছে জামারাতের প্রবেশপথের একটি ব্রিজের উপর।

কয়েক বছর আগে জামারাতে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করে ফিরে আসার সময় সুড়ঙ্গপথে অনেক হাজীকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। কারণ তখন একই সুড়ঙ্গপথ দিয়ে যাওয়া-আসার ব্যবস্থা ছিল। ওই দুর্ঘটনার পর সৌদি সরকার জামারাতে আসা-যাওয়ার জন্য পৃথক পৃথক সুড়ঙ্গপথ নির্মাণ করেছে। শুধু তাই নয়, এখন জামারাতে পায়ে হেঁটে যেতে আগের মতো আর এত কষ্ট করতে হয় না। সুড়ঙ্গপথে কিছুক্ষণ পর পর বসানো হয়েছে এসকেলেটর। এমনকি এয়ার কন্ডিশনসহ বৈদ্যুতিক পানি ও পাখার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। সেখান থেকে ঠাণ্ডা পানি ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এত সুন্দর ব্যবস্থা, সত্যি প্রশংসনীয়।

এভাবে আরও অনেক কাজ রয়েছে যেগুলো পরিপূর্ণ হলে ভবিষ্যতে হাজীদের আর কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না। সৌদি সরকার এ বিষয়ে দ্রুত কাজ করে চলছে বলেই মনে হচ্ছে।

মিনার নিকটে জামারাতের প্রবেশপথে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে সে সম্পর্কে অনেক কথা মিডিয়ায় ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। সৌদি বাদশা সালমান ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফের নেতৃত্বে একটি জরুরি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। ওই দিন সকাল সাড়ে দশটায় আমরা যখন জামারাতে প্রবেশ করি, তখন কোনো কিছুর দর্শন পাইনি। তবে দুয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশের গাড়ি নজরে পড়েছে।

শুনেছি, একজন প্রিন্সের আগমন কেন্দ্র করে নিরাপত্তা বাহিনীর ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণেই দুর্ঘটনার সূত্রপাত। হঠাৎ করে একটা চলমান পদযাত্রাকে জামারাতের প্রবেশপথে আটকে দিলে কী হতে পারে আপনারা নিজেরাই ধারণা করুন। ফলে চলমান হাজীদের চাপে সামনে থাকা হাজীরা নিজেদেরকে আর ধরে রাখতে পারেননি। শত শত হাজীকে এভাবে প্রাণ দিতে হল। বিবিসির সর্বশেষ সংবাদ অনুসারে, মুত্যুর সংখ্যা ১৪৫৩। তবে সৌদি অ্যারাবিয়ান সরকারের মতে, এ সংখা ৭৬৯ এবং আহত ৯৩৪। যারা ইন্তেকাল করেছেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের বেহেমত নসিব করুন। আর যে সকল হাজী আহত হয়েছেন, মহান আল্লাহর কৃপায় তারা শিগগির সুস্থ হয়ে উঠবেন ইনশাল্লাহ।

সৌদি আরবের শীর্ষ ধর্মীয় নেতা শেখ আবদুল আজিজ আল শেখ জামারাতের প্রবেশপথে ঘটে যাওয়া ট্রাজেডি-সংক্রান্ত বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ঘটনাটি মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। তবে বহির্বিশ্বের অনেকেই এই দুর্ঘটনার জন্য সৌদি সরকারকে দায়ী করেছেন।

এদিকে হাফসা কারা মুস্তফা নামের একজন ব্রিটিশ আলজেরিয়ান সাংবাদিক বলেছেন, মক্কা, মদিনা এই দুই পবিত্র শহরের ব্যবস্থাপন সৌদি রাজপরিবারের হাতে একচেটিয়াভাবে ন্যস্ত করা উচিত নয়। তিনি বলেন, পবিত্র শহর দুটির নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সরকারগুলোকে জড়িত করতে হবে। ইংল্যান্ডের মানচেস্টার থেকে জাকার্তা নিউজে এক লেখায় জনৈক গবেষক বলেন, আমি ব্রিটিশ-আলজেরিয়ার সাংবাদিক হাফসা কারা-মোস্তফার সঙ্গে একমত। এই দুটি শহর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন সংস্থার অধীনে নিয়ে আসা উচিত।

আমার মতে, এ ধরনের উক্তি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতি সরাসরি আঘাত। মক্কা-মদিনা রক্ষার দায়িত্ব সৌদি বাদশার। এখানে অন্য কোনো মুসলিম দেশের নেতৃত্ব আসার প্রশ্ন আসতে পারে না। তবে বাদশা সালমান চাইলে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ নেওয়ার জন্য ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত, নাইজেরিয়াসহ আরও কয়েকটি মুসলিম দেশের মাধ্যমে সৌদি আরবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করতে পারেন। এই কমিটির কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থাকবে না। তারা বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মতামত বাদশার কাছে উত্থাপন করতে পারবেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন বাদশা। বিষয়টি নিয়ে সৌদি কর্তৃপক্ষের নতুন করে চিন্তাভাবনা করা উচিত বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন।

আরেকটি বিষয় যা আমরা পদে পদে উপলব্ধি করেছি, সেটা হল আরবি ভাষার প্রাধান্য। বিশ্বের সকল মুসলমান পবিত্র কোরান শরিফ পড়তে পারলেও আরবি ভাষায় কথা বলতে পারেন না। ফলে মক্কা ও মদিনায় যে সকল নিরাপত্তা বাহিনী কর্মরত, তাদের সঙ্গে যোগাযোগে সমস্যা সৃষ্টি হয়। বিশ্ব মুসলমানের পবিত্র শহর মক্কা-মদিনায় কর্মরত সকলকে আরবির পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তাহলে কোনো দুর্ঘটনা বা সমস্যা হলে তা সহজেই সমাধান করা যেতে পারে যা বর্তমানে নেই। সৌদি কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে গুরুত্ব নতুন পদক্ষেপ নিতে হবে।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এ বছর হজ্জ শুরুর পূর্বে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদে ক্রেন উপড়ে পড়ে অন্তত ১০৭ হাজী নিহত হয়েছেন। ২০০৬ সালে প্রায় ৩৬০ হাজী জামারাতে শয়তানকে পাথর ছুঁড়ে মারতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে নিহত হন। এর আগে, ২০০১ সালে তীর্থযাত্রা অনুষ্ঠানের চূড়ান্ত দিনে মিনায় পদপিষ্ট হয়ে নিহত হন ৩৫ হজযাত্রী। ২০০৪ সালে মিনায় তীর্থযাত্রীদের চাপে নিহতের সংখ্যা ছিল ২৪৪। ১৯৯৮ সালে জামারাতে শয়তানকে লক্ষ্য করে চূড়ান্ত ঢিল মারার এক পর্যায়ে হাজীদের মধ্যে প্যানিক সৃষ্টি হলে ওভারপাস খসে পড়লে পদদলিত হয়ে প্রায় ১৮০ জন মৃত্যুবরণ করেন।

১৯৯৭ সালে বাতাসের কারণে মিনায় তাঁবুতে আগুন লেগে ৩৪০ তীর্থযাত্রী নিহত হন। এই সময় আহত হন ১৫০০ জন। ১৯৯৪ সালে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করতে গিয়ে ২৭০ তীর্থযাত্রী পদদলিত হয়ে নিহত হন। ১৯৯০ সালে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করে ফেরার সময় টানেলে পদদলিত হয়ে ১৪২৬ তীর্থযাত্রীকে প্রাণ দিতে হয়। এই সময় জামারাতে যাওয়া ও আসা একই টানেলের মধ্য দিয়ে ছিল।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় লক্ষ্য করেছি, জামারাতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে হাজীদের মনে শয়তানের বিরুদ্ধে একটা শক্ত আক্রোশ জেগে ওঠে। এই সময় অনেকে মনে করেন, শয়তান হয়তো এখানে অবস্থান করছে। তখন অনেকে বড় বড় পাথর ছুঁড়ে মারতে থাকেন। আসলে এখানে শয়তানের উদ্দেশে একটি সিম্বলিক ঢিল ছুড়ে ঘৃণা প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই করার নেই্। তবে ঢিল নিক্ষেপের পর আল্লাহ রাব্বুলের কাছে দোয়া করার নিয়ম রয়েছে। এ জন্য উত্তেজিত হওয়ার কোনো কারণ নেই্। শয়তানকে মারা পাথরগুলো মুজদালিফা থেকে কুড়িয়ে আনতে হয়।

পরিশেষে বলতে হয়, সেদিনের ঘটনার জন্য যদি কাউকে দায়ী করতে হয় তাহলে যার উপর জামারাতের সকল প্রকার নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাকেই করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে সৌদি বাদশা সকল প্রকার সিদ্ধান্তের মালিক, অন্য কোনো রাষ্ট্র নয়।