অর্থনৈতিকের পাশাপাশি কিছু নৈতিক উন্নয়ন নয় কেন

রাহমান নাসির উদ্দিন
Published : 13 Oct 2015, 02:45 AM
Updated : 13 Oct 2015, 02:45 AM

আমাদের সংকট এবং সংকট সমাধানের রীতি-পদ্ধতির মধ্যে একটা বড় ধরনের সংকট রয়েছে। আমরা কোনো সংকট তৈরি হলে, সেটাকে ত্বরিৎ বিবেচনায় না-নিয়ে 'দেখা যাক-না জল কতদূর গড়ায়' বলে তার শেষ দেখতে থাকি।

শেষ দেখতে দেখতে যখন সব কিছু শেষ হয়ে যায়, তখন আমরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে সমাধানের চিন্তাভাবনা শুরু করি এবং একটা পথ খুঁজে বের করি। তত দিনে বেশ বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যায় এবং নতুন সংকটের আশঙ্কা তৈরি হয়। সংকটের তড়িত সমাধান যে সমাজের অনেক সম্ভাব্য সংকট শুরুর আগেই শেষ করে দেয়, এটা আমাদের নীতিনির্ধারকরা কখনও বুঝতে চান না বা বোঝার চেষ্টাও করেন না।

মেডিকেলে ভর্তিপরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ নিয়ে এবং মেডিকেলে ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে বাংলাদেশে এখন চলছে ঠিক সেই দশা। হয়তো শেষ পর্যন্ত সরকারকে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে এবং একটা সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু সেটা একটু আগে করলে কিংবা সময়মতো করলে কার কী ক্ষতি তা আমার মাথায় কাজ করে না।

মিডিয়ার কল্যাণে মোটামুটি এটা সবাই জানেন যে, ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত মেডিকেল ভর্তিপরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ এনে এ পরীক্ষা বাতিল এবং পুনরায় ভর্তি-পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে মেডিকেল ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, পুলিশের লাঠিপেটা খেয়ে, শাহবাগ থানার সার্ভিস ডেলিভারি রুমের 'সার্ভিস' গ্রহণ করে (বেধড়ক মার খেয়ে), পিপার স্প্রের ঝাঁজ খেয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে 'মেডিকেলের প্রশ্নপত্র আউট হয়নি' বলে একটা পাতলা বক্তব্য ছাড়া এ বিষয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরকে এবং এদেশের জনগণকে, তেমন কোনো গ্রহণযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য ও বোধগম্য ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। ফলে, চট্টগ্রাম এবং সিলেটসহ সারাদেশে এ আন্দোলন অব্যহত রয়েছে।

সম্প্রতি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা নানানভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার প্রমাণ হাজির করে সাংবাদিক সম্মেলন করে, এ অভিযোগের তদন্তের জন্য একটি 'স্বাধীন তদন্ত কমিশন' গঠনের দাবি করেছে। এ দাবির মধ্যে এক ধরনের সচেতন, পরিণত ও গণতান্ত্রিক চেতনা লক্ষ্য করা যায়। এর সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও সংহতি জানিয়েছেন বিভিন্ন মেডিকেলে অধ্যয়নরত বেশ কিছু শিক্ষার্থী, কিছু বাম ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে প্রগতিশীল ছাত্র জোট এবং কিছু সংবেদনশীল শিক্ষক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী।

তবে, মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁস ইস্যুতে মিডিয়ার অবস্থান এবং আচরণ বেশ হতাশাজনক। কেননা, এদেশের মিডিয়া মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ব্যাপারটি যতটা একটা মামুলি 'নিউজ-আইটেম' হিসেবে প্রকাশ করছে, এ-আন্দোলনের ন্যায্যতার প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসার দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে ততটা প্রকাশ করছে না।

এদেশের তথাকথিত সুশীলদের মধ্যে জাতিকে 'সুশাসনের' সবক দেওয়ার ক্ষেত্রে যতটা ব্যকুলতা এবং নির্বাচনের সুষ্ঠুতা-অসুষ্ঠুতা নিয়ে যতটা কাতরতা দেখা যায়, এ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে তাদের তেমন কোনো দৃশ্যমান মাথাব্যথা নেই। বলা যায়, তারা রীতিমতো 'লা-জবাব'। হয়তো, এসব আন্দোলনের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে সবক বিলানোর জন্য দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে কোনো ফান্ড পাওয়া যায় না! তাই, সবার কাছে এসব আন্দোলন হয়ে উঠেছে আলগা ঝামেলা।

ফলে, মেডিকেলে ভর্তিপরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার বিষয়টি এবং এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের গোটা বিষয়টিই আমাদের সচেতন বিবেচনা এবং আগ্রহী নজর কাড়তে পুরোপুরি না-হলেও মোটামুটি ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু সেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

এ বিষয়ে আমার বক্তব্য একেবারেই সোজা এবং সাফ।

এক.

শিক্ষার্থীরা যে সব অভিযোগ করছে, সেটা অবশ্যই প্রমাণ-সাপেক্ষ। যদিও গত ১০ অক্টোবর জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার আগেই যে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এ প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে সে তথ্য স্ক্রিনশট করে প্রজেক্টরের মাধ্যমে সাংবাদিকদের সামনে উপস্থাপন করে প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রমাণ হাজির করেছে। তাছাড়া, ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া একজন শিক্ষার্থীর মুঠোফোনের রেকর্ড সাংবাদিকদেরকে বাজিয়ে শুনানো হয়, যেখানে কোথা থেকে প্রশ্ন এসেছে, কীভাবে সে এ প্রশ্ন সংগ্রহ করে এবং কত টাকা দিয়ে সংগ্রহ করে এসব তথ্য সেখানে রয়েছে।

এরপরও যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই যে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি এবং আন্দোলনকারীরা যে অভিযোগ উত্থাপন করছে, সেটা অসত্য; তাহলে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ যে সত্য নয়, সেটা প্রমাণের দায়িত্ব্ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। তাই, একটি সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ তদন্ত না-করে কেবল 'রাজনৈতিক বুলি' হিসাবে অনুমানের উপর ভিত্তি করে যদি বলে দেওয়া হয়, 'মেডিকেলের ভর্তির প্রশ্ন ফাঁস হয়নি', তবে তা প্রকারান্তরে অভিযোগ মোকাবেলা না-করে এক ধরনের পাস কাটিয়ে যাওয়ার সমার্থক। যা প্রকারান্তরে অভিযোগের বিষয়ে নতুন সন্দেহের উদ্রেক করতে পারে এটা ভেবে যে, 'ডাল মে কুচ কালা হ্যায়'।

দুই.

প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) একজন কর্মকর্তাসহ তিনজন এবং রংপুর মেডিকেল কলেজের তিনজন ডাক্তারসহ সাত জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু ইউজিসির কর্মকর্তা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে 'হার্ট-অ্যাটাকে' মৃত্যুবরণ করেন। এটি একটি সিরিয়াস ইস্যু হলেও এ ক্ষেত্রে পুরো ব্যাপারটি একটি গড়পড়তা বিষয় হিসেবে ইতোমধ্যেই মানুষের মনোযোগের অন্তরালে চলে গেছে। অধিকন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারে ইউজিসির সম্পৃক্ততার ভয়াবহতা নিয়ে আমাদের সম্ভাব্য জানাশুনার বিষয়টি আর সামনে এগোয়নি।

তাই, অনেকে বলেছেন, 'ইউজিসির কর্মকতার আইন-শৃংখলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুই প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি প্রমাণ করে'। এ-বিশ্লেষণটিও একেবারে ফেলে দেওয়া যাবে না।

তিন.

মেডিকেলে ভর্তিচ্ছুক হাজার হাজার শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন। কিন্তু সরকারের কোনো পর্যায় থেকে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাইনি। প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই কেবল 'পুলিশের অ্যাকশনে'।

এখানে মনে রাখা জরুরি যে, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা এদেশেরই মানুষ। এরা আমাদেরই কারও-না-কারও সন্তান, ভাই-বোন, কিংবা বন্ধু, বন্ধুর ছেলে-মেয়ে কিংবা আত্মীয়-স্বজন। তাই, এসব কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে তাদের জীবনের স্বপ্ন-সাধ কিংবা আশা-আকাঙ্ক্ষা থেকে বঞ্চিত করা মানে আমরা প্রকান্তরে আমাদের উত্তর-প্রজন্মের একটা জেনারেশনকে অন্যায়ভাবে তাদেরকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করছি। আমরা যদি তাদের সঙ্গে সুবিচার না-করি, তবে ইতিহাস আমাদের কোনো দিন ক্ষমা করবে না।

চার.

বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি হওয়া সকলের পক্ষে সম্ভব হয় না। কেননা ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীদের সংখ্যানুপাতে মেডিকেলের আসন-সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু তাদেরকে একটি স্বচ্ছ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ অবশ্যই দিতে হবে। এটা তাদের অধিকার। প্রতিযোগিতামূলক ভর্তিপরীক্ষার ভেতর দিয়ে তাদের মধ্যে যারা মেডিকেলে ভর্তি হতে পারবে না, তাদের মনে অন্তত এ সান্তনা থাকবে যে, অন্যরা তাদের চেয়ে ভালো পরীক্ষা দিয়েই মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে।

কিন্তু 'ডাক্তার' হওয়ার এক বুক স্বপ্ন নিয়ে নিজেদের তৈরি করা এ সব মেডিকেল ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীদের একটি সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে 'প্রশ্নপত্র ফাঁস করে' বিশেষ কিছু চতুর এবং সুযোগসন্ধানী শিক্ষার্থীদেরকে (যারা সুযোগ পেয়েছে আমি অবশ্যই সবাইকে বলছি না) ভবিষ্যতের ডাক্তার হওয়ার অন্যায়-ব্যবস্থা করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

পাঁচ.

আমি সব সময় বলি, সমাজের কোনো ক্ষেত্রে বা কারও সঙ্গে অন্যায় হলে সেটার প্রতিবাদ করা আমাদের সকলের কর্তব্য। কেননা যে অন্যায় আজ অন্যের সঙ্গে হচ্ছে, সে একই অন্যায় অন্যদিন আপনার সঙ্গে হবে। আজ যদি আপনি অন্যের প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদ না-করেন, যেদিন আপনার সঙ্গে অন্যায় হবে সেদিন কেউ আপনার পাশে দাঁড়াবে না। তাই, মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে যে আন্দোলন হচ্ছে তার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে মেডিকেলে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে এ জন্য যে, তাদের সঙ্গে একটি বড় ধরনের অন্যায় হয়েছে বা হচ্ছে।

একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজের সর্বস্তর থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ ওঠাই হচ্ছে সংবেদনশীল মানবিক সমাজ গঠনের প্রাথমিক ধাপ। তাই, আমাদের সম্মিলিত উদাসীনতা সমাজে ক্রমবর্ধমান অন্যায়ে প্রকারান্তরে উৎসাহ যোগাবে।

পরিশেষে একটা উজ্জ্বল ন্যায্যতার উদাহরণ দিয়ে শেষ করছি। এ-বছর ভারতেও মেডিকেলে ভর্তিপরীক্ষার, যেটাকে ভারতে বলা হয় 'অল ইন্ডিয়া প্রি-মেডিকেল এন্ট্রারেন্স টেস্ট', প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ উঠে। সে পরীক্ষায় ছয় লক্ষ তিরিশ হাজার পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে এবং মাত্র তিন হাজার আটশত শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পায়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের যে অভিযোগ ওঠে, তার দ্বারা মাত্র ৪৪ জন শিক্ষার্থী লাভবান হয়েছে বলে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। কিন্তু বিচারপতি আর কে আগরওয়ালের নেতৃত্বে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন বেঞ্চ পুরো পরীক্ষাই বাতিল করে দিয়ে পরবর্তী চার সপ্তাহের মধ্যে পুনরায় ভর্তিপরীক্ষা গ্রহণ করার নির্দেশ দেন।

এটাই সামাজিক ন্যায়বিচারের উদাহরণ যা ভারত থেকে আমরা শিখতে পারি। রাষ্ট্র কীভাবে নাগরিকদের জন্য 'সামাজিক ন্যায্যতা' নিশ্চিত করে ঘটনাটি তার একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। আমাদের মোটামুটি সবাইকে বোঝানো হচ্ছে যে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্রমান্বয়ে উন্নতি করছে। এ উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আমরা কিছু নৈতিক উন্নয়নের চেষ্টা করি না কেন?

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।