বাঙালির নববর্ষ

সেলিনা হোসেন
Published : 13 April 2010, 06:20 PM
Updated : 13 April 2010, 06:20 PM

বাঙালির নববর্ষ শুধু বাংলা ক্যালেন্ডারের একটি দিন মাত্র নয়। এর নানামুখী মাত্রা আছে, আছে গভীর ব্যাপক অর্থবহ শেকড়-সন্ধানী অনুপ্রেরণা। এটা তো ঠিক বাংলাদেশের বাঙালির আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, রাষ্ট্র পরিচালনা, শিক্ষা কার্যক্রম ইত্যাদির মতো অন্যান্য ক্ষেত্রগুলো বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পরিচালিত হয় না। পরিচালিত হয় গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। আন্তর্জাতিক বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করতে এক ধরনের ক্যালেন্ডার মেনে চলা বিধিতে পরিণত হয়েছে।

বিপরীতে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি জাতির সামাজিক সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের একটি বড় দিক। এই অর্থে বাংলা নববর্ষ বাঙালির এক মহান জাতীয় দিন। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ এই দিন জাতিগত ঐক্যের দৃঢ় বন্ধন। ভবিষ্যতের শুভ সূচনা এই দিনের মধ্যে নিহিত আছে। বাঙালি এই দিনের মর্মবাণীর সাধনায় এক হতে পারলে তার আত্মশক্তির জাগরণ অটুট থাকবে। এই অর্থে বাংলা সন বাঙালির দিনযাপনের সঙ্গে যতটা না সম্পৃক্ত তারচেয়ে অনেক বেশি সম্পৃক্ত জাতিগোষ্ঠীর মানবিক বোধের সাধনার সাংস্কৃতিক পরিচয়ের দীপশিখায়। এটাই বাংলা বর্ষপঞ্জির উজ্জ্বল দিক।

নববর্ষ এই দিনের মহাজাগতিক বিস্ফোরণ উৎসব, আনন্দে, মিলনে, বন্ধনে, ধর্মীয় আচরণের উর্ধ্বে মানব সত্যের জয়গানে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের অমর রচয়িতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৈশাখকে আবাহন করে লিখেছেন: 'মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।' এই দুটো পঙ্‌ক্তি একজন কবির শুধু ঋতু-বন্ধনা নয়, কবি জীবনের কল্যাণে প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা করেছেন। বছর ধরে জমে ওঠা গ্লানি ও জীর্ণতা দূর করে ধরণীকে শুচি করার কথা বলেছেন। বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাওয়ার মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন।

এই মন্ত্র ধুলিমলিন জরাগ্রস্থ পৃথিবীর বিপরীত চেতনা–যে চেতনা জীবন পরিশুদ্ধ করে। যে বোধ জীবনের অবমাননা ঘটায় তাকে দূর করে জীবনের দার্শনিক সুন্দরকে প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন কবিগুরু। এই সত্য ও মঙ্গলের সাধনার গভীর বোধটি বাংলা নববর্ষে সব বাঙালির ভেতরে থাকুক এই আহ্বান ধ্বনিত হয় এই দিনটিকে কেন্দ্র করে।

ঋতুপরিক্রমায় বৈশাখ আসবে। এটা প্রকৃতির নিয়ম। বৈশাখের সঙ্গে আসে কালবৈশাখী ঝড়। বৈশাখে থাকে গ্রীষ্মের দাবদাহ। তারপরও বৈশাখের জন্য মানুষের আবাহন কেন? কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় বৈশাখের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থনীতির সম্পর্ক–খাজনা আদায়, বর্গা চাষ, রবিশস্য ঘরে তোলা ইত্যাদি নানা কিছু। যুক্ত হয়েছে বাণিজ্যিক লেনদেন–হালখাতা, হিসাবের খতিয়ান, নতুন করে হিসাবের শুরু। যুক্ত হয়েছে বৈশাখী মেলার আয়োজন করে পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে পণ্যের বিকিকিনি।

এই বাণিজ্য মেলায় থাকে উৎসবের আমেজ। সৃজনশীলতার প্রকাশ। চিত্রিত হাঁড়ি-সরাই-কলসি, মাটির পুতুল-হাতি-ঘোড়া, আম আঁটির ভেঁপু, শুকনো মিষ্টান্ন –বাতাসা-মোয়ামুড়ি নাড়ু–-পিঠা ইত্যাদির ঘটা। থাকে বাঁশের কারুকাজ করা নানা বৈচিত্র্যময় সাংসারিক উপকরণ। আরও কত কী! শুধু বর্ণনা দিয়ে তো এই সৃজনশীলতা প্রকাশের ব্যাখ্যা করা যাবে না।

পুতুল নাচ, যাত্রা জারীসারী, ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়ার মতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জমজমাট আয়োজন মানুষ রাতভর উপভোগ করে। মানুষের দিনকে অন্যরকম করে তাকে পূর্ণতার পথে নিয়ে যাওয়ার ডাক দেয়। এ ডাক অসংখ্য মানুষের বুকের ভেতরে থাকে, যারা সমাজকে সুস্থ রাখার চিন্তায় নিজেদের কর্মসূচি নির্ধারণ করে।

বৈশাখের দাবদাহ শুধু পোড়ায় না তাকে সুন্দর স্নিগ্ধও করে। জীবনের যা কিছু প্রয়োজন রবীন্দ্রনাথ বৈশাখের প্রকৃতির মাঝে তাকে অনুভব করেছেন। বলেছেন:

বৈশাখ হে, মৌনী তাপস, কোন্‌ অতলের বাণী
এমন কোথায় খুঁজে পেলে।
তপ্ত ভালের দীপ্তি ঢাকি মন্থর মেঘখানি
এল গভীর ছায়া ফেলে॥
… … … …
হঠাৎ তোমার কণ্ঠে এ যে আশার ভাষা উঠল বেজে,
দিলে তরুণ শ্যামল রূপে করুণ সুধা ঢেলে॥

প্রকৃতির এমন বিচিত্র রূপই শুধু ধরণীর সৌন্দর্য নয়। মানুষের জীবনবোধের বহুরূপ অভিধাও এই সৌন্দর্য। বাঙালির বিকশিত জনন-চেতনার এমন দার্ঢ্য ব্যাখ্যা রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কে করতে পারতেন। বৈশাখের মর্মবাণী এভাবে পরিশুদ্ধ করেছে তাঁকে। তিনি বুঝেছিলেন বাঙালির শক্তি। সেজন্যই তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, 'সকল মানুষকে ঐক্যবন্ধনে বেঁধে দেশের কাজে অগ্রসর হতে পারলে সিদ্ধি আসবে।'

বাংলা বর্ষপঞ্জিতে একসময় অগ্রহায়ণ ছিল সূচনা মাস। অগ্রহায়ণ ফসল কাটার মাস। আর বৈশাখ বীজ বপণের মাস। রবিশস্য ঘরে উঠিয়ে আবার বীজ বোনার কাজ। ফসলের গন্ধভরা স্বর্গসুখের মাস ছেড়ে খরতাপের অমলিন দিনে এসে ঠাঁই নিয়েছে নতুন বছরের সূচনা। বাংলার আদিপ্রাণ কৃষককূল কালের বিবর্তনে এই সত্যকে মেনে নিয়েছে। তারা বর্ষপঞ্জির এই পরিবর্তনের হিসেব রাখেনি। ব্যবস্থাটি মেনে নিয়ে উৎপাদনের ধারাটি বহাল রেখেছে–বিপনণের সম্পর্ক ঠিক রেখেছে। মানুষ তার আপন নিয়মে নতুন পুরনোর মেল বন্ধন করেছে। তারা ঠিকই জানতো যে এটা না হলে এগিয়ে যাওয়ার গতি মুখ থুবড়ে পড়বে। আবহমান কালের বাঙালি এভাবে আপন শক্তিতে টিকে থেকেছে। সেজন্য বৈশাখকে এভাবে আহবান করে বাঙালি রবীন্দ্রনাথের ভাষায়:

তব পিঙ্গল জটা হানিছে দীপ্ত ছটা,
তব দৃষ্টির বহ্নিবৃষ্টি অন্তরে গিয়ে পশে

বৈশাখকে অন্তরে টেনে নিয়ে বাঙালির নতুন বছরের যাত্রা শুরু হয়। বাঙালি অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে জানে। রুখে দাঁড়ায়ও। এখানেই তার ঐক্যের বিস্তার।