অস্ট্রেলিয়াকে ক্ষমা করা কঠিনই হবে

আরিফ রনি
Published : 6 Oct 2015, 03:27 AM
Updated : 6 Oct 2015, 03:27 AM

গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহে সিদ্ধান্তটি অবধারিতই ছিল। একেকটি দিন গড়াচ্ছিল আর একে একে নিভছিল আশার দেউটি। তারপরও অনেকের মনের কোণে আশার সলতে নিশ্চয়ই জ্বলছিল। নইলে নিশ্চিত ব্যাপারটি জানার পরও এমন হতাশার স্রোতধারা কেন বইবে বাংলাদেশের ক্রিকেট আঙিনায়!

ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা প্রতিনিধি দল ঢাকায় থাকতেই গুলশানে ইতালিয়ান নাগরিক খুন ও বাংলাদেশ সফরের স্কোয়াডের ক্রিকেটারদের নিজ নিজ রাজ্য দলে ফেরার নির্দেশনা দেওয়ার পর অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল অস্ট্রেলিয়ার মনোভাব। তারপরও বিসিবি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। বিশেষ করে বৃহস্পতিবার যখন সিদ্ধান্ত জানাতে অনুমিত সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সময় নিচ্ছিল ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া, মেলবোর্নে বৈঠক চলছিল দফায় দয়ায়, মিরপুরে বিসিবি কার্যালয়ে বিসিবি কর্তারাও তখন আশায় বুক বাঁধছিলেন। হয়তো ইতিবাচক পথে এগোচ্ছে বলেই সিদ্ধান্ত নিতে এত আলোচনা।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের উদ্বিগ্ন অপেক্ষার অবসান বৃহম্পতিবার বিকেলে। বাংলাদেশ সময় সোয়া ৫টা নাগাদ আশাভঙ্গের ঘোষণাটি আসে মেলবোর্ন থেকে, আসছে না অস্ট্রেলিয়া।

নিরাপত্তা নিয়ে সফর বাতিল ক্রিকেটে নতুন কিছু নয়। পাকিস্তানের কথা বাদই থাকল। বিশ্বকাপের মতো আসরে পর্যন্ত সফর বাতিল হয়েছে। ১৯৯৬ সালের জানুয়ারিতে কলম্বোয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বোমা হামলা করল এলটিটিই। পরের মাসে বিশ্বকাপের ম্যাচ খেলতে কলম্বো যায়নি অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২০০৩ বিশ্বকাপে কেনিয়ায় যায়নি নিউজিল্যান্ড, রবার্ট মুগাবে সরকারের সঙ্গে ঝামেলার কারণে জিম্বাবুয়েতে যায়নি ইংল্যান্ড।

তবে এবার বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেটা হলে, সেটাকে বলা যায় 'এক্সট্রা অর্ডিনারি।' খুব একটা ঝুঁকি না নিয়েই বলে দেওয়া যায়, এমন কিছু আগে দেখেনি ক্রিকেট। কারণ আগে যে সব দেশে সফর বাতিল হয়েছে, সে সব দেশের সঙ্গে আমাদের প্রেক্ষাপট মেলানো যাবে না কোনোভাবেই। অস্ট্রেলিয়ার সফর পেছানো ছিল একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাত। গত শনিবার তারা যখন নিরাপত্তার ঝুঁকিতে সফর পেছানোর কথা জানাল, শুধু বাংলাদেশ নয়, চমকে গিয়েছিল সম্ভবত পুরো ক্রিকেট বিশ্ব। বাংলাদেশে এই সময়ে নিরাপত্তার ঝুঁকি? কীভাবে সম্ভব! প্রশ্ন আর বিস্ময় প্রায় সবাইকে ছুঁয়ে যাওয়ার কথা।

পেছনে কারণ অনুসন্ধানে আমাদের নিজেদেরই দায় দেখতে পারেন অনেকে। 'দেশে জঙ্গি আছে' বা 'জঙ্গি নেই', 'অমুকের অস্তিত্ব আছে, তমুক নেই', 'এটা হয়, ওটা হয় না'… আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-নেত্রীদের অনেক কথার উদাহরণ টেনে অনেকে বলতে পারেন যে, সমস্যা আমরাই তৈরি করেছি। তবে এই সব কিছু মাথায় রেখেও দিনশেষে বলতেই হবে যে, অস্ট্রেলিয়া সফর পেছানোর সময় বাংলাদেশের যা অবস্থা ছিল, এতটা শান্ত ও স্থিতিশীল পরিস্থিতি গত কয়েক বছরে ছিল কিনা সন্দেহ। অস্ট্রেলিয়া যেভাবে সফর পেছাল, 'আউট অব দা ব্লু' কথাটির জন্ম এমন মুহূর্তের জন্যই।

নিরাপত্তার কারণে অস্ট্রেলিয়া সফর পিছিয়েছে, অনেকের কাছেই এটা ছিল অবিশ্বাস্য। তারপরও তারা অস্ট্রেলিয়া দল বলেই নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধান বা অন্য কিছু ভাববার অবকাশ খুব একটা ছিল না। প্রফেশনাল দল হিসেবে ক্রিকেট বিশ্বে আদৃত অস্ট্রেলিয়া; মাঠের ভেতর-বাইরে তাদের ক্রিকেট-দর্শন, ধরন, কাঠামো ও ক্রিকেট-ভাবনা, সবই অনুকরণীয়। আর নিরাপত্তার ব্যাপারে বরাবরই তারা খুঁতখুতেঁ। এ জন্যই ব্যাপারটি জানার ও বোঝার অপেক্ষা ছিল।

ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা পরিদর্শক দল বাংলাদেশে আসার পর বিসিবি যে তৎপরতা দেখিয়েছে, সেটিকে অসাধারণ ও অবিশ্বাস্য বললেও কম হবে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার নোটিশে ও দেড় দিনের মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, র‌্যাব, পুলিশ, এনএসআই, ডিজিএফআইসহ সব নিরাপত্তা সংস্থা, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর খুব কাছের মানুষ বলেই এত দ্রুত এ সব সম্ভব হয়েছে। বোর্ড প্রধান সংবাদমাধ্যমকে বলেছেনও যে, নিউ ইয়র্ক থেকেই প্রধানমন্ত্রী সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন পুরো প্রক্রিয়ায়।

সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ বা হুমকির কথা জানায়নি অস্ট্রেলিয়া। সেটা না জানানোর অধিকার তাদের রয়েছে। বিসিবির বিভিন্ন সূত্র থেকে যতদূর জানা গেছে বা ইঙ্গিত মিলেছে, বাংলাদেশে স্থায়ী অস্ট্রেলিয়ান ও নিউজিল্যান্ডাররা প্রতি বছর একটি অনুষ্ঠানে মিলিত হন, এর নাম 'গ্লিটার বল।' সে অনুষ্ঠানে হামলার কোনো পরিকল্পনা হয়তো ছিল। ২৬ বছর ধরে চলে আসা সে অনুষ্ঠানও বাতিল করা হয়েছে এবার। তারপরও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ব্যাপারটি দেখা হয়েছে। সবগুলো নিরাপত্তা সংস্থার প্রধান ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধি দলকে অভয় দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিজে বলেছেন, "আমি দায়িত্ব নিচ্ছি, আপনাদের কোনো সমস্যা হবে না।"

গুলশানে ইতালিয়ান নাগরিক হত্যার পর চিত্র অবশ্যই কিছুটা পাল্টেছে। অস্ট্রেলিয়ার শঙ্কিত হওয়ার কারণও রয়েছে। তবে সেই শঙ্কার এমন উচ্চতা ছোঁয়ার কোনো কারণ নেই যে, সফর স্থগিত করতে হবে। বিশ্বের কোন দেশে বিদেশিরা খুন হন না? বাংলাদেশে বরং ক্রিকেট-খেলুড়ে অন্য অনেক দেশের তুলনায় এমন ঘটনা কমই ঘটে থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকায় যে সংখ্যক বাংলাদেশি খুন হন, সেটি বিবেচনায় নিলে তো ওই দেশের ধারেকাছে আমাদের ক্রিকেট দলের যাওয়ার কথা নয়। ভারতেও কি ঘটেনি এমন ঘটনা?

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বিসিবি প্রধান প্রশ্ন তুলেছেন, অস্ট্রেলিয়া সরকারের 'গ্লোবাল টেরর ইনডেক্স'এ ভারত ৬ নম্বরে, বাংলাদেশ ২৩ নম্বরে। তাহলে কি ভারতে ক্রিকেট হবে না? অত্যন্ত যৌক্তিক প্রশ্ন। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়ার ভারত সফর থাকলে সেটা নিয়ে হয়তো 'টু' শব্দটি করত না ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। বিসিসিআইয়ের প্রভাব ও অর্থের কাছে পাত্তা পেত না নিরাপত্তার শঙ্কা। বাংলাদেশ বলেই অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তার জুজু অন্য সব কিছু ছাড়িয়ে গেছে।

সফর স্থগিত করা যখন প্রায় নিশ্চিত, তারপর বুধবার রাতে বিসিবির পাঠানো বিবৃতিও ছিল দারুণ এক পদক্ষেপ। অত্যন্ত সুলিখিত ও বলিষ্ঠ সে বিবৃতিতে তুলে ধরা হয়েছিল বাংলাদেশ এখন কতটা শান্তিপূর্ণ, ক্রিকেট তথা বিভিন্ন ক্রীড়া অনুষ্ঠান আয়োজনে আমাদের অতীতের দক্ষতা ও গৌরব এবং এ দেশ ক্রিকেটের জন্য কতটা নিরাপদ। সেই শেষ চেষ্টাও মাথা ঠুকে মরেছে অস্ট্রেলিয়ার অনমনীয় মনোভাবের দুয়ারে।

ঘটনাপ্রবাহ হয়তো ক্রিকেটের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়ার হঠাৎ সফর পেছানো আর তাদের নিরাপত্তা পরিদর্শক দল এখানে থাকতেই বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনা চাইলে এক সুতোয় গাঁথা যায়। ইতালিয়ান নাগরিক খুন হল, অথচ ইতালি অ্যালার্ট জারি করল না, করল কিনা যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-কানাডা! আন্তর্জাতিক রাজনীতি বা অভ্যন্তরীন রাজনীতির কূটচাল থাকতে পারে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট রাজনীতির 'খেল' হতে পারে। বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলকে পাকিস্তানে পাঠানো বা বিশ্ব ক্রিকেটের তিন মোড়লের কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হতে পারে, বিসিবিকে 'শিক্ষা' দেওয়ার ব্যাপার থাকতে পারে। এ সব সত্যি হোক বা না হোক, সব কিছুর পরও, নিরাপত্তার ঝুঁকিতে বাংলাদেশে কোনো দল ক্রিকেট খেলতে আসতে পারছে না, এ মুহূর্তে সেটা মানা কঠিন। সত্যি বলতে, মানা অসম্ভব।

১৯৯৮ সালে দেশের প্রায় পুরোটা যখন বন্যায় ডুবে, তখন আইসিসির সহযোগী দেশ বাংলাদেশ নকআউট বিশ্বকাপের আসর আয়োজন করেছে দারুণ সফলভাবে। গত নির্বাচন ঘিরে দেশজুড়ে নানা নৈরাজ্যের সময়টায় বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার গৌরব প্রায় হারিয়েই ফেলেছিল। সেখান থেকে বাংলাদেশ ঠিকই সফলভাবে আয়োজন করেছে বিশ্বকাপ। অনেক বেশি হুমকি ছিল তখন, পরিস্থিতি ছিল বহুগুণে খারাপ। তারপরও ছেলে ও মেয়েদের মিলিয়ে ২৪টি ক্রিকেট দলকে একসঙ্গে অভূতপূর্ব নিরাপত্তা দিয়েছে বাংলাদেশ। এবারও একটি অস্ট্রেলিয়া দলকে নিরাপত্তা দিতে না পারার কারণ নেই।

বিসিবি প্রধান মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, "অস্ট্রেলিয়াকে যে নিরাপত্তার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, বিশ্বের আর কোনো দেশে কখনও কোনো দলকে তেমন কিছুর প্রস্তাব দেওয়া হয়নি। এরপর আমাদের আর কিছু করার নেই।"

আসলেই এরপর আর কিছু করার ছিল না নেই। বোর্ড প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, এরপরও অস্ট্রেলিয়া না এলে সেটি নিরাপত্তার কারণে নয়, অন্য কিছু আছে। আসলেই হয়তো সেটি কারণ। অন্যভাবে বললে, 'অন্য কিছু' ছাড়া আর কিছু ভাবা যাচ্ছে না।

ক্রিকেট তো আর যুদ্ধ নয়। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে এখন যুদ্ধ বা লড়াইয়ের কিছু নেই। তাদের সঙ্গে খেলতেও হবে। সুযোগ খুঁজতে হবে তাদের এদেশে আনার। আগামী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে হওয়ার কথা অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ। সেটি নিয়েও এখন শঙ্কার কারণ আছে। ক্রিকেট-কূটনীতি তাই চালিয়ে যেতে হবে।

আপাতত যেটা হয়েছে, সেটা কোনোভাবেই হতে পারে না। অস্ট্রেলিয়া যেটা করেছে সেটা তারা করতে পারে না। যেটা আমরা মানতে বাধ্য হচ্ছি, সেটা মানার মতো নয়। কোনো যুক্তিতে, কোনো হিসাব বা বিবেচনাতেই এখনকার বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য এটা প্রাপ্য নয়। বিষয়টা শুধু বাংলাদেশ ক্রিকেটের নয়। নিরাপত্তা ঝুঁকির ধুয়া তুলে বাংলাদেশে না আসার অস্ট্রেলিয়ার এ সিদ্ধান্তে এই দেশ ও দেশের মানুষদের অপমানিত বোধ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

সব কিছুই হয়তো আবার স্বাভাবিক হবে। আশা করা যায় খুব শিগগির। তবে বরাবর সফল, নিরাপদ ও ক্রীড়াপ্রেমী আয়োজক হিসেবে বাংলাদেশের যে খ্যাতি, তাতে কলঙ্কের দাগ লাগিয়ে দেওয়ার জন্য অস্ট্রেলিয়াকে ক্ষমা করা কঠিনই হবে।

আরিফ রনি: ক্রীড়া সাংবাদিক।