সুকুমার রায়ের ছড়ায় ছিল, 'মাথায় যত প্রশ্ন আসে, দিচ্ছে না কেউ জবাব তার'। প্রশ্নের শেষ নেই। কী সব মজার মজার বৈপরীত্য! 'ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট' বইতে কিছুটা পড়েছিলাম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ব্যক্তিগত জীবনের কথা। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত সুদর্শন সুমিষ্টভাষী এই যুবক সম্ভবত জীবনে ইসলামি জীবনধারার আশেপাশেও ছিলেন না, অথচ তিনিই ছিনিয়ে নিলেন এক বিশাল মুসলিম দেশের নেতৃত্ব। আমাদের সাবেক এক রা্ষ্ট্রপতির প্রচুর নারী-বিষয়ক রসালো গল্প প্রচলিত রয়েছে। ব্যক্তিজীবনে নিজের ভোগবাদিতার কথা তিনি অকপটে বলতেন। অথচ সেই তিনিই দেশকে ইসলামি রাষ্ট্র বানিয়েছিলেন। ধর্মীয় অনুশাসনের চাইতে বোধকরি ক্ষমতার মোহ তাকে অনেক বেশি হাতছানি দিত।
ভারতে গোমাতার পুজারীরা একজন মানুষকে মেরেই ফেলল গোমাংস খাওয়ার ভুয়া গুজবে কান দিয়ে। গরু তাদের এতই প্রিয় যে, মানুষের জীবন তার কাছে কিছুই নয়। এটি কি আসলেই গরুর প্রতি ভালোবাসা, না একটি সম্প্রদায়কে নিরাপত্তাহীনতার বিভীষিকায় ঢেকে সেই সম্প্রদায়ের জায়গাটুকু দখল? কে জানে!
আমার সবচেয়ে প্রিয় ঐতিহাসিক চরিত্রের একটি, মার্কিন সংবিধানের অন্যতম প্রধান প্রণেতা টমাস জেফারসন। মহান এই মানুষটি প্রায় সোয়া দুশ বছর আগে সাম্য, সৌহার্দ্য আর চিন্তার স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। আজও হয়তো পৃথিবীর অনেক মানুষ সে রকম চিন্তাও করতে পারে না। কিন্তু কোথায় যেন পড়েছিলাম জেফারসনের নিজের প্ল্যানটেশনে অনেক 'কালো' ক্রীতদাস কাজ করতেন। কী বৈপরীত্য!
আমেরিকানরা দোকানে ঢুকে অর্ডার দেয় একটা বড় ম্যাকবার্গার উইদ এক্সট্রা চিজ, লার্জ ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর ডায়েট কোকের। সারা শরীরে ট্যাটু আঁকা, দুই কানে দুল পড়া ছেলেটি ডাক্তারের কাছে ভয়ে ইঞ্জেকশন নিতে যায় না। গ্যারি ক্রেমেন নামে এক ভদ্রলোক 'ম্যাচ ডটকম' নামের একটি ওয়েবসাইট খুলেছিলেন যাতে নিঃসঙ্গ মানুষ সাথী খুঁজে পায়। ভদ্রলোকের দয়িতা সেই ওয়েবসাইট থেকে একজনকে খুঁজে নিয়ে তাকে ছেড়ে চলে যা্য়। এসব আবোল তাবোল ঘটনার কুল-কিনারা খুঁজে পাই না।
খুব সম্ভব ঢাকার রামপুরায় ঈদের দিন একটি মন্দিরের সামনে গরু জবাই করা হয়েছে। ফেসবুকে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে ছবিটি। কেউ লাইক দেয়, তো কেউ শেয়ার করে। কেউ সেক্যুলার, আবার কেউ মৌলবাদী। এ বিষয়ে একটি অনলাইনে পোস্ট করা সংবাদে দেখলাম, শামীম আনোয়ার নামের জনৈক আওয়ামী লীগ নেতা এ কাজ করিয়েছেন। কিন্তু আমি বেকুব মানুষ; মাথায় কোনোমতেই ঢুকছে না এই ছবির এমন কী তাৎপর্য যে, এটি এত বড় করে দেখতে হবে?
সরকার (আরও ছোট করে বলতে গেলে, ঢাকার দুই মেয়র) জবাইয়ের স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, কিন্তু কোনো বাধ্যবাধকতা তৈরি করে দেননি যে, এখানে অথবা ওখানেই জবাই করতে হবে। অনেক বছর ধরে এটাই হয়ে আসছে যে, মানুষ তার সুবিধাজনক জায়গাতে কোরবানি দেয়। এতে পরিবহনের ঝামেলা কমে; বিতরণেরও বটে।
জনাব, নিজেকে প্রশ্ন করুন, বাসে বসে যখন আপনার থুতু আসে আপনি কী করেন? সেটি গিলে ফেলেন না আশেপাশের খালি জায়গায় ফেলে দেন?
'আ্যগ্নোস্টিক' শব্দটার বাংলা করেছে 'অজ্ঞানবাদী'। আমার এই অনুবাদে ঘোর আপত্তি। বরং আমি বলব, আমি নাস্তিক (কোপ খাওয়ার ভয় নিয়েও বলছি)। কে কোথায় গরু জবাই করল তা নিয়ে আমার বিন্দুমা্ত্র ভাবনা নেই। আমি উপমহাদেশের প্রায় সব বড় ইসলামি স্থাপনা ও মন্দির দেখেছি। আমার কাছে কাশী মন্দিরের নুলো ভিখারি কিংবা আজমীর শরীফের সামনের দাড়ি-টুপিওয়ালা বৃদ্ধ দানপ্রার্থী, দুজনেই নিস্ফল। আবার কখনও যদি রাস্তায় দেখি, ভিখারি আল্লার ওয়াস্তে ভিক্ষা চায়, গাড়িতে খুচরা থাকলে দিয়ে দিই– এটা ভাবি না যে, সে ভিখারির মাথায় টুপি আছে নাকি হাতে কৃষ্ণের ছবি। আমার দান আমার পকেটের ভাঙতি পয়সার উপর নির্ভর করে, ধর্মচেতনার উপর নয়।
কিন্তু আজ শামীম আনোয়ার নামের সেই না-দেখা আওয়ামী নেতার প্রতি আমার শ্রদ্ধার শেষ নেই। জনাব, আপনার প্রতি এই নাস্তিক বাংলাদেশের সমস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আপনি মহান। আপনি যদি মন্দিরের ভিতর ঢুকে কাজটি করতেন, শপথ করে বলতে পারি কেউ আপনাকে বাধা দেওয়ার সাহস করত না। যদি বাধা দিত তবে একদিনেই হয়তো ঢাকা শহরে হিন্দুর সংখ্যা– নিদেনপক্ষে রামপুরা্য় হিন্দুর সংখ্যা– অর্ধেক হয়ে যেত। কী দরকার? সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশে অশান্তি করে লাভ নেই।
আর 'মালাউনের বাচ্চাদের'ও সাহস বাড়ছে। আপনি তো আর পুরো মন্দিরটা ভেঙে ফেলেননি। ফেললেই-বা কী হত? রামুর মন্দির ভেঙেছে আজ বরাবর তিন বছর, এখনও কারও সাজা হয়েছে বলে শুনিনি। মজার ব্যাপার, সম্ভবত বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইন আর হিন্দু মন্দির ভাঙার মামলায় এদেশে এখনও একজনেরও সাজা হয়নি।
আপনারা প্রতি বছর বনানী দুর্গাউৎসবে সম্বর্ধনা দেন। এবার এই মহান ব্যক্তিকে সংবর্ধনা দিন। তিনি যদি আপনাদের এই মন্দিরটি ভেঙে দিতেন আপনারা কিছুই করতে পারতেন না। তিনি তো তা করেননি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। সেটা করতে জানেন না বলেই আপনাদের আজ এই দশা।
২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচন-পরবর্তী এক ভয়াল রাতে ভোলার এক নবছরের শিশুকন্যাকে ধর্ষণেচ্ছুক তরুণদের কাছে কত কষ্টে মিনতি করেছিলেন সেই শিশুর মা, 'বাবারা, তোমরা একজন একজন করে আস, আমার মেয়েটা এখনও রক্ত দেখেনি'! অসহায় সেই মায়ের মিনতি রেখেছিল ওরা, একজন একজন করেই ধর্ষণ করেছিল শিশুটিকে। কিন্তু কী লাভ হয়েছে? 'মালাউনরা' কখনও ভালো কাজের দাম দেয় না। মিডিয়ায় সে সব সংবাদ দিয়ে কী এক ঝামেলা করেছিল তখন, যদিও তাতেও কিছুই হয়নি। চাইলে কি তারা একটু 'গ্যাং-ব্যাং' করতে পারত না?
নতুন চন্দ্র সিংহের পুরো পরিবারকেে একাত্তরে মেরে ফেলা কোনো ব্যাপার ছিল না। যদি সেটি করা হত আজ চন্দন সিনহা জাতীয় সঙ্গীত পুরস্কার পেতেন না, কেউ সাক্ষীও দিত না। পুরো পরিবারটিকে যে মেরে ফেলা হয়নি, ৫ বছরের শিশুটিকে যে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল, আমার বন্ধু চন্দন কখনও সে কারণে রাউজানের সেই প্রভাবশালী পরিবারটির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়নি।
জনাব শামীম আনোয়ার, আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম নিন। আপনি আছেন বলেই রামপুরা এলাকায় প্রায় হাজার দুয়েক হিন্দু আছে। আমাদের বন্ধু রউফ একবার বলেছিল, তার বাবার কারণেই চট্টগ্রামের চন্দনাইশে হিন্দুরা বেঁচে গিয়েছিল। কথাটি হয়তো শতভাগ সত্য। আমি তো একাত্তরে জন্মাইনি। শুনেছি, রউফের বাবা শুধু সোনার গয়না আর টাকা-পয়সা নিয়ে মানুষজনকে ছেড়ে দিতেন, কাউকে প্রাণে মারেননি।
হুমায়ূন আহমেদের একটি লেখার কথা এখনও মনে পড়ে। একাত্তরে পিরোজপুর থেকে তাদের নিখোঁজ পিতার সন্ধান পেতে তাঁরা দু' ভাই, হুমায়ূন আর জাফর ইকবাল নিরন্তর খোঁজাখুঁজি করতেন। হঠাৎ পাকা খবর পেলেন, দক্ষিণাঞ্চলের এক বড় দরবার শরীফের হুজুরের কাছে গেলে তাঁদের পিতার খোঁজ পাওয়া যেতে পারে। দুভাই সেখানে গেলেন আর চাক্ষুষ দেখলেন রাজাকারের কার্যকলাপ। বড় দুঃখ করে হুমায়ূন তাই লিখেছিলেন তাঁর বিবমিষার কথা, যখন সেই হুজুরকে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়েছিল।
তারও বেশি বিস্ময় নিয়ে আমি ভাবি, জাতির দুই শ্রেষ্ঠ সন্তান হুমায়ূন আহমেদ আর জাফর ইকবাল এত বোকা কেন? আরে, আপনাদের দুভাইকে যে বাঁচিয়ে রেখেছেন সে হুজুর, এটা কি এদেশের প্রতি কম বড় অবদান? আপনাদের পিতা মুক্তিযোদ্ধা জানার পরও হুজুর আপনাদের মেরে ফেলেননি, কী মহান ছিলেন তিনি! আমাদের জাতীয় জীবনে মনন, সংস্কৃতি আর সাহিত্য বিকাশে আপনাদের ভাইদের যে অবদান সে তো পুরোপুরি সেই হুজুরের অবদান। তাকে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হবে না তো কি আজেবাজে লোককে দিতে হবে?
বিচারহীনতার দেশে নাকের বদলে নরুণ নিয়ে যদি আপনি খুশি না হন তবে বলতেই হয় আপনি ভয়ানক লোভী। বিচারহীনতার দেশে বিচারের আশা করে বোকারা।
শামীম সাহেবের ছেলেময়ে নাতিপুতিরা একদিন গল্প করবে, আমাদের এলাকায় হিন্দুরা আমার দাদার ছায়ায় বাস করত। আরও অনেক বছর পরে শামীম সাহেবের মৃত্যু হবে, বিশাল জায়গা জুড়ে শ্বেতপাথরের কবর হবে। সেই কবরে মখমলের মতো ঘন সবুজ ঘাসও জন্মাবে। কলকাতার কিংবা দণ্ডকারণ্যের কোনো এক নোংরা অস্বাস্থ্যকর বস্তিতে বসে এক সদ্য-কিশোর খবরের কাগজে পড়বে, প্রতি বর্গফুট জায়গার দাম হিসেবে টোকিওর পর নিউইয়র্ককে টপকে ঢাকা দ্বিতীয় স্থানে। তারপর চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে কিশোর ভাববে, "দাদু বলেছিল, ওখানে নাকি একটা পুকুরওয়ালা বাড়ি ছিল আমাদের।"
জীবন জীবনের মতো চলবে। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া এসব ছোট ছোট আবোল-তাবোল ঘটনা মনে রাখার দায়ই-বা কার?