গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কি আবারও বাধাগ্রস্ত হবে!

মনজুরুল আহসান খান
Published : 8 July 2011, 02:50 PM
Updated : 8 July 2011, 02:50 PM

বাংলাদেশের জনগণ দীর্ঘদিন ধরে যে আন্দোলন-সংগ্রাম করে এসেছে তা মূলত গণতন্ত্রের সংগ্রাম। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি সংগ্রামই ছিল গণতান্ত্রিক। গণতন্ত্র বলতে শুধু ভোটাধিকার বা নির্বাচন নয়, রাজনীতি, রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা, অর্থনীতি, সমাজনীতি এবং মতাদর্শ সর্বক্ষেত্রেই গণতন্ত্রের সংগ্রাম ছিল বিস্তৃত। জনগণের গণতান্ত্রিক রায় বাস্তবায়ন ও নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় যেতে দেয়া হয়নি বলেই শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করতে হয়েছে।

স্বাধীন বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান রচিত হলেও শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকেনি। স্বাধীন বাংলাদেশে এ গণতন্ত্রের জন্য এদেশের মানুষকে সুকঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।

পাকিস্তান আমলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বারবার স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। বারবার সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে। বাংলাদেশের জন্ম গণতান্ত্রিক আদর্শ নিয়ে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। এরপরও বাংলাদেশের রাজনীতির বড় ট্র্যাজেডি হচ্ছে আমরা এখনও পাকিস্তান আমলের সামরিক হস্তক্ষেপের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। এদেশে একের পর এক সফল ও বিফল সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। দু'জন রাষ্ট্রপতি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নিষ্ঠুর হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন এবং শত শত সেনা সদস্য ও কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন বা ফাঁসিকাষ্ঠে জীবন দিয়েছেন।

সামরিক হস্তক্ষেপ একটা দেশকে কতখানি ভয়ঙ্কর পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ পাকিস্তান। বিশিষ্ট পাকিস্তানি গবেষক আয়েশা সিদ্দীকা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্যবসা-বাণিজ্যের যে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সিআইএর প্রত্যক্ষ পরিচালনা ও সহযোগিতায় যে বিশাল অস্ত্রসম্ভার গড়ে তুলেছে, কিভাবে দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে তার বিবরণ তুলে ধরেছেন তার লেখা বইতে। অবশ্য আয়েশাকে পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সিআইএ পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে আফগানিস্তান, ভারত, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে মার্কিন স্বার্থে ব্যবহার করেছে। আল কায়দা এবং তালেবানদের অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সহায়তা দিয়েছে সিআইএর সহযোগিতায় এবং আইএসআই। এখন খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আল কায়দা তালেবান এবং আইএসআইই হয়ে উঠেছে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন। আইএসআই দ্বৈত ভূমিকা পালন করছে বলে অভিযোগ তুলেছে আমেরিকা। পাকিস্তানের চরম অর্থনৈতিক সঙ্কট সত্ত্বেও বিপুল অর্থ ব্যয় করে সমরাস্ত্র ক্রয় অব্যাহত আছে। বিপুল অস্ত্র, অর্থ, ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সেখানকার রাজনীতিতে নিয়ামক ভূমিকা পালন করছে। সরকার পরিবর্তন, পরিবর্ধন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হত্যাকা-, বিভিন্ন অন্তর্ঘাতী কর্মকাণ্ডে পাকবাহিনী সিদ্ধহস্ত। এখন সেই অন্তর্ঘাত চলছে খোদ সেনাবাহিনীর মধ্যেই ক্যান্টনমেন্ট ও সেনা সদরেই। পাকিস্তান রাষ্ট্র আজ অস্তিত্বের সঙ্কটে।

সেনাবাহিনীর এই ধরনের ভূমিকা শুধুমাত্র পাকিস্তানেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা ক্রমবর্ধমান। সারা বিশ্বে যুদ্ধ, সংঘর্ষ ও উত্তেজনা যতই বৃদ্ধি পাচ্ছে, ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে অস্ত্র প্রতিযোগিতা, অস্ত্রসজ্জা ও সামরিক শক্তি। পৃথিবীর দেশে দেশে সামরিক বাহিনী সর্বাধুনিক অস্ত্র, সুদক্ষ জনবল, যুদ্ধ ও নিরাপত্তার জন্য ব্যাপক অবকাঠামো এবং অর্থশক্তিতে ক্রমেই স্ফীত হয়ে উঠছে। জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার অজুহাতে জনগণের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকার, প্রাইভেসি, মানবিক অধিকার ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দারুণভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে। এক সময়ের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো ক্রমেই হয়ে উঠছে 'কঠিন রাষ্ট্র' বা হার্ড স্টেট।

গণতন্ত্রের পীঠস্থান বলে পরিচিত খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন তার বিশাল সামরিক প্রতিষ্ঠানের কাছে অনেকটাই জিম্মি। ১৯৩৬-এর মহামন্দার সময় অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে পরিত্রাণের অন্যতম উপায় হিসেবে সমরাস্ত্র উৎপাদন ও বিশ্বব্যাপী তা বিক্রির ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্র। এটা করতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক বিশাল সামরিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং দেশ, সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে অত্যন্ত প্রভাবশালী এক সামরিক শিল্প কমপ্লেক্স গড়ে ওঠে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এদের প্রভাব বৃদ্ধিতে খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডয়াইট ডি আইজেনহাওয়ার উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন। ১৯৬১ সালের ১৭ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে বিদায়ী ভাষণে তিনি বলেন : 'This conjunction of an immense military establishment and a large arms industry is new in the American experience….. In the councils of government we must guard against acquisition of unwanted influence, whether sought or unsought by the military industrial complex. The potential of the disastrous rise of misplaced powers exists and will persist. We must never let the weight of this combination endanger our liberties and democratic process.'

আইজেনহাওয়ারের বক্তৃতার ২ বছর পার হতে না হতেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন, এফ কেনেডীকে ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর হত্যা করা হয়। আইজেনহাওয়ার যে বিশাল সামরিক প্রতিষ্ঠান ও সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্সকে স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করে দিলেন সেই শক্তিই 'নিজ স্বার্থ' রক্ষায় এই হত্যাকা- বা গবেষকদের ভাষায় সামরিক ক্যু-দ্যাতা সংগঠিত করে দিল।

সামরিক প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রেসিডেন্ট কেনেডীর বেশকিছু বিষয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হচ্ছিল। কেনেডী স্নায়ুযুদ্ধ হ্রাস করার ব্যাপারে মনোনিবেশ করেন। বে অব্ পিগ্স-এর বিপর্যয়ের পর সেনাবাহিনীর চাপ সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট কেনেডী সরাসরি কিউবা আক্রমণ করতে অস্বীকার করেন। কিউবান মিজাইল সঙ্কটের পরও কেনেডীর সামরিক উপদেষ্টারা পারমাণবিক যুদ্ধে নামার জন্য চাপ সৃষ্টি করলে কেনেডী সে পথে যেতে রাজি হননি। কেনেডী মহাকাশে পারমাণবিক পরীক্ষা বন্ধ করে দেন এবং সামরিক প্রতিষ্ঠানের ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু করেন। শোনা যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী নিকিতা ক্রশেভ কেনেডীকে এই মর্মে অবহিত করেন যে, তাঁর (কেনেডীর) নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সিআইএর এজেন্টরা ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট কেনেডী যখন খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ক্যাস্ট্রো হত্যার তৎপরতা অব্যাহত আছে, তখন তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন এবং রাগে গড় গড় করতে করতে এক সভা থেকে বেরিয়ে বলেছিলেন : আমি সিআইএকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ছাড়বো। অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস সিআইএ কিছুদিন পরেই কেনেডীকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে মেরেছে। মার্কিন রাজনীতিতে সামরিক প্রতিষ্ঠান এবং মিলিটারী-ইন্ডস্ট্রিয়াল ফিন্যান্সিয়াল কমপ্লেক্সের প্রভাব ও হস্তক্ষেপ সাম্প্রতিককালে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

সাম্প্রতিককালে বিবিসিতে প্রচারিত এক অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন "ফৌজি বাণিজ্য"-এ বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পাকিস্তানি মডেল অনুসারেই অগ্রসর হয়েছে। দুটি দেশেই সামরিক শাসন আমলে পাকিস্তান বাংলাদেশ সেনা কল্যাণ সংস্থাকে একটি সিমেন্ট কারখানা প্রজেক্ট বাস্তবায়নে আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য এবং সেনা পরিবারের কল্যাণের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত এই ধরনের প্রজেক্ট ক্রমান্বয়ে পুরোপুরি ব্যবসায়িক উদ্যোগ হিসেবে এগিয়ে গেছে। উৎপাদন থেকে শুরু করে সার্ভিস সেক্টর পর্যন্ত, সিমেন্ট, টেক্সটাইল, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, বৈদ্যুতিক ও ইলেক্ট্রনিক শিল্প, ব্যাংকিং, বিলাসবহুল হোটেল, ফাস্ট ফুড, খুচরা দোকান, ফিলিং স্টেশন, ট্রেনিং সেন্টারসহ সর্বত্র সেনা বাণিজ্যের উপস্থিতি ও প্রভাব লক্ষ্য করার বিষয়। এছাড়া শান্তি মিশনে সেনা সদস্যদের অর্জিত বাড়তি আয় শেয়ার ব্যবসায়ও নিয়োজিত হচ্ছে। সামরিক প্রতিষ্ঠান আজ আর শুধু প্রতিরক্ষা ও যুদ্ধের শক্তি নয়, দেশের প্রভাবশালী কর্পোরেট জায়ান্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আমলে ১৯৭৩ সালে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে সেনাবাহিনীকে নামানো হয়। অভিযানের ফলে অনেক ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার ও আক্রমণের শিকার হন। আওয়ামী সরকার তাদেরকে ছাড়িয়ে নেয় এবং শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে। এসব নিয়ে সেনাবাহিনীতে বিক্ষোভ-পরবর্তী বিভিন্ন ঘটনার উপর প্রভাব ফেলে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর দেশের নিয়ন্ত্রণ বাস্তবে সেনাবাহিনীর হাতে চলে আসে। এরপর থেকে জিয়া-এরশাদসহ বিভিন্ন আমলে দেশের রাজনীতিসহ বিভিন্ন ব্যাপারে সেনা হস্তক্ষেপ এবং প্রভাব বাড়তে থাকে। ক্ষমতার রদবদলে সেনাবাহিনীর ভূমিকা গুরত্বপূর্ণ, এমনকি প্রধান হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য সংগঠনকে প্রভাবিত করা, ভাঙন, নতুন দল গঠন, নেতৃত্বের পরিবর্তন, অর্থ ও ভাতা প্রদান, গোয়েন্দা বাহিনীর হস্তক্ষেপ, হত্যা, নির্যাতন, চাপ ও হুমকি প্রয়োগ নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক দলাদলি ও বিশেষত ক্ষমতায় যেতে সক্ষম রাজনৈতিক দলগুলোও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বা ক্ষমতাকে পরিবর্তন করার জন্য সেনাবাহিনীকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করে। বিভিন্ন বিদেশি শক্তি এসবের সাথে জড়িত হওয়ার ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। সেনাবাহিনীর মধ্যেও নানা সন্দেহ, অবিশ্বাস ও দলাদলির সৃষ্টি হয়। সেনা কর্মকর্তাদের দু'চারজনের উচ্চাকাক্সক্ষা পূরণের জন্য কমান্ড ও পুরো বাহিনীকে ব্যবহার করার চেষ্টা চলে। এসবের ফলে ক্যু-পাল্টা ক্যুর অনেক ঘটনা ঘটে। শত শত সেনা কর্মকর্তা ও সদস্য নিহত হন, ফাঁসিকাষ্ঠে জীবন দেন। হাজারো সুশিক্ষিত সেনা কর্মকর্তা ও সদস্য অকালে চাকরি হারিয়ে অসহায়, অনিশ্চিত ও মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হন।

এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এক পর্যায়ে দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ব্রতী হলো। দেশের মানুষ সামরিক স্বৈরাচারের নিষ্ঠুর নির্যাতন মোকবেলা করে বিশাল গণসংগ্রাম গড়ে তোলে। এরশাদ সরকারের পতনের পর আবারও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হয়।

রাজনৈতিক সঙ্কট ও সংহাত, ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন শেষ পর্যন্ত ২০০৭ সালে এক-এগারোর পরিবর্তন নিয়ে আসে। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় বসে।

সঙ্কটগ্রস্ত গণতন্ত্রকে 'উদ্ধার' করার জন্য বরাবরের মত এবারও সেনাবাহিনী কার্যত ক্ষমতায় আসে। তবে এবারের ঘটনা শুধু সেনাপ্রধানদের উদ্যোগে নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, ভারত এবং বাংলাদেশে ইউএনডিপি'র প্রধানসহ অনেকেই এই ঘটনা ঘটাবার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ক্রিয়াশীল ছিল। খালেদা-হাসিনাসহ রাজনৈতিক নেতা অনেকেই গ্রেফতার, নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হলেন।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল অতীতে যেমন হয়েছে, তেমনি গণতন্ত্র আর উদ্ধার হলো না। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পিছু হটতে বাধ্য হলো। গণদাবীর মুখে মানে একটা নির্বাচন দিয়ে তাদের কেটে পড়তে হলো। পাকিস্তান আমলে, বাংলাদেশের চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এটাই দেখলাম গণতন্ত্র সঙ্কটে পড়লে গণতন্ত্রের পথেই তা উত্তরণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। সামরিক হস্তক্ষেপ গণতন্ত্রকেও ধ্বংস করে, দেশ এবং সেনাবাহিনীকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।

কিন্তু আমরা কি ইতিহাস থেকে আদৌ কোনো শিক্ষা নিয়েছি ? আওয়ামী মহাজোট সরকারের দুই বছর পার হয়ে গেল। দেশের পরিস্থিতি আবারও যে প্রেক্ষাপটে এক-এগারোর জন্ম হয়েছিল, সেই ধরনের একটা অবস্থা সৃষ্টি করছে বলে অনেকেই মনে করেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপিরসহ অনেক নেতাই আবারও এক-এগারোর মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন। জনৈক বুদ্ধিজীবী প্রশ্ন তুলেছেন সরকারের মধ্যে কি আর একটি সরকার আছে, সরকারের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে শক্তিশালী কে আছে! মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলছেন, রাষ্ট্রের ভেতরে আর একটি রাষ্ট্র কাজ করছে। জাতীয় সংসদের স্পিকার আবারও এক-এগারোর ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন।

এবারের সংসদ নির্বাচনের পর একটি অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে। সংসদে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অনেক দলের সদস্য সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক (এক-এগারোর) সময়ের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেছেন। দুই দলের একই ভাষায় কথা বলাটা ছিল বিরল ঘটনা। বিষয়টি নিয়ে সংসদে খোলামেলা আলোচনা ও জাতীয় সংলাপ, হতে পারত সেনাবাহিনীর সাথে সংলাপ। কিন্তু তা করা হয়নি। এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতির এই মৌলিক প্রশ্নটির সুরাহা না করে যখন বড় দলগুলো বেঘোরে খেলতে থাকে, ক্ষমতায় যওয়ার জন্য, থাকার জন্য ফাউল করে, যা কিছু করার তাই করতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে, তখন আমার কাছে তা খুব হাস্যকর মনে হয়। মনে হয় একটা বাঁশি বাজলেই তো এই চায়ের পেয়ালার ঝড় শেষ!

মনজুরুল আহসান খান : বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি।