মেনি বিড়ালের ইন্টারভিউ : বিএনপি কি প্রস্তুত?

আরিফ জেবতিক
Published : 6 July 2011, 03:06 PM
Updated : 6 July 2011, 03:06 PM

শফিক রেহমান আমার খুব প্রিয় লেখকদের একজন। তিনি খুব সহজ ভাষায় লিখতে পারেন এবং তার লেখায় অপ্রয়োজনীয় জটিলতা নেই। এ কারণে মানুষরা তো বটেই, আমার মতো মিনি বেড়ালও তার লেখা বুঝতে পারে।>

শফিক রেহমান আগে লিখেছেন খালেদা জিয়ার ভাষণ, এখন লিখেন নেড়ি কুকুরের ইন্টারভিউ। নেড়ি কুকুরের ইন্টারভিউ প্রকাশের সময় লেখকের নাম প্রকাশিত হলেও খালেদা জিয়ার ভাষণ শফিক রেহমানের নামে প্রকাশিত হয় না। সুতরাং আমি জানি না, উনি এখনও খালেদা জিয়ার ভাষণ এবং নেড়ি কুকুরের বক্তব্য একই সঙ্গে লিখে যাচ্ছেন কি না। তবে বিএনপি সংশ্লিষ্টদের কুকুরপ্রীতি ও কুকুরভীতি আছে। এর আগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী একবার কুকুর লেজকে নাড়াচ্ছে নাকি লেজ কুকুরকে নাচাচ্ছে সেটা নিয়ে মন্তব্য করে বিএনপি থেকে বহিস্কার হয়েছিলেন। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরোধীরা বলেছিলেন তিনি লেজ ও কুকুর বলতে দলের দুইজন শীর্ষব্যক্তিকে বুঝিয়েছিলেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে বিএনপি সমর্থকদের কাছে কুকুর গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী। তাদের কুকুরপ্রীতি আছে কিন্তু কোনো বিড়ালপ্রীতি নেই।

ড়ি কুকুর ও খালেদা জিয়ার ভাষণ লেখক আমার প্রিয় এই ওল্ড প্রফেশনাল ও লেখক শফিক রেহমানের শেষ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে গত ৪ জুলাই। বিডিনিউজ২৪.কম-এ এই লেখাটি পড়ে আমি দেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি।

আপনারা জানেন, আমরা বিড়ালরা সহজে উদ্বিগ্ন হই না, পেটের দায়ে বর্জ্য আবর্জনা ঘাটা আমাদের কাজ নয়। আমরা নিরুদ্বিগ্ন জীবন যাপন করি এবং ঘরের মধ্যে আয়েশ করে থাকি। এই আয়েশ করার কারণে আমাদের পক্ষে টেলিভিশন দেখা সম্ভব হয়, টেবিলে লাফ দিয়ে উঠে পত্রিকার ছবি দেখাও সম্ভব হয়। এবং বাসায় শুয়ে বসে থাকার কারণে চিন্তা করার জন্য আমাদের হাতে বেশি সময় থাকে, আমরা চিন্তাভাবনা না করে কোনো কিছু বলতে তাই পছন্দ করি না।

নেড়ি কুকুরের ইন্টারভিউতে শফিক রেহমান দেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছেন, তিনি চিন্তা করছেন বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কি দেশের বারোটা বাজবে? আওয়ামী লীগের বারোটা বাজবে?

তার এই প্রশ্ন আমি বুঝতে পেরেছি। আমি চিন্তা করেছি, যদি দেশের বারোটা বেজেই যায়, অথবা আওয়ামী লীগের বারোটা বাজে, তখন আমাদের উদ্ধার করবে কে?

আমার প্রথম পছন্দ বিএনপি। শেষ জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী তারাই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল। সুতরাং প্রথমজন ব্যর্থ হলে, দ্বিতীয় হিসেবে তাদেরই সুযোগ পাওয়ার কথা। কিন্তু আমি উদ্বিগ্ন হলাম, কারণ বিএনপি কি এই দায়িত্ব নিতে সক্ষম?

২০০৮ সালের নির্বাচনের পরে আড়াই বছর কেটে গেছে। এর মধ্যে বিএনপির কর্মকাণ্ড আমি বিবেচনা করলাম। বিএনপির জন্য এই সময়কালকে আমি কয়েকটি ভাগে বিবেচনা করতে পারি।

দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত হওয়া

গত আড়াই বছরে বিএনপি দুর্নীতিবাজদের দল হিসেবে পরিচিত হয়েছে বেশি। বিএনপির মূল শক্তি ছিল জিয়াউর রহমানের সততা সম্পর্কে জনগনের আস্থা। শেখ হাসিনা এবং অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতারা যদিও অনেকবারই জিয়াউর রহমানকে অসৎ প্রমাণিত করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সেটি তারা সফলভাবে করতে পারেননি। ৯১ সালে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তখনও তার সততা নিয়ে জনমনে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি।

কিন্তু এই সততা সম্পর্কে জনগনের ধারণা অক্ষুন্ন রাখতে পারেননি জিয়া পরিবারের দুই উত্তরাধিকারী। তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমানের নামে দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে। আরাফাত রহমানের দুর্নীতি বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচার হয়েছে। তিনি বমাল ধরা পড়েছেন। সিঙ্গাপুরে তার ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করেছে সেই দেশের সরকার। এটা তারা বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে করেনি, করেছে আমেরিকার অনুরোধে। সুতরাং আরাফাত রহমানের দুর্নীতি নিয়ে আওয়ামী লীগ ষড়যন্ত্র করেছে–সেটি আমরা বেড়াল সমাজ বিশ্বাস করতে পারি না। ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক ভালো থাকলেও, সিঙ্গাপুর এবং আমেরিকার উপর আওয়ামী লীগের এমন প্রভাব নেই।

তারেক রহমানের দুর্নীতি এখনও আদালতে প্রমানিত হয়নি। কিন্তু তার বন্ধুবান্ধবদের সম্পত্তি দৃশ্যমান হয়েছে। বিএনপির আরেক রহস্যময় নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালু মাত্র কয়েক বছরে ঢাকায় অনেকগুলো বড় বড় মিডিয়ার মালিক হয়েছেন। তিনি দামী গাড়িতে চলাচল করেন এবং সম্পদশালী ব্যক্তি হিসেবে নিয়মিত হজ্ব করেন। খালেদা জিয়ার হজ্ব বহরে তাকে নিয়মিত দেখা যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ফালু, মামুনসহ তারেক রহমানের আশেপাশের লোকদের বিপুল সম্পত্তির কথা পত্রিকায় সচিত্র প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা বেড়াল সমাজ সম্পত্তির কিছু বুঝি না। কিন্তু মানুষ সমাজ এটা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যাবে। তারা চিন্তা করবে, আওয়ামী লীগ যদি দেশের বারোটা বাজিয়ে দেয়, তাহলে তারা কোথায় যাবে? তারা কি আবারও ফালু-মামুন-কোকোদের কাছে ফিরে যাবে? এর পরিনতি কী হবে? যারা জিয়াউর রহমানের সততার উপর বিশ্বাস রেখে বিএনপিকে ভোট দিতেন, তারা এখন কোথায় ভোট দেবেন?

খালেদা জিয়ার ইমেজ ধ্বংস

খালেদা জিয়ার ইমেজ তৈরি হয়েছিল এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে। মানুষ এবং আমরা বিড়ালরা বিশ্বাস করতাম, তিনি আপোষহীন নেত্রী। তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন এবং তিনি ক্ষমতার লোভে এরশাদের সঙ্গে কোনো ভাগাভাগির নির্বাচনে যাননি।

কিন্তু খালেদা জিয়ার সেই ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মানুষ দেখেছে তিনি সন্তানস্নেহে অন্ধ হয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি।

আমরা বেড়ালরা দেখেছি, তিনি অত্যন্ত বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন। তার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে তাকে উচ্ছেদ করার পরে সেই বাড়ির ছবি পত্রিকায় আমরা দেখেছি। আমরা বিড়ালরা এরকম আরামদায়ক সোফা এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে মার্বেলের বিছানাকে পছন্দ করি। কিন্তু সাধারণ মানুষ এরকম সুযোগ পায় না। তারা খালেদা জিয়ার জীবন যাপন দেখে ঈর্ষান্বিত হয়েছে। তারা হয়তো এরকম বিলাসী জীবনযাত্রার কাউকে আগের মতো নেতা মানতে প্রস্তুত থাকবে না।

বিপর্যস্ত সংগঠন

আমরা দেখেছি বিএনপি গত আড়াই বছরে অত্যন্ত বিপর্যস্ত একটি সংগঠন হিসেবে ইমেজ রেখেছে। এই দলের নেতারা নির্বাচন কমিশন ঘেরাও করতে রওনা দিয়ে সেখানে গিয়ে পৌঁছাতে পারেননি। মাঝপথে তাদের দম শেষ হয়ে গেছে। আড়াই বছরে বিএনপি মাত্র কয়েকটি হরতাল ডেকেছে। কারণ হরতালে সক্রিয় হয়ে ওঠার মতো তরুণ কর্মী এখন বিএনপির নেই। হরতালে নেতাদের সক্রিয় হয়ে ওঠার জন্য খালেদা জিয়াকে ধমক ধামক দিতে হচ্ছে।

এই দল ঢাকডোল বাজিয়ে বড় করে কাউন্সিল করলেও, কাউন্সিলের পরে কোনো কমিটি তৈরি করতে পারেনি। তারা শুধু মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে যুগ্ম মহাসচিব করতে পেরেছে। বাকি পদগুলো ধীরে সুস্থে পরে পূরণ করা হয়েছে, কাউন্সিলে কিছুই হয়নি। কাউন্সিল তাই শেষ পর্যন্ত হয়ে গেছে বিরিয়ানি খাওয়ার উৎসব। সেই বিরিয়ানিতে নেড়ি কুকুরদের খাওয়ার সংস্থান হয়েছে, কিন্তু আমাদের মতো বিড়ালদের কোনো লাভ হয়নি। আমরা বিরিয়ানিতে উৎসাহিত ছিলাম না, আমরা চেয়েছিলাম বিএনপি গনতন্ত্র চর্চায় ফিরে যাক। কিন্তু তারা সেটি করতে পারেনি। তারা তাদের জাতীয় কমিটিও গঠন করতে পারেনি কাউন্সিলে।

তারা অসংখ্য জেলা কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিলেও সেগুলো সম্পন্ন করতে পারেনি। এমনকি ঢাকা মহানগর কমিটি গঠন করতেও তাদেরকে বেগ পেতে হয়েছে। বছরের পর বছর তারা দুই সাবেক মেয়র মির্জা আব্বাস এবং সাদেক হোসেন খোকার মাঝে কার হাতে দায়িত্ব দেবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এর ফলে ঢাকা মহানগরে বিএনপির তৎপরতা প্রায় শূণ্য হয়ে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত ঢাকা মহানগর কমিটির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সাদেক হোসেন খোকাকে। আপনারা হয়তো স্মরণ করতে পারবেন, সাদেক হোসেন খোকা হচ্ছেন বিএনপির সেই অংশের নেতা, যারা খালেদা জিয়াকে মাইনাস করতে চাচ্ছিলেন। খোকা খালেদা জিয়াকে মাইনাস করতে চাইলেও খালেদা জিয়া খোকাকে মাইনাস করতে চাননি। তিনি তাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। আপনারা হয়তো আরো স্মরণ করতে পারেন যে, এই সাদেক হোসেন খোকাই বিএনপির কাউন্সিলে বিরিয়ানি সরবরাহের দায়িত্বে ছিলেন। আমরা বিড়ালরা নিমকহারাম হই না, এবং নেড়ি কুকুরও নিমকহারাম হয় না। কিন্তু মানুষ নিমকহারাম হয়। যেমন হয়েছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। কিন্তু বড় দল হিসেবে বিএনপি নিমকহারাম হতে পারবে না। তারা বিরিয়ানির নিমক খেয়েছে। কিন্তু কাউন্সিলের সেই বিরিয়ানির বিনিময়ে সাদেক হোসেন খোকা বিএনপির দায়িত্ব পেয়েছেন কি না, সেটা আমরা জানি না।

তরুণদের মধ্যে কোনো আশা নেই

আপনারা মনে করতে পারবেন যে শফিক রেহমান শুধু নেড়ি কুকুর এবং খালেদা জিয়ার ভাষণই লিখেন না, তিনি ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে এক কোটি তরুণ ভোটারদের কাছে আবেদন জানিয়েও লিখেছিলেন। তার লেখায় তরুণ সমাজ উদ্দীপ্ত হয়েছিল। তারেক রহমানের তারুণ্যদীপ্ত স্মার্টনেসেও তারা উদ্দীপ্ত হয়েছিল। আরেক তরুণ নেতা মাহি বি চৌধুরী বিএনপির পক্ষে টেলিভিশন প্রোগ্রাম বানিয়েছিলেন, সেই প্রোগ্রাম সফল হয়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে তাই বিএনপি ছিল অনেক স্মার্ট লুকিংয়ে। সেই স্মার্টনেস তরুণ সমাজকে বিএনপির পক্ষে ভোট দিতে উৎসাহিত করেছিল।

কিন্তু বিএনপির সেই স্মার্টনেস এখন আর দেখা যাচ্ছে না। বিএনপির স্মার্ট সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরের চুলের জেল মুছে গিয়ে বাবর এখন দাড়িওয়ালা একজন রোগাক্রান্ত বিধ্বস্ত মানুষের ছবি নিয়ে প্রকাশিত হয়েছেন। বাবরের মতোই চেহারা হয়েছে বিএনপির।

২০০১ সালের ওল্ড প্রফেশনাল শফিক রেহমান যেভাবে ২০১১ সালে তরুণদের উদ্দীপ্ত করার জন্য টু ওল্ড হয়ে গেছেন, তেমনি টু ওল্ড হয়ে গেছেন বিএনপির অন্যরাও।

ছাত্রদলের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটিতে ছাত্র ছাড়া বাকি সব প্রফেশনের লোক আছে। আপনারা জানেন সেখানে লন্ডনের একটি রেস্টুরেন্টের বাবুর্চি থেকে শুরু করে বাংলাদেশ সরকারের পুলিশের এসআই পর্যন্ত আছে। শুধু নেই ছাত্ররা। ৯০ এর আগে যে ছাত্রদল সবগুলো ক্যাম্পাসে খালেদা জিয়ার শক্তি হয়েছিল, তারা এখন ক্যাম্পাসে প্রবেশই করতে পারে না। অবশ্য পারারও কথা নয়। অছাত্রদের ক্যাম্পাসে কোনো কাজ থাকা ঠিক নয়। ছাত্রদলের সভাপতি হয়েছেন টুকু। তিনি একজন টেকো প্রৌঢ়, তার নিজের সন্তানই সম্ভবত কলেজে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আপনারা জানেন ছাত্ররা তাদের নেতাদেরকে ভাই বলে সম্ভোধন করে। কিন্তু টেকো মাথার প্রৌঢ় টুকুকে ডাকতে হবে আংকেল। ছাত্ররা কোনো আংকেলের প্রতি আকর্ষিত হচ্ছে না। তাই ছাত্রদলের কোনো অস্তিত্ব এখন কোনো ক্যাম্পাসে নেই। যুবদলের কমিটি নিয়ে ক্ষোভ এবং পাল্টা ক্ষোভের কথা আপনারা নিয়মিতই পত্রিকায় পড়ছেন।

আপনারা যারা অনলাইনে এই লেখা পড়ছেন, তারা জানেন এখন ইন্টারনেটের যুগ। তরুণ সমাজ ইন্টারনেটে আকর্ষিত। কম্পিউটার এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দেশের প্রায় নব্বই লক্ষ লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করে। কিন্তু আপনারা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন বিএনপির কোনো ওয়েবসাইট নেই। তাদের সম্ভাব্য ডোমেইন নামগুলো অন্যরা আগেই কিনে নিয়েছে। বিড়াল হিসেবে আমি উদ্বিগ্ন হচ্ছি যে দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল তাদের নিজেদের ওয়েবের বারোটা বাজানো রোধ করতে পারেনি, তারা কীভাবে দেশের বারোটা বাজানো বন্ধ করতে পারবে?

জাতীয় ইস্যু বিএনপি বুঝতে পারছে না

আমি যখন এই ইন্টারভিউ দিচ্ছি, তখন দেশে বিএনপি দুই দিনের হরতাল ডেকেছে। এই হরতালের সঙ্গে মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা হরতাল ডেকেছে তারেক রহমানকে মামলায় জড়িয়ে ফেলার প্রতিবাদ করতে। তারা এর আগেও এসব ইস্যুতে হরতাল ডেকেছে। তারা খালেদা জিয়ার বাড়ি রক্ষার জন্যও হরতাল ডেকেছে। সংবিধানে আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস কথাটি পুনঃস্থাপনের দাবিতেও তারা হরতাল ডেকেছে। দেখা যাচ্ছে বিএনপির কর্মকাণ্ড বাড়ি-মামলা এবং আল্লাহপাকের নামের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে।

অথচ দেশে অনেক বড় বড় সমস্যা রয়েছে। বিএনপি এসব বুঝতে সক্ষম হচ্ছে না। তাই শেয়ার কেলেংকারিতে জড়িতদের বিচারের দাবিতে বিএনপির হরতাল নেই। অবশ্য এই কেলেংকারিতে ফালুর নামও এসেছে। সুতরাং ফালুকে বাঁচাতে বিএনপি হয়তো শেয়ার কেলেংকারি নিয়ে হরতাল ডাকা থেকে বিরত আছে। আমরা বিড়ালরা বুঝতে পারব না ৩০ লক্ষ বিনিয়োগকারীদের তুলনায় ফালু গুরুত্বপূর্ণ কি না। এটা বুঝতে পারবেন খালেদা জিয়া। বিএনপির তৈরি র‌্যাব এখন মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। তারা মির্জা আব্বাসের বাড়িতে ঢুকে অমানবিক নির্যাতন করেছে, লিমন নামে একজনকে পঙ্গু করে দিয়েছে। কিন্তু বিএনপি এই ইস্যুতে কথা বলছে না। খালেদা জিয়ার বাড়ির লিজ বাতিল নিয়ে তারা প্রতিবাদী হলেও কনকো-ফিলিপসের কাছে সাগরের কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্রের লিজের ব্যাপারেও বিএনপি কথা বলছে না। সব মিলিয়ে বিএনপি চিহ্নিত হচ্ছে একটি স্বার্থপর দল হিসেবে, যারা নিজেদের বাড়ি এবং মামলার বাইরে দেশের মানুষের সমস্যা নিয়ে আপাতত চিন্তিত নয়।

তাহলে কী হবে

আমরা বিড়ালরা দেখতে পাচ্ছি যে বিএনপির প্রতি তবু ভোটারদের ভালবাসা আছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির সমর্থনে বিপুল ভোটে মেয়র পদে বিজয়ী হয়েছেন মঞ্জুর আলম। পৌরসভা নির্বাচন, ইউপি নির্বাচন এবং বিভিন্ন প্রফেশনাল সংগঠনগুলোর নির্বাচনে বিএনপি সমর্থকরা ভালো করছেন।

এতে আওয়ামী লীগ ভয় পেয়েছে। তারা ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন দেওয়া থেকে সরে এসেছে। তারা আদালতের দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করে দিয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগে অনেক বড় বড় উকিল ব্যরিস্টার আছেন। তারা জানেন যে আগামী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার ব্যাপারে আদালতের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তারা সে পথে যায়নি। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিয়েছে। তারা রাজপথে সহিংস হয়ে উঠছে। তেল গ্যাস আন্দোলনকারীদেরকে তারা পিটিয়ে আহত করেছে। বিএনপি নেতাকর্মীদেরকেও তারা পুলিশ দিয়ে পেটাচ্ছে। আমি যখন এই ইন্টারভিউ দিচ্ছি তখন চিফ হুইপ জয়নাল আবেদিন ফারুক হাসপাতালে গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। কারণ আওয়ামী লীগ সরকারের পুলিশ তাকে মারাত্মক আহত করেছে।

এভাবে আওয়ামী লীগের নৈতিক পরাজয় ঘটছে। তারা নির্বাচনের আগেই পরাজিতের মতো আচরণ করছে। সুতরাং আমি আশংকা করছি, নিশ্চিত বিজয়ের সম্ভাবনা না থাকলে আওয়ামী লীগ ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মতো জাতীয় নির্বাচনও আটকে দিতে চেষ্টা করতে পারে।

এতে বিড়ালদের কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু বিএনপির সমস্যা হতে পারে। বিএনপির কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তারেক এবং কোকোর নিরাপদ জীবন। এটাই তাদের কাছে বড় এজেন্ডা। সুতরাং খালেদা জিয়া চাইবেন তিনি যেকোনো মূল্যে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যেতে।

আপনারা জানেন খালেদা জিয়া ইস্পাত কঠিন নেত্রী হিসেবে উনার সমর্থকদের কাছে চিহ্নিত। সেই ইস্পাত কঠিন নেত্রী এখন সন্তানস্নেহে অন্ধ আহত বাঘীনি। সন্তানস্নেহে অন্ধ বাঘিনী সম্পর্কে আপনারা মানুষরা অবগত না থাকলেও আমরা বিড়ালরা অবগত। কারণ বিড়াল এবং বাঘ একই প্রজাতির প্রাণী।

সন্তানের জন্য এই বাঘিনী ঝাপ দেবেন। নির্বাচনে ক্ষমতায় যেতে পারার নিশ্চয়তা না পেলে খালেদা জিয়াও নির্বাচনে যাবেন না। তার সামনে অনেক অজুহাত থাকবে।

নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তন একটি বড় অজুহাত। সেই অজুহাতে খালেদা জিয়া নির্বাচন বর্জন করতে পারেন। তিনি আরো কঠিন আন্দোলন করার জন্য তার সমর্থকদের নির্দেশ দিতে পারেন।

এখন অবস্থা সুবিধার নয়। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিজেদের হালুয়া রুটির ভাগাভাগিতে ব্যস্ত, বিএনপি ছন্নছাড়া এবং নিজেদের স্বার্থের বাইরে কিছুই দেখছে না। বিএনপির সমর্থক আছে, কিন্তু তাদের নেতা নেই।

এভাবেই আরো আড়াই বছর কেটে যাবে। নির্বাচনে সময় আসবে। তখন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি কেউই নির্বাচনের জন্য দলগতভাবে প্রস্তুত থাকবে না। অথচ দুই দলই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করবে। তখন সংঘাত অনিবার্য।

দেশে হানাহানি বাড়বে। মানুষ বিরক্ত হবে। তারা আওয়ামী লীগের থেকে মুখ ফেরালেও বিএনপির দিকে মুখ দিতে উম্মুখ হবে না।

আমরা বিড়ালরা বাসায় বসে ঝিমাবো, কিন্তু মানুষ ঝিমাতে পারবে না। তারা তখন কী করবে?