খালেদা জিয়ার বিলেত সফর: আনন্দ, উদ্বেগ না বিপদের

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 17 Sept 2015, 03:00 PM
Updated : 17 Sept 2015, 03:00 PM

মাতা-পুত্রের মিলন সব সময় আনন্দের। জগতে যত সম্পর্ক আছে তার ভেতর এটাই মধুরতম। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের দেখা হবার ঘটনাটা সে দিক থেকে ঠিক আছে। তবে এই দেখা হওয়া না-হওয়ার কারণ কিন্তু এমন যাতে আমাদের দেশ জাতি ও জড়িত। একদা দেশের যুবরাজ, হাওয়া ভবনের মালিক, 'খাম্বারাজ' নামে পরিচিত তারেক রহমান কিন্তু স্বেচ্ছায় বিদেশে যাননি।
তার এই আপাত 'অগস্ত্য' যাত্রার পেছনে রয়েছে কালো ইতিহাস।

দেশের রাজনীতিতে বোমা ছুরি গুলি বা চাপাতি নতুন পুরনো যাই হোক না কেন, গ্রেনেড একেবারেই ভিন্ন স্বাদের একটা বিষয়। আমরা জানতাম যুদ্ধে এটি ব্যবহার করে সৈনিকেরা। মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রেনেড হামলা ছিল আশাব্যঞ্জক একটি খবর। আবার উপমহাদেশে পাক-ভারত লড়াইতেও এর বহুল ব্যবহারের কথা শুনেছিলাম। কিন্তু খোদ ঢাকার বুকে বড় বড় গ্রেনেড হামলা বড়সড় বুকের পাটা না থাকলে করানো বা করা অসম্ভব। নিন্দুকেরা বলে, এর সামনে যদিও ছিল উগ্রবাদী নামের কিছু যুবক বা মানুষ, নেতা হিসেবে যদিও ছিলে চুলে জেলি-মাখা বাবর, পেছনে নাকি ছিলেন ওই তারেক রহমান।

কী করে কী করে যেন আমাদের দেশের সঞ্জয় গান্ধী হয়ে ওঠা তারেকের মায়ের অবস্থাও ধীরে ধীরে ইন্দিরা গান্ধীর মতো হয়ে গিয়েছিল। পার্থক্য এই যে, ইন্দিরার পুত্রটি ষড়যন্ত্রে বা দুর্ঘটনায় মারা যাবার পর শ্রীমতি গান্ধী তাঁর দূরদর্শিতা আর প্রজ্ঞায় আবারও উঠে দাঁড়াতে পেরেছিলেন।

খালেদা জিয়াকে যদ্দিন আপোসহীন নেত্রী বলে জানতাম তত দিন তাকে পুরো না হলেও কিছু বুঝতাম। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বদলায়। তিনি ও তার দলের বয়স বাড়ার পর এমন বদলে গেলেন তিনি যে, আমরা যারা আোম্মক বা বোকা টাইপের, তারা পড়ে গেলাম বড় ফাঁপরে। কখনও মনে হতে লাগল বিএনপি আসলে জামায়াতের অঙ্গ সংগঠন, কখনও-বা উগ্রবাদী, কখনও নেই নেই ভাবের ছায়াভূত।

মুশকিলটা বাড়ল যখন আওয়ামী লীগ যেন-তেন প্রকারে একটা নির্বাচন করে পাওয়ারে চলে গেল। বিএনপি না পারল ঠেকাতে, না জনমত গড়ে তুলল। বদলে তাদের আসল জায়গা হারিয়ে হয়ে উঠল জামায়াতের ছায়াসঙ্গী। এককালে যে জামায়াত বিএনপির কল্যাণে দেশের রাজনীতিতে জায়গা করতে পেরেছিল তারাই চলে এল চালকের আসনে।

কথাগুলো বললাম এই কারণে যে, এর পেছনে তারেক রহমানের ভূমিকাই দায়ী। একটা কথা মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মানুষ যে কোনো বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে। তারা কখনও নীরবে, কখনও সরবে তার জানান দেয়। ভারত-বিরোধিতা, সাম্প্রদায়িকতা আর পাক-প্রীতির রাজনীতি যে চিরকাল চলবে না এটা হয়তো আঁচ করতে পারেনি তারা। পারার কথাও নয়। রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ পুঁচকে তারেক রহমান যাদের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন বা যারা তাকে মদদ দিত তাদের সামনে ছিল এক আদর্শ, এক উদ্দেশ্য– ভোগ আর মজা লোটা। কোনো ভবন যে কাউকে বাঁচাতে পারে না সেটা বোঝার আগেই তার বিদায়ের ঘণ্টা বেজে যায় এবং এক সময় 'গণতন্ত্রের সূতিকাগার' নামে পরিচিত বিলেতে আশ্রয় নেওয়া তারেক মাঝে মাঝেই খবরের শিরোনাম হতে শুরু করেন।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তার একটি অডিও-ভিডিও বার্তা দেখা ও শোনার সুযোগ হয়েছিল। বাংলা বলেন ভালো। উচ্চারণও পরিষ্কার। কিন্তু বিষয়বস্তু ছিল সাংঘাতিক। জানি না কারা তাকে মদদ ও উস্কানি দিয়েছিল। তাদের কথামতো তারেক ভেবেছিলেন, তিনি বললেই বাংলার মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্বাচন বয়কটের জন্য জান দিতে এগিয়ে আসবে। খাম্বার ছেঁড়া তারে তখনও যে জোড়া লাগেনি সেটা বুঝতে না পারার মাশুল দিয়েছে বিএনপি।

তখন থেকে এক ধরনের আন্ডারগ্রাউন্ড খেলা আর অফিসে বসবাস করে খালেদা জিয়া হয়ে উঠলেন আরও নিঃসঙ্গ। এক দিকে রাস্তায় মাতম– পেট্রল বোমা– যান, মানুষ, জীবননাশ– আরেক দিকে না-আন্দোলন না-সমঝোতা। এ সব কিছু এক সময় থিতু হয়ে এলে খালেদা জিয়া কি এখন আসলে আইনের ভয়ে বিচারের রায় বেরুনোর আগে সরে পড়লেন, না এ-ও এক ধরনের গোপন সন্ধি?

এই প্রশ্ন জাগিয়ে একবার যাত্রা বাতিল করে শেষ পর্যন্ত তিনি এখন লন্ডনে। বিলেত একদা সভ্য বা ভদ্রলোকের দেশ হলেও এখন আর নয়। ইউরোপের বাতিল মালদের তীর্থভূমি লন্ডন। এশিয়ার যে সব দেশের মানুষরা সেখানে আছেন তাদের ভেতরও ভয়াবহ উগ্রতা। পাকিস্তান আর ভারতের ক্রিকেট ম্যাচের পর দাঙ্গা, পাকিদের রায়ট, ভারতীয়দের জাল ব্যবসা, বাংলাদেশিদের নব্য মৌলবাদ এমন আকার ধারণ করেছে যে, স্বয়ং ব্রিটিশ গভর্নমেন্টও বিচলিত।

তারেক রহমান সেখানে তাই বরপুত্র হিসেবে ভালো আছেন এটাই জানতাম। মা যাবার পর তার ছবি দেখে বুঝলাম, শুধু ভালো নয়, নয়া মার্সিডিজ গাড়িও হাঁকান তিনি। এটা বড় আশ্চর্যের বিষয়, কিন্তু খোশ খবরও। এই যে কাজী জাফর মারা গেলেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, বাম রাজনীতি করেও ঢাকায় বড় বড় দালান-কোঠার মালিক, তার আশ্রয় ছিল আমাদের সিডনিতে। দেশে যিনি রাজ, যার জানাজায় শরীক হয়ে তাকে স্বর্গে পাঠানোর দায় নিলাম, একবারও জানতে চাইলাম না কেন তিনি অস্ট্রেলিয়ায় শরণার্থী কোটায় আশ্রয় নিয়েছিলেন? কেন হয়েছিলেন এদেশের কাগজে 'সুগার জাফর' নামের দুঃসংবাদ? কেন তাঁর শরণার্থী হবার খায়েশ নিয়ে বাংলাদেশকে ব্যঙ্গের সম্মুখীন হতে হয়েছিল?

ভেবে দেখুন, যে হয়রানি আর জীবননাশের হুমকির কারণে তিনি এদেশে রিফিউজি হয়ে আশ্রয় নিয়ে ভিসা পেলেন, তাই যদি সত্য হত তিনি কি এদেশে থাকতেন না? যে দেশে কথিত ভয় আর বিপদের কথা বলে আশ্রয় নিলেন সে দেশেই শেষ দিন অবধি বহাল তবিয়তে ছড়ি ঘুরিয়ে গেছেন। তা্হলে কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা? মারা গেছেন বলে কি এসব ভুলে যেতে হবে আমাদের? তাহলে তো হিটলার বা এজিদকে মাফ করে দেওয়ারও বিকল্প নেই।

যে কথা বলছিলাম, আমাদের দেশের হাজার হাজার পরিশ্রমী মানুষ, যারা বিদেশে কষ্ট করেন, দিনরাত পরিশ্রম করেন, তাদের অনেকের গাড়ি নেই। রিকশা-অটোবিহীন এসব দেশে কী কষ্ট আর দুর্ভোগ তা দেশের মানুষ কল্পনাও করতে পারবেন না। যারা গাড়ি কেনেন তাদের বেশিরভাগের গাড়ি সেকেন্ড-হ্যান্ড, থার্ড-হ্যান্ড বা হাত হাত বদলাতে বদলাতে প্রায় নো-হ্যান্ড টাইপের। কিন্তু পার্থক্য এই যে, তারা সবাই দেশে টাকা পাঠান। রক্তে অর্জিত অর্থ পাঠিয়ে দেশকে সবল করেন। আর তারেক রহমানরা দেশের টাকায় বিদেশে মার্সিডিজ হাঁকান।

কী যে দিনকাল পড়েছে, সভ্য দেশেও এগুলোর কোনো স্বচ্ছতা বা জবাবদিহিতা নেই। গাড়ি কোম্পানি ভাবে, আমার গাড়ি বিক্রি হলেই হল। ইন্সুরেন্স ভাবে, মন্দ কী, আমার তো ব্যবসা হল। এভাবেই চলছে।

তারেক রহমানের আয়-উপার্জনের উৎস জানা আমার উদ্দেশ্য নয়। তাদের জমানো টাকা অঢেল হতেও পারে। আর দেশে-বিদেশে তাদের দেবার বা নেবার লোকের সংখ্যাও কম নয়। আমাদের দুর্ভাবনা অন্যত্র। ষড়যন্ত্র কি থেমে থাকবে? খালেদা জিয়া এখন প্রায় নিঃসঙ্গ আর হতাশ। যে কোনো ফাঁদে পড়ার এটাই সময়। মহাভারতের বিদুষী গান্ধারীও সন্তানের শঠতায় নীতিতে অটল থাকতে পারেননি।

তারেক রহমান বিলেতের রাজনীতি করেন না। লেবার লিবারেল কনজারভেটিভ কোনো দলে যাবার মতো জায়গায় নেই তিনি। তার ধ্যান-জ্ঞান সব দেশের সিংহাসন-কেন্দ্রিক। প্রায় পেতে পেতে হারিয়ে ফেলা বস্তুটি কি এত সহজে ছেড়ে দেবেন? সঙ্গে আছে জামায়াতের বিদেশি লবিং আর অর্থায়ন। শুনতে খারাপ লাগলেও সত্য, আওয়ামী লীগের চাইতে নীরব ভোটে বিএনপি এগিয়ে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে ভালো খেললেও সরকারে প্রধানমন্ত্রী ছাড়া বাকিরা কমবেশি 'হোপলেস'। আশাহীন মানুষদের ওপর জনগণের আস্থাও তাই নড়বড়ে।

আগেই লিখেছি মা-পুত্রের মিলন মধুর। তবে এর পানি কোথায় গড়াবে বলা মুশকিল। সরকার বাধ্য হয়ে অথবা সমঝোতায় হোক, যেভাবেই তাঁকে যেতে দিক না কেন, এর একটা অন্তর্নিহিত রহস্য অবশ্যই আছে। কে নিরাপদ আর কারা আসলে জয়ী তা এখনই বলা যাবে না। তবে অনেক দিন পর বিদেশের আলো-হাওয়া গায়ে মাখা খালেদা জিয়া নিশ্চয়ই তাঁর লাল কার্পেট আর রাজকীয় অভ্যর্থনা মিস করবেন। অন্যদিকে তারেক রহমানের চিন্তা-চেতনা আর রাজনীতিতে যদি এখনও উগ্রতা আর ষড়যন্ত্র থাকে, তার মাশুলও দিতে হতে পারে।

অগ্রজরা বহুকাল আগে বিলেত ঘুরে দেশে ফিরে লিখেছিলেন: বিলেত দেশটা মাটির। সে দেশে বাংলাদেশের ভালো মন্দ উ্ভয় দিকে কাজ করার মানুষগুলো প্রমাণ করেছে, মাটির হলেও এর একটা কঠিন পাষাণ দিক আছে। এই সফর কি সেই জগদ্দল পাথর ভারি করবে, না নতুন বিপদ ডেকে আনবে? নাকি সব কিছু চলবে সেই ছকে যার হদিশ খোদ সরকার, বিরোধী দল বা নেতা-মন্ত্রী কেউ জানেন না? সেটাই এখন দেখার বিষয়।