উচ্চশিক্ষায় ভ্যাট বনাম উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা

এইচ এম মহসীন
Published : 13 Sept 2015, 05:46 PM
Updated : 13 Sept 2015, 05:46 PM

বেশ কিছু সময় ধরেই দেশের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে চরম অস্থিরতা চলছে। সর্বশেষ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফিতে ভ্যাট (ট্যাক্স) আরোপের বিষয় নিয়ে এ পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে কদিন ধরে রাজপথে নেমেছে শিক্ষার্থীরা। চলমান এই আন্দোলনের কারণে দেশের সাধারণ মানুষও প্রচুর ভোগান্তির শিকার হয়েছেন, হচ্ছেন।

আন্দোলন নিরসনের উদ্দেশ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা প্রদান করা হলেও বিষয়টির মীমাংসা নিয়ে গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ বা উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। রাজস্ব বাড়ানোর অজুহাতে উচ্চশিক্ষা খাতে কর আরোপ শুধু দূরদর্শিতার অভাবই নয়, এটি অনৈতিক এবং বৈষম্যের চরম একটি উদাহরণ।

দেশ ও জাতির উন্নয়নে শিক্ষার অবদান প্রশ্নাতীত। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশকে ২০২১ সালের মধ্যে 'মধ্যম' আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে শিক্ষার ওপর যে অপরিসীম গুরুত্ব দিতে হবে সেটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জানা না থাকার কথা নয়। তাই উচ্চশিক্ষা উৎসাহিত করতে সরকার শিক্ষাবান্ধব নীতিমালা গ্রহণ করবে, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন প্রণোদনামূলক সুবিধা প্রদান করবে সেটি ছিল প্রত্যাশিত। শিক্ষা খাতটি খরচের খাত হিসেবে না দেখে, বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করাই ছিল কাঙ্ক্ষিত।

তা না করে হঠাৎ রাজস্ব বাড়ানোর লক্ষ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে টিউশন ফিএর ওপর ভ্যাট আরোপ করা সরকারের দীর্ঘমেয়াদী ভিশনের সঙ্গে সম্পূর্ণ সংঘাতপূর্ণ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অপরিণামদর্শিতারই প্রমাণ।

টার্গেট করে শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর ভ্যাটের বোঝা চাপানো নৈতিকতার পরিপন্থী। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেখানে সরকারি ভর্তুকির বিনিময়ে নামমাত্র খরচে পড়াশোনা করছে, সেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিক বেতনের ওপর অতিরিক্ত ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্তটি দুচোখা নীতি বলা যেতে পারে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জাতির ভবিষ্যত আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ধনী বাবা-মায়ের আদরের দুলাল বা দুলালী এবং তারা দেশের কল্যাণে আগ্রহী নয় বা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে না– এমন ভাবনার সপক্ষে কিন্তু প্রমাণ নেই।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু 'অ-মেধাবী' ধনী শিক্ষার্থীরাই পড়াশোনা করে এমন ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন বেশ কজনকে চিনি যারা পার্টটাইম চাকরি করে, অথবা মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত বাবা বা ভাইয়ের পাঠানো টাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তাই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের 'প্রত্যেক শিক্ষার্থীর দৈনিক হাত খরচ ১০০০ টাকা' এই তথ্য হালে পানি পাবে না। পক্ষান্তরে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও এমন শিক্ষার্থী রয়েছে যাদের পরিবারের অবস্থা অত্যন্ত স্বচ্ছল। তাই বলে তাদের কাছ থেকে কি আলাদা করে অধিক বেতন নেওয়া হবে?

ভ্যাট মানে ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স। 'ট্যাক্স' ও 'টিউশন' শব্দ দুটি গুগলে সার্চ করতে গেলে গুগলের অটো সাজেশনস ফিচার ট্যাক্স ডিডাকশন, ট্যাক্স ক্রেডিট বা ট্যাক্স রিইমবারসমেন্টের বিষয়গুলো মনে করিয়ে দেয়। অর্থাৎ টিউশন ফি এবং ট্যাক্সের প্রসঙ্গ এলেই ধারণা করা হয় যে, শিক্ষার্থীর পরিবার টিউশন ফি বাবদ খরচের কারণে আয়কর সুবিধা (একটি নির্দিষ্ট অংকের আয়কর অব্যাহতি) পাবে। পাঠকের সুবিধার্থে আয়কর সুবিধার ব্যাপারটি একটু খুলে বলছি।

ধরুন একটি পরিবারের বার্ষিক আয় ১৫ লাখ টাকা এবং করমুক্ত আয়ের সীমা ২ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে তাদের আয়কর দিতে হবে ১৩ লাখ টাকা আয়ের ওপর। এবার ধরুন, পরিবারটি তাদের সন্তানদের টিউশন ফি বাবদ বছরে চার লাখ টাকা খরচ করেছে। এ ক্ষেত্রে তারা ১৩ লাখ টাকার পরিবর্তে ৯ লাখ টাকার ওপর আয়কর পরিশোধ করবে। অর্থাৎ আয়করের হার যদি ১৫ শতাংশ হয়, তাহলে পরিবারটি ৬০ হাজার টাকা কম কর প্রদান করবে।

পাঠকের স্বার্থে উদাহরণটি সহজ করে উপস্থাপন করা হয়েছে, তবে বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষা উৎসাহিত করার জন্য সরকার এ ধরনের ট্যাক্স সুবিধা প্রদান করে থাকে। এ ধরনের ট্যাক্স শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশেই নয়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও রয়েছে। ট্যাক্স সুবিধা ছাড়াও কম সুদে লোন প্রদান করা, শিক্ষার্থীর জন্য পার্টটাইম কাজের ব্যবস্থা করার মতো পদক্ষেপও অনেক দেশেই প্রচলিত রয়েছে। অন্যান্য দেশে যেখানে শিক্ষায় উৎসাহিত করার জন্য ট্যাক্স ছাড় দেওয়া হয়, সেখানে বাংলাদেশ কেন উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করল সেটি বোধগম্য নয়।

প্রশ্ন জাগে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর ভ্যাট আরোপ কি নেহায়েত রাজস্ব বাড়ানোর উদ্দেশ্যে নাকি সেখানে পড়াশোনা অনুৎসাহিত করতে? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ব্যবসা' বন্ধ করার উদ্যোগ কি এটি? অনেকে হয়তো ধারণা করেন, এ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার মান ভালো নয় এবং কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে বেশি প্রাধান্য দেয়। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা উল্লেখ করতে চাই।

প্রথমত, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান অনেক ভালো এমন দাবির স্বীকৃত প্রমাণ কারও কাছে নেই। মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা উঠলেই বুয়েট, মেডিকেল বা আইবিএএর কথা অনেকের মনে ভেসে ওঠে। প্রমাণ হিসেবে কেউ হয়তো বিভিন্ন পেশায় সফল ব্যক্তিদের তালিকা উল্লেখ করে তারা কে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট ছিলেন সেটি তুলে ধরতে পারেন।

এর সবই ঠিক আছে। কিন্তু প্রথাগত এই ধারণা চ্যালেঞ্জ করে বলতে চাই, ফল দেখে বৃক্ষ চেনা গেলেও শুধু গ্র্যাজুয়েটদের সাফল্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বিচার করা উচিত নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের সাফল্যের পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান কতখানি এবং তাদের ব্যক্তিগত মেধা ও প্রচেষ্টার অবদানের হিসাব বিবেচনায় নিতে হবে। এটি কারও অজানা নয় যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। যারা ওখানে ভর্তি হয় তারা শুধু মেধাবী নয়, হাজার জনের সঙ্গে 'যুদ্ধ করে জয়ী' হওয়ার মতো মানসিকতাও তাদের প্রমাণিত শক্তি। তাই এই দল যে তাদের কর্মক্ষেত্রে সফল হবে সেটি অনুমান করতে ক্রিস্ট্যাল বলের প্রয়োজন হয় না।

প্রকৃতভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বিচার করতে হলে, ইনপুটের মান (ভর্তিকৃত শিক্ষার্থী) ও আউটপুটের মান (গ্র্যাজুয়েট) দুটো বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্জিত জ্ঞান একজন শিক্ষার্থীকে তার শিক্ষাপূর্ব অবস্থান থেকে কতখানি (শতকরা হিসেবে) উন্নীত করতে পেরেছে সেটি তুলনা করতে হবে। এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়, তবে শুধু এটুকু বলতে চাই যে, সংখ্যার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান অথবা একজন শিক্ষার্থীর উপার্জন ক্ষমতার ওপর প্রভাব নির্ণয় সম্ভব। ফোর্বস, ফরচুন, ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস, বিজনেস উইকের মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের কনসেপ্ট ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং প্রকাশ করে থাকে।

আমাদের দেশে এমন কোনো গ্রহণযোগ্য র‌্যাংকিং নেই। তাই শুধু পারসেপশন থেকে, আবেগের ভিত্তিতে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ঢালাও দোষারোপের সুযোগ নেই।

দ্বিতীয়ত, দেশে চাহিদার তুলনায় মানসম্মত পর্যাপ্ত পাবলিক মেডিকেল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এ প্রসঙ্গে শুধু একটি তথ্য দেখে নিই। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব মতে, বাংলাদেশে প্রতি ১০০০ জনের জন্য ০.৪ জন চিকিৎসক রয়েছেন; অর্থাৎ প্রতি ২,৫০০ মানুষের জন্য মাত্র একজন চিকিৎসক। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তুলনা তো দূরের কথা, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা এমনকি মালদ্বীপের তুলনায় বাংলাদেশে জনপ্রতি চিকিৎসকের সংখ্যা অর্ধেক বা তার চেয়েও কম। দেশের বিদ্যমান সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো সমষ্টিগতভাবেও যে চাহিদার বিপরীতে যোগান দিতে সক্ষম নয়, সেটি অত্যন্ত পরিস্কার। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ না থাকলে দেশে চিকিৎসকের সংখ্যা যে আরও কম হত সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।

তৃতীয়ত, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় শিক্ষার্থীদের কাছে বেশি পছন্দনীয়। এসব প্রতিষ্ঠানে নেই সেশনজট, দলীয় রাজনীতি বা টেন্ডারবাজি। তাই শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হতে হয় না। আর নির্দিষ্ট সময়ে ডিগ্রি অর্জন করার কারণে গ্র্যাজুয়েটরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারে তাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের তুলনায় অনেক আগে– অর্থাৎ, এখানে 'সিস্টেম লস' কম।

কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শিক্ষার মান বজায় রাখতে না পারার অভিযোগ থাকলেও ভ্যাট আরোপ সমাধান হতে পারে না। বরং কোনো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান ঠিক না থাকলে এবং অনৈতিক চর্চা থাকলে, তাদেরকে আইনের আওতায় এনে, নীতিমালা করে, মান নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা কাম্য। সে পথে না গিয়ে ওগুলোর কাছ থেকে ভ্যাট গ্রহণ ওই ধরনের অনৈতিক চর্চার বৈধতা দেওয়ার শামিল।

মোদ্দা কথা, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও দেশের উচ্চশিক্ষায় অবদান রাখছে, তাদের গ্র্যাজুয়েটরা রাখছে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা। তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভাজন বা বৈষম্য সৃষ্টি না করে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এক চোখে দেখতে হবে।

টিউশন ফির ওপর আরোপিত ভ্যাট শিক্ষার্থীরা পরিশোধ করবে না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ করবে, এই ব্যাখ্যা অত্যন্ত গলদপূর্ণ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রেভিন্যিউ যেখানে মূলত শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি থেকেই আসে, সেখানে টিউশন ফির ওপর নির্ধারিত ভ্যাট সরকারের নিকট যে পরিশোধ করুক না কেন, সেটি শিক্ষার্থীদের ঘাড়েই বর্তাবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি আপাতত টিউশন ফি নাও বাড়ায়, ছয় মাস বা নয় মাস পর হলেও তারা টিউশন ফি বৃদ্ধি বা অন্যান্য ফিএর মাধ্যমে এই টাকা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করবে।

এ সব কারণেই ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিটি অত্যন্ত নায্য। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনে 'লীগ' বা 'দল'এর সম্পৃক্ততা নেই বলে একে হালকা করে নেওয়া ঠিক হবে না। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর বৈষম্যমূলক ভ্যাট প্রত্যাহার করে, তাদেরকে রাজপথ থেকে ক্লাসরুমে ফিরিয়ে নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভ্রান্তিবিলাস ত্যাগ করে যত শিগগির বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিবেন, ততই দেশ ও জাতির মঙ্গল।