খোরাসান: আইএসের নতুন রাষ্ট্র ও বাংলাদেশের দুশ্চিন্তা

বিজন সরকার
Published : 14 Sept 2015, 04:33 PM
Updated : 14 Sept 2015, 04:33 PM

ইউরোপের চলমান অভিবাসী সংকট আমাদের বিশ্বের সামনে মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস (ইসলামিক স্টেট)এর হিংস্র রূপটি আরেকভাবে উন্মোচন করেছে। কয়েকটি মুসলিমপ্রধান দেশে এই গোষ্ঠীর উত্থান সে সব দেশ থেকে লাখ লাখ নাগরিককে ভিনদেশে পাড়ি জমাতে মরিয়া করে তুলেছে। স্বদেশে থাকলেও অনিবার্য মৃত্যু বা অপমান জেনেেই তারা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সামান্য ডিঙি নৌকায় চড়ে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছেন। কেউ কেউ হাঁটছেন দীর্ঘ পথ, ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে। জঙ্গিবাদের এই হিংস্রতার শিকার হবার ঝুঁকিতে পড়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশও। এ প্রেক্ষিতে আইএস নিয়ে কিছু আলোচনা জরুরি মনে করছি।

ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া (আইএসআইএস) অথবা সংক্ষেপে ইসলামিক স্টেট (আইএস) কিন্তু আরও বেশ কিছু নামে পরিচিত। এটি বর্তমান বিশ্বের জঙ্গি সংগঠনগুলির মধ্যে সাংগঠনিক, প্রশাসনিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দিক দিয়ে সবচেয়ে শক্তিশালী ও ভয়ঙ্কর। সমকালীন বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের বড় উৎস আইএস। ধর্মীয় শাসন কায়েম করার নামে সংগঠনটি প্রতিনিয়ত গণহত্যা, লুটতরাজ এবং ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের মধ্যযুগীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে।

এর সদস্যরা বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশে ছড়িয়ে পড়লেও এদের গঠিত ইসলামিক স্টেট রাষ্ট্রটি ইরাক ও সিরিয়াসহ পার্শ্ববর্তী দেশের ভূখণ্ডে অবস্থিত। আয়তনে এ রাষ্ট্র ব্রিটেনের চেয়ে বড় আর যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া প্রদেশের প্রায় সমান। প্রায় চল্লিশ লাখ লোক এখন এখানকার বাসিন্দা।

২৬ জানুয়ারি, ২০১৫ আইএসের মুখপাত্র আবু মোহাম্মদ আল আদনানি আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের বেশিরভাগ এলাকাসহ প্রতিবেশি দেশগুলির (সম্ভবত ভারত ও চীনের) কিছু অংশ নিয়ে আইএসের নতুন রাষ্ট্র 'খোরাসান' ঘোষণা করেন। তবে আল আদনানি এ রাষ্ট্রের সীমানা নির্দিষ্ট করেননি। ইতোমধ্যে এদের কার্যক্রম পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে যে ডুরান্ড লাইন রয়েছে তার দুপাশে চলছে।

এ প্রেক্ষাপটে, আইএসের পক্ষে দক্ষিণ এশিয়ায় 'খোরাসান' নামক নতুন ইসলামিক খেলাফত গঠনের সক্ষমতা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। যাহোক, নতুন এই রাষ্ট্র ঘোষণার ফলে বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রনায়করা আবারও নড়েচড়ে বসেছেন। পাকিস্তান বিষয়টিতে খুব একটা উদ্বেগ প্রকাশ না করলেও আফগানিস্তান ও ভারত এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে।

নির্মোহ সত্য হল, 'খোরাসান' রাষ্ট্রের জন্মের বেশ কিছু সহজাত বাস্তবতা আমাদের এই অঞ্চলে রয়েছে। ইসলামিক জঙ্গি আদর্শটি আফ্রিকার মিশর থেকে উৎপন্ন হলেও দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষত পাকিস্তান ও আফগানিস্তান হল জঙ্গিদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের তীর্থভূমি। আফগানিস্তানে দীর্ঘদিন তালেবানেরা রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। পাকিস্তানের শাসনক্ষমতায় জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি 'নন-স্টেট' সামরিক শক্তি হিসেবে দশকের পর দশক ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

আল-কায়েদা ও তালেবানের মতো জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি প্রায় চার দশক ধরে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণের চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। অথচ আইএসের বয়স মাত্র কয়েক বছর হলেও তারা ইতোমধ্যে সফল। তাই পাকিস্তান ও আফগানিস্তান-কেন্দ্রিক আল-কায়েদা ও তালেবানসহ অন্যান্য ধর্মীয় জঙ্গি সংগঠনগুলির নেতা-কর্মীরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

যদিও তেহরিক তালেবান অব পাকিস্তান (টিটিপি) পেশাওয়ারের সেনা স্কুলে হামলা চালিয়ে তাদের সক্ষমতা জানাতে চেষ্টা করেছে, তবু একটি রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য যে পরিমাণ সামরিক-বেসামরিক শক্তি ও দক্ষতা দরকার, এ অঞ্চলের জঙ্গি সংগঠনগুলির মধ্যে তা লক্ষ্য করা যায়নি।

পাকিস্তান ও আফগানিস্তান-কেন্দ্রিক তালেবানদের উপরের স্তরের বহু নেতা ২০১৩ সাল থেকেই তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের নেতৃত্ব বাদ দিয়ে আইএস প্রধান আবু বাগদাদির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। টিটিপির মুখপাত্র শেখ মকবুল ২০১৩ সালে আইএসের পাঁচ দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ঘোষণা করেন। আইএসের নীতিনির্ধারকরা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের জঙ্গি নেতাদের আনুগত্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিচার-বিশ্লেষণ করার জন্য এক বছরের উপর সময় নেন। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ছোট বড় বহু জঙ্গি সংগঠনও আইএসের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করে আবেদন করে।

২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে আইএস টিটিপির আবেদন মঞ্জুর করে। পাকিস্তানি তালেবান নেতা হাফিজ সাইদ খানকে নতুন রাষ্ট্র 'খোরাসান'এর প্রধান এবং মোল্লা আবদুর রুউফ খাদিমকে হাফিজ খানের ডেপুটি ঘোষণা করা হয়। হাফিজ সাইদ খান পাহাড়ি উপজাতি, সুন্নি সম্প্রদায়ের নেতা। খোরাসানের নেতৃত্বে উপরের স্তরের বারটি পদে তেহরিক তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) নেতাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

আইএস মূলত টিটিপিকে সামনে নিয়ে এগুতে চাচ্ছে। পেশোয়ারে টিটিপির দ্বারা শিশু গণহত্যার বিষয়টি আইএস টিটিপির যোগ্যতা হিসেবেই নিয়েছে বলে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের ধারণা। আল-কায়েদা আইএসের প্রতি নাখোশ হলেও পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ছোট বড় সকল জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে 'খোরাসান' রাষ্ট্র ঘোষণার ফলে ওখানে জঙ্গিদের মধ্যে আনন্দের ভাব দেখা যায়। তারাও বিভিন্ন পদ-পদবির জন্য আইএসের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

আগেই বলেছি, আইএসের সম্ভাব্য নতুন রাষ্ট্রের সীমানা কী হবে তা এখনও নির্দিষ্ট করা হয়নি। তবে ডুরান্ড লাইনের উভয় পাশের প্রদেশগুলিকে নিয়ে আইএস কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে অনেক নিরাপত্তা বিষয়ক সূত্র নিশ্চিত করে। ডুরান্ড লাইনের উভয় পাশেই সুন্নি উপজাতিগুলি বাস করে। উল্লেখ্য, ডুরান্ড লাইন বরাবর পাহাড়ি এলাকাগুলি জঙ্গি গোষ্ঠীর কাছে স্বর্গরাজ্য হিসেবে খ্যাত।

পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সকল জঙ্গি গোষ্ঠীকে একটি পক্ষে নিয়ে আসার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে আইএস। বিশেষ করে, ডুরান্ড লাইন বরাবর দেশ দুটির সুন্নি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির মধ্যকার বিভেদ দূর করে তাদের অভ্যন্তরীন সম্পর্ক আরও সংহত করার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে তারা।

আইএসের এমন কৌশলী সিদ্ধান্ত বিদ্যমান বাস্তবতার নিরিখেই নেওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। ডুরান্ড লাইনের উভয় পাশের উপজাতিরা যদি এক হয়ে খোরাসান জন্মের পক্ষে অবস্থান নেয়, তাহলে খোরাসানের জন্ম টিকিয়ে রাখার মতো সামাজিক ও সামরিক শক্তি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের নেই। আইএস সে উদ্দেশ্যেই কাজ করছে।

বিভিন্ন সুন্নি উপজাতি গোষ্ঠী এবং তরুণ সমাজকে আইএসের কর্মকাণ্ডে জড়িত করার জন্য আইএস বিভিন্ন ধরনের কৌশল গ্রহণ করছে। আইএসের মুখপাত্র আল-আদনানি খোরাসানের কমান্ডারদেরকে একেশ্বরবাদী আখ্যায়িত করে আহ্বান জানিয়েছেন, যেন তারা বহুদেববাদী, অবিশ্বাসী এবং ধর্মদ্রোহীদেরকে ধ্বংস করে। এটি বেশ পরিষ্কারভাবেই বুঝা যায়, শিয়া ছাড়াও সুফিবাদী সুন্নি গোত্রগুলিও আইএসের হুমকির মধ্যে রয়েছে। উল্লেখ্য, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা আইএসের তালিকার প্রথম দিকেই আছে।

আফগানিস্তানের হেলমন্দ প্রদেশে আইএসের কার্যকলাপ অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। মোল্লা আবদুল রঊফের নেতৃত্বে আইএসের সদস্য সংগ্রহ, 'খোরাসান' রাষ্ট্র নির্মাণের পক্ষে বিভিন্ন প্রচারণা পরিচালিত হত। আফগান-ভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধন ও তাদেরকে আইএসে যোগদানে নেতৃত্বে ছিলেন মোল্লা আবদুল রঊফ। গত ৯ ফেব্রুয়ারি ন্যাটোর ড্রোন হামলায় নিহত হন আবদুল রুউফ। এরপর গত ৬ আগস্ট খোরাসানের আফগান অংশের আইএসের আমির গুল জামান মার্কিন বিমান হামলায় নিহত হন।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিতে জঙ্গিদের ভূমিকা সব সময় গুরুত্বপূর্ণ। জঙ্গিদের উপর নির্ভর করে পাকিস্তান চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত-বিরোধী পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করে থাকে। জামাত-উদ-দাওয়া (আমেরিকা ও জাতিসংঘ দ্বারা নিষিদ্ধ) এবং জয়-শে-মুহাম্মদের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলিকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে।

পাঞ্জাব প্রদেশের গভর্নর সালমান তাসিরের হত্যাকারী মমতাজ কাদ্রিকে পাকিস্তানের জাতীয় বীর হিসেবে মূল্যায়ন করে সমাজের একটি বড় অংশ। লাল মসজিদের ইমাম মাওলানা আবদুল আজিজ পেশোয়ারের শিশু গণহত্যার প্রতিক্রিয়ায় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ 'অনৈসলামিক' বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। তেহরিক-ইনসাফের নেতা ইমরান খান জঙ্গিবিরোধী অভিযান থেকে সরকারকে বিরত রাখার জন্য জামায়াতে ইসলামীর পরামর্শে সরকারবিরোধী লংমার্চের নাটক মঞ্চায়ন করেছিলেন।

এসবের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সমাজ ব্যবস্থার দুর্বল চিত্রটি দৃশ্যমান হয়। খোরাসানের জন্মের বাস্তবতা বুঝতে হলে আমাদেরকে আইএসের রাষ্ট্রের বিভিন্ন অনুষঙ্গের উপর নজর দিতে হবে।

আইএস ১৯৯৯ সালে 'জামাত আল-ওয়াহিদ ওয়াল-জিহাদ' নামে আত্মপ্রকাশ করে। ২০০৪ সালে সংগঠনটি আল-কায়েদার ইরাক অংশের দায়িত্ব পালন করে। তখন আইএস 'আল-কায়েদা ইন ইরাক' (একিউআই) নামে কর্মকাণ্ড শুরু করে। ২০০৩ সালে আমেরিকার ইরাক আক্রমণের সময় থেকেই এই সংগঠন জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে শুরু করে। ২০০৬ সালে আইএস অন্যান্য সুন্নি জঙ্গি সংগঠনদের সঙ্গে এক হয়ে 'মুজাহিদিন সুরা কাউন্সিল' গঠন করে। ইরাকের কিরকিট, আল আনবারসহ বহু এলাকা দখল করে সংগঠনটি ইসলামিক স্টেট অব ইরাক (আইএসআই) ঘোষণা করে।

সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই আইএসআই সিরিয়ার সংখ্যাগুরু সুন্নি সম্প্রদায়ের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। উল্লেখ্য, সিরিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতায় রয়েছে সংখ্যালঘু শিয়া সম্প্রদায়। আবু বক্কর আল-বাগদাদির নেতৃত্বে আইএস সিরিয়ার সুন্নিপ্রধান এলাকাগুলি দখল করে নেয়। ২০১৩ সালের এপ্রিলে ইসলামিক স্টেট অব ইরাককে (আইএসআই) ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া (আইএসআইএস) ঘোষণা করা হয়।

প্রসঙ্গত, আইএসের 'একলা চল' নীতির কারণে ২০১৪ সালের ফ্রেরুয়ারিতে আল-কায়েদা আইএসের সঙ্গে তাদের নিবিড় সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলে।

আইএস বিতর্কিত ইসলামিক খেলাফতের শাসনব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে কঠোর চেইন অব কমান্ড রক্ষা করে। যদিও আইএস পশ্চিমা গণতন্ত্র অনৈসলামিক হিসেবে জ্ঞান করে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের শাসনব্যবস্থার কাঠামোটি শত ভগ গণতান্ত্রিক। অনেকটা পশ্চিমা দেশগুলির শাসনব্যবস্থার মতো। এমনকি আইএস রাষ্ট্রের প্রধান বাগদাদিকেও সুরা কাউন্সিলের (ওয়ার কাউন্সিল নামেও পরিচিত) কাছে জবাবদিহির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বাগদাদিসহ যদি কেউ ইসলামিক আইন ভঙ্গ করে, তাহলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। এমনকি নির্বাহী প্রধান বাগদাদিকে গুলি করে হত্যার নির্দেশও দিতে পারে সুরা কাউন্সিল।

সুরা কাউন্সিলের সদস্যরা বাগদাদি কর্তৃক সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তাদের মূল দায়িত্ব হল, রাষ্ট্রের ভিতর কোথাও যদি ইসলামিক আইনের ব্যত্যয় ঘটলে, তা নির্বাহী প্রধান বাগদাদির কাছে রিপোর্ট করা। সুরা কাউন্সিলের রয়েছে তিনটি বিভাগ। দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন বন্দিদেরকে হত্যা করার সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয় সুরা কাউন্সিল থেকে। এটি মূলত বিচার বিভাগের মতো দায়িত্ব পালন করে। সুরা কাউন্সিল নির্ধারণ করে শাস্তির পরিমাণ কী হবে এবং তা কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে।

সুরা কাউন্সিল ছাড়াও বাগদাদির রয়েছে ৭ সদস্যের শক্তিশালী উপদেষ্টা কেবিনেট। উপদেষ্টারা সরাসরি বাগদাদি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হন এবং তাদেরকে তার কাছে জবাবদিহি করতে হয়। রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাগদাদি উপদেষ্টা কেবিনেটের সভা থেকেই গ্রহণ করে থাকেন।

আইএস ইসলামিক খেলাফতের প্রধান বাগদাদির রয়েছেন দুজন ডেপুটি। একজন ইরাকের জন্য এবং অন্যজন সিরিয়ার জন্য। ইরাকে ফাদেল আহমেদ আবদুল আল-হিয়ালি এবং সিরিয়াতে আবু আলী আল আনবারি ডেপুটির দায়িত্বে রয়েছেন। দুই ডেপুটির তত্বাবধানে রয়েছেন ১২ জন করে গভর্নর। প্রত্যেক গভর্নরের তত্ত্বাবধানে ৭টি ভিন্ন ভিন্ন কাউন্সিল রয়েছে।

নিয়োগপ্রাপ্ত গভর্নররা ডেপুটিদের বিভিন্ন নির্বাহী আদেশ বাস্তবায়ন করার জন্য ৭টি কাউন্সিলকে নির্দেশ দেয়। পাশাপাশি কাউন্সিলররা নিজ নিজ ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনগণের প্রতিটি ঘটনা পর্যবেক্ষণ করার দায়িত্বে নিয়োজিত। উল্লেখ্য, সুরা কাউন্সিল গভর্নরদের তত্বাবধানে থাকা ৭টি কাউন্সিল রাষ্ট্রের ইসলামিক আইন মোতাবেক পরিচালিত হচ্ছে কিনা, তা মনিটর করে এবং সরাসরি বাগদাদির কাছে রিপোর্ট করে।

আইএস অন্যান্য জঙ্গি সংগঠন থেকে একেবারেই আলাদা। বিশেষ করে আল-কায়েদা, তালেবানের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলির কর্মকাণ্ড ব্যক্তি-পর্যায়ের অর্থনৈতিক সহযোগিতা-নির্ভর। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের মাদক ও চোরাচালান কারবার থেকে মুনাফা দিয়ে তাদের জঙ্গি কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। এ ক্ষেত্রে আইএস একেবারেই বিপরীত অবস্থানে রয়েছে।

সংগঠনটির রয়েছে বিশাল অর্থনৈতিক শক্তি। ইরাকের মসুল দখল করার পর আইএস শহরের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৪২০ মিলিয়ন ইউএস ডলারের সমপরিমাণ ইরাকি দিনার লুট করে। সংগঠনটির প্রতিরক্ষা বাজেট বছরে ২ বিলিয়ন ইউএস ডলার। এই বিশাল অর্থ কোথা থেকে আসছে, তাও ধারণা করা যায়।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত ও আরব আমিরাত সিরিয়ার আল আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য দীর্ঘদিন আইএসকে অর্থায়ন করে আসছিল। কিন্তু বর্তমানে আইএস এই দেশগুলির নিরাপত্তার জন্যই হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাই বর্তমানে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে অর্থায়ন বন্ধ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ৪ উপসাগরীয় দেশের সরকারের কাছ থেকে এখন আইএসের কাছে অর্থ না গেলেও দেশগুলির সুন্নি ধনী ব্যক্তিরা বড় আকারের অনুদান পাঠাচ্ছে। বিশেষ করে সৌদির ওয়াহাবি মতবাদের অনুসারীরা আইএসের জন্য একটি বড় অর্থনৈতিক প্রাণশক্তি। এরা চায়, সিরিয়ায় শাসনক্ষমতা সুন্নিদের হাতে যাক। সিরিয়ায় শাসনক্ষমতা রয়েছে অভিজাত সংখ্যালঘু শিয়া সম্প্রদায়ের হাতে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে দুটি খাত থেকে আইএসের নিয়মিত আয় হয়, তা হল প্রাকৃতিক সম্পদ তেল এবং রাষ্ট্রে বসবাসকারী ব্যবসায়ী শ্রেণির কাছ থেকে প্রাপ্ত মাসিক চাঁদা। আইএস ইরাকের মসুল থেকে তেল উত্তোলন করে ট্রাকে নিয়ে বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র তুরস্কের সীমান্তে নিয়মিত রপ্তানি করছে। মার্কিন ট্রেজারের রিপোর্ট অনুযায়ী, এভাবে আইএস প্রতিদিন ১ মিলিয়ন ডলার আয় করছে।

যাহোক, একটি রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য যে সকল অনুষঙ্গ দরকার, তার প্রায় সবই আইএসের রয়েছে। দুবছর হতে চলল তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। আল-কায়েদা ও তালেবানের সঙ্গে তাদের মৌলিক পার্থক্য এখানেই। তাই তালেবানসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলি আইএসের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে তার আদলে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের ভিতরে আরেকটি ফ্রেঞ্চাইজ নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে এগুচ্ছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের কর্মকাণ্ডের ফলে বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার মানচিত্র পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো নয়। তবে আশংকার বিষয়, বাংলাদেশেও সময়ের সমান্তরালে জঙ্গি-বান্ধব সামাজিক-রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ক্রমশই দৃশ্যমান হচ্ছে।

দেশে বর্তমানে প্রায় শতাধিক জঙ্গি সংগঠন রয়েছে এবং এদের মধ্যে ৪-৫টির রয়েছে আত্মঘাতী হামলা চালানোর মতো সক্ষমতা। বিভিন্ন উৎস থেকে জঙ্গি কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য অর্থায়ন করা হচ্ছে। ব্যাংক, বীমা, স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন বিনিয়োগের লভ্যাংশ জঙ্গি কর্মকাণ্ডের অক্সিজেন হিসেবে কাজ করছে। দেশের ভিতরেই জঙ্গিদের জন্য একটি বড় অর্থনীতি দাঁড়িয়ে গেছে। এটি প্রায় হাজার দুই কোটি টাকার কম হবে না বলে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

মাঠ পর্যায়েও তাদের কার্যকলাপ পরিচালনা করার মতো বড় ধরনের সাংগঠনিক কাঠামো ও সক্ষমতা রয়েছে। এর প্রমাণ তারা ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ভালোভাবেই রেখেছে। তখন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনসহ মোট ৭০টি জঙ্গি সংগঠন ছিল। পাকিস্তানি সমাজে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি যেমন দেশটির প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক অনুষঙ্গের অবিচ্ছেদ্য অংশ, ঠিক তেমনি তৎকালীন জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের সময় জঙ্গিরা প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক অনুষঙ্গের অংশ হয়ে উঠেছিল।

২০০৬ সালের পরের সরকারগুলির জিরো টলারেন্সের কারণে জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে নির্মূল হয়নি। এখনও পুলিশ প্রশাসন এবং বিচার বিভাগের জানা অজানা দুর্বলতার সুযোগে জঙ্গিরা জেল থেকে বের হয়ে যায়। কিছু হাইপ্রোফাইল জঙ্গি ছাড়া জঙ্গিদের শাস্তি হয়েছে, এমনটি শোনা যায়নি।

রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ভিতরেই রয়েছে বড় ধরনের ত্রুটি। আর এই ত্রুটিগুলি জঙ্গিবাদ রক্ষার একটি কাঠামো হিসেবে কৌশলে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই কাঠামো সচল থাকার পিছনে কেবল রাষ্ট্রের বিভিন্ন অনুষঙ্গ দায়ী নয়, মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলির সুবিধাবাদী রাজনীতি ও সমাজের মৌলিক মূল্যবোধের পরিবর্তনও দায়ী।

জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তাদের আদর্শটি বিভিন্নভাবে সমাজের উপরের স্তর থেকে নিচের স্তর অবধি বিস্তার লাভ করছে। কয়েক বছর আগে জঙ্গিবাদ আদর্শটির জন্য কেবল মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা দায়ী বলে মনে করা হত। আর এখন দেশের মূলধারার শিক্ষার ভিতরেই জঙ্গিবাদের বীজ কচুরিপানার মতো বেড়ে চলছে। সমাজে ধর্মীয় উগ্রবাদ দেশের সকল আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নীরব ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের মনোজগতের এই পরিবর্তন রাষ্ট্র তার প্রশাসনিক ক্ষমতা নিয়ে রুখতে পারবে না। নির্মূল করা তো দূরের বিষয়।

এজন্য দরকার সাংস্কৃতিক বিপ্লব। তবে সেটির সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ, দেশের মৌলিক চেতনা ও আদর্শের জায়গায় সাধারণ জনগণ দুটি বড় শিবিরে বিভক্ত। শিবির দুটির আদর্শিক চিন্তা-চেতনার মধ্যে এতই ফারাক যে, বাংলাদেশের আদর্শগত গন্তব্যই আজ অবধি নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি।

দেশের মূলধারার রাজনৈতিক বিভাজন যত গভীরে যাবে, উগ্র গোষ্ঠীগুলি সমাজের কেন্দ্রে আসার সুযোগ তত বেশি পাবে। তাই এটি সহজেই অনুমেয় যে, দক্ষিণ এশিয়ায় আইএসের উপস্থিতি আমাদের ভিতরকার জঙ্গিবাদী রাজনীতি ও উগ্রবাদ উজ্জীবিত করবে।

এ অঞ্চলে আইএসের উপস্থিতি বাংলাদেশের মূলধারার ক্রিয়াহীন রাজনীতি ও রাজনৈতিক ইসলাম আরও ত্বরান্বিত করবে। দেশের জঙ্গি সংগঠনগুলির জন্য পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ও আরব বিশ্বের অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির অর্থনৈতিক, সামরিক এবং আদর্শিক প্রণোদনা বেড়ে যাবে। সিরিয়ার আসাদকে উৎখাতের জন্য যেভাবে আইএসকে মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্র ও ব্যক্তি-পর্যায় থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা করা হচ্ছে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলিকে ২০০১-২০০৬ সালের ন্যায় আবারও সাহায্য করা হবে। পাশাপাশি ভারত-বিরোধী আন্তর্জাতিক শক্তি বাংলাদেশের ভিতরকার জঙ্গিবাদকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করবে।

আইএসের সম্ভাব্য রাষ্ট্র ঘোষণার ফলে আমাদের দেশের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি নতুন করে যে হিসাব-নিকাশ শুরু করছে, সেটি হলফ করেই বলা যায়। তারা নিজেরা আরও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করবে। সন্দেহ নেই যে, দেশীয় জঙ্গিরা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের জঙ্গিদের মতো আইএসের সহযোগিতার জন্য তাদের কাছে ধর্না দিবে। মূলধারার রাজনীতির বিভিন্ন ধরনের গণতান্ত্রিক দুর্বলতাগুলি ব্যবহারের পাশাপাশি ধর্মীয় উগ্রতা পুঁজি করে সাধারণ জনগোষ্ঠীকে নিজেদের দলে নেওয়ার প্রচেষ্টা জঙ্গিরা আরও বেগবান করবে।

পাকিস্তানের জঙ্গি-বান্ধব সেনা গোয়েন্দা আইএসআইয়ের নানাবিধ প্রণোদনায় বাংলাদেশের ভিতরকার ধর্মীয় উগ্রবাদী আদর্শটিও আমাদের সমাজের গভীরে প্রবেশ করছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকাস্থ পাকিস্তানি হাইকমিশন কার্যালয়ের কূটনীতিক মুহাম্মদ মাজাহার খানকে জঙ্গি-অর্থায়ন ও জাল টাকা তৈরির অভিযোগে সরিয়ে নেওয়া হয়। পিআইএর ঢাকাস্থ কান্ট্রি ব্যবস্থাপক আলী আব্বাসের বিরুদ্ধেও জাল টাকা তৈরির অভিযোগ আনা হয়েছিল। দেশের ভিতরেই অনেক প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাবে যেখানে বসে আইএসআইয়ের এজেন্টরা বাংলাদেশে জঙ্গি-উত্থানের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।

জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটিয়ে যদি দেশটিকে পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থা কিংবা জামায়াত-বিএনপি জোটের ২০০১-২০০৬ সালের শাসনামলের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় এতে পাকিস্তানের দুটি উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হয়। এক, একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়া হবে; দুই, ভারতকে দেশটির পশ্চিম ফ্রন্টের পাকিস্তান-ভারত সীমান্তের ন্যায় পূর্ব ফ্রন্টে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ব্যস্ত রাখা যাবে। এটি কেবল পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইচ্ছা নয়, মার্কিনীদের দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক কৌশলেরও অংশ।

বাংলাদেশের ভিতরকার জঙ্গি গোষ্ঠী এবং জঙ্গি-বান্ধব গোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সক্ষমতার ভযঙ্কর চিত্রটি যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদীর রায় এবং ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে। জঙ্গিদের অবস্থানও বেশ কৌশলী হয়। একটু গভীরভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, ঢাকার প্রবেশ পথগুলিতে জঙ্গিরা বেশ শক্তিশালী। যেমন যাত্রাবাড়ী, গাজীপুর। অতিসম্প্রতি ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামেই বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর অপতৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটি দেশের জন্য সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ।

দক্ষিণ এশিয়ায় আইএসের উত্থান ঘটলে বাংলাদেশের অবস্থা পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো হবে না। তবে হলফ করেই বলা যায়, দেশের সর্বস্তরের নিরাপত্তা ভয়ানক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, সংগঠিত শক্তি যত ছোটই হোক, অসংগঠিত বিশাল আকারের জনগোষ্ঠী তার কাছে পরাজিত হয়।

ঠিক উল্টো ঘটনার চিত্র ইতিহাসের কোথাও নেই।