আমাদের অজ্ঞানতা নিয়েই থাকতে দিন

খাদেমুল হক
Published : 10 Sept 2015, 03:16 AM
Updated : 10 Sept 2015, 03:16 AM

সংবাদপত্রের প্রায় দ্বিগুণ বেতনের চাকরি ছেড়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হিসেবে যোগ দিলাম, তখন একটাই স্বস্তি ছিল– এখানে অন্তত সম্মানটা থাকবে, বেতন কম পাই, মর্যাদাটুকু পাব। দেড় দশক পর বুঝতে পারছি, সেটা ভুল ছিল। মাননীয় অর্থমন্ত্রীর কথা মিথ্যে নয়; আমাদের, মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সত্যিই জ্ঞানের বড় অভাব। অন্তত আমার নিজের তো বটেই! দেড় দশক পর কী ঘটতে পারে, সে পূর্বাভাষই যদি চিহ্নিত করতে না পারি তাহলে আর কীসের জ্ঞান আমার?

তবে ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ টেলিভিশনের পর্দায় মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের রাগান্বিত চেহারাটি দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল, ব্রিটিশ আমলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়া আমার 'মূর্খ' মায়ের মুখে শোনা একটি প্রবচন।

বাংলা ভাষায় বহুল প্রচলিত একটি প্রবচন একটু সম্প্রসারিত করে, একটু ব্যঙ্গ মিশিয়ে আমার মা বলতেন, 'রতনে রতন চেনে, শুয়োরে চেনে কচু'। মাননীয় মন্ত্রীর ওই বক্তব্যের আমরা তো আর 'রতন' পদবাচ্য দাবি করতে পারি না, তাই কচুপোড়ার দলেই ফেলতে হচ্ছে নিজেদের। প্রশ্ন হচ্ছে, মন্ত্রী মহোদয় সেটা জানতে পারলেন কী করে?

উত্তরটা ওই প্রবচনের মধ্যেই আছে। মাননীয় মন্ত্রী যদি বুঝতে না পারেন, সে জন্য আরেকটু ভালো করে খুলে বলি, আমাদের মতোই জ্ঞানের অভাব তাঁরও আছে! না, আমার কথা নয় এটা তাঁর নিজের কথা। সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি।

তার আগে, গতকাল মন্ত্রী মহোদয় যা বললেন, সেটা একটু মনে করার চেষ্টা করি। আমি যদি ভুল না করি, তিনি যা বলেছেন তার সার-সংক্ষেপ হল:

১. বেতন কাঠামো বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের 'জ্ঞানের অভাব' রয়েছে, সে কারণেই তাঁরা আন্দোলন করছেন। তাদের মর্যাদা হ্রাসের কোনো ব্যাপার এখানে নেই।

২. আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম-কানুন নেই, তাই এখানে প্রভাষকের চেয়ে প্রফেসরের সংখ্যা বেশি। এটা 'কোরাপ্ট প্র্যাকটিস' মানে দুর্নীতি।

৩. এই দুর্নীতি বন্ধে, প্রশাসন যেভাবে ম্যানেজ করা হয়, সেভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ও ম্যানেজ করতে হবে।

এখন, বেতন কমিশনের ভেতরের খবর তো আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জানার কথা নয়, কারণ এটা তাদের ক্ষেত্র নয়। এখানে সাদা চোখে যেটা দেখা যায়, আমরা মূর্খ লোকেরা সেটাই দেখতে পাই। আর সেভাবে আমরা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি, সর্বশেষ সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী আমরা যে মর্যাদা পাচ্ছিলাম, অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশে সেটা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সপ্তম বেতন কমিশনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেকশন গ্রেড পাওয়া প্রফেসররা এক নম্বর গ্রেডে বেতন পেতেন, সরকারের সচিবরাও তা-ই। কিন্তু অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশে পদায়িত সচিব আর সিনিয়র সচিবদের জন্য এক নম্বর গ্রেডের ওপরে আরও বেনামি দুটি গ্রেড সৃষ্টি করা হয়েছে, সে সঙ্গে বাতিল করা হয়েছে সিলেকশন গ্রেড। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররা কার্যত আর এক নম্বর গ্রেডেই উঠতে পারবেন না। ওপরের দুটি গ্রেডে তো নয়ই। আমরা সাদা চোখে এটা দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু মন্ত্রী মহোদয় মর্যাদা হ্রাসের কোনো ব্যাপার দেখতেই পাচ্ছেন না।

কেন পাচ্ছেন না, তার আসল কারণ জানতে একটু পেছন ফিরে দেখা যেতে পারে। গত ১৮ আগস্ট বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস সমন্বয় কমিটির সঙ্গে এক বৈঠকে অর্থমন্ত্রীকে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বিষয়ক জটিলতার বিষয়টি বুঝিয়ে বলার পর তিনি নিজেই স্বীকার করেছিলেন, 'আমি এটা ভেবে দেখিনি, আপনাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে এতে যুক্তি আছে।' পরদিনের পত্রপত্রিকায় এটা ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিল।

সমন্বয় কমিটি যে বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার মধ্যে ছিল, সিলেকশন গ্রেড বাতিল করলে ২০টি গ্রেড রাখা বিষয়ক জটিলতা। বিদ্যমান ২০টি গ্রেডের মধ্যে ৪, ৭ ও ৮ নম্বর গ্রেড তিনটি মূলত সিলেকশন গ্রেড পাওয়া কর্মকর্তাদের জন্য, সিলেকশন গ্রেড না থাকলে ওই গ্রেডগুলো কীভাবে বহাল রাখা হবে?

মাননীয় মন্ত্রী শেষ পর্যন্ত ভেবে কী পেয়েছেন আমরা এখনও জানি না। তবে তাঁর ওই বক্তব্য থেকে এটুকু ঠিক জানি যে, প্রস্তাবিত বেতন স্কেলের সুপারিশ সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত জানেন না, মানে এ ব্যাপারে তাঁর 'জ্ঞানের অভাব' রয়েছে।

কাল মন্ত্রী মহোদয় দ্বিতীয় যে অভিযোগ করেছেন, সেটিও আসলে তাঁর 'জ্ঞানের অভাব'ই প্রকাশ করে দিচ্ছে। মাননীয় মন্ত্রী জানেনই না যে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পদ না থাকা সত্ত্বেও কীভাবে শিক্ষকরা প্রফেসর হিসেবে পদোন্নতি পাচ্ছেন। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সুষ্পষ্ট নীতিমালা রয়েছে। শূন্য পদে প্রফেসর হওয়ার জন্য কী যোগ্যতা লাগে আর পদ-পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে ওই পদে উঠতে কী কী শর্ত পুরণ করতে হয়, তা তিনি চাইলেই জানতে পারেন। তখন তিনি ঠিকই বুঝতে পারবেন, প্রক্রিয়াটি কত জটিল।

এটাও জানতে পারবেন, সুনির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ সাপেক্ষে, আইন মেনেই শিক্ষকদের পদোন্নতি হয়; এটা কোরাপ্ট প্র্যাকটিস নয়। কারণ, পদোন্নতি পেতে হলে অভিজ্ঞতার বাইরেও নির্দিষ্ট সংখ্যক গবেষণা প্রবন্ধ নির্ধারিত মানের জার্নালে প্রকাশ করতে হয়। কিন্তু এই গবেষণা প্রবন্ধ লিখতে যে গবেষণা করতে হয়, তার জন্য কোনো আর্থিক বরাদ্দ শিক্ষকরা পান না।

তিনি সম্ভবত প্রশাসনের অভিজ্ঞতা থেকেই বিষয়টি মূল্যায়ন করেছেন। কারণ, প্রশাসনে অন্ততপক্ষে পদোন্নতির ক্ষেত্রে এ রকম সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই। তাই জনপ্রশাসনে যখনই কোনো পদোন্নতির ঘোষণা আসে, আমরা দেখতে পাই পদোন্নতি-বঞ্চিতরা আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করে দেন। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম না মেনে রাজনৈতিক বিবেচনায় এই পদোন্নতির তালিকা তৈরি করা হয়।

সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড নামে একটি কমিটি এ জন্য কাজ করে, কিন্তু তারা ঠিক কী কী শর্ত বিবেচনায় নেবে, তার সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই। ফলে পরের ব্যাচের কর্মকর্তারা আগের ব্যাচের কর্মকর্তাদের ডিঙিয়ে পদোন্নতি পাচ্ছেন এমন অভিযোগ প্রতিনিয়তই শোনা যায়। আজ পর্যন্ত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম ব্যাখ্যাতীত পদোন্নতির ঘটনা কি ঘটেছে? উত্তরটা এক কথায়, না!

'কোরাপ্ট প্র্যাকটিস' বলতে গিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্ধারিত অর্গানোগ্রামের বাইরে পদোন্নতির বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন। এটা সত্যি, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিচের দিকের পদগুলোর চেয়ে ওপরের দিকের পদে শিক্ষকসংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। প্রশাসনে কি সেটা হচ্ছে না? ৬ মে প্রশাসনে সর্বশেষ পদোন্নতির পরের অবস্থাটা তার পরের দিনের পত্রপত্রিকাগুলো খুললেই জানা যায়। এই পদোন্নতির পর উপ-সচিবের ৮৩০টি পদের বিপরীতে ১৬২৩ জন, যুগ্ম সচিবের ৪৩০টি পদের বিপরীতে ১১৬৬ জন, অতিরিক্ত সচিবের ১০৭টি পদের বিপরীতে ৪৫৭ জন কর্মরত ছিলেন।

এদের অনেকেই সচিবালয়ে বসার জায়গা পর্যন্ত পান না। পদোন্নতি পেলেও এখনও নিচের স্তরের পদের নির্ধারিত দায়িত্বগুলোই পালন করেন। গত চার মাসে অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে বলে অন্তত আমরা জানি না।

মাননীয় মন্ত্রী আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও ওই স্টাইলে 'ম্যানেজ' করতে চান। শুনে আমি রীতিমতো আতঙ্কিত, তাহলে কি এখন বিশ্ববিদ্যালয়েও রহস্যময় কোনো গোপন নিয়মের ভিত্তিতে পদোন্নতি হবে? আমার জুনিয়র, কিংবা আমার ছাত্ররা রাজনৈতিক আনুগত্যের জোরে আমাকে ডিঙিয়ে যাবে? পদোন্নতির জন্য আমাকে বসে থাকতে হবে অনুকূল রাজনৈতিক সরকারের ক্ষমতায় আসার জন্য?

আমি সবিনয়ে বলতে চাই, এই 'সৎ' ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, এই জ্ঞানের আমাদের দরকার নেই। দয়া করে আমাদের 'অজ্ঞানতা' নিয়েই আমাদের নিজেদের মতো থাকতে দিন।

খাদেমুল হক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।