রুমানার উপর দ্বিমুখী নির্যাতন

মাকসুদা সুলতানা
Published : 25 June 2011, 05:35 PM
Updated : 25 June 2011, 05:35 PM

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানার উপর যে নির্যাতন ও হত্যা চেষ্টার ঘটনা গত ৫ জুন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তা দেখে সাধারণ মানুষ বিস্মিত হয়েছে। আমাদের দেশে পারিবারিক নির্যাতন ও নারীর প্রতি সহিংসতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। স্বামীরা দুটো অস্ত্র বেশ ব্যবহার করেন প্রভুত্ব রক্ষায়, এক হচ্ছে সামাজিক অস্ত্র, অন্যটি হচ্ছে তাদের শারীরিক শক্তির অস্ত্র। প্রভু হিসেবে মেনে নিয়ে অনেক নারীই নীরবে পারিবারিক নির্যাতনের বলি হওয়া স্বাভাবিক একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এ সমাজে। তাই নিপীড়ক সাইদ নিজেকে "সাইকিক কেস" হিসেবে উপস্থাপন করার সুযোগ পায়। নির্যাতিতাকে উল্টো দোষী করে কিছু গল্প উপস্থাপন করে সমাজের সহানুভূতি কুড়াতে চেষ্টা করে। খটকা লেগেছে মিডিয়ার আচরণে। রুমানার স্বামী তাঁর নিজের চামড়া বাঁচানোর জন্য রুমানার চরিত্র হনন করলো এবং প্রায় সবগুলো মিডিয়া ফলাও করে রুমানার স্বামীর সাজানো কুৎসা প্রচার করলো। হায় আমাদের পুরুষতান্ত্রিকতা ! শিক্ষক রুমানার প্রতি নির্যাতন, নির্মম এই সহিংসতার চেয়ে তাঁর স্বামীর প্রচারিত গল্প হয়ে ওঠে চারিদিকে আলোচনার বিষয়।

সেদিন পত্রিকার পাতা খুলে যখন চোখে পড়লো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ডিপার্টমেন্টের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের একজন শিক্ষিকা স্বামী কর্তৃক নির্মমভাবে নির্যাতিত হয়েছেন, তখন যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। পত্রিকার শিরোনামটি ছিল বিদেশে উচ্চ শিক্ষায় যেতে না দেয়ার জন্য স্বামী কর্তৃক এক শিক্ষিকা নির্যাতিত। প্রথম আলোর সেই রিপোর্টটিতে শিক্ষক রুমানা নাম উল্লেখ করা হয়নি। তখন শিরোনামটি দেখে অবাক হয়েছিলাম, বিদেশে পড়তে চাওয়া কি একটি মেয়ের জন্য অন্যায় এ সমাজে? যে বিষয়টিতে খটকা লাগে, তা হচ্ছে শিক্ষিকার নাম উল্লেখ না করা। তবে কি নির্যাতিতার পরিবার ভয় পেয়েছিলো বলে নাম উল্লেখ করা হয়নি পত্রিকায়? ডিপার্টমেন্টের অন্য একজন শিক্ষককে সরাসরি ফোন করে বললাম, "পত্রিকায় যে নিউজ দেখলাম, সেটি আসলেই কি সত্যি? আসলেই কি চোখ উপড়ে ফেলতে চেষ্টা করেছে?" তিনি উত্তরে জানান, "হ্যাঁ ঘটনা সত্যি, এই মাত্র তিনি হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন। শিক্ষক রুমানাকে জরুরী বিভাগ থেকে কিছুক্ষণ আগেই কেবিনে আনা হয়েছে। ডাক্তার বলেছে একটি চোখ একেবারেই নষ্ট করে ফেলেছে, অন্যটিরও তেমন আশা নেই। তিনি আফসোস করে বললেন, " শিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার স্বামী এমনটা করতে পারলো?" আরও জানালেন, "তার স্বামী নাকি তাকে প্রায়ই মারধর করতো। কিন্তু মার খেয়েও তিনি কাউকে কিছুই জানান নি"। সেদিন সারাদিন দোয়া করে একদিকে চাচ্ছি শিক্ষক রুমানা যেন ভাল হয়ে ওঠেন, উনি যেন আবার আগের মত হাসি মুখে ডিপার্টমেন্টে চলাফেরা করেন, অন্যদিকে চাচ্ছি, তার স্বামীটির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় এবং এতে করে অন্য নির্যাতকরাও যেন ভয় পায়।

শিক্ষক রুমানা তার ডিপার্টমেন্টে মিষ্টভাষিতার জন্য সুপরিচিত, তার ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে অনেক ভালবাসেন। পত্রিকায় প্রকাশিত ঘটনার পরদিনই ফেসবুক থেকে মানব বন্ধনে অংশগ্রহণের তথ্যটি পাই। সেখানে ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র জুনিয়রদের এক বিরাট অংশগ্রহণ ছিল। সবাই পাশাপাশি হাতে হাত রেখে দাঁড়াল, কেউ ছবি তুললো ও পরে ফেসবুকে দিল। ছবিতে কমেন্টস করলেন আমাদের ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক, তিনি লিখলেন, "সহমর্মিতার মানব বন্ধব।" ছাত্ররা মন্তব্য করল "আমরা ন্যায় বিচার চাই"। আমরা হাজারও মানুষ আছি রুমানা ম্যাডামের পাশে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজনের কাছে শুনলাম নির্যাতক হাসান সাইদ উপরের মহলের প্রভাবশালী দুই একজনের ছত্রছায়ায় আছেন। হয়তো ছাড়া পেয়ে যেতে পারে বা সাজা কম হতে পারে। আমি বললাম, না তা হতে পারবে না, তার সাথে প্রভাবশালী দুই একজন ব্যক্তি থাকতে পারে কিন্তু রুমানা ম্যাডামের জন্য আছে হাজারও মানুষ।

পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে নিপীড়ককে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না–আদালতের এই রুলের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই নির্যাতক সাইদ ধরা পড়ল। ঘটনাটির পর প্রায় ১০ দিন সময় নিয়েছে পুলিশ গ্রেফতার করতে। তার আগে এটি সাধারণ পারিবারিক একটি নির্যাতনের সাধারণ মামলা হিসেবে নিয়েছিল তারা। এ সময় অনেকেই শিক্ষক রুমানার চারিত্রিক বিশ্লেষণ করেন এবং তাকে "ভাল মেয়ে" হিসেবে অভিমত দেন। আর এই ভাল মেয়ে বলেই নীরবে অত্যাচার হজম করেছে। ফেসবুকে অনেকেই প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন এতটা কষ্ট করে সংসার নামক জিনিসটা টিকিয়ে রাখার কোন প্রয়োজন ছিল কি নির্যাতিতার? আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এ ধরনের চিন্তা করতে দিতে নারাজ।

যতদিন পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় নির্যাতিতার চরিত্র হনন হবে, নিপীড়কের সাজানো গল্প যতদিন উৎসুক সমাজের কিছু মানুষের কাছ থেকে সহানুভুতি পাবে, ততদিন এ ধরনের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন হবে। নির্যাতিতা নারীর পাশে দাঁড়াতে কখনোই তার চারিত্রিক গুণ বা দোষ, "ভাল মেয়ে" কি "মন্দ মেয়ে" বিষয়টি বড় হয়ে দাঁড়াতে পারে না। নারী যখন অত্যাচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তখন অনেক সামাজিক বাঁধাই তাকে প্রতিহত করে। আমাদের উচিৎ এই বাধাগুলো সড়িয়ে ফেলা।

মাকসুদা সুলতানা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রী। লেখক ও গবেষক।