নীরবে ক্ষীয়মান রাখাইন সম্প্রদায়

Published : 8 Sept 2015, 04:54 AM
Updated : 8 Sept 2015, 04:54 AM

ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ঢেউ আর হুইলের গম গম তরঙ্গের মধ্যে আধো তন্দ্রা আধো জাগরণে জাহাজের কেবিনে শুয়ে এপাশ ওপাশ করে রেঙ্গুন (ইয়াঙ্গুন) নয়, যাচ্ছিলাম বরগুনা ও পটুয়াখালীতে। সদরঘাট থেকে এমভিতে উঠেছি। লঞ্চ ছাড়ল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। বুড়িগঙ্গা ধরে দেশের সব বড় নদীর বুকের ওপর দিয়ে লঞ্চ চলছে। বাংলাদেশের দক্ষিণে, উপকূল অঞ্চলে রাখাইনদের দেখতে যাচ্ছি। অন্য সব সংখ্যালঘু জাতিসত্তা আর ধর্মীয় জাতিসত্তার মতো বিলুপ্তপ্রায় ঐ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে দেখে তাদের জন্য কী করতে পারব, কতটুকু করতে পারব? প্রচার, জনমত তৈরি বা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি, এই আর কী। একটি নাগরিক কমিটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছি সেখানে।

২৫ আগস্ট সন্ধ্যায় রওনা হয়ে পরদিন ভোরে পটুয়াখালী পৌঁছে বরগুনার তালতলীতে রাখাইনদের গ্রামে পৌঁছুল আমাদের টিম। প্রথমে গেলাম তালতলীর বরবগী মৌজার একটি শ্মশানে। ১ একর ৩৩ শতাংশ আয়তনের এ শ্মশান আশেপাশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের লোকজনের গ্রাসের শিকার হতে হতেে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪০ শতাংশে। শ্মশান দখল করে বানানো হয়েছে বাড়ি, শৌচাগার; স্থাপন করা হয়েছে কাঠ চেরাই কল।

স্থানীয় তালতলী এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা আমাদের জানালেন রাখাইনরাই নাকি এই শ্মশানসহ আশেপাশের জায়গা বাঙালি মুসলমানের কাছে বিক্রি করেছে। আইনে দেবোত্তর সম্পত্তি, মঠ, শ্মশানের জায়গার যে কোনো ধরনের হস্তান্তর নিষিদ্ধ। দান, বিক্রয়, কট, রেহেন, বন্ধকও তাই। এ কারণে আগ্রাসী, বর্ণবাদী, সাম্প্রদায়িক একটি গোষ্ঠী রাখাইনদের অন্তর দখল না করে দখল করছে জমি, বাড়ি, ধর্ম, সংস্কৃতি, ধর্মস্থান সবই।

প্রায় সব গ্রামের একই চিত্র। বরগুনার তালতলীর একটি স্থানে বসতে হল আশেপাশের গ্রামের রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন নিয়ে। তারা তাদের জমির কাগজপত্র, উত্তরাধিকারের সমস্ত পর্চা, দলিল, ম্যাপ দেখালেন। আর বললেন আত্মা থেকে ছিঁড়ে নেওয়া পূর্বপুরুষের রক্তের উত্তরাধিকার বেহাত হওয়ার কাহিনি। তাদের সমস্যা ব্যক্ত করার সময় আবাদি ভূমিখণ্ড আর মন্দির, শ্মশান আর বসতভূম, পুকুর আর জলা থেকে উৎসাদন প্রক্রিয়ার জান্তব শিকার এ সব রাখাইন সদস্যের চোখে ছিল বেদনা। জমির কাগজ ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে (সিএস), স্টেট অ্যাকুইজেশন সার্ভে (এসএ), রিভারসিভ সার্ভে (আরএস)সহ হালনাগাদ পর্চা, বাটোয়ারা দলিল, নামখরিজ পর্চা দেখলাম। কোনোটি স্পষ্ট আর কোনোটি একটু জটিল।

জটিল জায়গা পেলেই স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতারা তাদের নিজেদের লোক দিয়ে ভিটা বা আবাদি জমি দখল অথবা ভয় দেখিয়ে কম দামে কেনার বন্দোবস্ত করে। এদের সম্পত্তি অর্পিত তালিকাতেও ঢুকে যায়। আর অর্পিত হয় কিছু ক্ষেত্রে আইনের প্যাঁচে, কিছু ভূমি অফিসের দুনীর্তিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কারসাজিতে।

অথচ এই রাখাইন গোষ্ঠীকে ব্রিটিশ সরকার গভীর শ্বাপদসঙ্কুল এই উপকূলীয় বনভূমিতে পাঠায় চাষাবাদ করে আবাদি ভূমিতে রুপান্তরকরণের জন্য। রাখাইনরা তাদের শ্রম, রক্ত, ঘাম দিয়ে এই অঞ্চল আবাদি ভূমিতে পরিণত করেন। যার দ্বারা যতটুকু ভূমি দখলে আসে সরকারিভাবে তা দখলি-স্বত্ত্বে মালিকানা সৃষ্টি করে দেওয়া হয়। ঐতিহসিক উইলিয়াম হান্টার ও জি ই হার্ভের সমসাময়িক তথ্যে দেখা যায়, আঠারশ শতকের শেষভাগে ব্রিটিশ সরকার জঙ্গল পরিস্কার ও ও ভূমি উদ্ধারের জন্য রাখাইনদের সুন্দরবনে পুনর্বাসিত করে। বর্তমানের পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা, কলাপাড়া, আমতলী ও বরগুনায় এভাবেই জনবসতি গড়ে ওঠে রাখাইনদের।

১৯০৮ সালে ব্রিটিশ সরকার সর্বপ্রথম খেপুপাড়ায় একজন কলোনিজেশন কর্মকর্তা নিযুক্ত করেন যার অধীনে এ এলাকার ২৩৭টি গ্রাম ছিল। এলাকার নাম ছিল 'দি বাখরগঞ্জ- সুন্দরবন কলোনিজেশন'। জঙ্গল আবাদের পর প্রথমে খাজনা ছাড়া দশ বছর চাষের অনুমতি ছিল তাদের। পরে সার্কেল সিএস সেটেলমেন্ট (জরিপ) হওয়ার পর প্রথম দশ বছরের জন্য খাজনা চালু করা হয়।

১৯০৮ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে এ অঞ্চলে রাখাইন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটে। ঐতিহ্যময় বিভিন্ন মন্দির ও স্থাপনা তৈরি হয়। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত পরিচালিত সার্ভে ও সেটেলমেন্ট অপারেশনে এ অঞ্চলে ৮৫ ভাগ রায়তদের অধীন এবং জেলার দক্ষিণাঞ্চলে আবাদকারীরা বিদ্যমান ছিল। ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ত্ব আইনে পটুয়াখালীর রাখাইনদের বাখেরগঞ্জের 'মগ' অভিধায় আদিবাসী রূপে স্বীকার করে ভূমির হস্তান্তর বিষয়ে তাদের স্বার্থরক্ষার্থে উক্ত আইনের ৯৭ ধারা সন্নিবেশিত হয়।

এটি রাখাইনদের ইতিহাসের একটি অংশ। অথচ আজ কী অবস্থা সেখানে! বাংলাদেশে অস্তিত্বমান বড় রাজনৈতিক দলগুলো রাখাইনদের সব কিছু গিলে ফেলার জন্য সমানভাবে তৎপর। সে কারণেই ১৭৮৪-১৯০০ সালের দিকে বরিশাল উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৫০ হাজার রাখাইন বসবাস করতেন। ১৯০০-১৯৪৮ সালে এই সংখ্যা নেমে যায় ৩৫ হাজারে। ১৯৯০ সালে ৪ হাজার জনে। আর ২০১৪ সালে কারিতাস বরিশাল অঞ্চলের ইন্টিগ্রেটেড কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের জরিপ অনুযায়ী এই উপকূলীয় অঞ্চলের রাখাইন জনসংখ্যা নেমে দাঁড়ায় ২ হাজার ৫শ ৬১ জনে।

এই পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট কী রকম নির্মম উচ্ছেদ-প্রক্রিয়া চালানোর ফলে অনবরত প্রান্তিক থেকে শূন্যের কোঠায় নেমে যাচ্ছে এই আদিবাসী জনগোষ্ঠী। কোথায় গেল আর কেন গেল এই জনগোষ্ঠীর বিপুল অংশ? কীভাবে নিষ্ঠুর ক্লিঞ্চিং প্রক্রিয়ার শিকার এরা ক্ষীণ থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি জাতিসত্তায় পরিণত হচ্ছেন, কেউ কি তার খবর রাখছেন?

নাগরিক হিসেবে প্রত্যেক ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া তার মৌলিক অধিকার। অথচ বসবাসকারী স্থানীয় রাখাইন নাগরিকদের ক্ষেত্রে এটি মানা হচ্ছে না। জন্ম নিবন্ধন সনদ থাকা সত্ত্বেও তাদের রোহিঙ্গা হিসেবে চিহ্নিত করে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানে গড়িমসি করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নানাভাবে যোগাযোগ করেও অনেকেই জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করতে পারছেন না।

বস্তুত রাখাইন আর রোহিঙ্গা এই দুই পরিচিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের তা না জানার কোনো কারণ থাকতে পারে না। দুরভিসন্ধিমূলকভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক পরিচিতিকে গুলিয়ে ফেলার একটি অপপ্রয়াস মাত্র।

প্রত্যেক মানুষই মৃত্যুর পর সৎকারের জন্য এক চিলতে ঠাঁই কামনা করে; কিন্তু রাখাইন আদিবাসীদের এটুকু চাওয়াই যেন অপরাধ। তাই কালাচাঁনপাড়ার ২৭ শতাংশ জমির শ্মশানটি বেদখল হয়ে আছে দীর্ঘদিন। স্থানীয় রাখাইনরা আমাদের কাছে অভিযোগ করলেন, শ্মশানের ২৩ শতাংশ জমি দখল করেছেন স্থানীয় সোহরাব হোসেন। এছাড়া তালতলী সদর উপজেলার শ্মশান ও তালুকদারপাড়ার শ্মশান দখল হয়ে গেছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগও রাখাইনদের ৪ শতাংশ জমি দখল করে সেটির ওপর লম্বা ব্রিজ নির্মাণ করেছে।

পুকুরের পানি রাখাইনদের কাছে পবিত্র হিসেবে বিবেচিত। তারা পুকুরের পানিতে কখনও গোসল করে না, কাপড় কাঁচে না ও গবাদি পশু নামায় না। তারা শুধুমাত্র খাবার পানির জন্য ব্যবহার করে থাকেন এ পানি। অথচ কালাচাঁনপাড়ার এই পবিত্র পুকুরের পূর্বাংশ দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেছেন স্থানীয় মেম্বার হানিফ মওলানা, ইউসুফ হাজি, জাফর হাজি গং। বরগুনা জেলার তালতলি উপজেলার কবিরাজপাড়ার রাখাইনদের দুশ বছরের পুরনো পুকুর দখল ও সেখানে স্থাপনা নির্মাণের পাঁয়তারা চলছে।

সুপেয় পানির জন্য রাখাইনরা তাদের পল্লীর সন্নিকটে এই পুকুর খনন করেছিলেন। এক সময় তারাই এ এলাকায় প্রায় সকল জমির মালিক ছিলেন। কালক্রমে প্রভাবশালীদের ক্ষমতা, হয়রানি, পেশিশক্তির ব্যবহার, হুমকি-ধামকির ফলে জমি হারাতে হারাতে এখন প্রায় ভূমিহীন হয়ে গেছেন। নিজস্ব ভূমি রক্ষা করার পরিবর্তে উল্টো তাদেরই বিরুদ্ধে ভূমিদস্যুরা ৩-৪টি করে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে; মামলার খরচ জোগাতে জোগাতে রাখাইনরা একে একে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। তাদের পাশে কেউ নেই, তাদের দেখারও কেউ নেই।

কুয়াকাটায়ও সেই ভূমিজ সন্তানদের অস্তিত্ব এখন চরম হুমকির মুখে। এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ক্ষমতার দাপটে শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগ রাখাইন মানুষ কৃষিজমি হারিয়েছেন। অনেক জমি অর্পিত সম্পত্তি করা হয়েছে। বালিয়াতলী ইউনিয়নের সোনাপাড়ার মং সি উ তার ৮.৬৬ একর জমির নিয়মিত খাজনা দিলেও জমিতে যেতে পারছেন না। স্থানীয় কাদের মিস্ত্রি, আতাহার, আজাহার ও শাহ আলম মোল্লা সে জমি ভোগ করছেন।

কৃষিজমি না থাকায় অন্যের জমিতে তাদের কাজ করতে হচ্ছে। দিনমজুর হিসেবেও তারা বর্তমানে বৈষম্যের শিকার। আবার যাদের সামান্য কিছু জমি আছে তার ফসলও তারা ঘরে তুলতে পারছেন না। ফসল ও পুকুরের মাছ জোর করে কেটে ও ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বেহাত হচ্ছে পুকুর, জমি, ফসল ও পশুসম্পদ।

এ বিষয়ে স্থানীয় কজন সাংবাদিকের সঙ্গেও আলাপ করা হলে তারা বিষয়টিতে সহমত পোষণ করেন। তবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলেন, রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজনদের অনৈক্যের কথা। স্থানীয় সাংবাদিক এবং সেখানকার একজন কলেজ শিক্ষক জানালেন, রাখাইনরা এখানে টিকতে না পেরে ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার চাপে, সে সঙ্গে এক ধরনের হীনমন্যতায় ভুগে মিয়ানমারে চলে যাচ্ছেন।

পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক অমিতাভ সরকারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা হয়। তিনি জানান, তার কাছে রাখাইনদের মধ্য থেকে যদি কেউ অভিযোগ করে তাহলে সেটি তিনি আন্তরিকভাবে আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়ে সুরাহার চেষ্টা করবেন। কিন্তু জেলা প্রশাসকের এসব কথাবার্তা আমাদের কাছে মনে হয়েছে এক ধরনের অক্ষমের অসহায়ত্ব হিসেবে। মনে হল তিনি নিজেকেই সান্তনা দিচ্ছেন। কারণ অভিযোগ জানানোর ভাষা ও সাহস, ঐক্য ও সাহসী নেতৃত্বের অভাব অবশ্যই রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে।

আমাদের সংবিধান দেশের প্রত্যেক নাগরিকের নিজ ধর্ম পালন, চর্চা ও বিকাশের নিশ্চয়তা দিয়েছে; অথচ এ অঞ্চলের রাখাইনরা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত। রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সঙ্গীত, নৃত্য, লোকগাথা, ভাষা আজ বিলুপ্তির পথে। মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ না থাকা, সাংস্কৃতিক একাডেমি না থাকার কারণে ঐতিহ্যবাহী রাখাইন সংস্কৃতি বিলীন হওয়ার পথে। এখন রাখাইন শিশুরা নিজের ভাষায় চিন্তা করে না– স্বপ্ন দেখে না, তারা বাংলায় স্বপ্ন দেখে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে বৌদ্ধ ধর্মীয় বই ও শিক্ষক সংকটের নাম করে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে নানা ছলে ইসলাম শিক্ষা পড়ানো হচ্ছে।

তাই নানাভাবে তাদের ধর্মীয় শিক্ষা ও লোকজ্ঞানসহ নাচ, গান, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাওয়া-দাওয়া হারিয়ে যেতে বসেছে। শুধুমাত্র কিছু রাখাইন নারী তাদের তাঁত ও বুনন শিল্প টিকিয়ে রেখেছেন। যথেষ্ট লাভজনক না হওয়ায় বর্তমানে এ তাঁত শিল্পও ধ্বংসের মুখে। পুঁজি ও কাঁচামালের অভাব, বাজারজাতকরণের সমস্যা, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ও পরম্পরাগত প্রশিক্ষণের অভাবের কারণে এ শিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে।

অনুসন্ধানে জানতে পারলাম, রাখাইনরা সরকারের বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম থেকেও বঞ্চিত। বিভিন্ন পাড়ার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, ভিজিডি, ভিজিএফ, প্রতিবন্ধী ভাতার কোনোটিই পান না। এছাড়া টিআর কর্মসূচী, কাবিখা, কাবিটা, রাস্তাখনন কোনো কার্যক্রমেই তাদের অর্ন্তভুক্ত করা হয় না। সকলেই এলাকায় রাখাইনদের উন্নয়ন ইস্যু সুকৌশলে এড়িয়ে গেছে। কেবল বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কারিতাস তাদের উন্নয়নে কিছু কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে।

কারিতাস কর্তৃক পরিচালিত আইসিডিপি-রাখাইন নামে পরিচালিত এই প্রকল্পটির কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রাখাইন শিশুদের মাতৃভাষায় পড়াশুনা, ভূমি আইন বিষয়ক প্রশিক্ষণ, কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ (যেগুলি সাইক্লোন সেন্টার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়), শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান এবং ভূমি বেদখল হওয়া ভুক্তভোগীদের জন্য আইনি সহায়তা প্রদান ইত্যাদি, যা আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে।

তবে দীর্ঘদিন ধরে রাখাইনরা যে বৈষম্যের শিকার হয়েছে কেবল দু-একটি উদ্যোগে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এ জন্য সরকার, স্থানীয় প্রশাসন ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি।

সারা দুনিয়াতেই সংখ্যালঘু জাতিসত্তা, সংখ্যালঘু ধর্মীয় সত্তা, ব্যতিক্রমী চিন্তাধারী ও আদর্শ ধারণকারী মানুষ নিপীড়িত হচ্ছেন। কিন্তু অপর দেশগুলোতে এসব অত্যাচার আর নিমর্মতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধও আমরা দেখি। কিন্তু আমাদের দেশে এই প্রতিরোধ খুব ক্ষীণমাত্রার আর প্রায় অনুচ্চকিত। পার্শ্ববর্তী ভারতে শুধু সামাজিক আন্দোলন, মিছিল, মিটিং-সেমিনার, সিম্পেজিয়াম নয়, প্রতিবাদী সাহিত্যচর্চাও রয়েছে। রয়েছেন অরুন্ধতী রায়, মহাশ্বেতা দেবী, অভিজিৎ সেন, ভগীরথ মিশ্র। আর আমাদের আদিবাসী, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা নিয়ে কী সাহিত্য আছে?

অনেক কথা, অনেক যুক্তি আর প্রতিবাদ একসঙ্গে চলে আসছে । কিন্তু সময় আর পরিসর ছোট। ভবিষ্যতে তাদের নীরবতা আর কষ্টের পাশে আবারও সরব হওয়ার প্রত্যাশা থাকল।

প্রকাশ বিশ্বাস: আইনজীবী ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আদালত প্রতিবেদক।