আমাদের এক টুকরো লাল-সবুজ পতাকা

শামীম আহমেদ
Published : 2 Sept 2015, 02:06 AM
Updated : 2 Sept 2015, 02:06 AM

আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র। তখন মানে ২০০২-০৩ সালের দিকে। আমাদের ক্লাসে একটা মেয়ে পড়ত, নাম খেয়া (অবশ্যই ছদ্মনাম)। খেয়াকে আমি ভীষণ হিংসা করতাম। হিংসা করবার কারণটাও অভিনব। বন্ধুত্বের কয়েক দিনের মধ্যেই জানা গেল, খেয়ার কাছে বাংলাদেশের এক বিখ্যাত লেখক ব্যক্তিগত চিঠি লেখেন এবং সেই বিখ্যাত লেখকের নাম মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

বাংলাদেশের আর দুদশ জন সাধারণ মানুষের মতো আমারও গল্পের বই পড়া শুরু সেবা প্রকাশনীর তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা দিয়ে। ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়তেই গোগ্রাসে সেই সব বই রীতিমতো গলাধঃকরণ করে পড়া শুরু করি হুমায়ূন আহমেদ। তারপর আলী ইমাম, শাহরিয়ার কবির হয়ে মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এরপর আস্তে আস্তে গম্ভীর বিষয়ে পড়ালেখা শুরু। দেশ-বিদেশের অনেক লেখকের লেখনীর প্রেমে পড়া; শহীদুল জহির, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আহমদ ছফাদের লেখা পড়ে সম্মোহিত হয়ে থাকা।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল সম্ভবত বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনপ্রিয় লেখক। নিজের ভাই হুমায়ূন আহমেদের কাছে তিনি জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে হেরে গেছেন। কিন্তু যেখানটায় এগিয়ে গেছেন সেটি হচ্ছে, ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি এবং লেখনীর বিষয়-বৈচিত্র্যে। হুমায়ূন আহমেদের ব্যাপারে সমালোচকদের একটা বক্তব্য হচ্ছে, তাঁর লেখার পাঠক অসংখ্য, কিন্তু তিনি পাঠক তৈরি করতে পারেননি। অর্থাৎ যারা হুমায়ূনের বই পড়েন তারা আর কারও বই পড়েন না।

মুহম্মদ জাফর ইকবালের ক্ষেত্রে এ কথা খাটে না। তাঁর লেখনীতে দেশপ্রেমের ছাপ প্রকট। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দরদ, সায়েন্স-ফিকসন, ফিকসন, শিশু সাহিত্য সব মিলে তিনি বাংলাদেশে অসংখ্যা ভালো পাঠক তৈরি করেছেন যারা পরবর্তীতে অন্য লেখকদের বইয়ের স্বাদও আস্বাদন করেছেন।

সাম্প্রতিককালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) সংঘটিত অনভিপ্রেত ঘটনার জের ধরে তিনি বৃষ্টিতে ভিজেছেন, অত্যন্ত ব্যথিত চিত্তে বলেছেন তাঁর হতাশার কথা। সরকার-সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কতিপয় নেতৃবৃন্দের কাছে শাবিপ্রবির শিক্ষকরা লাঞ্ছিত হয়েছেন। কারণ তাঁরা সরকার-সমর্থিত উপাচার্যের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনরত ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, শিক্ষকরা যখন আন্দোলনরত ছিলেন, তখনও কিন্তু তাঁরা ক্লাস বর্জন করেননি। নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা নিয়েছেন, ফলাফল প্রকাশ করেছেন।

লেখার শুরুতেই বান্ধবী খেয়ার কথা বলছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে খেয়াকে খানিকটা হিংসা করতাম, কারণ তার কাছে জাফর ইকবালের হাতে লেখা চিঠি ছিল। কর্মসূত্রে সেই জাফর ইকবালের সঙ্গে আমার সখ্যতা গড়ে ওঠে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক আদর্শজনিত মতাদর্শ আমাদের আরও কাছে এনে দেয়। বাংলাদেশে গত দুবছরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর যে ভয়াবহ সহিংসতা, তাতে অনেকের মতো আমিও মাঝে মাঝে হতাশ হয়েছি। সিলেটে ছুটে গিয়ে স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি, হতাশা প্রকাশ করেছি। ওই সময় তাঁর মধ্যে যে অসম্ভব দৃঢ়চেতা ভাব দেখেছি, তিনি যেভাবে আমাদের উৎসাহিত করেছেন, তা অবিশ্বাস্য।

স্যারের সঙ্গে আলাপ শুরু শাহবাগ আন্দোলনকালীন সময়। তিনি শাহবাগ আন্দোলনের মূল যে চেতনা, অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে কঠিন অবস্থান নিয়েছিলেন। প্রতি শুক্রবার তিনি সিলেট থেকে এসে গণজাগরণ মঞ্চের অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন– তখন দেখা হত, কথা হত। ইয়াসমীন আপাও থাকতেন।

সে কথা আলাপে গড়ায় যখন সারাদেশে হেফাজত আর জামাতের আগুনের জ্বালাও-পোড়াও আর ধ্বংসের চিত্র ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। গত বছর এবং তার আগের বছরও, অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে স্যারের সঙ্গে দেখা হলে ট্রেনে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া, মানুষ পুড়িয়ে হত্যা নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করছিলাম। স্যার খুব দৃঢ়চিত্তে আমাকে বলেছিলেন, হেফাজত-জামাতের এটাই উদ্দেশ্য, তারা এভাবেই চায় যে, আমাদের মতো সচেতন, প্রগতিশীল মানুষেরাও হতাশ হয়ে পড়ুক এবং তারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে ক্ষমতায় আসুক এবং বাংলাদেশকে আরেকটি পাকিস্তান বানাক।

স্যার বলতেন, ওরা যা করে করুক, আমাদের হতাশ হলে চলবে না, হাল ছাড়া যাবে না। তিনিও এ-ও বলছিলেন, ডিসেম্বর এলেই এদের আন্দোলনের চিত্র ধারালো হয়ে ওঠে, কারণ আমাদের বিজয়ের মাসটি ওরা সহ্য করতে পারে না। স্যারের কথাই ঠিক ছিল দেখেছি। পরবর্তীতে সরকারপ্রধানের দৃঢ় অবস্থান এবং সর্বোপরি মানুষের সচেতনতায় জামাত-হেফাজত তাদের উদ্দেশ্য 'কামিয়াব' করতে পারেনি।

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ একটি শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়েছে, আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ২৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি প্রগতির দিকে। এমন যখন অবস্থা তখনই শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনা দেখতে হল। তা-ও জামায়াতে ইসলামীর কোনো ছাত্র সংগঠন নয়, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকারের ছাত্র সংগঠনই শিক্ষকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে হায়েনার মতো। স্যার অবশ্যই সেটা মেনে নিতে পারেননি। প্রতিবাদ করেছেন।

এখানে একটি কথা বলে রাখতে চাই শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশব্যাপী তরুণদের মধ্যে জাফর ইকবাল ব্যপক জনপ্রিয় হলেও সিলেটের একটা বড় অংশ, যারা ধর্মীয় গোঁড়ামিতে বিশ্বাসী, তারা স্যারকে দেখতে পারে না। নানা সময় নানা অজুহাতে তারা তাঁকে শাবিপ্রবি থেকে বের করে দিতে চেয়েছে। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের বাধার মুখে 'কামিয়াব' হতে পারেনি।

শাবিপ্রবির ঘটনায় এই অংশটি খুব খুশি মনে হচ্ছে। তারা অর্থাৎ জামাত-হেফাজত, এরা সবাই এখন একজোট হয়ে জাফর ইকবাল আর ছাত্রলীগের মধ্যের এই ঘটনা উস্কে দিতে চাচ্ছে যাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সিলেটে ভুলুণ্ঠিত হয়। যখন সংঘটিত ঘটনার জন্য ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্ট নেতা-কর্মীদের বিচার চাই, ঠিক তখন এটাও চাইব যে, এই ঘটনা পুঁজি করে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি সিলেটে মৌলবাদ আর ধর্মান্ধতা উস্কে দিয়ে যাতে সুবিধা নেবার চেষ্টা না করে।

সরকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে যদিও তিন ছাত্রলীগ নেতাকে বহিস্কার করা হয়েছে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শিক্ষকদের এবং মুক্তিযুদ্ধের ধারক-বাহক রাজনৈতিক শক্তিকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া একটি সাধারণ ঘটনা হিসেবে দেখলে সরকার নিজের পায়ে কুড়াল মারবে। তাদের উচিত হবে এ বিষয়ে একটি তদন্ত করে নিজেদের ছাত্র সংগঠনের মধ্যে অযোগ্য অংশটির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।

সরকার আজকে যখন একটি শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সে সময় সমগ্র দেশেই শিক্ষাব্যবস্থায়র কেমন যেন একটা বেহাল অবস্থা যা দীর্ঘমেয়াদে আমাদের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। মুক্তিযুদ্ধের শেষভাগে এসে যখন পাকিস্তান হানাদার বাহিনী আমাদের সঙ্গে পেরে উঠছিল না তখন তারা আমাদের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষকদের বেছে বেছে হত্যা করেছিল। আজকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি যখন দেশকে ঈর্ষণীয় সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে ঠিক সেই সময়ে শিক্ষাব্যবস্থার দুর্গতি আমাদের ভাবিয়ে তোলে। এটি সেই একই 'কামিয়াবি' গোষ্ঠীর কোনো দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা কিনা খতিয়ে দেখা দরকার।

একই দেশে নানামুখী শিক্ষাব্যবস্থা, মাদ্রাসা শিক্ষায় সরকারের ক্রমাগত পুঁজিবৃদ্ধি কি আত্মঘাতীমূলক অবস্থানের দিকেই আমাদের ঠেলে দিচ্ছে কিনা সে বিষয়েও কঠোর সিদ্ধান্ত নেবার সময় এসে গেছে।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও সুখ্যাতি এনে দিয়েছেন। কোনো বেয়াড়া ছাত্র সংগঠনের অযোগ্য ছাত্রনেতাদের কর্মকাণ্ডের জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয় অচল হতে দেওয়া যাবে না। মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ কোনো শিক্ষকের সম্মানও ভুলুণ্ঠিত হতে দেখতে চাই না। সঙ্গে সঙ্গে ভাবা দরকার সরকার কাদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে বসাচ্ছেন সেটা নিয়েও। এই পদে দরকার দক্ষ প্রশাসক, যা আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাচ্ছি না।

গত কবছর ধরে স্যারের সঙ্গে বইমেলায় নিয়মিত দেখা হয়। জনপ্রিয় এই লেখককে যখন শত শত তরুণ-তরুণী ছেঁকে ধরেন অটোগ্রাফের জন্য, তখন নিজের কবিতার বই হাতে নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকি কখন তার একটা কপি স্যারের হাতে তুলে দিতে পারব। হাজারও তরুণ, মধ্যবয়স্ক পেশাজীবী, বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবার রয়েছে স্যারের পাশে। এই লড়াই আমাদের সবার। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এখন একটি ছোট্ট বাংলাদেশের নাম, আর সেই বাংলাদেশে ছোট্ট লাল-সবুজের পতাকা আমাদের প্রিয় শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

শামীম আহমেদ: উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক।