ইংরেজের আইন ও রবীন্দ্রনাথ

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
Published : 17 June 2011, 05:30 PM
Updated : 17 June 2011, 05:30 PM

সমাজ রক্ষা করতে কিছু রীতিনীতি মানতে হয়। রাজ্য বা রাষ্ট্রের জন্য আইনের প্রয়োজন রয়েছে। সমাজের রীতিনীতি, বিধির বিধান ও মনুষ্যপ্রণীত আইন হচ্ছে দেশের আইনের উৎস। বাংলাদেশের আইনে অনার্য্য, আর্য্য, তুরস্ক, ইংরেজ নানাজাতির আইনি পলি পড়েছে। 'বাংলায় সংবিধান' বক্তৃতায় আমি বলি, 'আইন', 'কানুন', 'আদালত', 'ইনসাফ'–এই শব্দগুলো আটশ বছর আগে আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল না। আইন-কানুন–এই দ্বিপদী শব্দ আইন শ্রেণীবাচক বা আইনের বহুবচন হিসাবে এখন ব্যবহার হচ্ছে। 'আইন' ফার্সি শব্দ। 'কানুন' আরবি, গ্রিক 'কানুন'-এর সঙ্গে শব্দটির সাদৃশ্য রয়েছে। 'অ্যাক্ট', 'ইক্যুটি', 'রুল', 'রেগুলেশান' শব্দগুলোর ব্যবহার আড়াই শ বছরেরও কম। তুরস্কদের আগমনের পূর্বে ইনসাফ-ইক্যুটি বলতে 'ধর্ম' শব্দের ব্যবহার হতো। 'অথরিটি', 'স্যাংসন, 'জুরিসডিকশান, 'লেজিসলেশন' ইত্যাদি ইংরেজি শব্দের দ্যোতনা সংস্কৃতে বা বাংলায় আমরা সরাসরি পাচ্ছি না।'

ইংরেজদের আগমনের পরে আমাদের দেশে বিবিধ নব প্রবর্তনার শুরু। সর্বোচ্চ আদালতের রায় রাষ্ট্রসহ সকলকে মান্য করতে হবে, বিচারক যে ধর্মেরই হোক না। ১ নভেম্বর, ১৮৫৮ রানি ভিক্টোরিয়া প্রজার ধর্মবিশাসে ও ধর্মপালনে হস্তক্ষেপ না করার নীতি ঘোষণা করেন এবং সরকারি কর্মে নিয়োগের ক্ষেত্রে পক্ষপাত করা হবে না বলে আশ্বাস দেন। ইংরেজের আইনে অপরাধের জন্য সবার জন্য এক আইনের বিধান দেওয়া হয়। ধর্মপরিবর্তনের জন্য কোনো শাস্তির বিধান দেওয়া হলো না। আর ইংরেজি আইনি ঐতিহ্যের নজির প্রথা গ্রহণ করা হলো।

জেরেমি বেনথাম তাঁর অফ দ্য ইনফ্লুয়েন্স অব টাইম অ্যান্ড প্লেস ইন ম্যাটার্স অব লেজিসলেশান (আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে কাল ও স্থানের প্রভাব) গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ে বলেন, 'প্রথমত, ইংরেজি আইনের প্রকৃতি বেশির ভাগের এমনই যে, প্রতিটি ব্যাপারেই তা মন্দ; দ্বিতীয়ত, শুধু তাই নয়, ইংল্যান্ডের চেয়ে তা বাংলা দেশ আরো খারাপ; তৃতীয়ত, বাংলা দেশের জন্য আরো ভালো, এমনকি ইংল্যান্ডের জন্যও আরো ভালো হতে পারে এমন এক ব্যবস্থা উদ্ভাবন করা যেতে পারে। আইন রোপণের সময় এর জন্য আইন প্রবর্তন করা যায়।'

কোনো কোনো দেশ বেশ সহজে বিদেশের আইন রপ্ত করতে পারে। এ ব্যাপারে জাপানিদের কৃতিত্বের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ জাপান-যাত্রীতে বলেছেন: 'য়ুরোপের কামান বন্দুক, কুচ-কাওয়াজ, কল-কারখানা, আপিস-আদালত, আইন-কানুন যেন কোন আলাদিনের প্রদীপের জাদুতে পশ্চিমলোক থেকে পূর্বলোকে একেবারে আস্ত উপড়ে এনে বসিয়ে দিলে। নতুন শিক্ষাকে ক্রমে ক্রমে সইয়ে নেওয়া, বাড়িয়ে তোলা নয়; তাকে ছেলের মতো শৈশব থেকে যৌবনে মানুষ করে তোলা নয়–তাকে জামাইয়ের মতো একেবারে পূর্ণ যৌবনে ঘরের মধ্যে বরণ করে নেওয়া। বৃদ্ধ বনষ্পতিকে এক জায়গা থেকে তুলে আর এক জায়গায় রোপণ করবার বিদ্যা জাপানের মালীরা জানে; য়ুরোপের শিক্ষাকেও তারা তেমনি করেই তার সমস্ত জটিল শিকড় এবং বিপুল ডালপালা সমেত নিজের দেশের মাটিতে এক রাত্রির মধ্যেই খাড়া করে দিলে।'

পাশ্চাত্যে ব্যবহারশাস্ত্রের উপর নানা গবেষণা হয়েছে। আমাদের দেশে তেমন মৌলিক কোনো চিন্তাভাবনা হয়নি। রবীন্দ্রনাথের মতে মৌলিন্যের এই অভাব আমাদের উচ্চশিক্ষা অমাতৃভাষার মাধ্যমে হওয়ার কারণে। ব্যাখাপূর্ব পর্যায়ে আইন শনাক্ত করা হয়। ব্যাখ্যাপর্বে তার যথার্থতা-নিরূপণ করা হয়। ব্যাখ্যা পরবর্তী পর্যায়ে আইনের পূর্ণ মূল্যায়ন করে তার ন্যায্যতা প্রতিপাদন করা হয়। আইনের সম্পূর্ণ তত্ত্ব কেবল আইন ও মান্যকরণের জন্য দমনক্ষমতা প্রয়োগ নয়, আইন শুধু অধিকার-অধিকক্ষেত্র নয়। বরং তার ন্যায্যতাও বিবেচ্য বিষয়। আইনের যথার্থতা বিচার শেষ কথা নয়। আইন মান্য করার জন্য ব্যক্তিমানুষের ওপর যে দমন শক্তি প্রয়োগ করা হয় তা কতখানি ন্যায্য তাও বিবেচনা করতে হবে।

রবীন্দ্রনাথের পিত্রালয়ে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অ্যাটর্নি-ব্যারিস্টারদের বেশ যাতায়াত ছিল। তাঁর ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর নিজে ইংরেজি-ফার্সিতে আইনি কাগজাদির মুশাবিদা করতেন।

১৯১২ সালের জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'ব্যারিস্টার হইব বলিয়া বিলাতে আয়োজন শুরু করিয়াছিলাম, এমন সময় পিতা আমাকে দেশে ডাকিয়া আনাইলেন। আমার কৃতিত্বলাভের এই সুযোগ ভাঙ্গিয়া যাওয়াতে বন্ধুগণ কেহ কেহ দুঃখিত হইয়া আমাকে পুনরায় বিলাতে পাঠাইবার জন্য পিতাকে অনুরোধ করিলেন। এই অনুরোধের জোরে আবার একবার বিলাতে যাত্রা করিয়া বাহির হইলাম। সঙ্গে আরও একজন আত্মীয় ছিলেন। ব্যারিস্টার হইয়া আসাটা আমার ভাগ্য এমনি সম্পূর্ণ নামঞ্জুর করিয়া দিলেন যে, বিলাত পর্যন্ত পৌঁছিতেও হইল না। বিশেষ কারণে মাদ্রাজের ঘাটে নামিয়া পড়িয়া কলিকাতায় ফিরিয়া আসিতে হইল।'

২৪ অক্টোবর ১৮৯৪ সালে ইন্দিরা দেবীকে লিখিত এক পত্রে তিনি বলছেন, 'আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমি যদি ব্যারিস্টার কিংবা সিভিলিয়ান হয়ে আসতুম তা হলে আমি আমার নির্দিষ্ট কাজের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে যেতুম–সাহিত্যচর্চায় মন দেওয়ার কোনো আবশ্যক অনুভব করতুম না। আইনের কূটমর্ম-উদ্ভাবন, বিপক্ষ পক্ষের যুক্তি-খণ্ডন, বিশৃঙ্খল সাক্ষ্যের মধ্যে থেকে একটা সুসংগত ইতিহাস এবং মত রচনা করে তোলা, এতেই আমার সমস্ত মন অহর্নিশি নিবিষ্ট থেকে একটা বিশেষ আনন্দ এবং আত্মবিস্মৃতি লাভ করত। ভাগ্যি আমি ব্যারিস্টার হয়ে আসিনি!'

মুসলমান আইনের ফৌজদারি বিধি-বিধান ও সাক্ষ্য-প্রমাণ আইন ইংরেজ আমলে পরিত্যক্ত হয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত আইনের বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে। অন্য সব আইনের মতো হিন্দু ও মুসলমানের আইনের ক্ষেত্রেও ইংরেজ আমলে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকের রায়, সে বিচারক যেকোনো ধর্মাবলম্বীই হোক না কেন, চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। এমন নজির প্রথা হিন্দু বা মুসলমান আইনের ঐতিহ্যে ছিল না।

উন্নততর ও জটিলতর সামাজিক অবস্থার আইনগত সমস্যার মোকাবিলা করতে গিয়ে পশ্চিম ইউরোপ যেমন রোমান আইনকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল বাংলা দেশ তেমন করে ইংলিশ কমন ল'কে আমন্ত্রণ জানায়নি। এখানে কমন ল' প্রভাব বিস্তার করেছে ব্যাপক সংকলনের মাধ্যমে।

১৮৩৩-এর সনদ বলে যে ল' কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয় তা মুসলমান আইন, হিন্দু আইন ও স্থানিক আইন–তিনটি স্বতন্ত্র সংকলনের কথা চিন্তা করে। মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায় প্রবল আপত্তি করায় সাধারণ দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিষয়ে কমিশনের কাজ সীমাবদ্ধ থাকে। ১৮৫৯ সাল থেকে ১৮৮২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সংকলনের মাধ্যমে দেশের আইন উল্লেখযোগ্যভাবে নতুন রূপ ধারণ করে।

য়ুরোপীয় রাষ্ট্রসমূহের বিশ্বের বিভিন্ন বলয়ে উপনিবেশ সৃষ্টির পর সেইসব উপনিবেশের আইনের ক্ষেত্রে দারুণ পরিবর্তন হয়। আধুনিকীকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ য়ুরোপীয় আইনের কার্যকরতা লক্ষ্য করে অনেক দেশ ঢালাওভাবে তা অনুকরণ-অনুসরণ করে। তুর্কিরা সুইস ও জার্মান আইন আমদানি করে। ভিয়েতনামে চীন, ফরাসি, সোভিয়েত রাশিয়া, মার্কিন ইত্যাদি বিভিন্ন দেশের আইন নিয়ে গ্রহণ-বর্জনের পরীক্ষা চলে। আজ বিশ্বায়নের যুগে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য চুক্তি, বিরোধনিষ্পত্তি, সালিস, কোম্পানি, বহুজাতিক কোম্পানির চেহারা প্রায় একই রকম হতে চলেছে।

সারা উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক আগে থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির তিনটি প্রেসিডেন্সি শহর কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাইতে ইংরেজি ফৌজদারি আইন চালু ছিল। নন্দকুমারের ফাঁসি হয়েছিল ইংরেজি জালিয়াতির আইনে। ইংল্যান্ডের আইন অনুযায়ী ফৌজদারি মামলার বিচার হতো জুরির সাহায্যে। ১৮২৬ সাল পর্যন্ত জুরি ইউরোপীয়দের দ্বারা গঠিত হতো।

১২১৫ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের ব্যারন-সামন্তরা রাজা দ্বিতীয় হেনরিকে ঘেরাও করে ম্যাগনা কার্টা (মহাসনদ) আদায় করে। ঐ সনদের একত্রিশ ও বাহান্ন অনুচ্ছেদে বিধান দেওয়া হয় যে, কোনো স্বাধীন ব্যক্তি আইন অনুযায়ী তার সমকক্ষের রায় ব্যতিরেকে কোনো শাস্তি ভোগ করবে না বা তার সম্পত্তি থেকে সে বঞ্চিত হবে না।

জুরি দুই রকম। গ্র্যান্ড জুরি বা মহাজুরিতে বারো থেকে তেইশজন জুরী থাকে। পেটি জুরি বা ছোট জুরিতে বারো জন। দুই ধরনের জুরির দুরকম কাজ। গ্র্যান্ড জুরি রাষ্ট্রকর্তৃক আনীত প্রমাণাদি শুনে সিদ্ধান্ত দেয় আসামির বিরুদ্ধে মামলা চালানোর মতো কোনো বিশ্বাসযোগ্য ভিত্তি আছে কি না। এ সিদ্ধান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠের। পেটি জুরিতে আসল বিচার হয়। জুরির ঐকমত্য থাকতে হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। জুরির অভিমতই চূড়ান্ত বলে গণ্য করা হয়।

১৮৩৩ সালের ২৭ জুলাই 'বঙ্গদেশীয় মহাশয়রা প্রথমতঃ গ্রান্ডজুরীতে উপবেশন করেন।' প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন। ১৮৩৫ সালের ৮ আগস্টের 'সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয়' হতে জানা যাচ্ছে যে, জুরিদের পরিশ্রম যাতে ব্যর্থ না হয় তার জন্য প্রত্যেক জুরিকে চার তঙ্কা বেতন দেওয়া হবে।

ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের অভিজ্ঞতায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জুরি প্রথার অযৌক্তিকতা ও জটিলতাকে অবিচারের চতুর্থ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে সরকার ফৌজদারি আদালতে জুরি প্রথা তুলে দেওয়ার প্রয়াস পেলে ১৮৯২ সালে কংগ্রেস দল তার বিরোধিতা করে।

কয়েক বছর পরে কটকে জেলা জজ বিহারীলাল গুপ্তের বাসায় এক সান্ধ্যভোজে রাভেনশ কলেজের এক ইংরেজ অধ্যাপক অতিথির শীলধর্ম লঙ্ঘন করে ভারতীয়দের সম্পর্কে একাধিক বিরূপ মন্তব্য করেন, 'যে দেশের লোক অর্ধসভ্য, অর্ধ শিক্ষিত, যাহাদের ধর্মনীতির আদর্শ উন্নত নহে, জুরির অধিকার তাহাদের হস্তে কুফল প্রসব করে… জীবনের পবিত্রতা, অর্থাৎ জীবনের প্রতি হস্তক্ষেপ করার পরমদূষণীয়তা সম্বন্ধে ভারতবাসীর ধারণা ইংরেজের তুলনায় অত্যন্ত স্বল্পপরিমিত। সেই জন্য হত্যাকারীর প্রতি ভারতবর্ষীয় জুরির মনে যথোচিত বিদ্বেষের উদ্রেক করে না।'

ওই ঘটনার উল্লেখ করে ১৩০১ সালে রবীন্দ্রনাথ 'অপমানের প্রতিকার' প্রবন্ধে মন্তব্য করেন, 'যাহারা মাংসাশী জাতি এবং যাহারা বিরাট হত্যাকাণ্ডের দ্বারা পৃথিবীর দুই নবাবিষ্কৃত মহাদেশের মধ্যে আপনাদের বাসযোগ্য স্থান পরিষ্কার করিয়া লইতেছে এবং সম্প্রতি তরবারির দ্বারা তৃতীয় মহাদেশের প্রচ্ছন্ন বক্ষোদেশ অল্পে অল্পে বিদীর্ণ করিয়া তাহার শস্য-অংশটুকু সুখে ভক্ষণ করিবার  উপক্রম করিতেছে, তাহারা যদি নিমন্ত্রণ সভায় আরামে ও স্পর্ধাভরে নৈতিক আদর্শের উচ্চ দণ্ডে চড়িয়া বসিয়া জীবনের পবিত্রতা ও প্রাণহিংসার অকর্তব্য সম্বন্ধে অহিংসক ভারতবর্ষকে উপদেশ দিতে থাকে তবে 'অহিংসা পরমো ধর্মঃ' এই শাস্ত্রবাক্য স্মরণ করিয়াই সহিষ্ণুতা অবলম্বন করিতে হয়।'

ইংরেজ ও মার্কিনিরা জুরি প্রথাকে সেভাবে বিচারকর্মে নাগরিকের শরিকানা হিসেবে গর্ব অনুভব করে, আমরা তা করি না বলেই জুরি প্রথা উঠে যায়। মহাত্মা গান্ধী জুরি প্রথার বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করেন। স্বাধীনতার দুই দশকের মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশে জুরি প্রথা উঠিয়ে দেওয়া হয়।

আইনের শাসন সম্পর্কে ১৩১০ সালে 'মন্দির' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেন: 'আমার যাহা ইচ্ছা তাহা করিব; সেই স্বাধীন ইচ্ছা যেখানে অন্যের কর্ম করিবার স্বাধীনতাকে হনন করে কেবল সেইখানেই আইনের প্রয়োজন। এই আইনের শাসন ব্যতিরেকে সমাজের প্রত্যেকের যথাসম্ভব স্বাধীনতা থাকিতেই পারে না। এইজন্য য়ুরোপীয় সমাজে সমস্ত শাসন ও শাসনের অভাব প্রত্যেক মানুষের ইচ্ছাকে স্বাধীন করিবার জন্যই কল্পিত।'

১৩২৪ সালে তাঁর 'ছোটো ও বড়ো' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন: 'ইংরেজিতে যাকে 'শর্ট কার্ট' বলে আদিম কালের ইতিহাসে তাহা চলিতে ছিল। 'লে আও, উসকো শির লে আও' এই প্রণালীতে গ্রন্থ খুলিবার বিরক্তি বাঁচিয়া যাইত, এক কোপে গ্রন্থি কাটা পড়িত। য়ুরোপের অংহকার এই যে, সে আবিষ্কার করিয়াছে এই সহজ প্রণালীতে গ্রন্থি কাটা পড়ে বটে কিন্তু মালের গুরুত্ব লোকসান ঘটে। সভ্যতার একটা দায়িত্ব আছে, সকল সংকটেই সে-দায়িত্ব তাহাকে রক্ষা করিতে হইবে। শাস্তি দেওয়ার মধ্যে একটা দারুণতা অনিবার্য বলিয়াই শাস্তিটাকে ন্যায় বিচার প্রণালীর ফিলটারের মধ্য দিয়া ব্যক্তিগত রাগদ্বেষ ও পক্ষপাত-পরিশূন্য করিয়া সভ্য সমাজ তবে তাহাকে গ্রহণ করিতে পারে। তাহা না হইলেই লাঠিয়ালের লাঠি এবং শাসনকর্তার ন্যায়দণ্ডের মধ্যে প্রভেদ বিলুপ্ত হইতে থাকে।'

আর প্রসঙ্গান্তরে 'সঙ্গীতের মুক্তি'তে রবীন্দ্রনাথ বলেন: 'লাঠিয়ালের হাতে রাজদণ্ড দিলেও সে তাহা লইয়া লাঠিয়ালি করিতে চায়, কেননা রাজত্ব করা তার প্রকৃতিগত নয়।'

১২৯৮ সালে 'প্রাচ্য ও প্রতীচ্য'-এ ইংরেজ আইন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলছেন: 'ইংরেজের মুলুকে আমরা অনেক আইন এবং অনেক আদালত পেয়েছি। দেশে যত চোর আছে পাহারাওয়ালার সংখ্যা তার চেয়ে ঢের বেশি। সুনিয়ম সুশৃঙ্খল সম্বন্ধে কথাটি কবার জোর নেই। আমরা ইংরেজের সতর্কতা, সচেষ্টতা, প্রখর বুদ্ধি, সুশৃঙ্খল কর্মপটুতার অনেক পরিচয় পেয়ে থাকি; যদি কোনো কিছুর অভাব অনুভব করি তবে সে এই স্বর্গীয় করুণার, নিরুপায়ের প্রতি ক্ষমতাশালীর অবজ্ঞাহীন অনুকূল প্রসন্নভাবের। আমরা উপকার অনেক পাই, কিন্তু দয়া কিছুই পাই নে। অতএব যখন এই দুর্লভ করুণার অস্থানে অপব্যয় দেখি, তখন ক্ষোভের আর সীমা থাকে না।'

ইংরেজের আইনের জটিলতা সম্পর্কে ১৩০১ সালে 'আমাদের প্রতিকার' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বললেন, 'আইন এতই জটিল, সাক্ষ্য এতই পিচ্ছল এবং দেশীয় চরিত্র-জ্ঞান মমত্বহীন অবজ্ঞাকারী বিদেশীয়ের পক্ষে এতই দুর্লভ যে অনিশ্চিতফল মকদ্দমা অনেকটা জুয়াখেলার মতো বোধ হয়।'

১৩০৫ সালে 'প্রসঙ্গকথা'য় রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'ক্ষমতা যাহার হস্তে বিচারের শেষ ফল সেই দিতে পারে। আমাদের মন বিগড়াইয়া গেলে আমরা কাগজে দু-চার কথা বলিতে পারি, কিন্তু কর্তৃপক্ষের মন বিগড়াইয়া গেলে তাঁহারা আমাদের কাগজের গলা চাপিয়া ধরিতে পারেন। আমরা ক্ষুব্ধ হইলে তাহা রাজবিদ্রোহ। কিন্তু রাজারা রুখিয়া থাকিলে তাহা কি প্রজাবিদ্রোহ নহে। উভয়েরই ফল কি রাজ্যের পক্ষে সমান অমঙ্গলজনক নহে।…

দেশীয় লোককে হত্যা করিয়া এ পর্যন্ত বাংলাদেশে কেবল বহুকাল পূর্বে একজন ইংরাজের ফাঁসি হইয়াছিল। রবীন্দ্রনাথ একটি ঘটনার উল্লেখ করেন 'একটি গোরা পুনা-রাজপথে বায়ু-বন্দুক ছুঁড়িয়া আমোদ করিতেছিল, তাহার বিবরণ কাগজে প্রকাশিত হইয়াছে। তিনজনের গায়ে গুলি লাগে। …অপরাধী স্বীকার করিয়াছে যে, 'He fired at a coffee shop sweeper for a lark' অর্থাৎ, সে কেবলমাত্র মজা করিয়া একজন কফি-দোকানের ঝাড়–দারকে গুলি করিয়াছিল। এই গুলি ঝাড়–দারের গাত্রে অধিক দূর প্রবেশ করে নাই, কিন্তু এইরূপ মজা ভারতবর্ষের মর্মের মধ্যে গভীররূপে নিহিত হইয়া থাকে।'

রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'আমাদের প্রতি সাধারণ ইংরাজের এইপ্রকার ভাবই প্রজাবিদ্রোহের ভাব। তাঁহারা আচারে ব্যবহারে ভাষায় ভঙ্গিতে সর্বদাই আমাদের মর্মস্থানকে ক্ষুব্ধ করিতেছেন। এমন-কি, তাঁহাদের মধ্যে এমন মূঢ়চেতারও অভাব নাই যাঁহারা অসহ্য অবজ্ঞার আঘাতে প্রজাহদয়ে অপমানক্ষত সর্বদা জাগাইয়া রাখাই রাজনৈতিক হিসাবে কর্তব্য জ্ঞান করেন। তাঁহারা পথে চলিতে চাবুক তুলিয়া সেলাম শিখাইতে শিখাইতে অগ্রসর হন।'

'স্বদেশী সমাজ' প্রবন্ধের পরিশিষ্ট-এ ১৩১১ সালের আশ্বিনে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ইংরাজের আইন আমাদের সমাজরক্ষার ভার লইয়াছে। হয়তো যথার্থভাবে রক্ষা করিতেছে, কিন্তু তাই বুঝিয়া খুশি থাকিলে চলিবে না। পূর্বকালে সমাজবিদ্রোহী সমাজের কাছে দণ্ড পাইয়া অবশেষে সমাজের সঙ্গে রফা করিত। সেই রফা-অনুসারে আপসে নিষ্পত্তি হইয়া যাইত।'

আইনের দ্বারা সংস্কার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'কোনো কোনো সামাজিক প্রথাকে অনিষ্টকর জ্ঞান করিয়া আমরা ইংরাজের আইনকে ঘাঁটাইয়া তুলিয়াছি, তাহাও কাহারও অগোচর নাই। যেদিন কোনো পরিবারে সন্তানদিগকে চালনা করিবার জন্য পুলিসম্যান ডাকাতে হয়, সেদিন আর পরিবাররক্ষার চেষ্টা কেন। সেদিন বনবাসই শ্রেয়।'

১৩১২ সালে 'অবস্থা ও ব্যবস্থা'-য় রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন করেন, 'যাহাতে মামলা মকদ্দমায় লোকের চরিত্র ও সম্বল নষ্ট না হইয়া সহজ বিচারপ্রণালীতে সালিস নিষ্পত্তি দেশে চলে তাহার ব্যবস্থা করা কি আমাদের সাধ্যাতীত?'

রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'একসময় পঞ্চায়েৎ আমাদের দেশের জিনিস ছিল, এখন পঞ্চায়েৎ গবর্মেন্টের আপিসে-গড়া জিনিস হইতে চলিল। যদি ফল বিচার করা যায় তবে এই দুই পঞ্চায়েতের প্রকৃতি একেবারে পরস্পরের বিপরীত বলিয়াই প্রতীত হইবে। যে পঞ্চায়েতের ক্ষমতা গ্রামের লোকের স্বতঃপ্রদত্ত নহে, যাহা গবর্মেন্টের দত্ত, তাহা বাহিরের জিনিস হওয়াতেই গ্রামের বক্ষে একটা অশান্তির মতো চাপিয়া বসিবে–তাহা ঈর্ষার সৃষ্টি করিবে–এই পঞ্চায়েৎপদ লাভ করিবার জন্য অযোগ্য লোকে এমন সকল চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইবে যাহাতে বিরোধ জন্মিতে থাকিবে– পঞ্চায়েৎ ম্যাজিস্ট্রেটবর্গকেই স্বপক্ষ এবং গ্রামকে অপর পক্ষ বলিয়া জানিবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট বাহবা পাইবার জন্য গোপনে অথবা প্রকাশ্যে গ্রামে বিশ্বাসভঙ্গ করিবে–ইহারা গ্রামের লোক হইয়া গ্রামের চরের কাজ করিতে বাধ্য হইবে এবং যে পঞ্চায়েৎ এ দেশে গ্রামের বলস্বরূপ ছিল সেই পঞ্চায়েৎই গ্রামের দুর্বলতার কারণ হইবে।'

১৩১৫ সালে 'সমস্যা'-য় রবীন্দ্রনাথ বলেন: ''ইংরেজের গায়ে জোর আছে বলিয়াই মানবপ্রকৃতিকে মানিয়া চলা কি তাহার পক্ষে একেবারেই অনাবশ্যক। ভারতবর্ষে চাঞ্চল্য-নিবারণের পক্ষে ভারতের পেনশনভোগী এলিয়টের কি তাঁহার জাতভাইকে একটি কথাও বলিবার নাই। যাহাদের হাতে ক্ষমতা অজস্র তাহাদিগকেই আত্মসম্বরণ করিতে হইবে না, আর যাহারা স্বভাবতই অক্ষম শমদমনিয়মসংযমের সমস্ত ব্যবস্থা কেবল তাহাদেরই জন্য।''…
তিনি বলেন, ''ভারতবর্ষে ইংরেজের গায়ে যাহারা হাত তোলে তাহারা যাহাতে কোনোমতেই নিষ্কৃতি না পায় সেজন্য সতর্ক হইতে হইবে। আর যে-সকল ইংরেজ ভারতবর্ষীয়কে হত্যা করিয়া কেবলই দণ্ড হইতে অব্যাহতি পাইয়া ব্রিটিশবিচার সম্বন্ধে চিরস্থায়ী কলঙ্কের রেখা আগুন দিয়া ভারতবর্ষের চিত্তে দাগিয়া দাগিয়া দিতেছে তাহাদের সম্বন্ধেই সতর্ক হইবার কোনো প্রয়োজন নাই?''

'কেবল ইংরেজের রক্তচক্ষু পিনাল-কোডই ভারতবর্ষে শান্তিবর্ষণ করিতে পারে এত শক্তি ভগবান ইংরেজের হাতে দেন নাই। ইংরেজ জেলে দিতে পারে, ফাঁসি দিতে পারে, কিন্তু স্বহস্তে অগ্নিকাণ্ড করিয়া তুলিয়া তার পরে পদাঘাতের দ্বারা তাহা নিবাইয়া দিতে পারে না– যেখানে জলের দরকার সেখানে রাজা হইলেও তাহাকে জল ঢালিতে হইবে। তাহা যদি না করে, নিজের রাজদণ্ডকে যদি বিশ্ববিধানের চেয়ে বড়ো বলিয়া জ্ঞান করে, তবে সেই ভয়ংকর অন্ধতাবশতই দেশে পাপের বোঝা স্তূপীকৃত হইয়া একদিন সেই ঘোরতর অসামাঞ্জস্য একটা নিদারুণ বিপ্লবে পরিণত না হইয়া থাকিতেই পারে না।'

যেখানে শাসয়িতা ও শাসিত পরস্পর দূরবর্তী হইয়া থাকে, উভয়ের মাঝখানে প্রয়োজনের অপেক্ষা উচ্চতর আত্মীয়তর কোনো সম্পর্ক স্থাপিত হইতে বাধা পায়, সেখানে রাষ্ট্রব্যাপার যদি অত্যন্ত ভালোও হয় তবে তাহা বিশুদ্ধ আপিস-আদালত এবং নিতান্তই আইনকানুন ছাড়া আর কিছু হইতেই পারে না।… শাসয়িতা ও শাসিত পরস্পর বিচ্ছিন্ন থাকাতে যে জীবনহীন শুষ্ক শাসনপ্রণালী ঘটা একেবারেই অনিবার্য, ভারতের ভাগ্যে তাহা ঘটিয়াছে সে কথা কেহই অস্বীকার করিতে পারে না।

রবীন্দ্রনাথ অতিশয় পন্থা পছন্দ করতেন না। সন্ত্রাসবাদ তাঁর পক্ষে গ্রহণ করা অসম্ভব ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উইলসনকে এক পত্রে রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'আমি এমন স্বদেশপ্রেমে বিশ্বাস করি না যা মানবতার উচ্চতর আদর্শ মাড়িয়ে যায়। গোপন মিথ্যা ও প্রচণ্ড অসৎকর্মপূর্ণ কোনো সেবা নিজের দেশকে উৎসর্গ করাকে আমি এক অধর্মের কাজ মনে করি।'

১৩১৩ সালের জ্যেষ্ঠের বঙ্গদর্শন-এ রবীন্দ্রনাথ বয়কটকে দুর্বলের প্রয়াস নয়, দুর্বলের কলহ বলে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, ইংরেজ ধৈর্য্যরে ওপর 'ভাবিয়া দেখো দেখি, ইংরেজের উপরে আমাদের কতখানি শ্রদ্ধা, কতখানি ভরসা জমিয়া উঠিয়াছে যে আমরা ঠিক করিয়া বসিয়াছিলাম যে, আমরা বন্দেমাতরাম হাকিয়া তাহাদের দক্ষিণ হাতে আঘাত করিব তবু তাহাদের সেই হাতের ন্যায়দণ্ড অন্যায়ের দিকে কিছুমাত্র টলিবে না।

কিন্তু এই সত্যটা আমাদের জানা দরকার যে, ন্যায়দণ্ডটা মানুষের হাতেই আছে, এবং ভয় বা রাগ উপস্থিত হইলেই সে হাত টলে। আজ নিম্ন-আদালত হইতে শুরু করিয়া হাইকোর্ট পর্যন্ত স্বদেশী মামলায় ন্যায়ের কাঁটা যে নানা ডিগ্রির কোণ লইয়া হেলিতেছে, ইহাতে আমরা যতই আশ্চর্য হইতেছি ততই দেখা যাইতেছে আমরা হিসাবে ভুল করিয়াছিলাম।'

রবীন্দ্রনাথ গান্ধীর অসহযোগ আইন অমান্য আন্দোলন সমর্থন করেননি। তাঁর চার অধ্যায় ও ঘরে বাইরে উপন্যাসদ্বয়ের জন্য কড়া সমালোচনা করা হলেও হিজলি কারাগারের বন্দিরা তাঁকে 'বন্ধনবিমূঢ় অবমানিতের মর্মবেদনাকে ভাষা দান করিয়াছ তুমি হে দরদী' বলে তাঁকে তাঁর জন্মদিনে অভিনন্দন জানান।

২৭ মাঘ ১৩৩৩ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে তাঁর পথের দাবী'র বাজেয়াপ্তি প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: 'বইখানি উত্তেজক। অর্থাৎ ইংরেজের শাসনের বিরুদ্ধে পাঠকের মনকে অপ্রসন্ন করে তোলে। লেখকের কর্তব্যের হিসাবে সেটা দোষের না হতে পারে–কেননা লেখক যদি ইংরেজরাজকে গর্হণীয় মনে করেন তাহলে চুপ করে থাকতে পারেন না। কিন্তু চুপ করে না থাকার যে বিপদ আছে সেটুকু স্বীকার করাই চাই। ইংরেজরাজ ক্ষমা করবেন এই জোরের উপরেই ইংরেজরাজকে আমরা নিন্দা করব সেটাতে পৌরুষ নেই। আমি নানা দেশে ঘুর এলেম–আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে এই দেখলেম একমাত্র ইংরেজ গবর্মেন্ট ছাড়া স্বদেশী বা বিদেশী প্রজার বাক্যে বা ব্যবহারে বিরুদ্ধতা আর কোনো গবর্মেন্টই এতটা ধৈর্যের সঙ্গে সহ্য করে না।… শক্তিমানের দিক দিয়ে দেখলে তোমাকে কিছু না বলে তোমার বইকে চাপা দেওয়া প্রায় ক্ষমা। অন্য কোনো প্রাচ্য বা প্রতীচ্য বিদেশী রাজার দ্বারা এটি হত না।…কিন্তু তাই বলে কি কলম বন্ধ করতে হবে? আমি তা বলিনে–শাস্তিকে স্বীকার করেই কলম চলবে।… তুমি যদি কাগজে রাজবিরুদ্ধ কথা লিখতে তাহলে তার প্রভাব স্বল্প ও ক্ষণস্থায়ী হত–কিন্তু তোমার মত লেখক গল্পচ্ছলে যে কথা লিখবে তার প্রভাব নিয়ত চলতেই থাকবে–দেশে ও কালে তার ব্যাপ্তির বিরাম নেই– অপরিণত বয়সের বালকবালিকা থেকে আরম্ভ করে বৃদ্ধরা পর্যন্ত তার প্রভাবের অধীনে আসবে। এমন অবস্থায় ইংরেজরাজ যদি তোমার বই প্রচার বন্ধ করে না দিত তাহলে এই বোঝা যেত যে সাহিত্যে তোমার শক্তি ও দেশে তোমার প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে তার নিরতিশয় অবজ্ঞা ও অজ্ঞতা।'

এই চিঠি পেয়ে শরৎচন্দ্রের খুশি হওয়ার কথা নয়। রবীন্দ্রনাথকে লেখা তাঁর একটি চিঠির খসড়ায় (চিঠিটা শেষ পর্যন্ত পাঠানো হয়নি) লেখা ছিল, 'আমার প্রশ্ন, ইংরাজ রাজশক্তির এ বই বাজেয়াপ্ত করার জাস্টিফিকেশন যদি থাকে, পরাধীন ভারতবাসীর পক্ষে প্রোটেস্ট করারও জাস্টিফিকেশন তেমনি আছে।'

৭ জুন ১৯৩০ ইংল্যান্ডের স্পেকটেটর পত্রিকায় প্রকাশিত একটি পত্র-প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ''ধ্বংস সাধনে অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন জাতি ও নিরস্ত্রজাতির মধ্যে সংঘর্ষ উপস্থিত হলে যেরূপ নিগ্রহভোগের সম্ভাবনা, ব্রিটিশ শাসনে আমাদের ভাগ্যে তা ঘটেনি। অন্য কোনো সাম্রাজ্যতান্ত্রিক শাসনে এর চেয়ে অনেক অধিক লাঞ্ছনা ভোগ করতে হতো তা নিশ্চিত।''

১৯৩০ সালে রাশিয়ার চিঠি-র উপসংহারে রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'কঠিন বেদনার অবস্থাতেও এ কথা আমি কখনো অস্বীকার করি নে যে, ইংরাজের স্বভাবে ঔদার্য আছে, বিদেশীয় শাসনকার্যে অন্য য়ুরোপীয়দের ব্যবহার ইংরেজের চেয়েও কৃপণ এবং নিষ্ঠুর। ইংরেজ জাতি ও তার শাসননীতি সম্বন্ধে বাক্যে ও আচরণে আমরা যে বিরুদ্ধতা প্রকাশ করে থাকি তা আর কোনো জাতের শাসনকর্তাদের সম্বন্ধে সম্ভবপর হত না; যদি বা হত তবে তার দণ্ডনীতি আরো অনেক দুঃসহ হত, স্বয়ং য়ুরোপে এমনকি আমেরিকাতেও তার প্রমাণের অভাব নেই। প্রকাশ্যভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করেও রাজপুরুষদের কাছে পীড়িত হলে আমরা যখন সবিস্ময়ে নালিশ করি তখন প্রমাণ হয় যে, ইংরেজ জাতির প্রতি আমাদের নিগূঢ় শ্রদ্ধা মার খেতে খেতেও মরতে চায় না। আমাদের স্বদেশী রাজা বা জমিদারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা আরো অনেক কম।'

ইংল্যান্ডে থাকার সময় রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করেন, 'ভারতবর্ষে দণ্ডবিধানব্যাপারে গ্লানিজনক ঘটনা ইংরেজ খবরের কাগজে প্রায় কিছুই এসে পৌছত না। তার একমাত্র কারণ এ নয়, পাছে য়ূরোপ ও আমেরিকায় নিন্দা রটে। বস্তুত কড়া ইংরেজ শাসনকর্তা স্বজাতির শুভবুদ্ধিকেই ভয় করে। বেশ করেছি, খুব করেছি, দরকার ছিল জবরদস্তি করবার–এটা বুক ফুলিয়ে বলা ইংরেজের পক্ষে সহজ নয়, তার কারণ ইংরেজের মধ্যে বড়ো মন আছে। ভারতবর্ষ সম্বন্ধে আসল কথাগুলো ইংরেজ খুব কম জানে। নিজেদের উপর ধিক্কার দেবার কারণ চাপা থাকে। এ কথাও সত্য, ভারতের নিমক দীর্ঘকাল যে খেয়েছে তার ইংরেজি যকৃত এবং হৃদয় কলুষিত হয়ে গেছে অথচ আমাদের ভাগ্যক্রমে তারাই হল অথরিটি।'

১৩৪০ সালে কালান্তর-এ ইংরেজি আইন সম্পর্কে বলছেন, 'নতুন শাসনে যে-আইন এল তার মধ্যে একটি বাণী আছে, সে হচ্ছে এই যে, ব্যক্তিভেদে অপরাধের ভেদ ঘটে না। সমাজে উচিত-অনুচিতের ওজন, শ্রেণীগত অধিকারের বাটখারাযোগে আপন নিত্য আদর্শের তারতম্য ঘটাতে পারবে না, এ কথাটা এখনো আমরা সর্বত্র অন্তরে অন্তরে মেনে নিতে পেরেছি তা নয়, তবু আমাদের চিন্তায় ও ব্যবহারে অনেকখানি বিপ্লব এনেছে সন্দেহ নেই। সমাজ যাদের অস্পৃশ্যশ্রেণীতে গণ্য করেছে তাদেরও আজ দেবালয় প্রবেশে বাধা দেওয়া উচিত নয়, এই আলোচনাটা তার প্রমাণ।'

ওই ইংরেজের ল অ্যান্ড অর্ডারের সমালোচনা করে রবীন্দ্রনাথ বললেন, 'আজ ইংরেজ-শাসনের প্রধান গর্ব 'ল' এবং 'অর্ডার', বিধি এবং ব্যবস্থা নিয়ে। এই সুবৃহৎ দেশে শিক্ষার বিধান, স্বাস্থ্যের বিধান অতি অকিঞ্চিৎকর, দেশের লোকের দ্বারা নব নব পথে ধন-উৎপাদনের সুযোগ-সাধন কিছুই নেই। অদূর ভবিষ্যতে তার যে সম্ভাবনা আছে, তাও দেখতে পাই নে, কেননা দেশের সম্বল সমস্তই তলিয়ে গেল 'ল' এবং 'অর্ডারের' প্রকাণ্ড কবলের মধ্যে। যূরোপীয় নবযুগের শ্রেষ্ঠদানের থেকে ভারতবর্ষ বঞ্চিত য়ূরোপেরই সংস্রবে। নবযুগের সূর্যমণ্ডলের মধ্যে কলঙ্কের মতো রয়ে গেল ভারতবর্ষ।'
অনুরূপভাব রবীন্দ্রনাথ একাধিকবার প্রকাশ করেছেন। তিনি ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯২৫ সালে পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারিতে বলছেন, ল অ্যান্ড অর্ডার রক্ষা হচ্ছে দারোয়ানিতন্ত্র, পালোয়ানের পালা; সিম্প্যাথি অ্যান্ড রেস্পেক্ট্ হচ্ছে ধর্মতন্ত্র, মানুষের নীতি।

'অবিচার করতে চাই নে, রাজ্যশাসন মাত্রেই ল অ্যান্ড অর্ডার চাই। নিতান্ত স্নেহপ্রেমের এলাকাতেও কানমলার বরাদ্দ থাকে। রাজ্যে ছট্ফটানি বৃদ্ধি হলে সাধারণ দণ্ডবিধি অসাধারণ অবৈধ হয়ে উঠলেও দোষ দিই নে। একপক্ষে দুরন্তপনা ঘটলে অন্যপক্ষে দৌরাত্ম ঘটা শক্তিমানের পক্ষে গৌরবের বিষয় না হলেও সেটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া যেতে পারে। আসল কথা, কোনো শাসনতন্ত্রকে বিচার করতে হলে সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রকৃতি বিচার করা চাই।

যদি শাসনকর্তা জিজ্ঞাসা করেন, 'তোমরা কি চাও না দেশে ল অ্যান্ড অর্ডার থাকে, আমি বলি, 'খুবই চাই, কিন্তু লাইফ অ্যান্ড মাইণ্ড তার চেয়ে কম মূল্যবান নয়।' মানদণ্ডের একটা পাল্লায় বিশ পঁচিশ মণ বাটখারা চাপানো দোষের নয়, অন্য পাল্লাটাতে যে মাল চাপানো হয় তাতে যদি আমাদের নিজের স্বত্ব কিছু থাকে। কিন্তু যখন দেখি এ পক্ষের দিকটাতেই যত রাজ্যের ইটপাথর, আর মালের পনেরো আনাই হলো অন্য পক্ষের দিকে, তখন ফৌজে পুলিশে গড়া মানদণ্ডটা অপমানদণ্ড বলেই ঠেকে। নালিশ আমাদের পুলিসের বিরুদ্ধে নয়, নালিশ আমাদের এই ওজনের বিরুদ্ধে; নালিশ-আগুন জ্বলে বলে নয়, রান্না চড়ানো হয় না বলে। বিশেষত, সেই আগুনের বিল যখন আমাদেরই টোকাতে হয়। চুল্লিতে কাঠের খরচটাই এত সর্বনেশে হয়ে ওঠে যে হাঁড়িতে চাল ডাল জোগাবার কড়ি বাকি থাকে না। সেই অবস্থায় যখন পেটের জ্বালায় চোখে জল আসে তখন যদি কর্তা রাগ করে বলেন 'তবে কি চুলোতে আগুন জ্বালব না', ভয়ে ভয়ে বলি, 'জ্বালবে বৈকি, কিন্তু ওটা যে চিতার আগুন হয়ে উঠল।'

১৩৪০ সালে কালান্তর-এ ইংরেজের বিচার সম্পর্কে বলেন: 'আজ আমরা মরতে মরতেও ইংরেজ-শাসনের বিচার করতে পারি ন্যায়-অন্যায়ের আদর্শে, এ কথা মনে করিনে, কোনো দোহাই পেড়ে শক্তিমানকে অসংযত শক্তি সংহরণ করতে বলা অশক্তের পক্ষে স্পর্ধা। বস্তুত ন্যায়-আদর্শের সর্বভূমীনতা স্বীকার করে এক জায়গায় ইংরেজরাজের প্রভূত শক্তি আপনাকে অশক্তের সমানভূমিতেই দাঁড় করিয়েছে। …আমরা সেদিন ভারতের স্বাধীনতার প্রত্যাশা মনে স্পষ্টভাবে লালন করতে আরম্ভ করেছি। সেই প্রত্যাশার মধ্যে এক দিকে যেমন ছিল ইংরেজের প্রতি বিরুদ্ধতা, আর এক দিকে ইংরেজ চরিতের প্রতি অসাধারণ আস্থা। কেবলমাত্র মনুষ্যত্বের দোহাই দিয়ে ভারতের শাসন-কর্তৃত্বে ইংরেজের শরিক হতেও পারি এমন কথা মনে করা যে সম্ভব হয়েছিল, সেই জোর কোথা থেকে পেয়েছিলেম। কোন যুগ থেকে সহসা কোন যুগান্তরে এসেছি। মানুষের মূল্য, মানুষের শ্রদ্ধেয়তা হঠাৎ এত আশ্চর্য বড়ো হয়ে দেখা দিল কোন শিক্ষায়। অথচ আমাদের নিজের পরিবারে প্রতিবেশে, পাড়ায় সমাজে, মানুষের ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য বা সম্মানের দাবি, শ্রেণীনির্বিচারে ন্যায়সংগত ব্যবহারের সমান অধিকারতত্ত্ব এখনো সম্পূর্ণরূপে আমাদের চরিত্রে প্রবেশ করতে পারেনি।

২৮ জুলাই ১৯৩৬ প্রমথ চৌধুরীকে লিখিত এক পত্রে রবীন্দ্রনাথ বলেন: 'আমি অনেকবার বলেছি যে পরজাতির শাসনভারপ্রাপ্ত সমস্ত য়ুরোপীয় জাতির মধ্যে ইংরেজকেই আমি সবচেয়ে শ্রদ্ধা করি। ওদের সঙ্গে আমাদের যে রকম অস্বাভাবিক সম্বন্ধ তাতে এই শ্রদ্ধার কথা আমাদের পক্ষে বলা কঠিন এবং আমাদের পক্ষে শোনা শ্রুতিসুখকর নয়। সম্প্রতি আমাদের প্রতিবেশে এমন অনেক নিদারুণ ঘটনা ঘটেছে যার সঙ্গে ওদের সংযোগ প্রত্যক্ষ হয়েছিল অথচ যা উচ্চারণ করবার অধিকার যুবকেরাই ভোগ করেছে। এই কারণগুলোতে বাংলাদেশের যুবকদের মনের দৃষ্টি তীব্রভাবে কলুষিত হয়ে গেছে।

তৎসত্ত্বেও বলতে হবে ইংরেজকে বিচার করবার সময়ে এই সমস্ত অভ্যুৎপাতকেও একান্ত করে দেখলে চলবে না। য়ুরোপে আরো কয়েকটি বড়ো বড়ো মহাজাতি আছে পরদেশীয়দের শাসন করবার ক্ষেত্র আছে তাদের অধীনে। তারা যে আমাদের শাসনকর্তা নয় অন্তত এ কথাটা আরামের দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেই স্বীকার করতে হবে। আমি আজ যা লিখছি, এবং আমাদের রাষ্ট্রসভায় ভারত শাসননীতি সম্বন্ধে অধীন জাতির বক্তব্য যে পরিমাণ স্বাধীনতার সঙ্গে আলোচিত হয়ে থাকে, পাশ্চাত্য শাসিত অন্য কোনো দেশেই তা সম্ভবপর হতো না। এখানে সীডিশনের সীমা যেখানে আরম্ভ অন্যত্র সেটা তার অনেক পশ্চাতে সে কথা ভুলে থাকি বলে উষ্মাপ্রকাশের সময় আমাদের বিভ্রম জন্মায় যে জোরটা আমাদেরই; জোরটা যে অপর পক্ষের ধৈর্য এবং পৌরুষে সেটা আমাদের মনে চাপা থাকে। …রাগ করলে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ নিজের জাতিধর্ম যতই বিস্মৃত হোন তবু তার মধ্যে লজ্জাশরমের কিছু জায়গা থাকে। কেন না ওদের জাতের মধ্যে যারা যথার্থ বড়ো এবং সেই কারণে যারা তার প্রতিনিধি তাদের কাছে জবাবদিহি আছে। এই হেতু রাজপুরুষেরা জোর করে বলতে পারে না আমাদের যা খুশি তাই করব। ইংরেজের মধ্যে মনুষ্যত্বের যে আদর্শ আছে কার্যগতিকে সেই আদর্শ থেকে যারা ভ্রষ্ট হয় তারাও বাহুবলের স্পর্ধার সেই আদর্শের প্রকাশ্য অবমাননা করতে পারে না। তাঁরা স্বজাতিকৃত বা পরজাতিকৃত অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে কুণ্ঠিত হন না। তারা হয়তো রাষ্ট্রনীতিক নন কিন্তু যাঁরা রাষ্ট্রনীতিক তারা কী জাপান কী য়ুরোপে সমগ্র জাতির যথার্থ প্রতিনিধি বলে গণ্য হতে পারত না। ইংলণ্ডে রাষ্ট্রচালকেরা যদি তাদের দেশের মহত্তর দলের বিচারবুদ্ধিকে নগণ্য করতে পারতেন তা হলেই মনুষ্যত্বের উচ্চ আদর্শ আজ হয়তো তাদের দ্বারা ভূমিসাৎ হতে পারত। যেমন হয়েছে জার্মানিতে, ইটালিতে, যেমনটা ঘটাতে হাত নিশপিশ করেছে ইংলণ্ডের নবদন্তোদগত ফ্যাসিস্টদের। বলা যায় না কালক্রমে ইংলন্ডে যদি এই ফ্যাসিস্টের রাস্তাই প্রশস্ত হয় তা হলে আন্দামানে লোকবিরলতা ঘটবে না এবং কৌন্সিলের সকল সভ্যেরই বুলি সমান নম্রমধূর হয়ে উঠবে, যেমন হয়েছে জার্মানিতে, যেমন হয়েছে ইতালিতে।'

১৩৪৪ সালে আইন-আদালত, অভিজ্ঞ বিচারক ও বিশেষজ্ঞ আইনজীবীর প্রয়োজনের কথা বলতে গিয়ে বিচারপদ্ধতির সীমাবদ্ধতারও কথা উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'প্রচলিত দণ্ডনীতি'তে: 'একটা কথা মনে রাখতে হবে, কোনো অপরাধীকে দণ্ড দেবার পূর্বে আইনে বাঁধা অত্যন্ত সতর্ক বিচারের প্রণালী আছে। এই সভ্যনীতি আমরা পেয়েছি ইংরেজের কাছ থেকে। এই নীতির 'পরে আমাদের দাবি অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আমাদের কাছে সহজ হয়েছে যে, অপরাধের অপবাদ-আরোপের পর থেকেই কোনো অভিযুক্তের প্রতি অন্যায় করা সহজ ছিল যে যুগে সে যুগের দণ্ডনীতি সভ্য আদর্শের ছিল না; মানুষের স্বাধীনতার অধিকার তখন অনিশ্চিত ভিত্তিতে স্থাপিত ছিল। সভ্যদেশে এ কথাও স্বীকৃত হয়েছে যে, অপরাধের নিঃসংশয় প্রমাণের জন্য প্রমাণতত্ত্বের অনুশাসনের ভিতর দিয়ে বৈধ সাক্ষ্যের সন্ধানও বিশ্লেষণের জন্য অভিজ্ঞ বিচারক ও বিশেষজ্ঞ আইনজীবীর প্রয়োজন আছে। এই বিশ্বাসের 'পরে যদি আস্থা না রাখি তা হলে আইন-আদালতকে প্রকাণ্ড অপব্যয়ের খেলা বলতে হবে। এই ব্যবস্থার মধ্যে নির্বিশেষে সকল মানুষের 'পরে যে সম্মান আছে এতদিন ধরে সেই নীতিকে শ্রদ্ধা করতে শিখছি। এও জানি, এত সাবধান হয়েও অনেক ঘটনায় অপরাধের শেষ মীমাংসা হয়নি। বহু নির্দোষী দণ্ডভোগ করেছে।'

রবীন্দ্রনাথ তার প্রমথ চৌধুরীকে লেখা ২০ জুলাই ১৯৩৬ তারিখের এক চিঠিতে বলেন: 'আমাদের দেশের লোক কেউ কেউ বিরক্ত হয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন ইংরেজ জাতির প্রতি তোমার শ্রদ্ধা যদি এতই তবে ভারতে ইংরেজ শাসনের চিরন্তনতা কামনা করো না কেন? আমার উত্তর এই, ইম্পীরিয়ালিজমের বিরাট জালে জড়িত বিদেশী রাজ্যশাসন ভারতের পক্ষে স্বভাবতই অশুভকর। এম্পায়ার বলতে যদি এক অখণ্ড কলেবর বোঝাত তা হলে তত বেশি ভাবনার কারণ থাকত না। '

যে রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ শাসনকে এক সময় বিধির বিধান বলতেন এবং তা ট্রাস্টি বা অছির মর্যাদায় মহিমামণ্ডিত করতেন তিনিই আবার ১৩৪৮ সালে সভ্যতার সংকট-এ বলছেন: 'এই বিদেশীয় সভ্যতা, যদি একে সভ্যতা বলো, আমাদের কী অপহরণ করেছে তা জানি; সে তার পরিবর্তে দণ্ড হাতে স্থাপন করেছে যাকে নাম দিয়েছে Law and Order, বিধি এবং ব্যবস্থা, যা সম্পূর্ণ বাইরের জিনিস, যা দারোয়ানি মাত্র। পাশ্চাত্য জাতির সভ্যতা-অভিমানের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা অসাধ্য হয়েছে। সে তার শক্তিরূপ আমাদের দেখিয়েছে, মুক্তিরূপ দেখাতে পারেনি।'

প্রাক্তন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশমুক্ত অঞ্চলে আজও ইংরেজ আইনের প্রভাব প্রায় অক্ষুন্ন রয়েছে। সংশোধন ও সংস্কারের কথা বলে ভারতের আইন কমিশন ইংরেজের রেখে যাওয়া আইনকে দেশের আত্মীকৃত আইন বলে বিবেচনা করেছে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের হামুদুর রহমান আইন কমিশন অনুরূপ বক্তব্য রাখে। ঔপনিবেশিক বা ধর্মবিরুদ্ধ আইন হিসাবে ইংরেজের আইনে ঢেলে সাজানোর কথা মাঝেমধ্যে বলা হলেও সেই উদ্যোগ নেওয়ার মতো দেশে তেমন উৎসাহ বা সামর্থ্যরে উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। ইংরেজের আইন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যে সমালোচনা করেন তা উপনিবেশমুক্ত দেশগুলো সম্পর্কে এখনো প্রযোজ্য এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুঃখজনকভাবে প্রযোজ্য ও প্রাসঙ্গিক।

সম্প্রতি সংবিধানে স্বীকৃত অধিকার লঙ্ঘনের জন্য দুর্ভোগগ্রস্ত ব্যক্তিকে খেসারত দেওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশের সর্বোচ্চ আদালত নতুন নতুন প্রতিকারের ব্যবস্থা করছে। এই সময় আমরা সম্পূর্ণ উল্টো পন্থায় অধিকার লঙ্ঘনের দায় থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য প্রয়াস পাচ্ছি। আমাদের দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী 'এনকাউন্টার' বা 'ব্রাশফায়ারে' আইনবহির্ভূত হত্যার সাফাই দিতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের আত্মরক্ষার অধিকারের কথা বলেন। বিন্দুমাত্র অনুতাপ বা দুঃখপ্রকাশ নেই সেই কথায়। তদন্ত বা বিচার শেষে শাস্তি দেওয়ার কোনো দৃষ্টান্ত নেই। ঢালাওভাবে দায়মুক্তির এক কলঙ্কময় আইন পাস হয় ২০০৩ সালে।

দায়মুক্তির আইনেও মানবিক মনের ছাপ থাকতে পারে। একটা উদাহরণ দিই। ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের সামরিক আইন জারির প্রসঙ্গে ১৯১৯ সালে একটি দায়মুক্তি আইন পাস করা হয়। সামরিক বা বেসামরিক কোনো সরকারি কর্মকর্তা কারও সম্পত্তি অধিগ্রহণ বা ব্যবহার করে থাকলে তার ন্যায়সংগত খেসারত নির্ধারণের বিধান দেওয়া হয় সেই আইনে। ঐকমত্যের মাধ্যমে খেসারতের পরিমাণ নির্দিষ্ট করতে ব্যর্থ হলে জেলা জজের অধস্তন নয় এমন এক  বিচারীয় কর্মকর্তার দ্বারা ব্যাপারটা নিষ্পন্ন করারও বিধান দেওয়া হয়। এটা সেই সময়কার কথা, যখন দেশটা পরাধীন ছিল। সাংবিধানিক সরকার তখন থাকার কথা নয়। এখনকার মতো মানবাধিকারের প্রশ্নও তখন উচ্চারিত হতো না।

রবীন্দ্র-রচনায় আইনি ভাবনায় আমি যে মন্তব্য করেছি তার পুনরোক্তি করে আমার বক্তব্য এখানে শেষ করছি। এমনিতেই ঔপনিবেশিকতার প্রভাব থেকে ঔপনিবেশিক মনের মুক্তি পাওয়া কঠিন। ইংরেজ আইনের ক্ষেত্রে সেটা বিশেষভাবে সত্য। সেই আইনের সাফল্য এই যে, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিও যেন শেষপর্যন্ত তার প্রতি বিশ্বাস হারাতে পারে না, যদিও সেই শাসনের চিরন্তনতা কামনা করতে তার মন রাজি হয় না।
ইংরেজি আইনের সৌভাগ্য এই যে রবীন্দ্রনাথের মতোন প্রজার হাতে তার মূল্যায়ন হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য ঔপনিবেশিক আইনের প্রতিতুলনায় তিনি ইংরেজ আইনের মন্দের ভালোর দিকটা লক্ষ করেছেন, যদিও ইংরেজ, এমনকি 'বড়'-ইংরেজের, শাসনের পক্ষে তার মন সায় দিতে রাজি হয়নি।

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা