দিল্লির সিংহাসনে প্রথম বাঙালি এবং তাঁর ভূমিকা

আবদুল গাফফার চৌধুরী
Published : 22 August 2015, 04:26 PM
Updated : 22 August 2015, 04:26 PM

ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির পত্মী শ্রভ্রা মুখার্জি ৭৪ বছর বয়সে মারা গেছেন। দিল্লিতে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও হয়ে গেছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পরিবারের অনেক সদস্যসহ এই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে দিল্লি গিয়েছিলেন। তিনি ঢাকায় ফিরেও এসেছেন। প্রণব বাবু নিজে বাঙালি; বিয়েও করেছেন বাংলাদেশের নড়াইলে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন বাংলাদেশের একজন অকৃত্রিম বন্ধু। শেখ হাসিনার তিনি একজন অভিভাবকের মতো। দুই পরিবারের মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা।

সুতরাং ভারতের রাষ্ট্রপতির এই পত্মীবিয়োগের শোকে তাঁকে সান্তনা জানাতে শেখ হাসিনা ছুটে যাবেন এটা স্বাভাবিক। এটা আনুষ্ঠানিকতা নয়, আত্মীয়তা। প্রণব মুখার্জি ভারতের একজন প্রবীণ নেতা। একজন রাজনৈতিক প্রবাদ পুরুষ। তিনি ভারতে যখন যে কোনো পদেই থাকুন, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি সব সময় বাংলাদেশ, বিশেষ করে হাসিনা সরকার সম্পর্কে অনুকূল মনোভাব দেখিয়েছেন এবং সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন।

অনেকের ধারণা, ভারতের গত সাধারণ নির্বাচনে বিজেপির বিরাট জয়লাভ এবং নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী পদে বসার পরে বাংলাদেশের হাসিনা সরকার সম্পর্কে খুব একটা ভালো মনোভাব দেখাবেন না বলে যে আশঙ্কা বিরাজ করছিল, দুদেশের রাজনৈতিক মহলেই সেটা নিরসনে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির একটা বড় ভূমিকা ছিল। নরেন্দ্র মোদী শুরু থেকেই রাষ্ট্রপতি সম্প্রতিক অতীতের একজন শীর্ষ কংগ্রেস নেতা হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে আস্থায় গ্রহণ করেছেন এবং তাঁর পরামর্শমতো বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা ও উন্নয়নে আগ্রহী হয়েছেন।

হাসিনা-মোদী সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় প্রণব মুখার্জি কতটা অবদান রেখেছেন তার সবটা জানা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রণব মুখার্জির শুধু রাজনৈতিক নয়, কূটনৈতিক বুদ্ধির কথা অনেকেই জানেন। সুতরাং বাংলাদেশের সঙ্গে মৈত্রী প্রতিষ্ঠায় দিল্লির বিজেপি সরকারের সবিশেষ আগ্রহের পেছনে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির ভূমিকা রয়েছে বলে অনেকেই মনে করতে পারেন। ভারতের সঙ্গে যখন আমেরিকার সম্পর্ক ভালো নয়, বিশেষ করে ভারতে কংগ্রেস সরকারের আমলে, তখন সাবেক কংগ্রেস সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির উপর আমেরিকার তৎকালীন বুশ (জুনিয়র) প্রশাসনের সঙ্গে একটি ভারসাম্যমূলক মৈত্রী প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অর্জন করেছিলেন। প্রণব বাবু এই দায়িত্বটি ভালোভাবে পালন করেছিলেন।

প্রণব বাবু তাঁর রাজনৈতিক বুদ্ধি ও চাতুর্যের খেলা দেখিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতেও। এক সময় তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য কংগ্রেসেও ব্রাত্য ছিলেন। রাগ করে কংগ্রেস ছেড়ে বাংলা কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। নিজে আলাদা কংগ্রেস সংগঠন চালানোর চেষ্টা করেছেন। পরে কংগ্রেসে ফিরে এসেছেন। ইন্দিরা-তনয় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী তাঁকে ভালো চোখে দেখতেন না। ফলে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বে পৌঁছুতে তাঁর বিলম্ব হয়েছে। কিন্তু কংগ্রেস হাই কমান্ড তাঁকে উপেক্ষা করতে পারেনি। তাঁর কুটবুদ্ধি কংগ্রেসকে বহু বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছে।

পশ্চিমবঙ্গে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের মুখ্যমন্ত্রিত্ব ও কংগ্রেস সরকারের বিপর্যয়ের পর যখন রাজ্যে দলটির খুবই দুরবস্থা এবং বামফ্রন্টের জয়যাত্রা চলছে, তখন পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের অস্তিত্ব রক্ষার দায়িত্ব পড়ে প্রণব মুখার্জির উপরে। তিনি বামফ্রন্টের সঙ্গে ভাবসাব রক্ষা করে রাজ্যে কংগ্রেসের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখেন। দীর্ঘ সময় তিনি রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। বামফ্রন্ট সরকারের পতনের সূচনায় তিনি খুব কৌশলে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে গাঁটছড়া বাধেন এবং নির্বাচনে জয়ী হয়ে তৃণমূল সরকার গঠন করলে কংগ্রেস প্রথম দিকে এই সরকারের শরিক দল ছিল।

রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর প্রণব মুখার্জি ধীরে ধীরে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বে উঠে আসেন। কিন্তু একাধিকবার কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রীর পদটি তিনি পাবেন বলে কংগ্রেস দলে গুঞ্জন উঠলেও তিনি তা পাননি। এমনকি তাঁকে ডিঙিয়ে মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেছেন, প্রণব মুখার্জি হতে পারেননি। কেউ কেউ বলেন, বাঙালি বলেই অবাঙালিদের দ্বারা ভর্তি কংগ্রেস হাই কমান্ডে বাঙালি প্রণব মুখার্জির এই হেনস্তা। শেষ পর্যন্ত সোনিয়া গান্ধী তাঁকে সান্তনা পুরস্কার হিসেবে নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানের পদটিতে বসিয়েছেন। এই প্রথম দিল্লির সিংহাসনে একজন বাঙালির আরোহণ। রাষ্ট্রপরিচালনায় তাঁর ক্ষমতা যত সীমাবদ্ধ হোক, দিল্লির সিংহাসনে এই প্রথম একজন বাঙালি বসলেন, এই গৌরবে সকল বাঙালিই গর্বিত।

কংগ্রেস এখন ভারতে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় নেই বটে, কিন্তু তাদের মনোনীত রাষ্ট্রপতি এখনও ক্ষমতায় থাকায় দলটি সফল প্রভাব হারায়নি। অন্যদিকে নিজের দূরদর্শিতা দ্বারা প্রণব বাবু কংগ্রেস মনোনীত রাষ্ট্রপতি হলেও পদটির নিরপেক্ষ মর্যাদা রক্ষা করে চলেছেন এবং বিজেপি সরকার এবং তাঁর প্রধানমন্ত্রীর আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন। প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে ভারত শক্তিশালী বড় দেশ হওয়া সত্ত্বেও যে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে পারছে, তার পেছনে অভিজ্ঞ কূটনীতিক হিসেবে প্রণব বাবুর প্রভাব কাজ করছে বলে অনেকেরই ধারণা।

প্রণব মুখার্জি যখন ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন, তখন দিল্লির একটি দৈনিকে এক কলামিস্ট মন্তব্য করেছিলেন:

"ভারতের রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রী পদে বহু আগে প্রণব মুখার্জি অথবা জ্যোতি বসুর মতো একজন বাঙালির বসা উচিত ছিল। তাহলে ভারতের সেক্যুলার রাজনীতি ও তার ঐক্যে সম্ভবত এতটা বিপর্যয় দেখা দিত না। বাঙালিকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে রাখার জন্য উত্তর ভারতের অবাঙালি নেতারা সেই ব্রিটিশ আমল থেকে যে ঘোট পাকিয়েছেন তার ফলেই দেশ বিভক্ত হয়েছে। সেক্যুলার রাজনীতি ধীরে ধীরে দুর্বল ও ঐক্যহীন হয়েছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পেরেছে। ভারতের রাজনীতিতে বাঙালি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা পেলে হয়তো উপমহাদেশের আজ এই অবস্থা ঘটত না।"

এই কলামিস্ট (তার নামটা এখন আমি স্মরণ করতে পারছি না) তার বক্তব্যের সপক্ষে কিছু তথ্যের উল্লেখ করেছিলেন, তার বক্তব্য যতটা স্মরণ আছে তা থেকেই লিখছি। তিনি লিখেছিলেন, উত্তর ভারতের হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের শীর্ষনেতারাই ছিলেন বাঙালি নেতাদের সম্পর্কে ভীত। বাঙালি নেতারা সর্বভারতীয় নেতৃত্বে উঠে এলে তাদের নেতৃত্ব টিকবে না বলে তারা আশঙ্কা করতেন। এ জন্যে কংগ্রেসের অবিসম্বাদিত নেতা হওয়া সত্ত্বেও মহাত্মা গান্ধী সর্বভারতীয় নেতা হিসেবে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে কংগ্রেস নেতৃত্বে উঠে আসতে দেননি।

দেশবন্ধু বাধ্য হয়ে কংগ্রেস থেকে আলাদা হয়ে স্বরাজ্য পার্টি গঠন করেছিলেন। সুভাষ বসু গান্ধীর মনোনীত প্রার্থীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। গান্ধী কুটকৌশলে তাঁকে সভাপতি পদে থাকতে দেননি। সুভাষ বসু নিজস্ব দল ফরোয়ার্ড ব্লক গঠন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অতঃপর তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় দেশত্যাগ করেন।

কংগ্রেসে মহাত্মা গান্ধী বাঙালি নেতাদের অভ্যুদয় যেভাবে ঠেকাতে চেয়েছেন। একইভাবে নিখিল ভারত মুসলিম লীগে বাঙালি নেতাদের মাথা তুলতে দেননি লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। যে ফজলুল হকের কারণে অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা অর্জন করে এবং হক মন্ত্রিসভায় মুসলিম লীগ নেতারা স্থান পান, জিন্নাহ প্রথম সুযোগেই সেই ফজলুল হককে তুচ্ছ অজুহাতে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করেন এবং অবিভক্ত বঙ্গের তৎকালীন ব্রিটিশ গভর্নর স্যার জন হার্বার্টের ষড়যন্ত্রে হাত মিলিয়ে ওই মন্ত্রিসভার পতন ঘটান।

ফজলুল হকের পর মুসলিম লীগের অবাঙালি হাই কমান্ডের রোষের শিকার হন বাঙালি নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান ইস্যুতে অবিভক্ত ভারতে যে সাধারণ নির্বাচন হয়, তাতে পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশসহ অধিকাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের মুসলিম লীগ পরাজিত হয়। একমাত্র অবিভক্ত বাংলায় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অসাধারণ সাংগঠনিক শক্তি ও নেতৃত্বের গুণে মুসলিম লীগ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ের অধিকারী হয়। ঢাকার অবাঙালি নবাব পরিবারের খাজা নাজিমুদ্দীন এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। শহীদ সোহরাওয়ার্দী নবনির্বাচিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা নির্বাচিত হন এবং অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ গ্রহণ করেন।

কিন্তু তিনি বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। দেশভাগের প্রাক্কালে পূর্ব পাকিস্তানে (খণ্ডিত পূর্ববঙ্গে) একটি শিখণ্ডি তাঁবেদার সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য মুসলিম লীগের উত্তর ভারতীয় অবাঙালি নেতৃত্ব চক্রান্ত শুরু করেন এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বদলে ঢাকার অবাঙালি নবাব পরিবারের খাজা নাজিমুদ্দিনকে এনে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির নেতার পদে বসানো হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত-ভাগের সঙ্গে বাংলা ভাগ হলে তার পূর্বাংশ হয় পূর্ব পাকিস্তান। এই পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দিন। তার শিখণ্ডি সরকারই কেন্দ্রের কাছে নতজানু হয়ে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি বিনাশ এবং বাঙালিদের অধিকার হরণের পথে একটার পর একটা পদক্ষেপ নিতে থাকেন।

ভারতের একজন কলামিস্টের এই লেখা আমি দীর্ঘকাল আগে পড়েছি। উত্তর ভারতের শীর্ষ অবাঙালি নেতাদের মধ্যে বাঙালি নেতাদের সম্পর্কে চিরচেনা ও ভীতির কথাটি তখনই আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে নিজের কলামিস্ট জীবনে যখনই লেখাটির কথা মনে পড়েছে, মনে হয়েছে স্বাধীনতা-উত্তর যুগেও ভারত এবং পাকিস্তানে ক্ষমতা করায়ত্ত করা অবাঙালি নেতাদের মধ্যে বাঙালি নেতাদের ও বাঙালিদের সম্পর্কে এই বিরূপতা দূর হয়নি।

স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে বাঙালিদের সম্পর্কে এই বিরূপতা ও বৈষম্য ততটা প্রকট হয়ে ওঠেনি, যতটা প্রকট হয়েছে পাকিস্তানে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তবু একজন শক্তিশালী স্বাধীনচেতা বাঙালি নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে তাঁর মন্ত্রিসভায় গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি বেশিদিন মন্ত্রিপদে থাকতে পারেননি। পশ্চিমবঙ্গে ডা. বিধান চন্দ্র রায় দীর্ঘকাল মুখ্যমন্ত্রী পদে ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর আর কোনো স্বাধীনচেতা নেতাকে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের রাজ্য সরকারের নেতার পদে বসানো হয়নি।

ফলে বঙ্গীয় কংগ্রেসের স্বাধীনচেতা নেতারা বিদ্রোহী হন। অজয় মুখার্জি থেকে একাধিক কংগ্রেস নেতা দল ত্যাগ করেন। স্বতন্ত্র বাংলা কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তারা জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে অকংগ্রেসী সরকার গঠন করেন। পরে বামফ্রন্ট একাই ৩৪ বছর দিল্লির আধিপত্য অস্বীকার করে পশ্চিমবঙ্গে রাজত্ব করেছে। তারপর ক্ষমতায় এসেছে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে এখনও মাথা তুলতে পারেননি। বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি যখন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন, তখনও পশ্চিবঙ্গে কংগ্রেসের ভাগ্য ফেরেনি।

ভারতের উত্তর ভারতীয় অবাঙালি নেতাদের মধ্যে বাঙালি-বিরূপতা যতটা প্রকট হয়েছে, তার শতগুণ প্রকট হয়েছে পাকিস্তানে। ক্ষমতাসীন অবাঙালি (জিন্নাহ, লিয়াকত আলী দুজনই ছিলেন উত্তর ভারতীয়) নেতাদের মধ্যে। পাকিস্তানের প্রথম মন্ত্রিসভায় জিন্নাহ যখন গভর্নর জেনারেল হলেন, তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তানের একজন বাঙালি নেতার কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী পদে বসা উচিত ছিল। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দীর মতো নেতারা ছিলেন। জিন্নাহ তাদের ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন।

পাকিস্তানের প্রথম মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দেশরক্ষামন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদ বাঙালি নেতাদের দেওয়া হয়নি। বরং কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে (গণপরিষদে) সোহরাওয়ার্দীর সদস্যপদ বাতিল করে দিয়ে তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানেও বেশ কিছুকাল ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পরবর্তীকালে পাকিস্তানে অবাঙালি শাসকদের রাজস্ব নিরঙ্কুশ রাখার জন্য সব বাঙালি নেতা উচ্চ পদে উন্নীত হয়েছিলেন, তাদেরও একে একে বন্দুকের জোরে বরখাস্ত করা হয়।

খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের অবাঙালি শাসক কোটারির একান্ত বশংবদ ছিলেন। তাকে গণপরিষদে আস্থাভাজন প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বরখাস্ত করা হয়। বগুড়ার মোহাম্মদ আলী পাকিস্তানের অবাঙালি সামরিক শাসক গোষ্ঠীর 'হ্যান্ডপিকড' প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তাকেও প্রয়োজন ফুরানোর পর বরখাস্ত করে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সবশেষে শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তাঁকেও সামরিক জান্তার নির্দেশে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয়। এই নিরন্তর অবমাননার মধ্য দিয়েই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি তরুণ-মানস বিদ্রোহী হয়। ধর্মের দোহাই দিয়ে তাদের দাবিয়ে রাখা যায়নি। তারা বিদ্রোহ করেছে। একটি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে অবাঙালি আধিপত্য ও শোষণের অবসান ঘটিয়েছে।

পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান ইসলামাবাদে ক্ষমতাসীন উত্তর ভারতীয় (পরে পাঞ্জাবি) অবাঙালি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়েছে। অবিভক্ত বাংলায় অপর অংশ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি দিল্লির আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। স্বশাসন প্রতিষ্ঠা করেছে, তবে স্বাধীন হতে চায়নি। সম্ভবত চাইত যদি পাকিস্তানের শাসকদের মতো দিল্লিও পশ্চিমবঙ্গের ভাষা, সংস্কৃতি, স্বার্থ ও অধিকারের উপর অনবরত হামলা চালাত।

দিল্লির কংগ্রেস অথবা বিজেপি কোনো সরকার এই ভুলটা করেনি। তারা পশ্চিমবঙ্গকে দিল্লির নাগপাশ থেকে সরে গিয়ে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছে। ৩৪ বছর বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গে দিল্লির হুকুম বরদারি না করে শাসনকার্য চালিয়েছে। এখন চালাচ্ছে তৃণমূল। দিল্লির সকল হুকুম মানতে অ-রাজি এই দুই সরকারকেই কেন্দ্রের কংগ্রেস অথবা বিজেপি কোনো সরকারই কখনও বরখাস্ত করার চেষ্টা করেনি। যেটা পাকিস্তান করেছে পূর্ব পাকিস্তানে একটি সাধারণ নির্বাচনে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী দলের মন্ত্রিসভাকে বন্দুকের জোরে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে; ফজলুল হকের মতো বাঙালি গভর্নরকে অবমাননাকরভাবে বরখাস্ত করে। অথচ ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান পাশ হওয়ার পর এই শেরে বাংলা ফজলুল হকেরই পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রপতি (গভর্নর জেনারেল পদ বিলুপ্ত করে) হওয়ার কথা ছিল।

পাকিস্তান বাঙালির অধিকার ও মর্যাদা স্বীকার করেনি। তার খেসারত আজ দিচ্ছে। বাঙালি প্রণব মুখার্জিকে অনেক বিলম্বে হলেও রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়ে ভারত হয়তো সময় থাকতে এই ভুলটা শোধরাতে চাইছে। প্রণব বাবু ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে বসে সারা ভারতেরই জন-আস্থা যেমন অর্জন করেছেন, তেমনি বাংলাদেশের মানুষেরও আস্থা ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। সবচাইতে বড় কথা, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শিবির তাঁকে একটা আস্থা ও ভরসার স্থল হিসেবে ভাবে। বাংলাদেশের মতো ভারতের অন্যান্য প্রতিবেশি দেশের মানুষেরও শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস যদি তিনি ধরে রাখতে পারেন, তাহলে ভবিষ্যতে উপমহাদেশে শান্তি ও ঐক্যের আহ্ববায়ক একজন শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর এক সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। যদি তিনি ভারতের প্রথম বাঙালি প্রধানমন্ত্রী হতেন তাহলে দেশটির ইতিহাস আজ অন্যভাবে লেখা হত। সাম্প্রদায়িক শক্তির এত বাড়-বাড়ন্ত দেশটিতে হয়তো দেখা দিত না। জ্যোতি বসুর মতো মহানায়ককে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়নি তার দল কম্যুনিস্ট পার্টি। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে ক্রমাগত হঠকারী নীতি অনুসরণের জন্য আজ তাদের এই বাম দশা। জ্যোতি বসু ভারতের প্রথম বাঙালি প্রধানমন্ত্রী হলে যে সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী ঐক্যবদ্ধ ভারত গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল, প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি পদে বসে যদি সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত করার পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন সেটাই হবে তাঁর সবচাইতে বড় সাফল্য।

তাঁর পত্মী-বিয়োগের জন্য আন্তরিক সমবেদনা জানাই।