নারীর ক্ষমতায়ন: খাতায় আছে গোয়ালে নেই

মাকসুদা সুলতানা
Published : 14 June 2011, 03:16 PM
Updated : 14 June 2011, 03:16 PM

আমাদের দেশের সামাজিক পরিস্থিতিতে নারীরা বিভিন্নভাবে বৈষম্য ও শোষণের শিকার। বাংলাদেশ ১৯৮৪ সনে সিডও(CEDAW) বা The Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination against Women-এর গুরুত্ব অনুধাবন করে নারীর ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে সিডওকে গ্রহণ করে। তবে সিডও কনভেনশনে নারীর প্রতি বৈষম্যকে পারিবারিক সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অসমতা হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশ এতে সম্মতি প্রদান করলেও আমরা কি এর সঠিক বাস্তবায়নের কাছাকাছি পৌঁছেছি?

বাংলাদেশের সংবিধানে সামাজিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীর সম-অধিকার স্বীকৃত আছে। কর্মক্ষেত্রেও সম অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ আইএলও(ILO) বা International Labour Organization কনভেনশন স্বাক্ষর করে । জাতিসংঘ ১৯৭৬ সনের ১৮ই ডিসেম্বর নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য নির্মূলের লক্ষ্যে একটি কনভেনশন সিডও গ্রহণ করে। নারীর সমঅবস্থান ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সর্বপ্রকার সহিংসতা দূরীকরণ, মাতৃত্ব অধিকার, আইন ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার্থে এটি করা হয়। সিডও অনুসারে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে আইন থাকলেও তার সঠিক বাস্তবায়ন বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রেই হয় না। তাই কর্মক্ষেত্রে উচ্চ পদবীর ক্ষেত্রেও যদি নারী পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করা যেত তবে সামাজিক উন্নয়নেও সফলতার সুফল পেত বাংলাদেশ। এদেশে যেখানে ৮০ শতাংশ নারী দারিদ্রের মাঝে বসবাস করছে, সেখানে নারীর ক্ষমতায়নে গুরুত্ব যে কেউ অনায়াসে স্বীকার করবে। নারীর কাজ করার প্রবণতা দরিদ্র শ্রেণীর মধ্যে বেশি দেখা যায়, কেননা তারা পেটের দায়ে দারিদ্রের চাপে কোন কিছুর তার ধার ধারে না।

বাংলাদেশের শিল্প ও কৃষি ক্ষেত্রে প্রায় ৯০ শতাংশ নারী নিয়োজিত আছে। কিন্তু কৃষিখাতে নিয়োজিত নারীর মধ্যে প্রায় ৯৪.৮ শতাংশ নারীই বিনাশ্রমে কাজ করে। অন্যদিকে শিল্পখাতেও নারী পুরুষের চেয়ে কম মজুরি পেয়ে থাকে। একইভাবে উচ্চ পদে নারী সদস্য কম নিয়োগ ও সরকারী চাকুরীতেও অল্প সংখ্যক নারী সদস্য নিয়োগ করা হয়।

পোষাক-শিল্পে বর্তমানে যদিও ৮০-৯০ শতাংশ অংশগ্রহণ দেখি নারীর । তারপরও নারী ও পুরুষের চাকুরীতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বৈষম্য দেখা যায়। কেননা নারীকর্মী সেক্ষেত্রে কেবল অপারেটর লেবেলই বেশি দেখা যায়। অথচ সুপারভাইজার লেবেলে অন্য চিত্র, সেখানে পুরুষের অংশগ্রহণই বেশি। তাই অনেক ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের দাবী-দাওয়া মালিক শ্রেণীর কাছে যাবার আগেই তা পুরুষ সুপারভাইজার দ্বারা প্রভাবিত হয়। গার্মেন্টস শ্রমিক অসন্তোষের ক্ষেত্রে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কে যে বিরাট ব্যবধান রয়েছে, তার কারণ হচ্ছে সুপারভাইজার পদগুলো পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই বলা যায়, নারীর ক্ষমতায়নের যে চিত্র গার্মেন্টস ক্ষুদ্রঋন ব্যবস্থায় দেখানো হয়, তা আসলে ক্ষমতায়নের সঠিক রূপ নয়, বরং পুরুষ-কর্মী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নারী আরো বেশি নির্যাতনের শিকার । আর তাই বুঝে না বুঝে তারা অনেক সময় আন্দোলনেও জড়িয়ে পরে । কিন্তু তারা বুঝতে পারে না, পরবর্তীতে তাদের কী ক্ষতি হতে পারে । পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কর্মক্ষেত্রে নারী তার দাবী দাওয়াগুলো মালিকের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারে না আর তুলে ধরলেও কেউ তা শোনে না। তাই যখন তখন শ্রমিক ছাঁটাইও হয়ে থাকে এ শিল্প-কারখানাগুলোতে । গার্মেন্টস শ্রমিকদের উপর করা আমার একটি গবেষণায় একটি কেস ষ্টাডি ছিল। এক প্রাক্তন নারী শ্রমিক আক্ষেপ করে বলেছিল, সুপারভাইজার তাকে ছুটি চাওয়ার অপরাধে চাকুরি থেকে ছাঁটাই করে দিয়েছিল । গ্রামে তার মা মৃত্যু পথযাত্রী, কিন্তু তাকে দেখতে যাওয়ার জন্য ছুটি চাইলেও তা তার কপালে জোটেনি। বরং জুটেছে চাকুরিচ্যুতি।

আমাদের অধিকাংশ স্বল্প শিক্ষিত নারী মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণের পর অনেক ক্ষেত্রে তাদের ঘরে বসে থাকার প্রবণতা দেখা যায়, ধর্মান্ধতা, পারিবারিক মর্যাদা, এবং স্বামী বা শ্বশুর বাড়ির চাপে । কিন্তু এ সব নারী যদি শিল্প ক্ষেত্রে, অফিস আদালতে, সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে এবং ব্যবসা বাণিজ্যে কাজ করার সুযোগ পেত তবে কর্মক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যেত। অন্যদিকে, সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেখা যায় নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন মাত্র ১০ শতাংশ পূর্ণ হওয়া থেকেও আমরা বহু দূরে। অথচ এই অংশগ্রহণ হওয়ার কথা ছিল ৩০ শতাংশ, যদি আমরা সিডও নীতিটি মেনে চলি।

উন্নত দেশগুলোতেও নারীর উচ্চ পদে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে কিছুটা বাধা রয়েছে। কিন্তু সেখানে যেমন-সুপারভাইজার, এক্সজিকিউটিভ, রিসিপসনিস্ট, রেস্টুরেন্ট কর্মী–এ ধরনের কাজে প্রচুর নারী শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। সেখানে তাই নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষজন এদেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের মত আর্থিক টানাপড়েন এতটা সহ্য করে না। আমাদের সমাজে দেখা যায় একজন মানুষ আয় করে এবং পুরো ৮-১০ জন সদস্যের পরিবারটি তার উপর নির্ভর করে চলে। নারীর ক্ষমতায়নে সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যদি ২০% নারীর নিয়োগ দেওয়া হত, তাহলে নারীর নির্যাতনের মাত্রা যেমন কমতো তেমনি অর্থনীতির চাকাও গতিশীল হতো।

মাকসুদা সুলতানালেখক ও গবেষক।