ওসামা বিন লাদেন হত্যা: কিছু প্রশ্ন

কমল কোড়াইয়া
Published : 8 June 2011, 12:09 PM
Updated : 8 June 2011, 12:09 PM

আল কায়েদা সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেন ১ মে পাকিস্তানের গ্যারিসন শহরে এ্যাবোটাবাদ স্থানে আমেরিকান কমান্ডো অভিযানে নিহত হবার ঘটনা নিয়ে যেন গল্পের আর শেষ নেই। দিন যত যাচ্ছে গল্পের ডালপালা ততো বাড়ছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ১ মে, রবিবার এক বিবৃতিতে বলেছেন,'আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি।' তিনি আরও বলেছেন, 'বিশ্বকে নিরাপদ করার জন্যে আমাদের এ উদ্যোগ।' আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ হত্যা নিয়ে উল্লাস চলছে।

বিশ্ব কাথলিক খ্রীষ্টান-প্রধান ধর্মগুরু পোপ ষোড়শ বেনেডিক্টের পক্ষে এ ব্যাপারে ভাটিকান থেকে ২ মে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'আল কায়েদা নেতা ওসমা বিন লাদেন, যিনি অনেক মতানৈকের ও ঘৃণার বীজ রোপণ করেছেন, যিনি অগণিত মানুষের হত্যার জন্যে দায়ী, তার হত্যাকাণ্ড নিয়ে আনন্দ করার কিছু নেই বরং ঈশ্বরের সামনে আমাদের দায়িত্ব নিয়ে গভীর বিচার-বিশ্লেষণ করা দরকার।' ভ্যাটিকানের মুখপাত্র ফাদার লম্বার্ডি আরও বলেছেন, 'কোন মানুষের হত্যাকাণ্ডেই একজন খ্রীষ্টবিশ্বাসী কোনভাবেই আনন্দ করতে পারে না। সে বরং সম্ভাব্য সকল প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে যেন সকল ঘটনাই শান্তি বৃদ্ধির একটি সুযোগ তৈরি করে। কোনভাবেই যেন তা ঘৃণা-বিদ্বেষ না বাড়ায়।' বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনীর আন্ত:ধর্মীয় সংলাপ কমিশনের চেয়ারম্যান বিশপ বিজয় ডি'ক্রুজ তাঁর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেছেন, 'কোন হত্যাই গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ যদি অন্যায় করে থাকে তবে তাকে যথাযথ আইনের আওতায় এনে ন্যায্য বিচারের ব্যবস্থা করা উচিৎ।'

ভারতীয় কাথলিক বিশপ সম্মিলনীর মুখপাত্র ফাদার বাবু যোসেফ এক বিবৃতিতে বলেছেন, 'আমরা দু:খ প্রকাশ করছি যে, ওসমা বিন লাদেনকে এভাবে সহিংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। চার্চ কখনও কোন সহিংস কার্যকলাপকে সমর্থন করে না।' তিনি আরও বলেন, 'ধর্ম ব্যবহার করে যদি কেউ কোন হিংসাত্মক হিংস্র কার্যকলাপ করতে চায় তবে পৃথিবীর কোন সভ্য সমাজই তা মেনে নেবে না।' পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ওসমা বিন লাদেন হত্যার পক্ষে বিপক্ষে এ ধরনের অনেক বিবৃতি গণমাধ্যমে আসছে।

এ পরিস্থিতে, একজন সচেতন ব্যক্তি হিসেবে সাধারণভাবেই মনে প্রশ্ন আসতে পারে, বিশ্বকে নিরাপদ করার নামে যুদ্ধ-হত্যা-নির্যাতন-ধ্বংস ছাড়া কি অন্য কোন বিকল্প পথ নেই? বিগত বছরগুলোতে আমরা দেখেছি, শান্তি স্থাপনের নামে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কত শত শত নিরীহ মানুষের প্রাণ দিতে হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে কত শত শত কোটি টাকার সহায়-সম্পদ। হিংসা-বিদ্বেষের বিষ-বাষ্পে মানব সভ্যতা আজ দূষিত-কলুষিত। এতে তো পৃথিবী এতটুকু নিরাপদ হয়নি বরং প্রতি পদে পদে নিরাপত্তাহীনতায় দিনাতিপাত করছে এ পৃথিবীর মানুষ। ঘর থেকে বের হয়ে ঘরে ফিরে যাবার গেরান্টি আজ কেউই দিতে পারছে না। রাস্তা-ঘাটে, বাড়ীতে-গাড়ীতে, হাটে-হোটেলে যখন তখন বোমার আঘাতে ঝাঁঝরা হচ্ছে শত শত মানুষ। আর এ ধরনের অপরাধের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এ পরিস্থিতিতে আমরা কীভাবে বলতে পারি, অস্ত্র দিয়ে এ পৃথিবীকে নিরাপদ করা সম্ভব!

প্রাসঙ্গিকভাবে এসে যায় ব্যক্তির মানবাধিকারের প্রশ্ন। আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পেরেছি, ওসমা বিন লাদেনকে যখন হত্যা করা হয় তখন তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। তিনি আত্মরক্ষার নিমিত্ত কোন অস্ত্র হাতে তুলে নেননি। পৃথিবীর যে কোন নিরস্ত্র ব্যক্তির উপর এ সশস্ত্র আক্রমণ বিশ্ব মানবাধিকার লঙ্ঘন ছাড়া আর কি হতে পারে? এমনতো হতে পারতো, লাদেনকে জীবিত আটক করলে তার কাছ থেকে আরও মূল্যবান অনেক তথ্য উদ্ধার করা যেত যা বিশ্ব অপরাধ নির্মূলে অনেক সহায়ক হত, তার স্বাভাবিক বিচারকার্যও পরিচালনা করা যেত।

মৃত্যুর পর নিজের ধর্ম ও প্রথা অনুসারে পরিবার-পরিজন মিলে প্রিয়জনকে দাফন করবে-এতো মানবধিকারেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মানব সভ্যতার এটাইতো প্রচলিত প্রথা। ওসমা বিন লাদেনের ক্ষেত্রে এ মানবধিকারও চরমভাবে উপেক্ষিত হল। সলিল সমাধি দেয়া হয়েছে বলে গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। ধর্মীয় রীতি অনুসারেই তা করা হয়েছে বলে দাবী করা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন জাগে, ইসলাম ধর্ম মতে "সলিল সমাধি" কি ধর্মসিদ্ধ? ইসলামিক প্রথায় কি এভাবে মৃত ব্যক্তিকে সমাধিস্থ করা যায়? আর যদি না করা যায় তবে কি আমরা বলতে পারি, বর্তমানে মরণের পরে ব্যক্তির মৃতদেহের সৎকারটুকুও নিরাপদ নয়? আর মৃত ব্যক্তির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন ও অংশগ্রহণে প্রিয়জনদের অধিকারের কথা এখানে না-ইবা বললাম।

ওসমা বিন লাদেন হত্যা নিয়ে বিশ্ব নেতাদের মধ্যে যে সমস্ত লুকোচুরি, মিথ্যা, প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হচ্ছে তাতে পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের নেতাদের কাছ কি শিক্ষা পাচ্ছে? তারা কী ধরনের আদর্শ নিয়ে বড় হচ্ছে? তাদের জন্যে কতটুকু নিরাপদ আমরা রেখে যাব এ পৃথিবী?
কেন জানি আমরা বৈজ্ঞানিক যুগের এ চরম শিখরে অবস্থান করেও ভুলে যাচ্ছি, আমরা নিজেরা আমাদের নিরাপদ বাসস্থান, শিক্ষা, খাদ্য, বস্ত্র ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে অন্যরা আমাদের তা কোনদিন কোনভাবেই করে দিতে পারবে না। অন্যরা যা পারবে তা হল, আমাদের অর্থ দিয়ে সহায্য করতে; আমাদের উদ্বুদ্ধ করতে; আমাদের প্রশিক্ষণ দিতে পারবে;কিন্তু প্রধান কাজটা আমাদেরই করতে হবে। আমাদের নিরাপত্তার বিধান আমাদেরই করতে হবে। আমাদের মঙ্গল-অমঙ্গল আমাদেরই নির্ধারণ করতে হবে।

তথ্যসূত্র:
1. www.ucanews.com/2011/05/02/archbishop-warns-of -backlash-over-bin-Laden
2. http://en.mercopress.com/2011/05/03/vaticn-says-killing-of-laden-calls-for-reflection-before-god-not-rejoicing

ফাদার কমল কোড়াইয়া ধর্মযাজক ও ফ্রীল্যান্স সাংবাদিক।