অসমাপ্ত কথা

বেবী মওদুদ
Published : 24 July 2015, 09:31 PM
Updated : 24 July 2015, 09:31 PM

প্রয়াত সাংবাদিক, লেখক বেবী মওদুদের অপ্রকাশিত একটি স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে জীবনের শেষদিকে এসে তাঁর সংসদ সদস্য হওয়ার ঘটনাক্রম। ২৫ জুলাই, তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে বাংলাদেশের পথিকৃৎ এই নারী সাংবাদিকের ঘটনাবহুল জীবনের খণ্ডাংশ পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হল। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সোস্যাল অ্যাফেয়ার্স এডিটর বেবী মওদুদের অপ্রকাশিত লেখাটি দিয়েছেন তাঁর ছেলে, রবিউল হাসান অভী।

মঙ্গলবার; ২২ নভেম্বর, ২০১১। রাতে অফিস থেকে ফিরে খেতে বসেছি। ভাত খাবার শখ মুছে ফেলতে হয়েছে নিষ্ঠুর ডায়াবেটিসের জন্য। ইনসুলিন নিতে হয় খাওয়ার সময়। দিনে একবার শুধু ভাত, মাছ ও ভর্তা খাওয়ার সুযোগ হয়। ১৬ দিন হাসপাতালে থেকে ১০ নভেম্বর ঘরে ফিরেছি। ডায়াবেটিস এখন নিয়ন্ত্রণে। রাত ৯টা ১৩ মিনিটে নজিবের (শেখ হাসিনার সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী এবং বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক) ফোন এল, ''আপা, তৈরি থাকেন, আপনাকে এবার এমপি হতে হবে। এটা আমার মিশন। আমি আপার অনুমতি নিয়েছি। আপনার জন্য ফর্ম কিনে আমি পৌঁছে দেব। ফর্মের দশ হাজার টাকা আমি দিয়ে দিচ্ছি। আপনি এবার কোনো কথা বলবেন না।''

ওর একটানা কথা শেষ হলে আমি বললাম: ''আমি খেতে বসেছি। এখন তোর পাগলামির কথা শোনার সময় নেই। এসব কথা আর বলবি না।''

আমার কথা ও শেষ করতে দিল না। বলল: ''রাখেন, আপনার সময় নাই। আমি যা বলছি তাই শুনবেন এখন। এবার আপনাকে হতেই হবে। আপা এই মাত্র মিটিংয়ে ঢুকেছেন। আমি তাঁকে বলেছি, 'আমার কথা আছে।' আপা জিজ্ঞেস করেছেন, 'বল, কার তদবির করবি?' আমি আপনার কথা বলতেই আপা বলেছেন, 'তুই আমার মনের কথা বলেছিস।'''

আমি ওটস খাচ্ছিলাম ঠাণ্ডা করে করে। বাঁধাকপি ও কাঁচা টমেটো দিয়ে তৈরি করেছে মাহমুদা (বুয়া)। খেতে বিশ্রী, স্বাদহীন। নজিবের কথায় মন আরও তিক্ত হল। ওকে বলি: ''তোর তো সাহস কম নয়। তুই আপার কাছে আমার কথা বলবি কেন? আপা কি আমাকে চেনে না? আমি আশা করিনি, নজিব, তুই আমার জন্য আপাকে বলবি। আমি কিন্তু রাগ করলাম।''

নজিব বলল: ''আমার অন্যায় হয়ে থাকলে আপনি মাফ করবেন। তবে এবার আর কোনো কথা শুনব না। আমার দুটো ভাগ্নের মুখের দিকে তাকিয়ে আপনাকে এমপি হতেই হবে। তারা তো বাইরে মায়ের পরিচয় দিতে পারবে।''

আমি উত্তর দিলাম: ''আমাকে এসব কথা বলিস না। আমার ছেলেরা আমার পরিচয় জানে। আমি কোনো কিছু পাওয়ার জন্য কখনও কোনো কাজ করি না। তুই আপার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা নষ্ট করিস না।''

নজিব নাছোড়বান্দা। বলল: ''আপনি ফর্ম পেয়ে ফিল আপ করে জমা দেবেন। আর কোনো কথাই আপনার শুনব না। আপনাকে এবার এমপি বানাবই।''

ফোন রেখে খেয়ে উঠলাম। ওষুধ খেলাম। নজিবের কথায় আমার দুচোখ ভরে এল। আমাকে আবার সে ঝামেলায় ফেলে দিল। ইনসুলিন নিতে হচ্ছে বলে মনোকষ্টে আছি। খুব হিসাব করে খেতে হয়। এমনিতেই আমি নিরিবিলি নিঃসঙ্গ থাকতে অভ্যস্ত। এমপি হওয়া মানেই তো শত ব্যস্ততা, নানা তদবির শোনা। আমি এসবে জড়াতে কখনও চাইনি। ছাত্রজীবনে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। ঊনসত্তরে, একাত্তরে আমরা আন্দোলনে, মিছিল-সমাবেশে অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু নিজেকে সাহিত্য-সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন রাখিনি।

ছাত্রজীবনেই সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি এবং এখনও রয়ে গেছি। মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই নারীআন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিই। সর্বজনশ্রদ্ধেয় সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে আমরা দেশব্যাপী নারীমুক্তি আন্দোলনে কাজ করি। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে সভায় বক্তৃতা দিয়েছি, প্রশিক্ষণ দিয়েছি। পাশাপাশি রাজনৈতিক আন্দোলনেও অংশ নিয়েছি। বিশেষ করে পনেরই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে একদল সেনা সদস্যের হাতে নিহত হওয়ার পর দেশে সামরিক শাসন জারি হয়। তারপর আমার পরিবারেও অনেক টানাপড়েন শুরু হয়। তবুও সামরিক শাসনবিরোধী কাজকর্মে জড়িত ছিলাম। লিফলেট বিতরণ, বাড়িতে গোপন বৈঠক ইত্যাদি কাজে সহযোগিতা করেছি।

হরতালের আগের দিন আমার বাসায় পিকেটাররা অবস্থান করত। এর মধ্যে আমার ছোট ছেলেটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি হতাশ হয়ে পড়ি। তার চিকিৎসাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম আসত না। আমার স্বামী ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে ছাত্রজীবন থেকেই জড়িয়েছিলেন। আইনজীবীর পেশায় যখন তাঁর পসার জমতে থাকল, হঠাৎ একদিন তিনি হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। তখন জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন চলছে। আমি দুটো শিশু সন্তানসহ সাংবাদিকতার চাকরি করে জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি।

বঙ্গবন্ধুকন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে প্রথম বর্ষ অনার্সে পড়ার সময়। আমি ছাত্র ইউনিয়ন করতাম, আর সে করত ছাত্রলীগ। কিন্তু সহপাঠী হওয়ায় আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওই সময়ে আন্দোলনে-মিছিলেও আমরা সঙ্গী ছিলাম। বিশেষ করে ঊনসত্তরের আন্দোলনে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। আর বন্ধুদের কাছেও সে ছিল খুব আকর্ষণীয়।

কিন্তু হঠাৎ বিয়ে হয়ে যাওয়ায় এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার লেখাপড়ায় বেশ ক্ষতি হয়ে যায়। সে আর আমাদের সঙ্গে লেখাপড়া এগিয়ে নিতে পারেনি। ১৯৭৩ সালে বিএ পাশ করে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়। আমরা ১৯৭৩ সালে এমএ পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে গেছি। ১৯৭৫ সালের শোকাবহ ট্র্যাজেডির সময় শেখ হাসিনা স্বামী ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে জার্মানিতে ছিল। সঙ্গে ছিল ছোট বোন শেখ রেহানা। ভাগ্যক্রমে তারা দুজন বেঁচে যায়। দেশে থাকলে সেদিন তাদেরও খুনিরা হত্যা করত। দশ বছরের রাসেলকে যখন বাঁচতে দেয়নি, তাদের মা ও দুই পুত্রবধূকেও যখন হত্যা করতে হাত কাঁপেনি খুনিদের, সেখানে এই দুই বোনকেও তারা বাঁচতে দিত না।

১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আমি দূর থেকে তাকে দেখতাম। তার সেই শোকাচ্ছন্ন মুখখানা আমার আজও মনে আছে। সেই প্রবল বৃষ্টিঝরা দিনে তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল ঐতিহাসিক। আমি শেরেবাংলা নগরে তার সেদিনের বক্তৃতা শুনেছি। তার সেই শোকাবহ ভারাক্রান্ত হৃদয়ের কথা শুনে আমরা সেদিন অশ্রুতে ভেসেছিলাম; লক্ষ লক্ষ মানুষের সেই একাত্মতাবোধ আমার আজও মনে আছে।

এর অনেক পরে একদিন কবি নির্মলেন্দু গুণ, যিনি আমাদের সহপাঠী ছিলেন, তার কথায় আমি সোজা বত্রিশ নম্বরের বাসায় হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। নিচতলার ড্রইংরুমে অনেক লোকজনসহ সে কথা বলছিল। আমাকে সামনের বারান্দায় উঠে দাঁড়াতে দেখে সে উঠে এসে জড়িয়ে ধরল। আমরা কয়েক মুহূর্ত কাঁদলাম। সে অনেক কথা বলল, কাঁদল। আমিও শুনলাম, কাঁদলাম। তারপর দুপুরে ভাত খেলাম। তখন মতিয়া চৌধুরী ছিলেন। এরপর আরও কিছু সময় তার সঙ্গে কাটিয়ে আমি বিদায় নিই। সে আবার জড়িয়ে ধরে বলেছিল: "আসিস। আমি তো এখন একা। তোর সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগবে। তুই তো সাংবাদিক, অনেক খবর পাওয়া যাবে।"

আমি সেদিন চলে এসেছিলাম এক ভালোবাসার স্পর্শ নিয়ে। এরপর মাঝে মাঝে যেতাম তার কাছে। সেও খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আমারও ছোট ছেলেটার জন্য ব্যস্ত সময় কাটছিল। এর মধ্যে আমার স্বামীর মৃত্যু হয়। আমাকে আবার সাংবাদিকতার পেশায় ফিরতে হয়। কিন্তু শেখ হাসিনার কাছে মাঝে মাঝে যেতে হত কাজে-অকাজে। ধীরে ধীরে নানা কাজে জড়িয়ে পড়ি। আওয়ামী লীগের আন্দোলন-সংগ্রাম, নির্বাচন, জেনারেল এরশাদবিরোধী আন্দোলন তো ছিলই এবং বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা ও বঙ্গবন্ধুর ওপর লেখার কাজেও জড়িয়ে পড়ি।

হাসিনার পরিবার, রেহানা, আত্মীয়স্বজন, দলের নেতাকর্মী সবার সঙ্গে আমারও একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সবার অনেক কথা শোনার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। তাদের ধারণা, আমাকে বললে নিশ্চয়ই হাসিনার কাছে আমি বলব। ঢাকার বাইরের নেতাকর্মীরাও আমাকে তাদের সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার কথা বলতেন। আমি যে তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি, এটাই আমাকে শক্তি যোগাত। আমার সাংবাদিকতার পেশা ও সত্তা আমি সব সময় আলাদা রেখেছি।

সাংবাদিক বন্ধু ও সহকর্মীদের সঙ্গে আমার খুব একটা টানাপড়েন ছিল না। সবার সঙ্গেই আমার সম্পর্ক নিবিড় ছিল। এর মধ্যে কেউ কেউ আমাকে পছন্দ না করলে, আমি সরে এসেছি তাদের কাছ থেকে। আমার বিরুদ্ধে তাদের নানা অভিযোগ থাকলেও সত্য নয় বলে আমি তা কানে তুলিনি। তাদের হয়তো চাওয়া-পাওয়ার প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, কিন্তু আমি কখনও কারও বাড়া ভাতে ছাই দেওয়ার মানসিকতা রাখিনি। আমি আমার পেশাগত কাজের মধ্যে থাকতে চেষ্টা করেছি।

কিন্তু একটা কাজে বিশ্বস্ত থেকেছি– হাসিনার কাছে কখনও মিথ্যা কথা বলিনি। তার বিরুদ্ধে বাইরে কোনো প্রচারণা থাকলেও জানিয়েছি। অনেকে অনেক ভালো-মন্দ মন্তব্য করলেও জানিয়েছি। প্রয়োজন মনে করলে কারও সম্পর্কে বলেছি। সে একদিন বলেছিল, ''যা শুনবি ও জানবি, আমার কাছে বলতে কখনও দ্বিধা করবি না।''

হাসিনা ও রেহানার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। তাদের কথা শুনতাম, অনেক কথা। মনে হত এগুলো শোনার মতো মানুষেরও অভাব আছে। ধীরে ধীরে তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও আমার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জয় ও পুতুল কত ছোট ছিল! বড় হয়ে আমাকে পুতুল বলেছে, 'কেউ কিছু বললে এক কানে শুনবেন আরেক কানে ফেলে দেবেন। নিজে যেটা ভালো মনে করবেন সেটাই করার চেষ্টা করবেন।' এটা তো আমার ছোটবেলায় শেখা। পুতুল আবার যেন বড়বেলায় এসে শেখাল। জয়ের ঝাড়ি খেয়ে আমি ও হাসু শেষ পর্যন্ত কম্পিউটারের সব কিছু শিখে ফেলেছি।

ববি ও টিউলিপ যথেষ্ট রাজনৈতিক সচেতন। তাদের সঙ্গে আমার এই সম্পর্ক সব সময় সব কিছুর ঊর্ধ্বে রাখার চেষ্টা করেছি। আমার ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন এর মধ্যে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করিনি। আর সম্পর্কের বিনিময়ে কিছু পেতে হবে বা চাইতে হবে আমি কখনও তা কল্পনাও করিনি। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা আমার কাছে কত মনের কথা, ইচ্ছা, প্রত্যাশার কথা বলেছেন। আমি সব হাসিনাকে বলেছি। কোনো কোনো ইচ্ছা পূরণ হয়েছে সত্য। আমি না বললেও হয়তো হত, কিন্তু তারা কেউ কেউ আমার কাছে এসে কৃতজ্ঞতা জানালে বড় বিব্রত হয়েছি। অনেকে তো আমাকে পরে এড়িয়ে চলেছেন। এতে আমি কখনও কিছু মনে করিনি।

আমি এইসব রাজনীতির অনেক ভালো-মন্দ দেখেছি, অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। হাসিনার ভালো সময়ে বা বিজয়ের সময় কত কিছু দেখলাম ও জানলাম। আবার দুঃসময়ে ও পরাজয়ের মুহূর্তে কত কিছু দেখেছি ও জেনেছি– এই সব দুর্লভ স্মৃতি কখনও ভুলে যাবার নয়। হাসিনা আপাদমস্তক রাজনৈতিক নেতা এবং তার মধ্যে প্রচণ্ড রকম সহনশীলতা, ধৈর্য ও মমত্ববোধ রয়েছে। এসব গুণের কারণে সে দেশের একজন দায়িত্বশীল নেতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছেন। হাসিনার শত্রুপক্ষের অনেকেও এ কথা আমার কাছে স্বীকার করেছেন।

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে হাসিনা বিজয়ী হল। আমাকে সংরক্ষিত মহিলা এমপি হতে বলল। বললাম, 'না।' তারপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বসতে বলল। বললাম, 'না।' সে বেশ অবাক হয়ে বলল, 'না বলছিস কেন?' আমি বললাম, 'তুমি এখন প্রধানমন্ত্রী হয়ে ক্ষমতায় বসবে। সবাইকে কাছে পাবে। আমি বাইরে থাকি। বাইরে থেকেই কাজ করি, তাহলে তোমার জন্য কাজ করতে পারব। সেটাই ভালো হবে।'

হাসিনা আর কিছু বলেনি। তবে আমাকে সংরক্ষিত আসনে এমপি করার জন্য অনেকেই তাকে অনুরোধ করেছিল। সে তাদের বলে দিয়েছে, ও রাজি নয়। তাদের অনেকেই পরে আমাকে এমপি হতে না চাওয়ার জন্য বকেছে, কথা শুনিয়েছে। আমি হেসেছি; বলেছি, এসব ঝামেলা বলে।

১৯৯৬ সালের ২৩ জুন হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর শপথ নিয়ে সরকার গঠন করলে আমি প্রথম দিকে দূরে দূরে থাকলাম। কিন্তু সে আমাকে কাছে টেনে নিল। ক্ষমতাসীনদের মধ্যে থেকে ক্ষমতার অনেক কিছু দেখার, শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কাজে-অকাজে হাসিনার অফিসে ও গণভবনের বাসায় যেতে হয়েছে। বিদেশ সফরও করেছি। আমাকে এ জন্য অনেকেই দেখতে পারত না। সাংবাদিকদের কিছু নেতা, আওয়ামী লীগের বড় ছোট কিছু নেতাও। এমনকি সংসদেও তারা প্রশ্ন তুলিয়েছে, 'আমি কে, কেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিদেশ যাই?'

আমার সাংবাদিক-লেখক পরিচয় বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বান্ধবী পরিচয়টা সামনে নিয়ে আসে আমাকে সবার কাছে নিন্দিত করার জন্য। এমনকি আমাকে যখন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার বাংলা বিভাগের প্রধান বার্তা সম্পাদক নিয়োগ দেওয়া হয় তখনও এই সব সাংবাদিক নেতারা পছন্দ করেনি। এর কারণ তারা নিয়োগ পায়নি। এমনকি সংসদীয় কমিটির সভায় আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন বর্তমান তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। এ কথা তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী আমাকে জানাল এবং কমিটির পরবর্তী সভায় আমাকে ডাকা হলে আমি এটা সম্পূর্ণ অস্বীকার করি।

এরপর যখন ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসে তারাও এ তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত ও অনুসন্ধান করে আমার বিরুদ্ধে কিছুই পায়নি। এসব কারণে আমার চুক্তি তারা ক্ষমতায় এসেই বাতিল করেছিল এবং বকেয়া পাওনা দিতে চার বছর দেরি করেছিল। এমনকি বিএনপির কোনো কোনো সাংবাদিক নেতা ও এমপি খালেদা জিয়ার কাছে আমার বিরুদ্ধে বলেছিল, কিন্তু তিনি এসব এড়িয়ে যান। এসব বিএনপির সাংবাদিকরাই আমাকে বলেছে।

আসলে আমাকে অসৎ ও নিন্দিত করাটাই উদ্দেশ্য এসব সাংবাদিক নেতাদের। এর মধ্যে আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠ সাংবাদিক নেতারাই ছিল বেশি তৎপর। তারা আমার ব্যাংকভর্তি টাকা আছে বলেও রটাত। আমি ধীরে ধীরে ইউনিয়ন ও ফোরাম থেকে সরে এলাম। নিজের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। তবে প্রেস ক্লাবে যাওয়া-আসা করতাম। ১৯৯৮ সালে শেখ রেহানার সম্পাদনায় 'বিচিত্রা'র দায়িত্ব পালনকালে এসব সাংবাদিকরা আমাকে পছন্দ করত না। কেন আমি হাসিনা রেহানার পছন্দ, এটাও যেন আমার অপরাধ।

বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে হাসিনা যখন কারাবন্দি, তখন এইসব নেতারা আর্মি ও উপদেষ্টাদের কাছে লাইন দিয়ে যেত। তারা তখন নিজেদের বলত, পেশাজীবী। প্রেস ক্লাবের দুই ফোরামের নেতাদের মধ্যে সম্পর্কও গড়ে ওঠে। তারা প্রকাশ্যে কেউ কেউ বলত, জেল থেকে আর বেরুতে হবে না। ক্ষমতায় যেতেও হবে না। আমরা যে গোপনে শেখ হাসিনার জন্য কাজ করতাম সেটারও সমালোচনা করত। আমাকে যখন গোয়েন্দারা ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তখনও তারা উপহাস করেছে। আমি এসব কথা কখনও কাউকে বলিনি।

২০০৮ সালে হাসিনা কারামুক্ত হলে আবার দেখেছি যারা বাইরে তার সমালোচনা করেছে, তারাই আবার সামনে বসে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমি এসব সহ্য করতে পারিনি বলে তখন নিজেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছি। হাসিনা এ সময় বিদেশে চলে যায়। দুমাস পর ফিরে এসে নির্বাচনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ সময় খুব একটা দেখা ও কথাবার্তা হত না। তারপরও যেতে হত।

বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর কাজ করছিলাম আমরা ২০০২ সাল থেকে। অধ্যাপক সালাহ্উদ্দিন আহমদ, শামসুল হুদা হারুন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপক) ও ফকরুল আলম (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক) ছিলেন। প্রধানত আমি ও শামসুজ্জামান খান (বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক) হাসিনার সঙ্গে কাজ করতাম। সে জন্য তার কাছে যেতাম। কিন্তু নির্বাচনের সময়, নির্বাচনে বিজয়ের পর তার শত ব্যস্ততার মধ্যে সে আমাদের সময় দিত। সে আমাকে বলেই রেখেছিল, 'আমার যত কাজই থাক, আমি যত ব্যস্ত থাকি না কেন, এইসব কাজে আমার কাছে চলে আসবি।'

২০০৭ সালে জেলে যাবার আগে আমার কাছে পেন ড্রাইভে সব কিছু রেখে বলেছিল, ''আমার কী হয় জানি না। কিন্তু তুই বইটা বের করিস।''

আমি বলেছিলাম, ''অবশ্যই বই বের হবে।'

হাসু (শেখ হাসিনা) কী মনে করে আরও একবার আমার সঙ্গে মূল খাতা পড়ে রিডিং দিল। তার এই ভাবনা ও আন্তরিকতা আমাকে স্পর্শ করেছিল গভীরভাবে।

কারাগার থেকে বের হয়ে বিদেশ গেল। ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে দেশে ফিরে নির্বাচন করে প্রধানমন্ত্রী হল। তারপর আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আগের মতো যখন তখন যেতাম না। দেখাও হত না। আমি, ফকরুল ও জামান ভাই বইয়ের শেষ কাজগুলো দেখছিলাম। এর মধ্যে মহিলা এমপি মনোয়নের বিষয়টি পত্রিকায় আসে। প্রতিদিন নাম ছাপা হচ্ছে। নজিব আমাকে বোঝাল, ''এবার কোনো কথা বলবেন না। আমি বলবই আপাকে।''

আমি বললাম, ''আপাকে বলার কোনো প্রয়োজন নেই। আপা যদি মনে করে আমাকে দেবে, তাহলে দেবেই। তুই কেন বলবি? আপার অনেক দায়ভার থাকে। আর আমার সঙ্গে সম্পর্কটাও তো কোনো চাওয়া-পাওয়া বা দেওয়ার-নেওয়ার মধ্যে নেই। আমরা তার কাছের লোক যদি হয়ে থাকি তাহলে চাইব কেন? আমাদের এসব থেকে বাইরে থেকেই কাজ করা উচিত। তুই চুপচাপ থাক।''

নজিব কিছুক্ষণ বক বক করে অনেক কথা শুনিয়ে চলে গেল।

ওর মতো আরও অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীও আমাকে বলেছিল তারা হাসিনার কাছে গিয়ে আমার কথা বলবে। আমি নিষেধ করে থামিয়ে রাখি। এরপর আমার কাছে অনেকে এল মহিলা এমপি হওয়ার জন্য। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলে বোঝাতে চেষ্টা করি যে, নেত্রী তো তোমাদের সবাইকে চেনেন, জানেনও কার কী ভূমিকা ছিল। তিনি ঠিকই মূল্যায়ন করবেন।

আমি হাসিনার কাছে রুবী রহমানের কথা বলেছিলাম। তার কথা বলার জন্য আমাদের বন্ধু সুলতানা কামাল লুলু, খুশি কবীরসহ অনেক আমাকে বলেছিল। বিশেষ করে নুরুল ইসলাম (গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি) ভাই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পর নৃশংসভাবে নিহত হওয়ায় রুবী আপার এটা প্রাপ্য ছিল। আমি তার কথা বলেছিলাম হাসিনাকে। সে সঙ্গে সঙ্গে রাজিও হয়।

জাসদের শিরীন আখতার তার কথা বলার জন্য অনুরোধ করেছিল। আমি বলেছিলামও। কাজী রোজী, মুক্তিযোদ্ধা রুনু এবং আরও অনেকে বলেছিল। আমি সবার নাম তাকে জানিয়েছিলাম। হাসিনা এদের সবাইকে চিনত, জানত। এই বিষয়টা দলীয়ভাবে হয়ে থাকে। এছাড়া দলের জন্য দেশের জন্য সমাজের জন্য যারা অবদান রাখে তাদের কথাও হাসিনাকে ভাবতে হয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সংগ্রামে-আন্দোলনে, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যারা কাজ করেছে তাদের সে প্রাধান্য দিয়েছে।

এ সময় আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনেকে চেয়েছে আমি এমপি হই এবং ফর্ম কিনে জমা দিই। আমি এর ধারেকাছেও যাইনি। বরং ওই সময় ঢাকার বাইরে চলে যাই। ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রত্যক্ষ নির্বাচনে নারীদের সংসদ সদস্য নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করেছি এবং লিখেছি। তার বিরুদ্ধস্রোতে যাওয়াটা কখনও উচিত নয়। আমি এই নীতিটা মেনে চলার জন্য জীবনভর চেষ্টা করেছি।

কিন্তু তারপরও কিছু কথা থেকে যায়। আমরা যারা মেয়েদের স্বার্থে বিভিন্ন স্থানে কাজ করি তারা অনেক ঝুট ঝামেলা এড়িয়ে কাজ করার চেষ্টা করে থাকি। অন্তত কিছুটা ভালো কাজ তো করতে পারি। কেউ কেউ ব্যক্তিস্বার্থের উপরে উঠতে পারে না। তারা আপোস করে চলার চেষ্টায় থাকে। মহিলা পরিষদে কাজ করার সময় আমি এসব দেখেছি। আমারও জীবনের স্বপ্ন ছিল কমিউনিস্ট পার্টি করব। একজন আদর্শবান কমিউনিস্ট হব। তাই ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ছিলাম। লেনিনের জীবনী, গোর্কির মা, টলস্টয়ের যুদ্ধ ও শান্তি, দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন, সোভিয়েত পত্রপত্রিকা পড়ে আমি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে পড়ি। শোষণমুক্ত সমাজ ও মানবিকতা হয়ে ওঠে আমার স্বপ্ন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ের একটা স্মৃতি মনে আছে। রোকেয়া হলে আমরা বান্ধবীদের রুমে আড্ডা দিতাম। একদিন শুয়ে শুয়ে গল্প করছি সবাই। আমার বান্ধবীরা কে কেমন স্বামী চায় এ নিয়ে কথা বলছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করতেই বললাম, 'একজন কমিউনিস্টকে বিয়ে করব।'

তখন সবাই বলল, 'তার পেশা কী হবে?'

আমি বললাম, 'পেশা যাই হোক আমার আপত্তি নেই, তবে কমিউনিস্ট হতে হবে। কেননা কমিউনিস্টরা বিপ্লবী হয়, ভালো মানুষ হয়।'

আমার বন্ধুরা আমাকে সেদিন খুব ঠাট্টা করেছিল। পরবর্তীতে আমার বাড়িতে বড় বড় অফিসার, ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে বিয়ের কথা হলেও, আমার ভাগ্যে কমিউনিস্ট পার্টির লোকই জুটেছিল, যিনি ফরহাদ ভাইয়ের কাছে অনুমতি নিয়ে আমাকে বিয়ে করেন।

তবে আমার দাম্পত্য জীবন মাত্র বার বছর বার দিনের। আমার স্বামীর কারণে আমি অনেক রাজনৈতিক নেতাকর্মীর ভালোবাসা ও স্নেহ পেয়েছি এটা আমি সব সময় স্মরণ রাখি। আমার কমিউনিস্ট হওয়া সম্ভব হয়নি। কেননা, যাদের সঙ্গে আমি কাজ করেছি তারা কখনও আমাকে পছন্দ করত না। এটা আমি টের পাই অনেক পরে। তারা আমার অনেক জুনিয়র ও অদক্ষদের সদস্য করেছিল। কিন্তু আমার কথা কখনও ভাবেনি। এই দুঃখটা আমার মনে আজও বাজে। এমনকি মহিলা পরিষদ থেকেও আমাকে সরে আসতে বাধ্য করেছিল। আমার কর্মদক্ষতা, জনপ্রিয়তা তাদের ঈর্ষার কারণ হয়ে ওঠে।

অবশ্য মোহাম্মদ ফরহাদ এটা জানার পর আমাকে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য করতে চেয়েছিলেন। আমি রাজি হইনি। আমি তখন হাসিনার অনেক কাছে চলে এসেছি। এছাড়া আমার পেশাগত চাকরিতে জড়িয়ে পড়ি। একমাত্র পঙ্কজ ভট্টাচার্য, অজয় রায় ও আজিজুর রহমানের সঙ্গে ছিল আমার পারিবারিক সম্পর্ক। হাসিনার সঙ্গে টুঙ্গিপাড়া যাওয়া, অনেক সময় সভায় যাওয়া ইত্যাদি কাজে জড়িয়ে পড়ি।

এরপর জেনারেল এরশাদবিরোধী আন্দোলন, একানব্বইয়ের নির্বাচন, বঙ্গবন্ধু জাদুঘর প্রতিষ্ঠা, ছিয়ানব্বইয়ের নির্বাচন ও হাসিনার প্রধানমন্ত্রী হওয়া, বঙ্গবন্ধুর অ্যালবাম ও অন্যান্য বই প্রকাশ, হাসিনার লেখালেখি ও গ্রন্থ প্রকাশ, শেখ রেহানা সম্পাদিত সাপ্তাহিক 'বিচিত্রা' ১০ বছর দেখা, ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজয়, আবার আন্দোলন-সংগ্রাম, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, সংস্কারপন্থী নেতাদের বক্তব্য, শেখ হাসিনার গ্রেপ্তার ও জেলজীবন, মুক্তিলাভ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ ইত্যাদি সব ঘটনার এক বিরল অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে।

হাসিনাকে দূরে বসে, আবার কাছে বসে নানাভাবে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। আমার জন্য কোনো বিধিনিষেধ কখনও কোথাও ছিল না। তবে আমিও অবস্থা ও অবস্থান বুঝে আমার সীমাবদ্ধতায় থাকতে চেষ্টা করেছি। হাসিনা আমাকে অনেক কথা বলে থাকে। দলের ভেতরের কথা, নেতাদের কথা, কোথায় কোন ষড়যন্ত্র হচ্ছে সব কথাই শুনেছি। এসব বলার মতো একজন মানুষের খুব দরকার ছিল তার। কিন্তু শোনার পর খুব বেশি কথা আমি বলতাম না।

রাজনীতি তো বুঝতাম, কিন্তু খুব বেশি বোঝার চেষ্টা ও এর সঙ্গে জড়িত থাকার চেষ্টা করতাম না। আমি নিঃসঙ্গ থাকতেই ভালোবাসতাম। নিরিবিলিতে একান্তভাবে নিজের মতন করে থাকাটাই আমার পছন্দ বেশি।

সে রাতেই নজিব আবার ফোনে জানাল, ''সভা শেষ হতেই আপার সঙ্গে কথা হয়েছে, আমার তদবির পাশ। কেউ আপত্তি তোলেনি। ফলে আপনার ফর্ম পৌঁছে যাবে।''

অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থেকে যত সব চিন্তাভাবনা মাথায় ঘুরপাক খেল। ক্লান্ত ছিলাম বলে ঘুম আসতে দেরি হল না।

পরদিন কাজের ব্যস্ততায় বাইরে কাটালাম। সন্ধ্যা ৭টায় নজিব জানাল, সে ফর্ম তুলে বাসায় রেখে গেছে পুটুর কাছে। ঘরে ফিরতে রাত প্রায় সাড়ে নটা বাজল। আমার পড়ার টেবিলে খামে ভরা ফর্মটা খুলে দেখলাম একবার। কী করব বুঝে পেলাম না। অন্তত হাসিনা না বললে তো আমি জমা দেব না।

পরদিন পত্রিকা আসতেই দেখি মনোনয়ন-প্রত্যাশীদের তালিকায় আমার নাম ছাপা হয়েছে এবং ফর্ম কিনেছি বলা হয়েছে। দুয়েক জায়গায় ফোন করলাম, ফর্ম কি আমি নিজে গিয়ে কিনেছি যে, এভাবে নাম ছাপা হল। তারা বলল, আওয়ামী লীগের অফিস থেকে জানানো হয়েছে। সেদিন সংসদে একটা কাজ ছিল। স্পিকারের সঙ্গে দেখা করে ঘরে ফিরলাম।

সারাদিনে কয়েকটা ফোন পেলাম। পত্রিকায় নাম দেখেই তারা ফোন করেছে। আমাকে উৎসাহ দিল। কিন্তু আমি সাড়া দিলাম না। সন্ধ্যায় হাসিনা একটা বিষয়ে ফোন করে কিছু কথা বলল, কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো কথা বলল না। আমিও জিজ্ঞাসা করলাম না।

যথারীতি বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর সকালে প্রথম টেলিফোন এল মুনতাসীর মামুনের। আমি ফর্ম ফিলআপ করিনি শুনে ঝাড়ি মেরে কথা শোনাল: ''কোনো গাইগুই শুনব না। ফর্ম পূরণ করে জমা দেন। ছেলে দুটোর কথা ভেবে এটা করবেন। আপনি প্রত্যেকবার এড়িয়ে যান, এবার আর এড়াতে পারবেন না।''

বললাম: ''দেখা যাক। নজিব এমন পাগলামি করে বসবে ভাবিনি।''

কবি মোহাম্মদ সামাদ ফোন করে জানাল, ''বেবী আপা, কাগজে আপনার নাম দেখে খুব খুশি হয়েছি। দশ হাজার টাকা আমি আপনাকে দেব ফর্মের দামটা।''

আমি বললাম, ''ওটা নজিব করেছে। এখনও ঠিক করিনি।''

সেও ধমক দিল। শামসুজ্জামান খান ভাইও ফোনে খোঁজ নিলেন ফর্ম জমা দিয়েছি কি না। দুপুরে রেহানাকে ফোন করলাম। সে ধরল না। বোধহয় ব্যস্ত আছে। তাই মেসেজ পাঠালাম, ''বড় বিপদে আছি। একবার ফোন কর।''

বিকালে সংসদে যেতে হল আমার আগের সেই অসম্পূর্ণ কাজটার জন্য। সঙ্গে নিনু ছিল। সে এখন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইংয়ের উপ প্রেস সচিব হিসেবে কাজ করছে। হঠাৎ নজিবের ফোন এল: ''আপা, আপনি ফর্মটা জমা দেননি এখনও। কখন দেবেন?''

বললাম, ''তোমার আপা তো কিছু বলেনি। সারাদিন ঢাকায় ছিল না। দেখি কী করা যায়।''

সে বলল, 'আমার মিশন ব্যর্থ করবেন না আপা।''

কিছুক্ষণ পর রেহানার ফোন এল। স্বভাবসুলভ গলায় প্রথমেই জিজ্ঞাসা করল, ''কী বিপদ, বেবী আপা, শরীর ভালো তো?''

বললাম, ''শরীর ঠিক আছে। তবে নজিব একটা সমস্যায় ফেলেছে।''

সে হেসে বলল, ''নজিব কী করেছে?''

বললাম, ''এমপি হবার জন্য ফর্ম কিনে এনেছে।''

সে খুশি হয়ে বলল, ''খুব ভালো করেছে। এটা আবার বিপদে ফেলা কেন হল?''

বললাম, ''তুমি তো জানো আমি এ সবে নাই।''

সে এবার বলল, ''না, আপনি এবার এমপি হয়ে যান। দরকার আছে।''

বললাম, ''না, রেহানা, হাসুর কাছে আমি কখনও চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে নাই। হাসু না বললে বা তোমার মতামত না নিয়ে আমি এসবে জড়াব না তুমি তো জানই।''

রেহানা বলল, ''আপার সায় পেয়েই নজিব ফর্ম কিনেছে। না হলে তার ঘাড়ে মাথা থাকত!''

''আমি ফর্ম জমা দিয়ে তাকে বিড়ম্বনায় ফেলা কি ঠিক হবে?''

রেহানা উত্তর দিল, ''আপনি জমা দেন। আমি হাসু আপার সঙ্গে কথা বলব। এবার আর না করবেন না।''

বললাম, ''কিন্তু আমি মন ঠিক করতে পারছি না। এটা কি ভালো হবে? হাসুর কাছ থেকে কিছু না শুনে কীভাবে জমা দেব? আমি তো নিরিবিলি মানুষ, তুমি তো জানই যে, কোনো রকম ঝামেলায় জড়াতে চাই না। আর এমপি হলে কত রকম ফর্মালিটিজ। আমি মাত্র হাসপাতাল থেকে বের হয়েছি।''

রেহানা আবার বলল, ''ঝামেলায় জড়ানোর দরকার কী? যেমন আছেন তেমন থাকবেন। আর কোনো কথা নয়, আপনি ফর্ম জমা দেন। কারও হাতে পাঠিয়ে দেন।''

অগত্যা বাসায় ফিরে ফর্ম ফিলআপ করলাম। এর মধ্যে নজিবের ফোন এল দুবার। রেহানার ফোনের কথা বললাম। সে বলল, ''তাহলে আর চিন্তা নাই। ফর্ম ফিলআপ করে পাঠিয়ে দেন।''

বললাম, ''নিনু আছে, ও নিয়ে গিয়ে জমা দেবে। দেখিস আবার যেন কোনো সমস্যায় না পড়ি।''

সে বলল, ''আপনার কোনো সমস্যা হবে না আমরা থাকতে, এটা মনে রাখবেন।''

নিনু ফর্ম নিয়ে গেল সাতটার পর। জমা দিয়ে সে জানাল যে, সব ঠিকমতো হয়েছে।

রাত নয়টা থেকে পত্রিকা অফিস থেকে ফোন এল অগ্রিম অভিনন্দন জানিয়ে। ফর্ম জমা দেওয়ার খবর পেয়েছে তারা। পরদিন সকালে পত্রিকায় আমার ছবি ছাপা হল ফর্ম জমা দেওয়ার খবরসহ। কয়েকটা ফোনও পেলাম। সারাদিন ঘরেই কাটালাম। কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে হল না। পরদিন বেলা বারোটায় গণভবনে ঢুকলাম। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর কাজ আছে হাসুর সঙ্গে। বাইরের গেইট থেকেই শুনলাম, ''আপা, পত্রিকায় আপনার নাম উঠেছে।''

মৃদু হাসি ছাড়া আমার কিছুই বলার ছিল না। উপরে উঠে দেখি শালু ভাবি হাসুর সঙ্গে গল্প করছে। আমিও বসলাম। টিভি দেখতে দেখতে কথা হচ্ছিল। শালু ভাবি বলল, ''আমি চাই তুমি অবশ্যই হও।''

আমরা একসঙ্গে ভাত খেলাম। ভাবি চলে যাবার পর ভেতরে গিয়ে বসলাম, বঙ্গবন্ধুর বইয়ের কাজ নিয়ে। কভারের ফ্ল্যাপ দেখে সংশোধন করল। বেলাল ফোন করে জানাল, বাসায় আওয়ামী লীগ অফিস থেকে ফোন করেছে সন্ধ্যায় সাক্ষাৎকারে থাকার জন্য। হাসুর হাতে দেখলাম একটা ফাইল। তাকিয়ে দেখি সংরক্ষিত আসনের ফর্ম। সবার উপরে আমারটা। পত্রিকায় উঠেছে একশত ঊননব্বইটা। চা খেয়ে কাজ শেষ করে উঠছিলাম। হাসু বলল, ''যাস কই? তোদের না আজ সাক্ষাৎকার?''

বললাম, ''আমার টিভি প্রোগ্রাম আছে সোয়া ছয়টায়। এর চেয়ে জরুরি।''

সে বলল, ''তা হোক। তবু থাকা ভালো। সবাই থাকবে।''

বললাম, ''ঠিক আছে, প্রোগ্রাম করে আসতে আটটা বাজবে।''

বিটিভিতে ৬টা ১০ মিনিটে প্রতিবন্ধীদের অনুষ্ঠান 'আমাদেরও ভালোবাসুন' সরাসরি অনলাইনে করে অফিসে কিছু সময় কাটিয়ে যখন গণভবন এলাম, তখন রাত আটটা। হলরুমে গিয়ে শেষের দিকে বসলাম। হাসিনা বক্তব্য রাখছিল। প্রায় শেষ সভা। হলঘর ভর্তি। ঢাকা ছাড়াও বাইরে থেকে অনেকে এসেছে। বক্তব্য শেষ করে নেতারা চলে গেলেন। তারা বসে আলোচনা করে প্রার্থী নির্ধারণ করবেন। সবার সঙ্গে কথা বললাম। খাবারের ব্যবস্থা থাকায় সবাই গিয়ে খেতে বসে গেল। আমি কিছুক্ষণ থেকে বাসায় চলে এলাম।

রাত প্রায় সাড়ে দশটায় প্রথম আলো থেকে শরীফুজ্জামান পিন্টু ফোন করে জানাল, ''আপা, আপনি এমপি মনোনীত হয়ে গেছেন। সংসদীয় সভায় ঠিক হয়ে গেছে।''

এরপর জনকণ্ঠের উত্তম ফোনে জানাল, পাঁচজনের নাম ঠিক হয়ে গেছে। রাতে আরও ফোন এলেও ধরা হল না। কেননা অন্য ঘরে চার্জে দেওয়া থাকে।

পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙলে মোবাইলে কল ও মেসেজের অন্ত নেই। পত্রিকা এলে দেখলাম পাঁচ নাম ও ছবিও এসেছে। সারাদিন ঘরেই থাকলাম। ফোন ধরতেই হল শুভাকাঙ্ক্ষীদের। আমার বান্ধবীদের। লন্ডনে রেহানা ও অভীকে মেসেজ পাঠালাম। সারাদিন ঘরেই কাটালাম। ছোট বোন রুবী এল, বড় ভাইয়ের ছেলে জয় এল। যেসব কাগজে ছবি ও খবর ছাপা হয়েছে সেগুলো পুটু কিনে নিয়ে এল, সেও খুশি। তবে তার একটা কথা আমাকে অবাক করল। তার ধারণা হয়েছে, এমপি বা মন্ত্রী হলে নিহত হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। 'নিহত' শব্দটা তার মুখ থেকে আমি শুনেছি। এ ধারণা তার মতো স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিকে আচ্ছন্ন করেছে কেমন করে আমি জানি না।

সে সরাসরি আমাকে বলেছিল, ''তুমি এমপি হলে কেন, তুমি যদি নিহত হয়ে যাও।''

বেবী মওদুদ: প্রয়াত লেখক ও সাংবাদিক।

ইতোপূর্বে প্রকাশিত বেবী মওদুদের ধারাবাহিক স্মৃতিকথা: