২০১৬ অর্থবছর হয়ে উঠুক অর্থনৈতিক সংস্কারের বছর

ড. আবুল বাসার
Published : 29 June 2015, 04:25 AM
Updated : 29 June 2015, 04:25 AM

নতুন অর্থবছর শুরু হতে যাচ্ছে ১ জুলাই থেকে। সরকার এবং দেশের জন্য এবারের অর্থবছরের শুরুটা এর চেয়ে ভালো প্রেক্ষাপটে আর হতে পারত না। ২০০৮ সালের পর থেকে প্রকৃতি বাংলাদেশের প্রতি তেমন কোনো বিরূপ আচরণ করেনি। বড় বন্যা বা বিধ্বংসী ঝড়-তুফান এসে হানা দেয়নি। রোদ-বৃষ্টির খেলাতেও ছন্দপতন ঘটেনি প্রকৃতির ভারসাম্যে। অন্যান্য আরও অনেক উপাদানের সঙ্গে প্রকৃতির এই উদারতাও কিন্ত আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সহায়তা করেছে।

একে পুঁজি করে আমরা কতটুকু এগিয়েছি সেটা সুস্পষ্ট না হলেও একে নিয়ে আমাদের তৃপ্তির ঢেঁকুর কিন্ত খুব একটা ছোট নয়। টানা প্রায় আট বছর প্রকৃতির আনুকুল্য পেয়ে বাংলাদেশে এর আগে কোনো অর্থবছর শুরু হয়েছে বলে জানা নেই। এ লেখা যখন লিখছি তখন খবরে দেখছি, মৌসুমী বৃষ্টির তোড়ে বান্দরবান এবং কক্সবাজারে বন্যা হয়েছে। এখন পর্যন্ত এই বন্যা স্থানীয় পর্যায়েই সীমাবদ্ধ আছে। যা ২০০৮ সাল পূর্ববর্তী সময়ের বিভিন্ন জাতীয় দুর্যোগের সমকক্ষ নয়।

দ্বিতীয় যে বিষয়টা সরকারের জন্য সুখদায়ক হতে পারে সেটা হল, রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বিরাজমান আপাত স্থিতিশীলতা। ২০১৩ সাল থেকে শুরু করে বাংলাদেশে কখনও থেমে থেমে, কখনও লাগাতার অনেক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, হানাহানি, জ্বালাও-পোড়াও চলেছে। এর বলি হয়েছে মূলত দেশের অর্থনীতি। স্থবির হয়ে পড়েছিল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ব্যবসা-বাণিজ্য। কিন্ত প্রধান বিরোধী শক্তি কার্যত অনেকটাই নিস্ক্রিয় হয়ে এসেছে; তারা কোনো অস্থিরতা তৈরি করবে না বলে ঘোষণা দেওয়ার কাজ সারা।

সংঘাতমূলক রাজনীতির এ দুর্ভাগা দেশে এটা অনেক ভালো একটা খবর। যা অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটি প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে। সরকারের উচিত এর অর্থনৈতিক সুযোগ গ্রহণ করা।

সরকারের জন্য মাঙ্গলিক প্রেক্ষাপট আরও রয়েছে। বিশ্বঅর্থনীতির চাকা এখনও ২০০৮ সালে হারিয়ে ফেলা গতি ফিরে পায়নি। কিন্ত সেটা নিয়ে খুব একটা দুশ্চিন্তার কারণ বাংলাদেশের নেই। আমাদের যে মূল রপ্তানি পণ্য সেটার চাহিদা বিশ্ববাজারে কমে যাওয়ার কারণ নেই। এগুলো একেবারে অত্যাবশ্যকীয় পোশাক। অপরদিকে, এসব পণ্য রপ্তানিকারক দেশসমূহে মজুরির হার বেড়ে যাওয়ায় আমাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ, যেমন চীন এসব পণ্যের রপ্তানি কমিয়ে দিয়েছে। তাতে আমাদের রপ্তানির সুযোগ বেড়েছে; আরও বাড়বে ভবিষ্যতে।

আবার আমাদের অন্যতম মূল আমদানি পণ্য, পেট্রোলিয়াম এবং পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের দাম কিন্ত বিশ্ববাজারে অনেক কমে গেছে। যতদিন না রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা মোড়লদের বোঝাপড়া হচ্ছে, ততদিন এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলেই ধারণা করা যায়। বাংলাদেশের উৎপাদন কাঠামো খুব একটা তেলনির্ভর নয়। সুতরাং তেলের দাম কমার ফলে আমাদের উৎপাদন খাতে আহামরি সুফল আশা না করাই ভালো। তবে আমাদের তেলের দাম এখনও বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়নি। তাই পড়তি তেলের দামের যেটুকু সুফল আমাদের উৎপাদন খাতে পাওয়া যেত, সেটি মিলেনি।

তবে যেহেতু সরকারকে এখন আর চড়া দামে তেল কিনে ভর্তুকি দিয়ে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে না, তাই এ খাতে সরকারের ব্যয়-সাশ্রয় হচ্ছে। সে অংকটা কিন্ত নেহায়েত কম নয়।

এ রকম ত্রিফলা সুসময়ে শুরু হওয়া অর্থবছরটি আমাদের জন্য আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সুফল নিয়ে আসে কিনা সেটাই দেখার বিষয়। তবে অর্থনীতিতে সময়ে সময়ে অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। প্রতিকূল পারিপার্শ্বিকতার কারণে সব সময় তা নেওয়া যায় না। আমাদের অর্থনীতিতে নতুন শক্তি সঞ্চারের জন্য অনেক ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রয়োজন। সে ক্ষেত্র অনেক বড়। মধ্য আয়ের দেশ হতে গেলে ওই মানের প্রশাসন, কর ও ব্যয়-ব্যবস্থাপনা, ব্যাংকিং খাতের শুদ্ধিতা, কয়লা নীতি প্রণয়ন এ রকম আরও অনেক বিষয়ের উপর নজর দিতে হবে।

দেশের বিশেষজ্ঞরা অনেক দিন যাবত আমাদের অর্থনীতি সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কী কী সংস্কার অপরিহার্য তা বলে আসছেন। এসব জানা জিনিস নতুন করে আবিস্কারের প্রয়োজন নেই। দরকার কেবল প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলি গ্রহণ।

এ মুহূর্তে দেশের জন্য কী করা দরকার তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের দরকার নেই, সাধারণ জ্ঞানের সাহায্যে তা বোঝা যায়। যেমন ধরা যাক, বাংলাদেশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে স্বল্প খরচে বিদ্যুত সরবরাহ করার পথে এগোচ্ছে। এ সব বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য নির্ধারিত স্থান নিয়ে নানা বিতর্কও রয়েছে। এইসব সুস্থ বিতর্ক আমাদের একটি যৌক্তিক পরিণতি এনে দেবে সেটাই আশা করা যায়।

যেটি বিতর্কের বিষয় নয় সেটি হল, সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদনের পথে দ্রুত হাঁটছে, অথচ কয়লা নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে একই জায়গায় স্থির। কেন এই বৈপরীত্য? দুই টার্ম মিলিয়ে এ সরকার ছয় বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় আছে। তবু কয়লা নীতি প্রণয়ন করতে আর কত বছর লাগবে? আর কত সময় গেলে সরকারের 'সময় হবে' বিষয়টিতে গুরুত্ব দেবার?

একইভাবে ধরা যাক রাজস্ব আদায়ের কথা। এ কথা সবাই জানেন যে, আমাদের রাজস্ব আদায়ের অংক দেশের মোট জাতীয় আয়ের তুলনায় অনেক কম। এ বিষয়ে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তাও মোটামোটি সুচিহ্নিত। এ রকম আরও উদাহরণ দেওয়া যায়। কিন্ত তারপরও কাজের কাজ হচ্ছে না। কারণ এখানে কাজ করছে সরকারের রাজনৈতিক অংকের হিসাব। অর্থনীতির অংক যখন রাজনৈতিক অংকের কাছে পরাজিত হয় তখন দরকার হয় প্রাজ্ঞ ও সাহসী রাজনৈতিক নেতৃত্বের।

গত কয়েক বছর ধরেই আমরা কর ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য ভ্যাট আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করার ক্ষেত্রে এক পা এগিয়ে দুপা পিছিয়ে আবার তিন পা এগোনোর ভান করে সময়ক্ষেপণ করেই চলেছি। বোঝা যাচ্ছে, প্রাজ্ঞ ও সাহসী রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য আমাদের অপেক্ষা ফুরায়নি। এই অর্থবছর কি সেই অপেক্ষার প্রহর শেষ হওয়ার বছর হয়ে উঠবে?

কোনো সংস্কারই শুরুতে জনপ্রিয় হয় না। সাধারণ মানুষের কাছে যখন সরকার এবং রাষ্ট্রের জনকল্যাণমুখী চরিত্রটি জোরালোভাবে প্রতিভাত না হয়ে উল্টোটাই মূখ্য হয়ে উঠে, তখন সরকারের গৃহীত নতুন পদক্ষেপ মানুষ শুরুতে সন্দেহের চোখে দেখে; পরে অনেকটা মেনে নেয়; তারও পরে গৃহীত পদক্ষেপের সুবিধা নেওয়ার জন্য সক্রিয় হয়। এটাই মানুষের ধর্ম। বাংলাদেশ যখন নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে বাণিজ্য উদারীকরণের কাজে হাত দেয়, তখনও এমনটাই দেখা গেছে।

অতিসম্প্রতি দক্ষিণ এশীয় দেশসমূহের মধ্যে যোগাযোগ এবং সহযোগিতার যে নীতি বাংলাদেশ গ্রহণ করেছে, সে বিষয়েও একই রকম প্রতিক্রিয়া সহজেই অনুমেয়। তা নিয়ে সরকার ভয় পেলে দেশের ক্ষতি হয়।

সরকারের গৃহীত সংস্কার সম্বন্ধে জনমনে দানা বাঁধা সন্দেহের সুযোগ নিয়ে বিরোধী পক্ষ রাজনীতির মাঠ ঘোলা করবে, এটাই উন্নয়নশীল দেশের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা। বাংলাদেশ সেখানে ব্যতিক্রম নয়। এখানে অতীতে সেটা হয়ে এসেছে। রাজনীতিতে যে দুই পক্ষ গত দুযুগ ধরে পালাবদল করে ক্ষমতা ভোগ করে আসছে, তারা সস্তা জনপ্রিয়তার লোভটুকু সামলে কল্যাণকর সংস্কারের বিরোধিতা না করার মতো পরিপক্ক হয়ে ওঠেনি।

কিন্ত এ বছর পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি যে কারণ বা প্রক্রিয়ায় হোক না কেন, বর্তমানে বেশ দুর্বল বলেই মনে হচ্ছে। একটি গণমুখী এবং জনকল্যাণকর সংস্কারের বিরুদ্ধে তেমন জোরালো আন্দোলন জমিয়ে তোলার বাহুবল তাদের আছে কিনা সেটা নিশ্চিত নয়। বর্তমান সরকারের মতো বাংলাদেশের নব্বই-পরবর্তী সরকারসমূহ এমন অনুকূল রাজনীতির ময়দান আর পেয়েছে বলে মনে হয় না। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতিরোধ এবং প্রতিবাদহীন অর্থনৈতিক নৈরাজ্যের পথে হাঁটতে পারে সরকার; আবার চাইলে অর্থনৈতিক সংস্কারের কাজেও হাত দিতে পারে।

আমরা চাই সরকার দ্বিতীয় পথেই হাঁটুক। ২০১৫-১৬ অর্থবছরটি হয়ে উঠুক সংস্কারের বছর।

ড. আবুল বাসার: গবেষক, বিআইডিএস এবং সাবেক অর্থনীতিবিদ, বিশ্ব ব্যাংক।