ফতোয়া: নারীমুক্তি কি সম্ভব

মাকসুদা সুলতানা
Published : 24 May 2011, 05:15 PM
Updated : 24 May 2011, 05:15 PM

এক দশক আগে নারী নির্যাতন রোধে হাইকোর্টের একটি রায় ছিল ফতোয়ার প্রয়োগ নিষিদ্ধ করা নিয়ে। এটি মানবতাবাদী বিভিন্ন সংগঠন থেকে সমর্থনও পেয়েছিল। ২০০১ সনের জানুয়ারি মাসের হাইকোর্ট ফতোয়ার নামে আইন বিরুদ্ধ কিছু করাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এটি ছিল সেসময় পত্রিকায় হিল্লা বিবাহের খবরের প্রতিক্রিয়া। এখানে মৌলবি সাহেবের ঘোষণাটি ছিল একজন মহিলার প্রতি যিনি তার আগের স্বামীকে ফিরে পেতে চাইছিলেন। তাকে ইসলামিক ফতোয়ার নাম দিয়ে মৌলবি অন্য একজনকে বিয়ে করে পূর্বের স্বামীকে পুনরায় বিয়ের মাধ্যমে ফিরে পেতে পারবে বলে ফতোয়া দেয়।

পরবর্তীতে মুফতী তায়েফ ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এই আইনের বিরুদ্ধে পিটিশন জারির মাধ্যমে তাদের অবস্থান নেন। ২০১১ সালের ১২ই মে সেই ঘোষণাকে আপীল বিভাগ আংশিকভাবে বাতিল ঘোষণা করেন। এই বাতিল করার সমর্থনে তাদের যেই যুক্তি ছিল তা হল ফতোয়াকে একটি মতামত প্রদানের স্বাধীনতা বা মতবাদ হিসাবে দেখানো। আপীল বিভাগের ঘোষণা অনুসারে ফতোয়ার মাধ্যমে কারো শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি সাধন করা যাবে না। ধর্মীয় ভিত্তিতে ফতোয়া দেওয়া যেতে পারে তবে শিক্ষিত ব্যক্তি ঐ ফতোয়া দিতে পারেন এবং ফতোয়া যিনি গ্রহন করবেন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তা গ্রহণ করতে পারবেন। এই আইনটি পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, এটি স্পষ্টতই নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে যায়। কেননা এখানে শিক্ষিত ব্যক্তি কে? তা কীভাবে নিশ্চিত হবেন সেটা খুবই অস্পষ্ট ও পরবর্তী একটি বিষয় । এক্ষেত্রে গ্রামের সাধারণ অর্ধশিক্ষিত মানুষ যারা ফতোয়ার শিকার, তারা একজন সাধারণ মাওলানাকেও যথেষ্ট শিক্ষিত এবং একজন ফতোয়াপ্রদানকারী ব্যক্তি হিসাবে মনে করতে পারেন। তাদের পক্ষে বোঝা কষ্টকর কোন কোন ব্যক্তির এই ফতোয়া বিষয়ক জ্ঞান রয়েছে।

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে হিল্লা বিবাহের যে ফতোয়া জারি করা হয় এতে নারীর সম্মতি আছে কিনা, তাতে কী ধরনের মানসিক ক্ষতিসাধন হয় সে বিষয়টিও এই নতুন আইনজারির মাধ্যমে প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের নারী নির্যাতনের যে ভয়াবহ চিত্র আমরা দেখি তার বেশ কিছু ঘটনাই ফতোয়া প্রদান ও তার প্রয়োগের ফলে হয়ে আসছে। এ বিষয়টি কি সংবাদপত্রের পাতায় দেখেও আমরা এড়িয়ে যেতে পারি? কত নারী যে জারিকৃত ফতোয়ার রায় মানতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিল অথবা জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে রইল সে কথা কি আমরা বিস্মৃত হতে পারি?

আপীল বিভাগ যদি ফতোয়া প্রদানে কোন প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের কথা উল্লেখ করতেন মধ্যপ্রাচ্যের মতো, তাহলে হয়ত শিক্ষিত ব্যক্তি বলে কাকে ভাবা হবে সে বিষয়টি পরিষ্কার হতো। শিক্ষিত ব্যক্তির দ্বারা প্রদানকৃত ফতোয়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেউ পালন করতে পারবে–এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ২০০১-এর জানুয়ারি মাসের "ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা" রায়টিকে কি পুরোপুরি স্ববিরোধী করে দেওয়া হলনা? এ বিষয়টি বর্তমান সময়ে যে কোন নারী সদস্যের সাথে সভ্য মানবসমাজের কাছেও একটি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। তারপরও নারীর অধিকার ক্ষুণ্নকারী হাইকোর্টের আদেশ এভাবে ধোয়াচ্ছন্ন করে রাখার যে প্রবণতা আমাদের দেশের আইন ও বিচার বিভাগে দেখা যায়, তার পিছনে  পিতৃতান্ত্রিক সমাজের কিছু প্রভাবশালী মহলের স্বার্থ রয়েছে কিনা সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার।

উন্নত বিশ্বে যে কোন প্রতিষ্ঠিত আইনকে এত দ্রুত পরিবর্তন এবং তার কিছুদিন পরই এর গুরত্বকে আরো শিথিল করে নতুন আইন প্রণয়নের বিষয়টি খুব কমই ঘটে। বাংলাদেশের মত দেশ যে কিনা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে ইতোমধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে সমালোচিত সেখানে কি এধরণের আইনকে শিথিল করে দেখা উচিত হবে? তারপরও ফতোয়ার মত একটি ধর্মীয় অস্ত্র যা সামাজিকভাবে নারী স্বাধীনতার পরিপন্থী ও নারী নির্যাতনের হাতিয়ার হিসাবে গ্রামের মাতব্বর ও রাজনৈতিক প্রশ্রয়প্রাপ্ত কিছু নেতৃবৃন্দ ব্যবহার করে আসছেন, তাদেরকে কি আরও আশকারা দেয়া হল না? যে দেশে তসলিমা নাসরিনের মতো লেখিকা তার স্বাধীন মতামত প্রকাশের জন্য প্রায় পুরো জীবনই ভিনদেশের আশ্রয়ে পার করে দিতে হচ্ছে মৌলবাদীদের ভয়ে, যে দেশে ফতোয়াকে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা হিসাবে দেখানো হয়, তখন বিষয়টি কি প্রশ্নের উদ্রেক করে না যে কোন বোধসম্পন্ন মানুষের মনে?

বাংলাদেশের আনাচে কানাচে আজও ঘটে দোররা মারা, পাথর মারা, এ জাতীয় বিভিন্ন ধরণের নারী নির্যাতন। আর এ ক্ষেত্রে অনেকেই দোহাই দেন ফতোয়া বা ইসলামিক শরীয়া আইনের। এ সমাজে কত নারী গ্রাম্য মাতব্বরদের চাপে কতটা নির্মমভাবে নির্যাতিত হয় তার কয়টির রিপোর্ট হয় অথবা সংবাদকর্মীর মাধ্যমে আমাদের নজরে আসে? গ্রামে অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত মানুষের সংখ্যাও কম নয়। তারা ফতোয়ার কথা জানতে যে মাওলানা বা মৌলবির আশ্রয় নিবেন তিনি উপযুক্ত ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত কিনা–এটি জানাও এক বড় প্রশ্নের বিষয়। এ সমস্যার সমাধানে আইনের অনুমতি ছাড়া ফতোয়ার প্রয়োগ নিষিদ্ধ ও আইন-বিরুদ্ধ ঘোষণা করাই হতে পারতো হাইকোর্টের উপযুক্ত সিদ্ধান্ত।

ইসলামপন্থী বহু আরব দেশে গ্রামের মাতব্বর নয়, ফতোয়া দিতে পারে কোন কাজী বা বিচারক। যেখানে বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামের মানুষ শিক্ষা, আইন ও সুবিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত, সেখানে ফতোয়া ব্যবস্থা কীভাবে বহাল থাকবে এটি যথেষ্ট চিন্তাভাবনার বিষয়। আমাদের মতন উন্নয়নশীল দেশে যেখানে শিল্পের চাকা এবং কৃষির চাকা নারীদের দ্বারাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘোরে সেখানে ফতোয়ার মত বিষয়কে হালকাভাবে দেখা কি আপীল বিভাগের উচিত হবে? এটি আমাদের অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করি। কারণ বিপুল সংখ্যক নারী রূপান্তরিত হচ্ছেন শ্রমিকে। ফতোয়ার অনুমোদন এই রূপান্তরে বাধা সৃষ্টি করবে।

মাকসুদা সুলতানা: লেখক ও গবেষক।