গণতন্ত্রের রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতির সহাবস্থান কি সম্ভব

আবদুল গাফফার চৌধুরী
Published : 27 June 2015, 03:28 PM
Updated : 27 June 2015, 03:28 PM

হ্যারল্ড উইলসন তখন ব্রিটেনের লেবার সরকারের প্রধানমন্ত্রী। পার্লামেন্টে তাঁর মাত্র একজন সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতা। যে কোনো সময় মন্ত্রিসভার পতন ঘটতে পারে। এ সময় ব্রিটেনের বর্ণবাদী ফ্যাসিস্ট দল, ন্যাশনাল ফ্রন্টের এক নেতা উপনির্বাচনে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য হন। কিন্তু লেবার, লিবারেল ও টোরি দলের এমপিদের সম্মিলিত বিরোধিতায় তিনি পার্লামেন্টে ঢুকে আসন গ্রহণ করতে পারছিলেন না। সকল দলের এমপি ফ্যাসিস্ট দলের একজন সদস্যের সঙ্গে পার্লামেন্টে একাসনে বসতে রাজি ছিলেন না।

ন্যাশনাল ফ্রন্টের সদস্য তখন প্রধানমন্ত্রী উইলসনকে একটা প্রস্তাব দেন। তিনি জানান, তাকে পার্লামেন্টে বসার সুযোগ দেওয়া হলে তিনি যে কোনো অনাস্থা প্রস্তাবের মুখে লেবার সরকারকে সমর্থন দেবেন; তাহলে মন্ত্রিসভার পতনের আশঙ্কা থাকবে না। উইলসন এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, "আমি কোনো রাজনৈতিক কুষ্ঠরোগীর সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চাই না।"

বর্ণবাদ ও ফ্যাসিবাদকে উইলসন রাজনৈতিক কুষ্ঠরোগের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।

ব্রিটেনে এই ধরনের আরও একটি ঘটনা ঘটেছিল। পূর্ব লন্ডনের একটি বার কাউন্সিলে এক বর্ণবাদী নেতা কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই বার কাউন্সিল অফিসের সকল স্টাফ একযোগে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, বর্ণবাদী কাউন্সিলর অফিসে ঢুকলে তাঁরা আর কাজ করবেন না। ফলে ওই বর্ণবাদী কাউন্সিলরকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল।

দুটি ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচিত এমপি এবং কাউন্সিলর হওয়া সত্ত্বেও, ব্রিটেনের মতো গণতান্ত্রিক দেশেও দুজন বর্ণবাদী নেতাকে পার্লামেন্টে এবং বার কাউন্সিল অফিসে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এটা কি গণতন্ত্রের বরখেলাপ নয়?

এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন ব্রিটিশ লেবার পার্টির প্রয়াত বামঘেঁষা নেতা টনি বেল (অ্যান্থনি ওয়েজউড বেল)। তিনি বলেছিলেন, ''তেলে জলে যেমন মিশ খায় না, তেমনি গণতন্ত্রও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে– যে ষড়যন্ত্র গণস্বার্থ ও অধিকারের বিরোধী, তার সঙ্গে সন্ধি বা আপস করে টিকতে পারে না। টিকতে পারলে ত্রিশের দশকের জার্মানিতে ও ইতালিতে গণতন্ত্র হিটলার ও মুসেলিনির ফ্যাসিবাদের সঙ্গে আপস করে টিকতে চেয়েও টিকতে পারেনি কেন?"

ইউরোপে গণতন্ত্র ফ্যাসিবাদের কাছে বার বার মার খেয়ে শিক্ষা নিয়েছে। ফলে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার স্বার্থে জার্মানিসহ কোনো কোনো দেশে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, যাকে আপাতদৃষ্টিতে গণতন্ত্রবিরোধী মনে হতে পারে। ব্রিটেনের উদাহরণ আগেই দিয়েছি। জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের পতনের সত্তর বছর পরও নাৎসি দল এবং তাদের নেতার নামোচ্চারণ নিষিদ্ধ। 'হাই হিটলার' স্লোগান দেওয়া আইনত অপরাধ।

বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী এবং ঘাতক গোলাম আযমের কারাগারে মৃত্যু হলে সরকারি মসজিদে প্রকাশ্যে তার জানাযা অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়া হয়। এমনকি সরকারি পুলিশের পাহারায় প্রকাশ্য স্থানে তাকে কবর দেওয়া হয়েছে। ফ্রান্সে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন ফরাসী যুদ্ধপরাধী মার্শাল পেঁতাকে তার বার্ধ্যক্য বিবেচনা করে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়নি এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু কারগারে তার মৃত্যু হলে অত্যন্ত গোপনে অজ্ঞাত স্থানে তাকে কবর দেওয়া হয়। ফরাসী সরকার মনে করেছেন, প্রকাশ্য স্থানে তাকে কবর দেওয়া হলে দেশের ফ্যাসিস্টরা ওই কবরকে তাদের তীর্থভূমি বানিয়ে ফেলবে।

গণতন্ত্রে যা খুশি তা করার অধিকার নেই। গণতন্ত্র এখন নানা সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত। গ্রিক সিটি স্টেটের গণতন্ত্র আর ওয়েস্ট মিনিস্টার গণতন্ত্রের চেহারা এক নয়। কিন্তু গণতন্ত্রের কোনো সংজ্ঞায় তার এক গালে চড় মারলে আরেক গাল পেতে দেওয়ার কথা বলা হয়নি। গণতন্ত্রবিরোধী শক্তির সঙ্গে আপস করে, যুদ্ধ এড়িয়ে গণতন্ত্র নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার দায়ে হিন্দু মহাসভার মতো বিরাট দলকে নেহেরু সরকার বেআইনি ঘোষণা করেছিলেন। সেই হিন্দু মহাসভার পুনরুজ্জীবন ঘটানো আর সম্ভব হয়নি। হিন্দু মহাসভাপন্থীরা অন্য সেক্যুলার নাম গ্রহণ করে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছে, ক্ষমতায় গেছে। কিন্তু 'হিন্দু মহাসভা' নামে আর রাজনীতি করতে পারেনি।

একমাত্র বাংলাদেশেই স্বাধীনতার শত্রু এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী হত্যা ও গণহত্যার অপরাধের শরিক জামায়াতকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিষিদ্ধ করা সত্ত্বেও সামরিক শাসকেরা তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন। সামরিক শাসকদের দল তাদের ক্ষমতার শরিকও করেছেন। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ এবং একশ্রেণির মিডিয়া এখন দেশদ্রোহী এবং চিহ্নিত গণশত্রুদের রাজনৈতিক তৎপরতা চালাবার অধিকার সমর্থন করেন এবং তাদের অশুভ রাজনৈতিক তৎপরতা চালানো গণতন্ত্রের নামে তাদের অধিকার বলে মনে করেন এবং কোনো গণতান্ত্রিক সরকার এই গণবিরোধী শক্তির কার্যকলাপ বন্ধ করতে চাইলে বা মোকাবিলা করতে চাইলে তাকে গণতন্ত্রবিরোধী কাজ বলে প্রচার চালান। সেই সঙ্গে গণতান্ত্রিক সরকারকেই 'স্বৈরতান্ত্রিক সরকার' বলে আখ্যা দেন।

আমাদের বুদ্ধিবীজী শ্রেণির একাংশের এই বুদ্ধিভ্রংশের ফলেই আমাদের গণতন্ত্র বার বার বিপন্ন হয় এবং বিপর্যয় বরণ করে। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমরা যতটা একাট্টা হতে পেরেছি, সেই স্বাধীনতা এবং তার মূল্যবোধ রক্ষায় আমরা তেমন একাট্টা থাকতে পারিনি। এ জন্যে দায়ী সমাজের সাধারণ মানুষ নয়, শীর্ষ মানুষ। স্বাধীনতার আগে এই শীর্ষ মানুষেরা ছিলেন সাধারণ মানুষের চাইতে একটু কম হলেও নানা সুবিধাবঞ্চিত। স্বাধীনতা তাদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধার যে আলাদিনের চেরাগ এনে দিল তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার তারা করেছেন।

নব্যধনীদের মতো তারাও বিত্তবান হয়েছেন। তাদের বিত্তের সঙ্গে বিদ্যাবুদ্ধি মিশ্রিত থাকায় তারা জনগণকে বিভ্রান্ত করেছেন বেশি। কারণ, জনগণ তাদের শ্রদ্ধা ও আস্থার চোখে দেখে; অন্তত বহুকাল ধরে দেখেছে। এরা যখন দীর্ঘ গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া আওয়ামী লীগকে ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেওয়া বিএনপির সঙ্গে একাসনে বসান; স্বাধীনতার স্থপতির কন্যাকে সামরিক শাসকের পত্মীর সঙ্গে একই তুলাদণ্ডে মাপেন বা ক্যান্টনমেন্টে বসে বিএনপির দীর্ঘকাল দেশশাসন; দেশদ্রোহী জামায়াতকে রাষ্ট্রক্ষমতায় অংশীদার করা; সন্ত্রাসী মৌলবাদ লালন; হাওয়া ভবনের মতো দুর্নীতির 'বাস্তিল দুর্গ' গড়ে তোলাকে ছোট করে দেখিয়ে আওয়ামী লীগের ভুলত্রুটিগুলো বড় করে তুলে ধরে বিএনপির মতো সমঅপরাধী বা তার চাইতেও অপরাধী বলে প্রমাণ করতে চান, তখন সাধারণ মানুষ সহজেই বিভ্রান্তির শিকার হয়। এই বিভ্রান্তির মধ্যে গোটা দেশের রাজনীতি এখন ঘুরছে। বলা হচ্ছে, দেশ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় চলছে। কিন্তু গণতন্ত্র স্থিতি পাচ্ছে না।

মানুষ যেমন দুপায়ে চলে, গণতন্ত্রও তেমনি দুপায়ে হাঁটে। এই দুপায়ের একটি সরকারি দল এবং অন্যটি বিরোধী দল। স্বাধীনতার পর এই দ্বিদলীয় বা বহুদলীয় গণতন্ত্র বাংলাদেশে ছিল না। স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক দলগুলো নিষিদ্ধ হওয়ায় এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দুটি দল, সিপিবি ও ন্যাপ (মুজাফফর) আওয়ামী লীগের সঙ্গে গণঐক্য জোট গঠন করায় সংসদে এবং সংসদের বাইরেও বঙ্গবন্ধু সরকারের কোনো বিরোধী দল ছিল না। ১৯৭৩ সালে স্বাধীনতার-পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনেও জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের অস্তিত্ব ছিল না।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই শূন্যাবস্থা বিপজ্জনক। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো সদ্য সামরিক শাসন ও ধর্মীয় রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে বেরিয়ে আসা একটি দেশের জন্য আরও বেশি। সংসদের বাইরে প্রথম সংগঠিত বিরোধী দল হিসেবে দাঁড়ায় অবিভক্ত জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল। গত শতকের ত্রিশের দশকে ফ্যাসিস্ট হিটলার জার্মানিতে তার দলের নাম রেখেছিলেন ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টি, সংক্ষেপে নাৎসি। যার বাংলা হল, জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্রী দল। এটা জেনেও বাংলাদেশে যারা আওয়ামী লীগ ভাঙলেন, তারা কেন ফ্যাসিবাদী এই নামটি গ্রহণ করলেন তা আমার জানা নেই।

আমার তখন আশা ছিল, জাসদ সম্ভবত দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বিশেষ করে দেশের গণতান্ত্রিক বিরোধিতার শূন্যস্থানটি পূর্ণ করার চেষ্টা করবে। বাস্তবে দেখা গেল, যে দেশ ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতায় কলুষযুক্ত হয়ে এখনও প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকেই এগুতে পারেনি, গণতন্ত্রের ভিত্তিই যেখানে নাজুক, সেখানে জাসদ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অবাস্তব ও অতিবিপ্লবী স্লোগান দিচ্ছে। রাজপথে সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধাচ্ছে।

জাসদ যে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সরকার পরিবর্তন চায় না, বরং বলপ্রয়োগে সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটাতে চায় সে কথা প্রকাশ্যেই পল্টনের জনসভায় ঘোষণা করেন জাসদের তখনকার সভাপতি মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) জলিল। তখনও পাকিস্তানে আটক বাংলাদেশি সৈন্য ও অফিসাররা দেশে ফিরে আসতে পারেননি। মেজর জলিল পল্টনে জাসদের সভায় ঘোষণা করলেন, "পাকিস্তানে আটক বাংলাদেশি সৈন্যেরা শিগগিরই দেশে ফিরে আসছে। তারা ফিরে এলেই দেশে বিপ্লব ঘটানো হবে এবং সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করা হবে।"

বঙ্গবন্ধুর সরকার তখন চারদিক থেকে আক্রান্ত। একাত্তরের ঘাতক মৌলবাদীরা আন্ডারগ্রাউন্ডে সংঘবদ্ধ হচ্ছে এবং মসজিদ, মাদ্রাসাগুলোতে ধ্বংসাত্মক প্রচার চালাচ্ছে। সন্ত্রাসী মাওবাদী গ্রুপগুলো, বিশেষ করে সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি, পূর্ব বাংলা কম্যুনিস্ট পার্টি, হক-তোহা গ্রুপ গ্রামাঞ্চলে বিপ্লবের নামে হত্যা, সন্ত্রাস চালাচ্ছে। প্রকাশ্য সন্ত্রাসে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান নিয়ে রাজপথে নেমেছে জাসদ। এটা ঘরের অবস্থা। বাইরেও বঙ্গবন্ধু সরকারের অবস্থা ভালো ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতাকারী পাকিস্তান, সৌদি আরব, চীন ও আমেরিকা তখন একটি অক্ষশক্তি গড়ে তুলে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু প্রতিবিপ্লবী চক্রান্ত থেকে দেশের স্বাধীনতা এবং তার মূল্যবোধগুলো রক্ষার জন্য পূর্ব ইউরোপীয় সাবেক সমাজতন্ত্রী ধাঁচের রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। নাম দেন বাকশাল শাসন ব্যবস্থা। বাকশাল ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মিলিত মোর্চা। এই বাকশালকে এখন পর্যন্ত একদলীয় শাসন বলে প্রচার চালানো হয়। এটাই ছিল বাংলাদেশে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের আমলাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা পাল্টে প্রকৃত জনগণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ। বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী মহলের একটি শীর্ষ অংশের মধ্যে এখন যে গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না চলছে, তা এই বুর্জোয়া গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না, আর কিছুর জন্য নয়।

বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ভিত্তি ধনবাদ। ধনবাদ বা ক্যাপিটালিজম তার শোষণ ও শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য এ যুগে নির্ভর করে অস্ত্র ব্যবসায়ের মুনাফা ও ধর্মান্ধতার প্রসারের উপর। মার্কিন অর্থনীতি এখন সম্পূর্ণভাবে অস্ত্র ব্যবসায়ের মুনাফার উপর নির্ভরশীল। এই পুঁজিনির্ভর অর্থনীতি টিকে থাকার জন্যই বিশ্বের সর্বত্র যুদ্ধ বাঁধায় এবং বাঁধিয়ে রাখে।

ধনবাদী বিশ্বের নেতৃত্ব যখন ছিল ব্রিটেনের হাতে, তখন তারা নিজেদের আধিপত্য অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে সাধারণ মানুষের মনে গণতান্ত্রিক অধিকারবোধ বিকাশে বাধা সৃষ্টির লক্ষ্যে ছোট বড় ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তৈরি করে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ লাগিয়েছে। ওয়াহাবি মতবাদ ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট। এই ওয়াহাবি মতবাদ সৌদি আরবে একটি মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। যা স্বৈরশাসনের সব ইতিহাস ম্লান করে দিয়েছে।

আমেরিকা ব্রিটিশদের হাত থেকে ধনবাদী বিশ্বের নেতৃত্ব গ্রহণের পর আমাদের উপমহাদেশে মওলানা মওদুদীর পরিচালনায় জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠা ঘটায়। আমেরিকার নির্দেশে সৌদি আরব এই জামায়াতের প্রতিষ্ঠালাভে অর্থসাহায্য জোগায়। এই জামায়াত পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তানে আহমদিয়া-বিরোধী দাঙ্গা বাঁধিয়ে ৫০ হাজার মুসলমান হত্যা করেছিল। আর সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করে গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যায় অংশগ্রহণ করে। তারপরও আমেরিকা জামায়াতে ইসলামীকে সার্টিফিকেট দিয়েছে 'মডারেট মুসলিম গণতান্ত্রিক দল' হিসেবে।

আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে তালেবান, আল কায়েদা, সাম্প্রতিক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বাহিনী আইএসের জন্ম দিয়েছে। এদের দিয়ে যুদ্ধ বাঁধিয়ে রেখে তার ওয়ার ইন্ডাস্ট্রির প্রসার ও মুনাফা বাড়াচ্ছে। আমেরিকার এই কাজকে 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' এবং 'গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই' বলে সাধারণ মানুষকে বোঝানোর জন্য দেশে দেশে ওয়াশিংটন বুদ্ধিজীবীদের একটি শীর্ষ অংশকে পোষেন। মিডিয়াকে পোষেন। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশও এই পোষা বুদ্ধিজীবীদের অন্তর্ভূক্ত হয়েছেন। তাদের কাজ 'গণতন্ত্র গণতন্ত্র' বলে চিৎকার করে গণতন্ত্রের আসল শত্রুদের আড়াল করে রাখা। অথবা গণতন্ত্রের শত্রু ও মিত্রদের এক পাল্লায় তুলে এই শত্রু-মিত্র চেনার ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের একাংশ 'সুশীল সমাজ' নাম নিয়ে এ কাজটিই করে চলেছেন।

বঙ্গবন্ধু ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্যমুক্ত একটি সেক্যুলার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাও তাই চাচ্ছেন। শেখ হাসিনা তো গণতন্ত্রের ভাঙা তলোয়ার নিয়ে গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই চালাচ্ছেন। তাদের ভুলত্রুটি ছিল না বা নেই তা আমি বলি না। কিন্তু পিতা ও কন্যার অভীষ্ট লক্ষ্যের ব্যাপারে ভুল ধারণা পোষণের অবকাশ নেই। একুশ বছর পরে হলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরতে পেরেছিল বলেই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চরিত্র অনেকটা টিকে রয়েছে। নইলে পাকিস্তানের পূর্বাংশ হিসেবে বাংলাদেশে তালেবানতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেত এবং ধর্মান্ধদের রাজত্বে নাগরিক অধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও নারীস্বাধীনতা সবই বিপন্ন হত।

এত বড় সত্যটি আমাদের একটি সুশীল সমাজ কীভাবে বিস্মৃত হয়ে গণতন্ত্রের রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতিকে একাসনে বসিয়ে উভয়ের জন্য সমান গণতান্ত্রিক অধিকার দাবি করেন তা আমি বুঝি না। যারা স্বাধীনতা যুদ্ধ, এই যুদ্ধের নায়কদের স্বীকার করে না, যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে, জাতীয় সঙ্গীতের অবমাননা করে, জাতীয় পতাকা বদলাতে চায়, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা প্রচার করে, তাদের কি স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন এবং তার আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল ও নেতাদের সঙ্গে একাসনে বসিয়ে গণতান্ত্রিক সমমর্যাদা দেওয়া যায়? তাহলে ইউরোপে নাৎসি দল ও নব্য নাৎসি নেতারা সেই মর্যাদা ও অধিকার ফিরে পাচ্ছে না কেন? পৃথিবীর কোন দেশে চিহ্নিত দেশদ্রোহী, যুদ্ধাপরাধী এবং সন্ত্রাসীদের সমান নাগরিক অধিকার দেওয়া হয়েছে বা গণতন্ত্রের নামে সেই অধিকারের বলে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসতে দেওয়া হয়েছে? একমাত্র বাংলাদেশেই সেটা সম্ভব হয়েছে এবং তাতেও আমাদের সুশীল সমাজ খুশি নন।

আমাদের সুশীল সমাজের প্রচারে আন্দোলনের নামে বিএনপি ও জামায়াতের চরম সন্ত্রাস সৃষ্টি ও মানুষ পুড়িয়ে মারা তেমন গুরুত্ব পায় না, কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার এই সন্ত্রাস দমনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই তা গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের বরখেলাপ বলে গণ্য হয়। তারা কি সরকারের বিরোধিতা ও রাষ্ট্রের বিরোধিতার পার্থক্যটা বোঝেন না? বিএনপি কি আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতা করছে; না দেশদ্রোহী জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশের স্বাধীনতা এবং তার মূল ভিত্তিই উপড়ে ফেলার চেষ্টা দ্বারা বহুকাল রাষ্ট্রেরই বিরোধিতা করেছে? এই প্রশ্নটির মীমাংসা হওয়া দরকার।

দেশে আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় থাকে, তাহলে তার একটি শক্তিশালী বিরোধী দল সংসদে ও সাংসদের বাইরে থাকা প্রয়োজন। তারা অবশ্যই রাষ্ট্রের কতিপয় মীমাংসিত বিষয় মেনে নিয়ে বিকল্প রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সরকারের বিরোধিতা করবেন। সরকার তাদের কাজে বাধা দিলে তা হবে চরম অগণতান্ত্রিক কাজ। কিন্তু কোনো গণতান্ত্রিক সরকারই রাষ্ট্রের বা রাষ্ট্রীয় মূলনীতির শত্রুতা করাকে শত্রুদের গণতান্ত্রিক অধিকার বলে মেনে নিতে পারবেন না। ষড়যন্ত্রের রাজনীতির সঙ্গে গণতন্ত্রের রাজনীতির সহাবস্থানও সম্ভব নয়। বিএনপি, এমনকি জামায়াতও ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসের রাজনীতি ত্যাগ করুক, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করুক, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরে আসুক, তখন অবশ্যই তারা দেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক মর্যাদা ও অধিকার লাভের দাবিদার হবে।

ষড়যন্ত্র, ক্যু, সন্ত্রাস দ্বারা ক্ষমতা দখলের চেষ্টা গণতান্ত্রিক রাজনীতি নয়। ষড়যন্ত্রের রাজনীতির সঙ্গে গণতন্ত্রের রাজনীতির সহাবস্থান সম্ভব নয়। তা গণতন্ত্রের অন্তিত্বের জন্যও নিরাপদও নয়।

লন্ডন; ২৭ জুন, ২০১৫; শুক্রবার