একটি স্মৃতিকথন ও জনগোষ্ঠীর ইতিহাস

Published : 25 June 2015, 10:13 AM
Updated : 25 June 2015, 10:13 AM

নীরা লাহিড়ীর নিজের বোনের উপর লেখা উপন্যাস বা স্মৃতিচারণ, 'নীপা'। ভাবনা-চর্চার জগতে যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন, তেমনিভাবে একটি বেদনাঘনিষ্ঠ তীব্র অভিজ্ঞতা বা বর্ণনা। আমার স্বীকার করা উচিত যে, আমি এই পাঠের অভিজ্ঞতা বহন করে বেড়াতে চাই না। কারণ বারবার মনে হয়েছে, যদি নীপা আমাদের সঙ্গে থাকত তাহলে হয়তো এই পাঠের অভিজ্ঞতা আরেকটু সিগ্ধ হত।

একাত্তর-চর্চায় কোনো স্বস্তির স্থান নেই এবং হয়তো আমরা বিশাল সংখ্যা ও বড় বড় রাজনৈতিক সামরিক অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে সেই সময়ের অভিজ্ঞতা গ্রহণীয় করার চেষ্টা করি। কিন্তু এই উপন্যাসের ক্ষেত্রে এটা অসম্ভব, যেহেতু এটি একই সঙ্গে একটি পারিবারিক ইতিহাস, রাজনীতির ইতিহাস ও নারীর ইতিহাস এবং সব মিশে গিয়ে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ইতিহাস। সেই ইতিহাস নির্মাণটি এই সমাজের সবচেয়ে অগ্রণী অংশের বয়ানও বলা যেতে পারে। অতএব বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে কেউ যদি নীপার মুখচ্ছবিটা দেখে তাহলে আমরা বলব, শ্রেষ্ঠ চেহারাটাই ধরা পড়েছে। এমন কাজটি করেছেন নীরা লাহিড়ী, তার লেখা 'নীপা' গ্রন্থে।

উপন্যাসের পটভূমি ও কুশীলবরা পরির্বতনের পতাকা বহনকারী মানুষ। ১৯৬৯এর আন্দোলন দিয়ে যাত্রা শুরু। যেখানে প্রতিবাদের পতাকা একটি প্রতীকে পরিণত হয় যেটি রাজনৈতিক জলযানের মতো এপার থেকে অন্যপারে চলে যাচ্ছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে জড়িয়ে পড়েছে। যেমন, নীপার বাবা-মা ভাই-বোন, অনেকেই। আর সাধারণ মানুষের অহংকার, মানুষ হিসেবে।

একটি অসাধারণ চরিত্র, নীপার বাবা শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী। জন্মেছেন ১৯১৯ সালে। পাবনার মানুষ। বড় হয়েছেন রাজশাহীতে। পেশায় সরকারি কলেজের বাংলার শিক্ষক। সর্বদা তটস্থ থাকেন চাকরির কী হয় না হয় তা ভেবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাতৃভূমি ত্যাগ করেননি তিনি। ব্যক্তিজীবনের বীর নন, জীবনের টিকে থাকার যোদ্ধা।

''লাহিড়ী বাবুর ভাই-বোন, মা-বাবা সবাই এক এক করে চলে গেলেন ভারতে। কারণ খুবই স্পষ্ট। সংখ্যালঘু হয়ে এদেশে থাকাটা তারা একেবারেই সমীচীন বোধ করেননি। কিন্তু শিবপ্রসন্ন কিছুতেই পারলেন না দেশপ্রেমকে অপশন দিয়ে ভারতে চলে যেতে। অথচ তিনি কিন্তু পড়াশুনা করেছেন ক্যালকাটা ইউনির্ভাসিটিতে।"

[পৃষ্ঠা- ১৯]

অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে লেখক পারিবারিক ও সামাজিক সংকট উপস্থিত করেছেন এই গ্রন্থে। নিম্নবিত্ত সংখ্যালঘু পরিবারের মাটির টানের এমন বর্ণনা সচরাচর পাওয়া যায় না, যদিও আবেগ-উচ্ছ্বাস রয়েছে ভাষা-বর্ণনা ও বিবরণের স্থানে। কিন্তু তারপরও এ রকম দলিলি ঢঙে এই বিষয় নিয়ে খুব কম লেখা দেখা যায়। সে কারণেই লেখাটির বহুবিধতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ পরিবারের বাইরে থেকে এ গ্রন্থে রাজনীতি আসেনি। সে পরিবারের সদ্যসদের ভাবনার জগতে আলাদা স্থান থেকে আসেনি এই সব ভাবনা, তাদের চোখে যেটা দেশপ্রেম বলে ধরা পড়েছে।

তবে যদি লেখক এই পরিসর সীমাবদ্ধ রাখতেন, কেবল পটভূমি উল্লেখ করেও, তাহলে এটা ইতিহাসচর্চার রসদ গ্রন্থ হিসেবে বেশি না হয়ে একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিচারণ হত। মাঝেমধ্যে কিছু পাঠকের মনে হতে পারে তিনি ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার একটা সচেতন প্রচেষ্টা করেছেন যা কখনও কখনও সামান্য হলেও ধারাবর্ণনায় ব্যাঘাত ঘটায়। কিন্তু লেখক এই বাড়তি আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কারণ বিভিন্ন স্তর থেকে এমন সাবলীলভাবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বর্ণনা কমই দেখতে পাওয়া যায়।

ষাট দশকের সংস্কৃতির একটি অসাধারণ দলিলচিত্র এই গ্রন্থটির বিভিন্ন চরিত্র গ্রন্থটির পাতায় পাতায় আসে এবং চলে যায় একটি বিশেষ রাজনীতির পরিচয় ধারণ করে। বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির মূলধারা এবং সবচেয়ে সবল অস্তিত্ব ছিল আওয়ামী লীগের। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগ ছিল প্রধানত মুসলমান মধ্যবিত্ত নিয়ন্ত্রিত এবং মূলধারার দল হিসেবে তারা আন্তঃসাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে উদারতা এবং বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিঘনিষ্ঠ ছিল। এ রকম একটি দলের সঙ্গে হিন্দু জনগোষ্ঠীর যে সব সময় যে মিল হত তা নয়।

বাম রাজনীতির দল-উপদলের মধ্যে সচেতন হিন্দুদের উপস্থিতি বেশি দেখা যায়। লাহিড়ী পরিবারের সদ্যসরা বামঘেঁষা ছিল। ষাটের একটি সংস্কৃতির বড় অংশ ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্র করে। অনেকের কাছে তাই আন্তঃসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তা নির্মাণের ক্ষেত্রে ভাষাই ছিল প্রধান পথ এবং ভাষাকেন্দ্রিক আন্দোলনই সবার কাছে তার পরিসর যুক্ত করে দেয়। সেই সূত্র ধরেই ছিল ষাটের দশকের লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন।

''নীপা, এবার কিন্তু একুশে সংকলন বের করতে হবে। চল।

কোথায় যাব?

আরে বোকা, ফান্ড যোগাড় করতে হবে না? বিনে পয়সায় কি আর সংকলন বেরুবে?

কত কত সংকলন যে বেরুত, তার হিসাব নেই। বিভিন্ন কলেজ আর পাড়াভিত্তিক, সংগঠনভিত্তিক, এছাড়াও ভার্সিটির ছেলেমেয়েরা ছোট ছোট লিটল ম্যাগাজিনের মতো সংকলন বের করত। অ্যাড যোগাড় করা হত বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে। নামও দেওয়া হত সে সব সংকলনের। বিভা, জ্যোতি, জয়, মাতৃকা নানা নামে ছোট ছোট কবিতা গল্প মিনি প্রবন্ধ নিয়ে বেরুত। একুশের আগের রাত থেকে সে সব বিক্রি শুরু হয়ে যেত শহীদ মিনার ও তার আশেপাশে।

প্রথম একুশে সংকলন বের করেছিলেন ১৯৫৩ সালে, হাসান হাফিজুর রহমান। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে দলে দলে ছেলেমেয়ে আর ছাত্রছাত্রীরা একুশে সংকলন বের করত। সেগুলোর মান নেহাত খারপ ছিল না। বেশিরভাগ গল্প কবিতা লেখা হত শহীদস্মৃতি এবং বাংলা ভাষার উপর। একেই একুশে সাহিত্য বলা যায়।"

[পৃষ্ঠা-২৯৩,২৯৪]

রাজনীতি ও সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমেই বাংলাদেশের জন্মের সূত্রপাত। যুদ্ধের সময় পালিয়ে যাওয়া মানুষের এই বর্ণনা সেই সময় দক্ষভাবে উপস্থিত করার চিত্র:


"রমার শাড়ির কাঁথাকাজে দিল খুব। বিলজোড়া খোলা হাওয়া, শীত লাগছে। শিবপ্রসন্ন, আবুল আর শাহাদাত কাঁথা-টানাটানির যুদ্ধ করল সারা রাত এবং এক পর্যায়ে শিবপ্রসন্ন বলে উঠলেন, কাঁথাটা আমাকে দাও। আমার খুব ঠান্ডা লাগছে।

নীপা হাঁটু মুড়ে বসে রইল সারারাত। কী যেন ভাবল। সুমন ঘুমের মাঝে উঠে ফিডার খেয়েছে একবার। তারপর আবার ঘুম। রমা সবাইকে চিড়ে-মুড়ি সাধলেন। কেউ খেল না। তিনি খেতে শুরু করলেন মুঠোভরে। দুপুরের খাওয়া হয়নি তাঁর। সারাটা রাত বিলের ঘাসের উপর কাটল হাজার হাজার মানুষের। বাদাইয়ের পাশ ঘেঁষে সকালের সূর্য উঠল আকাশ রাঙা করে। গ্রামের পোড়াবাড়ির ছা্ই উড়িয়ে নিয়ে গেল দখিনা বাতাস। মানুষের কোলাহল আর শিশুদের কান্নায় বিলের বাতাস ভারি। পুরু ঘাসের আর এবড়োখেবড়ো ফাটা মাঠের ভিতর ভোরের রোদ্দুরে আবার হাঁটা আর হাঁটা, আরও কত দূর পালানো যায়? বোতলের জল শেষ হয়ে গেছে। প্রচণ্ড তেষ্টায় প্রাণ যায়।"

[পৃষ্ঠা-৩৫৪,৩৫৫]

নীপা যোদ্ধা ছিলেন। নীপাকে নীরা এমনিভাবে উপস্থিত করেছেন:

"গোটা গ্রাম জ্বলছে। আগুন ছড়িছে পড়েছে ঘরের চালে। নীপা অস্ত্রগুলো উদ্ধারের জন্য বিপদ মাথায় নিয়ে আবার ঘরে ঢোকে। সে গ্রেনেড আর অস্ত্রের ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে বেরুতে চেষ্টা করে ঘর থেকে। কিন্তু আগুন ততক্ষণে ছড়িয়ে ঘরের চাল থেকে তরজার বেড়ায়। কামান গর্জনের নারকীয় আওয়াজে কান পাতা যাচ্ছে না। ধোঁয়ার অন্ধকার চারদিক, তার মাঝে মাঝে ঝলকিত আগুনের শিখা। ঘরের চাল ভেঙ্গে পড়ে। নীপা অস্ত্রের সম্ভার নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু কখন সে আগুনের স্ফুলিঙ্গ তার দেহে ছুটে এসেছে জানতে পারেনি নীপা।"

[পৃষ্ঠা-৪৬৯,৪৭০]

কিন্তু উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধ বা রাজনীতির স্মৃতিচারণের চেয়ে অনেক বৃহৎ। লেখক আশ্চর্য ক্ষমতা ও দক্ষতার সঙ্গে অনেকের জীবন, ভাবনা ও ইতিহাস একত্রিত করেছেন। নিজের পরিবারের সদস্যদের জীবন-মৃত্যু নিয়ে লেখা অত্যন্ত দুরুহ কাজ যেটি নীরা লাহিড়ী অবিশ্বাস্য সবল হাতে পালন করেছেন। একজন মানুষের জীবন কীভাবে একটি জাতির জীবনের গাঢ় রঙ ধারণ করতে পারে যে রঙ পতাকার রঙের সঙ্গে মিশে যায় তা এই গ্রন্থ পাঠ ব্যতীত বোঝা সম্ভব নয়। গ্রন্থের সর্বশেষ লাইনটি নীরার মা রমা লাহিড়ীর যা সবার জন্য প্রযোজ্য।

"রমা তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত নীপার অপেক্ষা করেন।"

[পৃষ্ঠা-৪৭৪]

'নীপা' গ্রন্থের লেখক নীরা লাহিড়ীর জন্ম ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর। বাবা অধ্যক্ষ শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী বাংলা ভাষার অভিধানপ্রণেতা। মা অধ্যাপিকা রমা লাহিড়ী বাংলা সাহিত্য আর ভাষাতত্ত্বের গবেষক। মায়ের কাছেই রাজনীতির হাতেখড়ি। অতঃপর মুক্তিযোদ্ধা বড় বোন নীপা লাহিড়ীর সাহচর্যে বিপ্লবে দীক্ষা। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হলেন মেডিকেল ছাত্রী নীপা আর অপূর্ণ ইচ্ছার ভার নিজ কাঁধে তুলে নিলেন ছোট বোন নীরা। ডাক্তারি, পোস্ট-গ্রাজুয়েশনের জটিল পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম নারী রেডিওলজিস্ট নারী লাহিড়ী সাহিত্যে ইতোমধ্যে তাঁর প্রাণপ্রাচুর্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। একাধিক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছেন তাঁর। তিন সন্তানের জননী নীরা লাহিড়ীর চতুর্থ সন্তান সাহিত্যকর্ম ।

আফসান চৌধুরী: লেখক, সাংবাদিক ও অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।