মোদি কী নিয়ে গেলেন, কী দিয়ে গেলেন

আমানুল্লাহ কবীর
Published : 22 June 2015, 05:10 PM
Updated : 22 June 2015, 05:10 PM

ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি দুদিনের (জুন ৬-৭) সফরে কী নিয়ে গেলেন, কী দিয়ে গেলেন? পাল্লাটা ভারি কোন দিকে– ভারতের দিকে, না বাংলাদেশের দিকে? যে ভালোবাসা তিনি নিয়ে এসেছিলেন, পেয়ে গেলেন কি তার বেশি, না কম?

ওই দুদিন ছিল মোদিতে আমোদিত বাংলাদেশ, লেনদেনের হিসাবের ফুরসৎ কোথায়? ঢাকায় বসে ভারতের খানা খেলেও তাঁর আপ্যায়নে কমতি ছিল না। বাংলাদেশের অতিথিপরায়ণ মানুষ তাঁর পাতে তাঁর পছন্দসই খানাই তুলে দিয়েছে। বড় দেশের বড় মেহমান, আদর-আপ্যায়ন তো হবে সে মান বজায় রেখেই। মোদি খুশি। বলে গেছেন, ২০২১ ও ২০৪১ ঘিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে আশা, তার পাশেই থাকবেন তিনি, বাংলাদেশকে বানাবেন ভারতের সহযাত্রী।

সেই সহযাত্রার আনুষ্ঠানিক সূচনাই করে গেলেন তিনি। ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে দুশ কোটি ডলারের ঋণ। এছাড়া দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য রিলায়েন্স ও আজাদী গ্রুপের সঙ্গে স্বাক্ষরিত হয়েছে ৫০০ কোটি ডলারের দুটি সমঝোতা স্মারক।

মোদির আগমনের আগে ঢাকার ওয়াকিবহাল মহলে কানাঘুষা চলছিল তাঁর আস্তিনের নিচে এরপরও থাকতে পারে কিছু চমক, যা তিনি ঘোষণা করতে পারেন দুদেশের শীর্ষ বৈঠকে। আসলে চমকটা তাঁকে দিয়েছে বাংলাদেশের মানুষই। যে ভারত-বিরোধিতার জন্য বাংলাদেশের জনগণের দুর্নাম আছে, এক বাক্যে তারা মোদিকে স্বাগত জানিয়ে চমকে দিয়েছে তাঁকেই। অনেকেই দ্বিমত প্রকাশ করলেও বলতে হবে, মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য-সহযোগিতা করেও বাংলাদেশ সফরে এসে ইন্দিরা গান্ধী যে স্বস্তি পাননি, তেতাল্লিশ বছর পর মোদি বুকভরে সে স্বস্তি নিয়েই ফিরে গেলেন।

বিশ্বের উদীয়মান শক্তি ভারতের উত্তাপ ক্ষুদ্র প্রতিবেশি বাংলাদেশ যথার্থই অনুভব করেছে। উত্তাপে বিচলিত না হওয়ার জন্য প্রতিবেশিদের প্রতি মোদির সান্তনা: আমরা Big Brother নই, Elder Brother– শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে দক্ষিণ এশিয়ার সকল দেশকে দাওয়াত দিয়ে তিনি বলেছিলেন, আমরা প্রতিবেশিদের সঙ্গে বৈরিতা নয়, বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে চাই।

রাজনীতিক হিসেবে মোদি উচ্চাভিলাষী। তাঁর উচ্চাভিলাষ ভারতকে নিয়েও। তাঁর এই উচ্চাভিলাষ দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি ছাড়িয়েও। বিশ্বের দরবারে তিনি ভারতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান বিশ্বশক্তি হিসেবে; নিজের দেশে চান জওহরলাল নেহেরু আর ইন্দিরা গান্ধীর পাশে নিজের নাম লেখাতে; আর দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশি হিসেবে। শক্তিধর ভারতের নেতা হিসেবে তিনি আসন করে নিতে চান বিশ্বের দরবারে বারাক ওবামা ও শি জিনপিংএর পাশে।

আন্তর্জাতিক মহলে আসন করে নিতে হলে নিজের ঘরে ও দক্ষিণ এশিয়ায় শক্ত মাটির উপর দাঁড়াতে হবে। এ জন্য ভারতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং অর্থনৈতিক পরিধি বাড়াতে হবে। ভৌগলিকভাবে ভারতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আফগানিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সকল দেশই ভারতের সীমান্তলগ্ন প্রতিবেশি। সুতরাং প্রতিবেশিদের নিরাপত্তা বহুলাংশে নির্ভর করে বৃহৎ প্রতিবেশি ভারতের উপর।

নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও ভারতের কাছে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক কারণে। দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমারের সঙ্গে কয়েক মাইল অভিন্ন সীমান্ত বাদ দিলে বাংলাদেশ বস্তুত তিন দিক দিয়ে পরিবেষ্টিত ভারত দ্বারা। বাংলাদেশের বের হওয়ার পথ কেবল বঙ্গোপসাগর। অন্য কথায়, বাংলাদেশ অবস্থিত ভারতের পেটের মধ্যে। পেটের মধ্যে অবস্থিত থেকে বাংলাদেশ ভারতের পেট কামড়াবে, এটা হতে পারে না।

ওদিকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিদ্রোহীদের উপদ্রব। উপদ্রুত উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান। বিদ্রোহের কারণ একমাত্র জাতিসত্তা নয়, ওই অঞ্চলের অনুন্নয়নও। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের সহজ পথ বাংলাদেশের ভূখণ্ড। এসব কারণেই ভারতের কাছে বাংলাদেশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশি। আন্তর্জাতিক শক্তির মহড়ায় খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিবেশি চীনের দাপুটে আবির্ভাব ভূরাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে ভারতের কাছে করে তুলেছে আরও গুরুত্বপূর্ণ।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছেন, ভারত বাংলাদেশকে সহযাত্রী করেই এগুবে। যে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ দমনে ও নিরাপত্তার উপর তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন, সে লক্ষ্যে পৌঁছুতে হলে ভিন্ন যাত্রা হতে পারে না। জঙ্গিবাদ বলতে বর্তমান আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ইসলামি জঙ্গিবাদই বোঝায়। বাংলাদেশ মুসলমানপ্রধান দেশ। ভারতেও ১৫ কোটির বেশি মুসলমান রয়েছে। কিছুদিন আগে আল-কায়দা প্রধান আল-জাওয়াহারি ভারত ও বাংলাদেশে তাদের কর্মকাণ্ড চালানোর হুমকি দিয়েছে।

দুদেশে জঙ্গি নেটওয়ার্কের তৎপরতা কীভাবে একই সূত্রে চলছে, তা তদন্তের জন্য ভারতের একটি গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষজ্ঞ দল কয়েক মাস পূর্বে ঢাকায়ও এসেছিল। জেএমবিসহ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের কয়েক জনকে উভয় দেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। উভয় দেশ জঙ্গিবাদ দমনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, সফরের সময় মোদি তার অঢেল প্রশংসা করেছেন। শেখ হাসিনা তাঁর দৃঢ় সংকল্প একাধিকবার পুনরুল্লেখ করে বলেছেন, সন্ত্রাসী ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁর দেশের মাটি ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না।

মোদি সরকার তাঁর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহী বা সন্ত্রাসী তৎপরতা দমনের ব্যাপারে কত তৎপর তার প্রমাণ চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহীদের ঘাঁটিতে ভারতীয় সেনা অভিযান। ভারতের তথ্য প্রতিমন্ত্রী বলেছেন: ''এ হামলার মধ্য দিয়ে আমরা প্রতিবেশিদের প্রতি এ বার্তা দিতে চাই যে, সীমান্তের ওপার থেকে কোনো জঙ্গি হামলা আমরা সহ্য করব না। জঙ্গি দমনে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আমরা আমাদের পছন্দমতো যে কোনো জায়গায়, যে কোনো সময় হামলা চালাব।''

মিয়ানমার ছাড়াও ভারতীয় জঙ্গিদের আশ্রয়স্থল হচ্ছে ভুটান, নেপাল ও চীন। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার অভিযোগ, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীরা এখনও বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করছে।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মোদি সরকার ভারতের প্রতিবেশি চীনকেই প্রধান শত্রু হিসেবে শনাক্ত করেছে। এর প্রধান কারণ কেবল সীমান্ত বিরোধ নয়, ভূরাজনৈতিকও। প্রতিবেশি হলেও ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত কারণে ভারত ও চীন পরস্পরের প্রতিপক্ষ। প্রেসিডেন্ট বারাক ওমার সফরের সময় মোদি এটা স্পষ্ট করেছেন যে, আন্তর্জাতিক রণাঙ্গনে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত পার্টনার। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে counter weight হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ পাবে। চীনের পাশাপাশি ভারতও নৌশক্তি বৃদ্ধি করছে। ভারত মহাসাগরে ভারতের নৌশক্তি বৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য স্বস্তিদায়ক না হলেও চীনের প্রতিপক্ষ শক্তি হিসেবে তা কাজে দেবে বলে যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে নিরব।

বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রপথে যোগাযোগ ও সহযোগিতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে নরেন্দ্র মোদি কৌশলগত দিক থেকে বঙ্গোপসাগরের উপর যে গুরুত্ব দিয়েছেন, তা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। ভারতের পূর্বাঞ্চলের এই জলরাশি অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক কারণে চীনের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। চীন তিব্বত ও ইউনানসহ তার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে উন্নয়নের যে প্রয়াস গ্রহণ করেছে, সে জন্য তার বঙ্গোপসাগরে প্রবেশদ্বার উম্মুক্ত করা দরকার। তাছাড়া মালাক্কা প্রণালি ঝুঁকিপূর্ণ বলে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে চীনের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যের পথ হচ্ছে বঙ্গোসাগর। কাজেই চীন বঙ্গোপসাগরে তার উপস্থিতি শক্তিশালী করতে চায়, যাতে ভারত মহাসাগরে তার স্বার্থ সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়।

বাংলাদেশ ভারতের সহযাত্রী হলে বাংলাদেশকে ভারত-মার্কিন অক্ষরেখায় পদচারণা করতে হবে। কিন্তু চীন চায় বাংলাদেশ নিরপেক্ষ এলাকা হিসেবেই তার অবস্থান মজবুত করুক। এ জন্যই বাংলাদেশের দিকে চীন বিশাল বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে হাত প্রসারিত করেছে। ইতোমধ্যে অর্থ বিনিয়োগ করে চীন, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষকে তাঁর 'অতি চীনপ্রীতি'র জন্য খেসারত দিতে হয়েছে। সেখানে সরকার বদলে সরাসরি 'র' এর হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে।

চীনের মতো ভারতের অর্থনীতি দ্রুত সম্প্রসারণশীল না হলেও বাংলাদেশকে চীনের পাল্টা প্রস্তাব হিসেবে ভারত অর্থনৈতিক সহযোগিতা দানে এগিয়ে এসেছে। বিশেষত বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে ভারত জলে-স্থলে-আকাশে যে যোগাযোগ জাল বিস্তারের উদ্যোগ নিয়েছে, তা এ অঞ্চলে তার প্রভাব নিরঙ্কুশ করারই প্রয়াস।

মোদির সফরের আগে চীন বেশ কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছিল। সম্ভবত তাঁর সফরের কারণেই সেগুলো ঝুলে ছিল। এই সফরের পর সে সব প্রকল্পের ভাগ্য কী হবে, তা দিয়ে শেখ হাসিনা সরকার তার কূটনীতিতে কতটুকু ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে সেটি নির্ধারিত হবে।

বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে শেষ পর্যন্ত কারা দায়িত্ব পাবে, সে প্রশ্নও সামনে এসে গেছে। ভারত থেকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার হয়ে কুনমিং পর্যন্ত যে অর্থনৈতিক করিডোরের প্রস্তাব চীন করেছিল এবং বাংলাদেশ ও মনমোহন সরকার যাতে উৎসাহ প্রকাশ করেছে তার ভবিষ্যত কী হবে, এ ব্যাপারে ঢাকায় মোদিকে সরব দেখা যায়নি।

এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, মোদির বন্ধুত্ব-সফরের পর বাংলাদেশের স্নায়ুর উপর চাপ বেড়েছে এবং বাংলাদেশের কূটনীতিতে নতুন করে বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রশ্ন ওঠা প্রাসঙ্গিক যে, চীনের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশ কি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে?

যে স্থলসীমান্ত চুক্তি নিয়ে এত হৈ-চৈ হল, তা একচল্লিশ বছরের পুরনো। ভারতের পার্লামেন্ট তা অনুমোদন করেনি বলে এতদিন ফাইলবন্দি হয়ে পড়েছিল। এটা ভারতের ব্যর্থতা। বাংলাদেশের জন্য তা দীর্ঘ প্রতীক্ষা হলেও উভয় দেশের ছিটমহলবাসীরা বসাবাস করেছে বস্তুত stateless মানুষের মতো, চরম অনিশ্চয়তা ও বঞ্চনার মধ্য দিয়ে। কে ফিরিয়ে দেবে তাদের জীবনের একচল্লিশটি বছর? বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চুক্তিটি বাস্তবায়নে উদ্যোগ ও আগ্রহ দেখালেও মনমোহন সরকারের আমলে পার্লামেন্টে এর অনুসমর্থন দিতে বিরোধিতা করেছিল বিজেপি।

বাংলাদেশের মাটি থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীদের উচ্ছেদ ও ট্রানজিট সুবিধা প্রদান করে আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে যে সহযোগিতা করেছে, বস্তুত তারই বিনিময়ে স্থলসীমান্ত চুক্তি শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়নের মুখ দেখেছে। এ জন্য সাফল্যের দাবিদার কেবল বাংলাদেশই হতে পারে। তবে মোদি সরকার নিঃসন্দেহে নিজের দেশে ও বাংলাদেশে তিস্তা চুক্তি না করেও এই সাফল্যের রাজনৈতিক ফায়দা লাভ করেছে।

তিস্তা চুক্তি আবার ঝুলে গেছে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে ঢাকায় এনে এত আদর-আপ্যায়ন করেও ফল হয়নি। মোদির সফরের সময়ও তিনি ঢাকায় এসে এ ব্যাপারে মুখ খোলেননি, যদিও তাঁর ফেব্রুয়ারির সফরের সময় বাংলাদেশকে এক ধরনের আশ্বাস দিয়ে গিয়েছিলেন।

মোদি বরং তিস্তার সঙ্গে ফেনী নদীর পানির হিস্যার কথা উত্থাপন করে শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। কারণ ফেনী নদীর উৎস বাংলাদেশের ফেনীতেই। ৫৪টি অভিন্ন নদীর মালিকানার দাবিদার চীন, ভুটান, নেপাল, বাংলাদেশ ও ভারত। সুতরাং পানি হিস্যার সমস্যাটি দ্বিপাক্ষিক নয়, বহুপাক্ষিক। এ জন্য বহুপাক্ষিক চুক্তিই কেবল পানি হিস্যার স্থায়ী সমাধান দিতে পারে। তাছাড়া পানিবিদ্যুতের যে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে, তা উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে আহরণ করে ভুটান, নেপাল, বাংলাদেশ ও ভারত, এ চারটি দেশই উপকৃত হতে পারে।

দুর্ভাগ্যজনক যে, ভারত বহুমাত্রিক যোগাযোগে উদ্যোগী হলেও আন্তঃবিদ্যুৎ সংযোগে আগ্রহী নয়। ভারত বর্তমানে ভুটানে ও নেপালে পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ করেছে এবং তা এককভাবে energy-hungry ভারতেই নিয়ে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের ফলে যে বহুমাত্রিক যোগাযোগের দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে, তার কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ। নৌ, রেল, সড়ক যোগাযোগ, যাই বলি না কেন, এসব ব্যবহারের সিংহভাগ সুযোগ পাবে ভারত। এর একাধিক কারণ হচ্ছে ভৌগলিক, অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক। এসব পথ ভারত থেকে শুরু হয়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে আবার ভারতেই শেষ হবে। আন্তঃদেশ সড়ক যোগাযোগের ফলে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানে যাতায়াত ও রপ্তানি আমদানির সুযোগ পেলেও ভারত যে কম খরচায় বিশাল বাণিজ্য সুবিধা পাবে তা সহজেই অনুমেয়।

ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি ও কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস চালু হওয়ায় ভারতই বেশি লাভবান হবে। কেননা ভৌগোলিকভাবে দূরবর্তী ও দুর্গম উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ভারতের বৃহদংশের যোগাযোগ অনেক সহজ হবে এবং মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ স্বাভাবিক হলে সেখানকার জনগোষ্ঠীর উপর তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, যা দিল্লি শাসকদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা। তাছাড়া উপকূলে জাহাজ চলাচল ও বাংলাদেশের দুটি সমুদ্রবন্দর (চট্টগ্রাম ও মংলা) ব্যবহার করেও ভারত বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হবে।

নৌ, রেল ও সড়ক পথ এবং দুটি সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের বিনিময়ে ভারত কী হারে মাশুল দেবে, তা এখনও নির্ধারিত হয়নি। মাশুলের হার নির্ধারিত হলে লাভালাভের বিষয়টি হিসাব-নিকাশ করে বোঝা যাবে, এসব চুক্তির ফলে বাংলাদেশের ভাগ্যে কী পরিবর্তন ঘটবে। তখন দুদেশের মধ্যে বিরাজমান বিরাট আকারের বাণিজ্য ঘাটতি কোন পর্যায়ে দাঁড়ায়, তা-ও দেখার বিষয়। ভারতকে উল্লিখিত সুবিধাদি প্রদানের বিনিময়ে যারা বাংলাদেশকে 'সিঙ্গাপুর' বানানোর স্বপ্ন দেখেন, তাদের সে স্বপ্ন কতটুকু বাস্তবসম্মত, চুক্তিগুলো কার্যকর হলে তা আমরা দেখতে পাব।

আঞ্চলিক সহযোগিতার নতুন দ্বার উম্মোচিত হয়েছে থিম্পুুতে চার দেশ ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে। এর ফলে চারটি দেশ পরস্পরের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের সুযোগ পাবে। বাংলাদেশ এই প্রথমবারের মতো ভারতের ভূখণ্ড দিয়ে তৃতীয় দেশে যাতায়াতের সুবিধা পেল, যদিও এটা দীর্ঘদিনের দাবি ছিল বাংলাদেশের।

ছিটমহল সমস্যা দুদেশের সম্পর্কের মধ্যে বার্লিন প্রাচীর ছিল না; বার্লিন প্রাচীর ছিল পরস্পরের প্রতি আস্থাহীনতা, মোদি নিজেও যা দূর করার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেছেন, পাখি, পানি ও বাতাসের কোনো সীমানা নেই। বন্ধুত্বও তো পানির মতো আপন গতিতে প্রবাহিত হয়। সীমানার কাঁটাতারের বেড়া সে প্রবাহ বিঘ্নিত করে। মোদি যখন বাংলাদেশ সফর করছেন, তখনও সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া উঠছে। বিএসএফের গুলি থামেনি, এখনও বাংলাদেশের নিরাপরাধ মানুষ প্রায় প্রতিদিন তার শিকার হচ্ছে। সীমান্তে নিষ্ঠুরতার শিকার ফেলানি হত্যার এখনও বিচার হয়নি। সীমান্তে নিষ্ঠুরতা যেন এখন গা-সহা ব্যাপার। তাতে কি বন্ধুত্বের পথই কণ্টকাকীর্ণ হবে না? কিন্তু মোদির সফরের সময় সীমান্ত ব্যবস্থাপনার তাগিদ উপেক্ষিত হয়েছে।

ঢাকায় অবস্থানের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ আরও তিনটি দলের নেতা-নেত্রী। খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকটি নিয়ে এখনও বিভিন্ন মহলে নানা প্রশ্ন ও আলোচনা শেষ হয়নি। এর একটা বড় কারণ, মোদির সফরসূচীতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর বৈঠকের সম্ভাবনার ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইতিবাচক সাড়া না দিলেও দিল্লি কর্তৃপক্ষ বৈঠক হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে। অর্থাৎ মোদির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ দিল্লির উদ্যোগেই হয়েছে বলে মনে হয়।

একান্ত আলোচনায় তাদের মধ্যে কী নিয়ে কথা হয়েছে, সে সব ঘিরেও বাংলাদেশ ও ভারতের পত্রপত্রিকায় জল্পনা-কল্পনা চলছে। এ ব্যাপারে তাঁরা বা তাঁদের প্রতিনিধিদের কেউ মুখ খুলছেন না। শোনা যায়, খালেদা জিয়া কেন রাষ্ট্রপ্রতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাৎ বাতিল করেছিলেন, সেটিও আলোচনায় উঠেছিল। জবাবে মোদিকে খালেদা জিয়া কী বলেছিলেন, তা জানা না গেলেও পরে ভারতের 'সানডে গার্ডিয়ান'কে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তাঁর জীবনের প্রতি হুমকি দেওয়া হয়েছিল বলে তিনি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। ওই সময় বাংলাদেশে কয়েক জন শীর্ষ জামায়াত নেতার দণ্ডাদেশের প্রতিবাদে সারাদেশে হরতাল চলছিল।

খালেদা জিয়ার সঙ্গে মোদির বৈঠকের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, সাক্ষাতে যাচাই করে দেখা ভারতবিরোধী বলে পরিচিত বিএনপি নেত্রীর মধ্যে ভারতের প্রতি মনোভাবের কোনো পরিবর্তন ঘটেছে কিনা। বৈঠকের পর সহাস্যে খালেদা জিয়া বলেছেন, 'আলোচনা আন্তরিক ছিল'। 'সানডে গার্ডিয়ান'কে তিনি বলেছেন, 'তিনি কখনও ভারতবিরোধী ছিলেন না, এখনও নন।' ৫ জানুয়ারির সংবিধান রক্ষার একতরফা নির্বাচনে দিল্লির সমর্থন ছিল, এটা এখন নতুন কথা নয়। খালেদা জিয়া নিশ্চয়ই উপলদ্ধি করতে পেরেছেন যে, ভারতের বিরোধিতা করে যেমন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা সম্ভব নয়, তেমনি সম্ভব নয় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাও।

আরেকটি বিষয় নিয়েও বেশ কানাঘুষা হচ্ছে: মোদি কি খালেদা জিয়াকে জামায়াত ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছেন, কিংবা খালেদা জিয়া জামায়াত ছাড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মোদিকে? যা-ই হোক, খালেদা জিয়া ভবিষ্যৎ বুঝেই মোদি সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন।

দুদিনের সফরে মোদি হাসিয়ে, শাসিয়ে ও ক্যারিশমা (charisma) দিয়ে ভাসিয়ে গেলেন বাংলাদেশ। তিনি ভারতবিরোধী বলে পরিচিত প্রতিবেশি বাংলাদেশের জনগণের কাছে প্রমাণ করতে চাইলেন ভারত Big brother নয়, Elder brother– আর Elder brother হিসেবে তিনি বাংলাদেশের শুভাকাঙ্ক্ষী। শুভাকাঙ্ক্ষী তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও। প্রকাশ্যে ঘোষণা দিলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন পূরণের পাশে তিনি থাকবেন। শেখ হাসিনার জন্য ব্যক্তিগতভাবে উৎসাহব্যঞ্জক বৃহৎ প্রতিবেশি দেশের প্রধানমন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতি। কংগ্রেস সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের প্রতি কী হবে ক্ষমতাসীন বিজেপির মনোভাব, এ নিয়ে সৃষ্ট ধোঁয়াশা খোলাসা হয়ে গেল মোদির স্পষ্ট উচ্চারণে। তিনি পরীক্ষিত বন্ধুর সম্মান দিলেন।

কুলদীপ নায়ার বলেছেন, শেখ হাসিনার পড়তি ইমেজ পুনরুদ্ধারের জন্য যেন ছিল মোদির এই সফর। কেবল তাই নয়, সুদূর পথচলায় তাঁর জন্য তা নতুন আস্থার সঞ্চার করেছে। এটা শেখ হাসিনার জন্য ব্যক্তিগত রাজনৈতিক অর্জন। মোদির সফরের প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের আগামীর রাজনীতিতেও।

আমানুল্লাহ কবীর: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সিনিয়র এডিটর।