নারীনিপীড়ন রোধে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

লীনা পারভীন
Published : 17 June 2015, 11:31 AM
Updated : 17 June 2015, 11:31 AM

নারীকে দমিয়ে রাখা বা তার প্রতি নিগ্রহ চলে এসেছে সৃষ্টির আদিকাল থেকেই। নারীপুরুষ সম্পর্কিত যে কোনো ঘটনায় সব সময় নারী দোষী হিসেবে বিবেচিত হয় সমাজের চোখে। নারীর প্রতি সহিংসতা্র স্বীকৃতি অনেকটা আভিধানিকভাবেই যেন দেওয়া আছে। তাই যখনই কোনো নারীনির্যাতন বা নারীনিগ্রহের ঘটনা ঘটে সবার কাছে তা কেবলই একটি ঘটনা। হয়তো কারও কারও মুখে শোনা যাবে, 'আহারে!!' কিন্তু কখনও জোর গলায় কেউ বলবে না, ''তার কথা বলার, মতপ্রকাশের, ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রকাশের সমান অধিকার আছে।''

নারীকে জন্মের পর থেকেই দেওয়া হয় পিছিয়ে থাকার শিক্ষা। পুরষরা করতে পারে নারীরা তা করতে পারে না সে শিক্ষা। তার বিরুদ্ধে কোনো অন্যায় হলেও প্রতিবাদ না করার শিক্ষা। এমনকি তার নিজের ওপর কোনো আক্রমণ হলেও তা চেপে যাওয়ার শিক্ষা।

বাঙালি সমাজব্যবস্থায় আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রথমেই চিনি পরিবার। যে কোনো প্রকার শিক্ষার বুনিয়াদ গড়ে ওঠে সেখান থেকেই। তার পরে আসে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেখানে আমরা পুস্তকি শিক্ষা পাই। ব্যবহারিক শিক্ষা খুব কমই পাওয়া যায় সেখানে। সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোয় ও বিশ্ববাস্তবতায় পরিবর্তনের ফলে এখন আমরা পেয়েছি ভার্চুয়াল শিক্ষার সুযোগ, ইন্টারনেটভিত্তিক তথা ডিজিটাল শিক্ষা। সামগ্রিক পরিস্থিতি এমন যে, আমাদের তথাকথিত পারিবারিক কাঠামো ও মূল্যবোধগুলি এখন বিলুপ্তপ্রায়। একসময় যেখানে নৈতিকতার শিক্ষা পেতাম সেখানে আমাদের নতুন প্রজন্ম ভুমিষ্ঠ হয়েই শিখছে ফেসবুকিং, সেলফি তোলা, নিত্যনতুন গেইম ডাউনলোড, এপের ব্যবহার, গুগল সার্চ করে বিশ্বজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। আমাদের শিশুরা যখন একটি আধুনিক মোবাইল ফোনের ক্যারিকেচার শিখে নিচ্ছে, কখনও কখনও পিতামাতার চেয়েও অগ্রগামী হয়ে উঠছে যন্ত্রকলায়, তখন আমরা গর্ব করে বলি, 'আমার বাচ্চা তো এখন থেকেই… মাশাল্লাহ!'

তাহলে কোথায় আমাদের সন্তানের পারিবারিক শিক্ষা? তারা কীভাবে শিখবে নারীকে কেমন করে সম্মান দিতে আর কেনই-বা দিতে হয় সে কথা? যৌনহয়রানি কী জিনিস আর কেন সেটা খারাপ, তাকে কে জানাবে সে সব? আধুনিকতার পাশাপাশি ফিরিয়ে আনা জরুরি আমাদের হারিয়ে যাওয়া মা, মাসিদের নৈতিকতার শিক্ষার আসর। দাদা, দাদির কাছ থেকে পাওয়া সামাজিক ও পারিবারিক শিক্ষার অভ্যাস।

আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি কী ভুমিকা রাখছে আজকাল? কেবল গাদা গাদা বই মুখস্ত করানো, বস্তা বস্তা টাকা কামাইয়ের কারখানা সেগুলো। এর কটিতে শিশুদের সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার মতো বিষয় পড়ানো হয়? শিক্ষকরা ব্যস্ত তাদের আখের গোছানোর তালে। অত সময় কোথায় তাদের শিক্ষার্থীরা কী পড়ছে আর কী শিখছে তা পরখ করে দেখার!

আমাদের পাঠ্যপুস্তকে কি আছে কোনো রকম নৈতিক শিক্ষার সূচি? বিদ্যালয়ে যেখানে প্রগতির শিক্ষা দেবার কথা সেখানে আজকাল আমরা কী দেখছি? নৈতিক শিক্ষার নামে তা যেন কেবলই নারীবিরোধী শিক্ষা। উদাহরণ হিসেবে সম্প্রতি দেশের নামকরা দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্কুলের পরীক্ষার জন্য তৈরি প্রশ্নের কথা মনে করা যাক। বিশ্বমানের শিক্ষা দেবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে আমরা দেখছি কুপমণ্ডূকতা আর শঠতার শিক্ষা। নারী কীভাবে চলাফেরা করবে, কোন ধরনের পোশাক পরবে, এসব কি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত বিষয় নাকি কিছু শিক্ষকের নিজস্ব নারীবিদ্বেষী মনোভাবেরই প্রকাশ?

বিষয়টিকে যদি আমরা ছোট বলে তদন্তের আওতায় না আনি, নিদেনপক্ষে এর বিরুদ্ধে সামগ্রিক প্রতিবাদ গড়ে না তুলি তাহলে বুঝতে হবে সমাজে পচনের মাত্রা কেবল বেড়েই চলেছে।

চোখের সামনে অবারিত দুয়ার। যেখানে পা দিলেই দেখা যায় এডাল্ট ছবি। নাটক সিনেমায় কেবলই নারীকে ছোট করে দেখানোর দৃশ্য। বিজ্ঞাপনের ভাষায় নেই নারীর কোনো মর্যাদা। একজন নারীকে কীভাবে দেখালে তার প্রতি সম্মান দেখানো যায় আর কোথায় তার অপমান তা বোঝার মতো জ্ঞান বা প্রজ্ঞা কারও নেই। সবাই মুনাফার পিছনে ব্যস্ত।

এখন একটি সেভিং ক্রিমের বিজ্ঞাপনেও ব্যবহার করা হচ্ছে নারীর অর্ধনগ্ন ছবি। কেউ কি কখনও প্রশ্ন তুলেছে তাদের বা এ নিয়ে কি আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে কোনো সংগঠন বা ব্যক্তি? কেন একটি ফেয়ারনেস ক্রিমে দেখানো হবে শুধুমাত্র 'কালো মেয়ে' বলে কারও চাকরি পেতে সমস্যা হবে? এরপর মুখে ক্রিম বা আস্তরণ মেখে ফর্সা, লাস্যময়ী হলেই তার একটি ভালো চাকরি হয়ে যাবে? কোথায় তাহলে নারীর যোগ্যতার মানদণ্ড?

আজকাল মিডিয়া আমাদের সমাজের চালক হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। এমনকি সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলিও তোয়াজ করে চলে তাদের। সেই মিডিয়া কি পারছে তাদের প্রত্যাশিত ভুমিকা রাখতে? তারা কি গড়ে তুলেছে একটি নারীবান্ধব কর্মস্থল? আছে কি তাদের সেই কমিটমেন্ট? এখনও কি পেরেছে তারা একটি নারীবান্ধব নীতিমালা করতে? কর্মস্থলে নারীর নিরাপত্তা দিবে কে?

জানি না কত দিন এসব প্রশ্নে আমরা নিরুত্তর থেকেই যাব!

সম্প্রতি যে সব যৌনহয়রানির ঘটনা দেখছি তা সমগ্র সমাজের চিত্র নয়, খণ্ডিত চিত্র মাত্র। আমরা নারীরা এখনও পর্যন্ত মুখ খুলতে শিখাইনি। নারীদের সেই অভয় দিয়ে কেউ নিশ্চিত করতে পারছে না। নারী সংগঠনগুলো বা নারী ইস্যুতে কাজ করা সংগঠনগুলো তাদের কিছু নির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়ে এগুচ্ছে। এখানে ফান্ড, বাজেট, প্রচার ইত্যাদি হিসাবের বেড়াজাল আছে। এজেন্ডার বাইরের ইস্যু কখনওই কেউ নিজের বলে মনে করে না। তার মানে এখানেও রয়েছে সীমাবদ্ধতা। সামগ্রিকতার যেখানে নেই সেখানে কর্মসূচি কেবল কর্মসূচি হিসেবেই থাকবে। প্রতিকারের উপায় হয়ে উঠবে না।

এই যে সমন্বয়হীনতা, একই ইস্যু নিয়ে যে যার মতো কাজ করার প্রবণতা যেখানে হিসাবনিকাশ করে পথচলা হয়, সেখানে নারীর প্রতি সহিংসতার কার্যকর প্রতিকার বা প্রতিবাদ কতটা ফল নিয়ে আসবে তা নিয়ে সংশয়মুক্ত হবার অবকাশ নেই। নারীনির্যাতন বা লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে নিয়মিই হচ্ছে সভা, সেমিনার, মিটিং, মিছিল, টকশো, গলাবাজি। কিন্তু কতটুকু কার্যকর হচ্ছে সেগুলো? গোড়ায় হাত দিতে অবে। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন না করলে নারীনির্যাতন বন্ধ হবে না।

কীভাবে হবে সেই পরিবর্তন? এমনি এমনি কি একজন পুরুষ শিখে যাবে যে, সে যে একজন নারীর ওড়না ধরে টান দিচ্ছে তা কতটা অনৈতিক বা অবমাননাকর; বা নারীর অমতে তার শরীরে হাত দেওয়া কতটা বেআইনি? না, তা হবে না। এ জন্য দরকার ব্যক্তির বেড়ে ওঠার পরিবেশে পরিবর্তন। দরকার পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সত্যিকারের নৈতিক শিক্ষা উৎসাহিত করা। অভিভাবককে আগে শিখতে হবে যে, নারী সমাজের অংশ। সমাজের অগ্রগতিতে নারীও সমান অংশীদার। এখানে কেউ কাউকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। নারীর শ্রমকে শ্রম হিসেবে স্বীকৃত দিতে হবে। নারীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে সবাই মিলে।

একজন বাবা বা মা যখন নিজে সচেতন হবেন তখনই পারবেন তাদের সন্তানকে সেই শিক্ষা দিতে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির বুঝতে হবে শিক্ষার্থীরা কী নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সে কথা। তারা সমাজকে কোনো অমানুষ উপহার দিচ্ছে না তো?

আমাদের মিডিয়া হাউজগুলিকে ব্যবসার বাইরে বেরিয়ে এসে বিবেচনা করতে হবে তাঁদের সামাজিক দায়িত্ব কি? নিশ্চিত করতে হবে তাদের নারীর প্রতি দায়বদ্ধতা। প্রমাণ করতে হবে যে, তারা নারীবান্ধব নীতিমালা অনুসরণ করেন যার লঙ্ঘনের জন্য কাউকে ছেড়ে দেওয়া হয় না। নারী সংগঠন বা নারী ইস্যুতে বা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগু্লোকে নির্ধারণ করতে হবে তারা এজেন্ডার বাইরে বেরিয়ে এসে কাজ করবে কিনা।

এখানে দরকার একটি সমন্বিত উদ্যোগ– সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় এবং সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে। সবাইকে একটি কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে এগুতে হবে। যেখানেই নারীনির্যাতন সেখানেই সমন্বিত ভূমিকা রাখা হবে। যার যেখানে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্র তা নির্ধারণ করে একটি কমপ্রিহেনসিভ ও কার্যকর কর্মসূচি যেদিন নেওয়া যাবে, সে দিনই আমরা আশা করতে পারি নারীর প্রতি সমাজের ধ্যানধারণা, মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের।

আইন করলেই সমস্যার সমাধান হয় না। সেই উদাহরণও রয়েছে ভুড়ি ভুড়ি। আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা বরং বেশি জরুরি। কেবলমাত্র সামাজিক শক্তিগুলোই পারে এখানে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে। তাই সবার আগে চাই সচেতনতায় বিনিয়োগ।

লীনা পারভীন: অ্যাকটিভিস্ট।