বামফণ্টের ব্যর্থতাই মমতার সাফল্য

আমজাদ হোসেন
Published : 21 May 2011, 12:45 PM
Updated : 21 May 2011, 12:45 PM

এক উৎসবমুখর পরিবেশে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তৃণমূল জোট নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যয় ২০ শে মে শপথ নিয়েছেন। একটি মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। ৬ দফায় ভোট গ্রহণের পর তা গণনা করা হয় ১৩ই মে। এ দিনই ফলাফল জানা যায়। ২৯৪ টি আসনের মধ্যে তৃণমূল জোট লাভ করে ২২৮টি আসন। বামফ্রণ্ট পেয়েছে ৬১ ও অন্যান্যরা পেয়েছেন ৫টি আসন। অর্থাৎ বিপুল জনসমর্থন লাভ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেতৃত্বাধীন জোট। ১৯৭৭ সনের ২১শে জুনের নির্বাচনে কংগ্রেসকে পরাজিত করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন বামফ্রণ্ট নেতা জ্যোতি বসু। সেই থেকে এ পর্যন্ত ৩৪ বছর ধরে বামফ্রণ্ট পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। ২০০০ সনে বার্ধক্যজনিত কারণে জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে অবসর নিলে নতুন মুখ্যমন্ত্রী হন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তিনি ১০ বছর মুখ্যমন্ত্রীত্ব করেন। ৩৪ বছর সিপিএম নেতৃত্বাধীন একটি ফ্রণ্ট ক্ষমতা ধরে রেখেছিল– এটা ছোট ঘটনা নয়। পশ্চিমবঙ্গের জনগণ তাদের সমর্থন দিয়েছিলেন। নইলে তারা ক্ষমতায় যেতে ও থাকতে পারতেন না।

তৃণমূল জোট বিজয়ী ঘোষিত হওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, জনগণের এই রায় শোষণ, নিপীড়নের বিরুদ্ধে। আজ বাংলার মাটিতে নতুন করে স্বাধীনতা এসেছে। বাংলা আজ মুক্ত। তিনি আরও বলেছেন, 'পশ্চিমবঙ্গ স্বাধীন হয়েছে।' মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৮৪ সনে অনেকটাই অখ্যাত ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী পর্যায়ে উঠতে তার লেগেছে ২৭ বছর। এটাকেও একেবারে কম সময় বলা যায় না।

যাহোক পশ্চিমঙ্গের রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। এটা স্বীকার করতেই হবে। বামফ্রণ্ট নেতারা তাদের পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছেন। বলতে হবে, ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকাটা একেবারে সাধারণ ব্যাপার নয়। জনসমর্থন তাদের সঙ্গেই ছিল।

কিছুকাল ধরে বামফ্রণ্টের নেতারাও তাদের ক্ষমতা ধরে রাখার বিষয়টি চিন্তা করছিলেন। সংকট ও ক্ষমতা হারানোর ভয় দুটোই তাদের ছিল। কিন্তু পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে তারা মোকাবেলা করে উঠতে পারেননি। অপরদিকে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস বামপন্থিদের ক্ষমতায় থাকাটা মোটেই পছন্দ করেন নি। ১৯৫৭ সনে কেরালায় কমিউনিস্ট পার্টি বিজয়ী হয় এবং ক্ষমতায় বসে। ২৯ মাসের মধ্যে নেহেরু সরকার অবৈধভাবে তা ভেঙে দেয়। কংগ্রেস সরকার ভারতের কমিউনিস্টদের গ্রেফতার, নির্যাতন ইত্যাদি চালিয়েও শেষরক্ষা করতে পারেন নি। পরবর্তী পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা ও ত্রিপুরায় বামপন্থিরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। কংগ্রেস বসে ছিল না। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বামফ্রণ্টকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য কংগ্রেস নানাবিধ চক্রান্ত চালিয়ে এসেছে। কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং পর্যন্ত মমতার পক্ষে জোর সমর্থন জানানোর জন্য পশ্চিমবঙ্গে ছুটে এসেছিলেন। নির্বাচনের মধ্যভাগে এসে জানা গেল পুরুলিয়ায় অস্ত্র নিক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল 'বামরাজত্ব' নস্যাৎ করা। তাছাড়া নানা ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে উইকিলিকস।

পশ্চিমবঙ্গে বামফণ্ট্রের পরাজয়ের প্রভাব বাংলাদেশে একেবারে পড়েনি তা নয়। জামায়াতে ইসলামী দলসহ কমিউনিস্ট বিরোধী ইসলামপন্থি দলগুলো খুব খুশি। তাদের পত্র-পত্রিকায় সে বিষয়ে লেখালেখিও হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। বাংলাদেশের বামপন্থি দলগুলো চাইছিল, ভালো হোক বা মন্দ হোক পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রণ্ট ক্ষমতায় থাকুক। এর অর্থ এই নয় যে, পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রণ্ট ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশের বামপন্থিরা শক্তিশালী হবে। তা যদি হতো তাহলে গত ৩৪ বছরে এদেশের বামপন্থিরা শক্তিশালী হতো, কিন্তু বাস্তবে তা হয় নি। বরং বামপন্থিদের বিভক্তি ও ক্ষয়ের ঘটনায় বেশি করে অনুভূত হয়। সিপিএম-এর সঙ্গে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সর্ম্পক ভালো ছিল এবং এখনো আছে। এছাড়া অপর কোনো বামদলের সঙ্গে সিপিএম-এর সম্পর্ক ছিল না। তবে পশ্চিমবঙ্গে বামজোট ক্ষমতায় থাকলে ওয়ার্কার্স পার্টির একটা যৌক্তিক ভরসা থাকতো। মানসিক প্রশান্তি বলে একটা কথা আছে; আমি সেকথাই বলতে চাইছি।

কেন বামফ্রণ্ট অর্থাৎ কথিত 'লালদুর্গের' পতন হলো? আগে থেকেই যেসব সংবাদ বাংলাদেশে বসে পাওয়া যাচ্ছিল তা থেকে অনুমান হচ্ছিল যে বামফ্রণ্ট এবারের রাজ্যসভা নির্বাচনে হারতে বসেছে। পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের মিডিয়া মোটামুটিভাবে বামফ্রণ্টের বিরুদ্ধে যথেষ্ট সার্ভিস দিয়েছে বলা যায়। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বামফ্রণ্টের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। এর বিপরীতে বামফ্রণ্ট মূলত কিছুই করতে পারেনি। প্রপাগাণ্ডায় বামফ্রণ্ট যথেষ্ট দুর্বল ছিল। তাদের মুখপত্র দৈনিক 'গণশক্তি'র পাতা উল্টালে সেটা বোঝা যায়। প্রবল প্রতিকূল অবস্থাকে বামফ্রণ্ট মোকাবেলা করে উঠতে পারেনি। মানুষ পরিবর্তন চায়– এটা বামফ্রণ্ট বুঝতে পারেনি। তৃণমূল জোটের 'পরিবর্তনের' স্লোগান তাই যথেষ্ট কার্যকরী হয়েছে। মানুষ প্রত্যাবর্তন না চেয়ে পরিবর্তনকেই অধিক শ্রেয় মনে করেছেন। একথা ঠিক যে গোটা পরিবেশটাই বামফ্রণ্টের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। মুসলিম ভোটাররাও এবারে বামফ্রণ্টের পক্ষে দাঁড়ায় নি। তাদের অভিযোগ ছিল বামফ্রণ্ট তাদের জন্য কিছুই করেনি। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে কিছু লোক সুবিধা অর্জন করে, সিপিএম ও বামফ্রণ্টকে কেন্দ্র করে তা ঘটেছে। বামফ্রণ্ট জোর করে সিঙ্গুরে টাটার কারখানা নির্মাণ করতে গিয়েছিল। এই বলপ্রয়োগ কৃষকরা মেনে নেয়নি। এসবের ফলে বামফ্রণ্ট-বিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই আন্দোলনের হাল ধরেন এবং এতে করে তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া বামফ্রণ্টের নেতৃত্বের উচ্চ ও নিচ পর্যায়ে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি দেখা দেয়। দুর্নীতি, নির্যাতন তাদের পরাজয় ঘটিয়েছে। আর যাই হোক পুলিশি দমন পীড়ন মানুষ পছন্দ করে না–পশ্চিমবঙ্গে যেটা ঘটেছে। বামজোট এই দীর্ঘ সময়ে পশ্চিমবঙ্গকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি, তেমন কর্মসূচিও তাদের ছিল না। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবর্তনকে তারা গুরুত্ব দেয়নি। এও তাদের পরাজয়ের কারণ বটে।

একথা বাস্তব সত্য যে ক্ষমতায় এসে বামফ্রণ্ট পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক ভূমি সংস্কার করেছিল আর তার সুফল ভূমিহীন ও গরীব কৃষকসহ অন্যান্য কৃষকরা পেয়েছিল। কংগ্রেস নেতারা এই সত্য স্বীকারও করেছেন। কিন্তু তার পর যে পূঁজিতন্ত্র তথা শিল্পায়নের প্রয়োজন সে উপলব্ধি সিপিএম-এর হয়নি। দরকার ছিল পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়ন ঘটানো। ভূমিসংস্কার পুঁজিবাদের প্রাথমিক স্তর। আর এটাই সব নয়। সিপিএম এখানে এসেই থেমে গেছে। কৃষকের হাতে অর্থ এলে এবং কিছু লোকের হাতে অর্থ কেন্দ্রীভূত হলে তা দিয়েই শিল্পকারখানা গঠন করতে হয় বা গঠন করার সুযোগ সরকারকে সৃষ্টি করে দিতে হয়। সিপিএম পূঁজিবাদকে বিকাশের দিকে নিয়ে যেতে পারেনি। এটা চরম ব্যর্থতা। সিপিএম-এর বোঝা উচিৎ ছিল যে ভূমি সংস্কার মানে শিল্পায়ন নয়। ভূমি সংস্কারের আবেদন এক পর্যায়ে ফুরিয়ে যায়। ২০১০ সনে এসে তা স্পষ্ট দেখাও গেল। সিপিএম শেষের দিকে এসে শিল্পায়নের বিষয়টি বুঝলো কিন্তু এখানে নেতারা দুটি ভুল করলেন। তা হচ্ছে শিল্পায়ন তারা টাটার মাধ্যমে করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বিষয়টি স্থানীয় অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের পুঁজিপতিদের দ্বারা হওয়া উচিৎ ছিল, বাইরে থেকে আমদানি করে নয়। আর এটা করতে গিয়ে বলপ্রয়োগের ঘটনা ঘটানো হলো। আর এই দুই ব্যর্থতার পুরো সুযোগ নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

কলিকাতা ঢাকার তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিল। গত দুই দশকের হিসাব ধরলে দেখা যাবে ঢাকাই এগিয়ে। কলিকাতায় পুঁজিতান্ত্রিক উন্নয়ন ঘটেনি, যেটুকু ঢাকায় ঘটেছে। বাংলাদেশের নগরায়ণ বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। বেকারত্বের অভিশাপে মানুষ অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছে এবং পড়ছে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ও ছোট শহরাঞ্চলের লোক ঢাকামুখী। কলিকাতায় এর উল্টো। কলিকাতা নগরের লোক সিপিএম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে পুঁজিতন্ত্রের অগ্রগতিতে বদ্ধতা এসেছে। এই বদ্ধতার কারণে বেকারত্ব ও অন্যান্য সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে। তাই তারা সিপিএম থেকে সরে গেছে। এছাড়া সিপিএম জাতীয় সংগ্রামেও পিছিয়ে পড়েছিল।

এখানে উল্লেখ্য যে, সিপিএম দলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল, সাধারণ গণতান্ত্রিক শাসন নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে যে গণতন্ত্রের প্রয়োজন সে পথে না গিয়ে সিপিএম দলীয় পথে অগ্রসর হয়। এর ফলে ঘটে ব্যাপক জনবিচ্ছিন্নতা। যে সিপিএম সফল ভূমিসংস্কার করলো, সুফল পেল যে কৃষকরা, সেই কৃষকরাই সিপিএম থেকে সরে গেল। পরিবর্তনের পথে অগ্রসর না হয়ে এক জায়গাতে আটকে থাকার পরিণাম বামফ্রণ্টের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠলো।

মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়ার আগেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুই বাংলার সম্পর্কের আরও উন্নতি ঘটাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। প্রকৃতপক্ষে ভারত-বাংলাদেশ সর্ম্পক যেমন আছে, তেমনই থাকবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নতুন করে আর কী করবেন তা স্পষ্ট করে বলেননি। বাংলাদেশ সম্পর্কে কংগ্রেস সরকারের একটা গৃহীত নীতি আছে তা বদলানোর ক্ষমতা কেবল কেন্দ্রের আছে, মমতার নেই। কংগ্রেস সরকারের নীতির বাইরে গিয়ে মমতা আলাদা করে পশ্চিমবঙ্গ- বাংলাদেশের সম্পর্কের উন্নতির জন্য অধিক কিছু করতে পারবেন বলে মনে হয়না। আর সকলেই জানেন যে সিপিএম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকেও সমর্থন দিয়েছে। সম্পর্কও ভালো। এর বাইরে মমতা কী করতে পারবেন তা কেবল ভবিষ্যতই বলতে পারে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শোষণ-নির্যাতন দূর করার কথা বলেছেন। এখন সেটা দেখার বিষয়। যে সমাজ শোষণ ও নির্যাতনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সেখানে কী করে শোষণ নির্যাতন দূর করা সম্ভব সেটা সম্ভবত একমাত্র মমতাই জানেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের সর্বাত্মক উন্নয়ন ঘটানোর কথা বলেছেন। তিনি কতটা করতে পারবেন সেটা একমাত্র ভবিষ্যৎই বলতে পারে। এখন আমাদের অপেক্ষার পালা।
২১.৫.২০১১
আমজাদ হোসেন: বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা,  গবেষক ও প্রাবন্ধিক।