তিস্তা নিয়ে মমতার রাজনীতি

সুখরঞ্জন দাশগুপ্তসুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
Published : 12 June 2015, 08:44 AM
Updated : 12 June 2015, 08:44 AM

বাংলাদেশ সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি উক্তিতে তোলপাড় চলছে সোশাল সাইটগুলোতে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে উনি বলেছেন– একজন মহিলা হয়েও উনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন। ব্যস! তাঁর এই উক্তিতে 'রে রে' করে উঠেছেন ভারতবাসী। অনেকে বলছেন, এতে এত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। উনি কথার তোড়ে বলে ফেলেছেন। আবার অনেকে বলছেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিভূ হলেন মোদি। একজন মহিলা যে কিছু করতে পারেন সেটা উনি ভাবতেই পারেন না।

টুইটারে ইতোমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে হ্যাশট্যাগ, 'বিয়িং আ উওম্যান'। অভিনেত্রী টুইঙ্কল খান্না সেখানে লিখেছেন, 'আসলে গোপনে আমরা সকলেই পুরুষ। খুব সকালে উঠে দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে ফেলি।' আবার অনেকে লিখেছেন, বিশ্বের বহু রাষ্ট্রের আগেই ভারত একজন মহিলা প্রধানমন্ত্রী দেখেছে। তিনি ইন্দিরা গান্ধী। একজন মহিলা হওয়া সত্ত্বেও তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। সে সব কি ভুলে গেলেন মোদি?

ভারতে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার প্রসঙ্গে বলতে গিয়েই ১৯৭৪ সালে তাঁর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মধ্যেকার চুক্তির প্রসঙ্গ মনে এল। সেই চুক্তিতে বলা হয়েছিল দুই দেশের ৫১টি নদীর পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। একচল্লিশ বছর আগের ওই চুক্তিতে স্পষ্ট বলা ছিল উভয় দেশের মধ্যে সব নদীর জল ভাগাভাগি করা হবে। ভারতে উৎস যে নদীগুলির, প্রয়োজনে সেগুলির জলও যাতে বাংলাদেশ পায় তার ব্যবস্থা করা হবে। আন্তর্জাতিক আইনেই আছে নদী এবং সমুদ্রের জল কোনো একটা দেশের মধ্যে আটকে রাখা যায় না। তলার দিকের দেশগুলির সঙ্গে জল ভাগ করে নিতে হয় আলাপ আলোচনার মাধ্যমে।

সে জন্যেই পাঁচ বছর আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং তিস্তা চুক্তি করতে ঢাকায় গিয়েছিলেন। উত্তর পূর্ব রাজ্যগুলির সাত মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে গেলেও বাদ সাধেন পশ্চিমববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে মমতা একটি আঞ্চলিক দল গঠন করে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসেন। পরে কংগ্রেস তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। তিনি আসরে দেন তার মন্ত্রিসভার কয়েকজন সংখ্যালঘু মন্ত্রীকে। তাঁরা প্রকাশ্যেই সে সময় মন্তব্য করতেন, ঢাকায় শেখ হাসিনাকে জেতানোর জন্য আমরা তিস্তার জল দেব না।

তাই তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছনো গেল না। বাকি ৫০টি নদীর ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়েও সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। এখানেই কাঁটার খচখচানি। কমাস আগে মমতা ঢাকায় গিয়ে বলে এসেছেন, তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে আমার ওপর ভরসা রাখুন। সমস্যা সেখানেও। মমতার ওপর ভরসা করে পশ্চিমবঙ্গবাসী পস্তেছে। হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন কী ভুল তাঁরা করেছেন। এবারে বাংলাদেশের পস্তানোর পালা।

ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংএর সঙ্গে কথা বলেন। মনমোহন তাঁকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত করতে তিনি কী কী ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তা বুঝিয়ে দেন। ঢাকা যাওয়ার আগে মনমোহন নিজে তিন তিনবার মমতাকে ফোন করেছিলেন। তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে মমতাকে রাজি করাতে তাঁর কাছে তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন, সাবেক বিদেশ সচিব জন মাথাই এবং জলসম্পদ সচিবকে বারবার কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু নাছোড়বান্দা মমতা রাজি হননি। এতদিন এই বার্তাই দিয়ে এসেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে তাঁর খুব একটা আগ্রহ নেই।

এবারে ঢাকায় মোদির সফরের ৫ দিন আগেও মমতা বলেছিলেন তিনি যাবেন না। কিন্তু সারদাকাণ্ড নিয়ে সিবিআই আরেকটি নোটিশ দেওয়ার পরেই তিনি সুড়সুড় করে চলে গেলেন। তবে মমতা জানিয়েছিলেন, তিস্তা জল চুক্তি নিয়ে আলোচনার সময় তিনি থাকবেন না। এই ঘোষণার পরেই প্রধান বিরোধী দলের (কংগ্রেস) মুখপাত্র শাকিল আহমেদ কটাক্ষ করে বলেছিলেন, মোদি মমতার কাছে আত্মসমর্পণ করে দেশের বিদেশনীতিকে অবহেলা করলেন। বামপন্থীরা বলছিলেন, মোদির এই সফরেই তিস্তা চুক্তি হয়ে গেলে ভালো হয়। পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতা আবদল মান্নানও এক বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, তিস্তা মমতার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, এটা ভারতের বিদেশনীতির অঙ্গ।

নরেন্দ্র মোদি কেন মমতার এই আবদার মেনে নিলেন তা নিয়ে ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দলই সমালোচনা করছে। তোলপাড় চলছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতেও। এমনকি কয়েক দিন আগে ঢাকায় গিয়ে সিপিএম'এর সাধারণ সম্পাদক শীতারাম ইয়েচুরি বলে এসেছেন, ভারতের বামপন্থীরা বকেয়া সমস্যাগুলি নিয়ে অর্ধেক চুক্তি চায় না। তবে এ ব্যাপারে বিজেপির তরফ থেকে এখনও কোনো কথা বলা হয়নি।

রাজনৈতিক মহল থেকে অভিযোগ করা হয়, যেহেতু মমতার সঙ্গে বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদী সংস্থা জামায়াতের গোপন সম্পর্ক আছে, তাই জামায়াত চায় না ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সব সমস্যা মিটে যাক। তাহলে তারা সেগুলি দিয়ে বাংলাদেশে সন্ত্রাস করতে পারবে। বর্ধমানকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জামায়াতের যোগাযোগের ঘটনা মমতা শুধু অস্বীকারই করেননি, তিনি সে সময় বলেছিলেন এটা ভারতের সংস্থা 'র'এর কাজ। ভারত সরকারের একটি সূত্র বলছে, মমতা নিজেও জানেন, তিনি বাংলাদেশের কত সন্ত্রাসবাদীদের মদত দিয়েছেন। জানেন মোদিও। স্থলসীমান্ত চুক্তি নিয়ে বিলটি ভারতের সংসদে পাশ হয়ে গেছে। যদিও মোদি সরকার যখন প্রথমবার বিলটি পেশ করে তখন তৃণমূলের সাতজন সাংসদ এর বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের মধ্যে একজন এখন সারদাকাণ্ডে জেলে আছেন। দলের আর এক বিধায়ক, রাজ্যের মন্ত্রী, তিনিও বর্তমানে জেলে আছেন।

ভারতের শীর্ষ আদালত সুপ্রিম কোর্টের মতে, এত বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি দেশে আগে হয়নি। কিন্তু সেই সারদা ইস্যুর তদন্ত নিয়ে মোদি ও মমতার একটা সমঝোতা হয়ে গেছে। ভারতের তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই সারদাকাণ্ডের তদন্ত করবে, কিন্তু মমতা বা তাঁর ভাইপোকে কিছু বলবে না। তার প্রতিদানে মমতা রাজ্যসভায় সমস্ত বিতর্কিত বিলগুলি পাশ করাতে সাহায্য করবেন। তিস্তা নিয়েও এমনই কোনো সমঝোতা হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে।

মমতা তিস্তা চুক্তিতে রাজি হচ্ছেন না কেন? এর কোনো জবাব এখনও পর্যন্ত রাজ্য সরকারের তরফ থেকে কিংবা তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে না। তবে এপার বাংলার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে তিস্তা চুক্তি নিয়ে মুখে রা কাড়বেন না পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। কারণ তাঁর আশঙ্কা, তিস্তা চুক্তি হলে উত্তরবঙ্গের ভোট হারাতে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হল, কোচবিহারসহ গোটা উত্তরবঙ্গে এমনিতেই মমতার দলের খুব একটা শক্তি নেই। তিস্তা চুক্তি হোক বা না হোক তাতে উত্তরবঙ্গে মমতার ভোট ব্যাংকে বাড়তি কোনো প্রভাব পড়ার কথা নয়।

তাহলে? তাহলে কি মমতার দলের সাংসদদের কথাই ঠিক? যারা বলেছিলেন, তিস্তা চুক্তি করে বাংলাদেশের হাসিনা সরকার ড্যাং ড্যাং করে জিতে যাবে তা আমরা হতে দিতে পারি না। ঘুরেফিরে সেই প্রসঙ্গও উঠে আসছে। কারণ ঢাকায় মমতার বন্ধুরা চান না তিস্তা চুক্তি হোক।

১৯৯৬ সালে হাসিনা সরকার যখন বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন, সে সময় তিনি অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন ফারাক্কার পানিবণ্টনের ওপর। সেই চুক্তির নায়ক ছিলেন এপার বাংলার দুই কিংবদন্তী রাজনীতিবিদ– সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এবং মালদহের সাংসদ তথা কংগ্রেস নেতা আবু বরকত গনি খান চৌধুরী। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান ফারাক্কার পানি নিয়ে অভিযোগ জানাতে জাতিসংঘে গিয়েছিলেন। আর তাঁর নালিশের জবাব দেওয়ার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাঠিয়েছিলেন জনাব গনি খান চৌধুরীকে।

এদিকে আগামী আগস্টে ভারত সফরে আসছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারতের তথ্যাভিজ্ঞমহল মনে করছেন, তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে মমতার ওপর মোদির তরফ থেকে ক্রমাগত একটা চাপ থাকবেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী চান, হাসিনার ঐ সফরেই চিস্তা চুক্তি চূড়ান্ত হয়ে যাক।

উল্লেখ্য, ইন্দিরা গান্ধী এবং শেখ মুজিবর রহমানের ১৯৭১ সালের চুক্তির প্রতিই সম্মাননা জানানো হয়েছে ভারত-বাংলাদেশের স্থলসীমান্ত চুক্তি এবং ছিটমহল বিনিময় চুক্তিতে। ২৫ বছরের সেই চুক্তিতে বলা হয়েছিল, শান্তি, সহযোগিতা এবং একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে ভারত। এর তিন বছর পর সামরিক অভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধু-হত্যা ও বাংলাদেশের সামরিক সরকার গঠিত হয়েছিল। এই চুক্তিতে ভারত, তথা বঙ্গবাসী খুশি।

তবে সেই সঙ্গে একটা কাঁটার খচখচানিও থেকে গেছে। তা হল তিস্তার জলবণ্টন চুক্তি। এই চুক্তিটিও সম্পন্ন হয়ে গিয়ে সোনায় সোহাগা হতে পারত। ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের আরও খানিকটা অগ্রগতি সম্ভব ছিল তাহলে।

মমতা বলেছিলেন, তাঁর ওপর আস্থা রাখতে। এখন বাংলাদেশের নাগরিকের 'বিশ্বাস' রাখার পালা। দেখা যাক কী হয়।