বাজেট বড় নয়, বাস্তবায়নের উদ্যোগ অপর্যাপ্ত

ড. আবুল বাসার
Published : 10 June 2015, 01:03 PM
Updated : 10 June 2015, 01:03 PM

বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর কাজটি বড়ই কঠিন। এ জন্য কঠিন বলছি না যে, একটি নিম্ন আয়ের দেশকে টেনে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করার গুরুদায়িত্বের ভারে তিনি ভারাক্রান্ত। এ জন্য কঠিন বলছি, কারণ প্রায়শই তাঁকে দিকনির্দেশনাহীন সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হতে হয়। যে সমালোচনা শুধুমাত্র কোনো ভুল শনাক্তকরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, শনাক্তকৃত ভুল কীভাবে সঠিক পদক্ষেপ দ্বারা প্রতিস্থাপন করা যায় সে বিষয়ে আলোকপাত করে না, সেটাই দিকনির্দেশনাহীন সমালোচনা। সরকারের ঘোষিত বাজেট দিকনির্দেশনাহীন সমালোচনার উর্বর উৎপাদক। বাজেট প্রদানের পরপরই রাত জেগে কত বাহারি শব্দে, কত উপমায় এর সমালোচনা তৈরিতে লেগে পড়েন বিদগ্ধ সমালোচকগণ, যা পরদিনই ইলেকট্রনিক মিডিয়ার উদার সহযোগিতায় দেশবাসীর কল্যাণে সরাসরি প্রচার করা হয়। বাজেটের পাশাপাশি এসব সমালোচনার উপযোগিতা নিয়েও আলোচনা হওয়া দরকার।

অর্থনীতির প্রথম পাঠ হল প্রয়োজনের তুলনায় সম্পদ সীমাবদ্ধ। এ সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েই অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। হোক তা ব্যক্তিগত কী জাতীয় জীবনের সিদ্ধান্ত। যেহেতু সম্পদের তুলনায় করণীয় অনেক বেশি, সে জন্য বাজেট প্রণয়ন বা যে কোনো অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গুরুত্ব অনুযায়ী তাদের পর্যায়ক্রমিকভাবে করতে হয়।

সরকারের রাজনৈতিক দর্শনের উপর নির্ভর করে সে কোন কাজে কতটা গুরুত্ব দিবে, সে কি প্রান্তজন গজনফর আলী বা রমেশ সেনের অর্থনৈতিক দুর্গতি কমানোর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বেশি বরাদ্দ দিবে নাকি গ্যাসের দামে ভর্তুকি দিয়ে দেশের যে ৭ শতাংশ পরিবার রান্নাবান্নার কাজে গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে সেই ভাগ্যবানদের আরও সুবিধা দিবে। বাজেটে গৃহীত বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ এবং তাতে বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে সরকার কোন কাজে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে তার এক ধরনের প্রকাশ ঘটে। সেটি সব বিদগ্ধ সমালোচকের গুরুত্ব-বিন্যাসের সঙ্গে নাও মিলতে পারে। শুধু সেটাই সমালোচনার বিষয় হলে, সে সমালোচনা অর্থহীন।

সরকারের ঘোষিত বাজেটের বিচার করতে হবে সরকারেরই ঘোষিত উন্নয়ন লক্ষ্য ও দর্শনের আলোকে। বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক লক্ষ্য হচ্ছে, বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করা। আর উন্নয়ন দর্শন হচ্ছে, বাজারনির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রবৃদ্ধির চাকা ত্বরান্বিত করা। মূল প্রশ্ন এখানেই এসে যায়। ঘোষিত বাজেট কি সরকারের লক্ষ্য ও দর্শনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না সাংঘর্ষিক?

বাংলাদেশ বর্তমানে উন্নয়নের যে ধাপে অবস্থান করছে, সেখানে উন্নয়নের চাকা বেগবান করতে হলে অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আর সে জন্য দরকার প্রচুর সরকারি বিনিয়োগ যা বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ লাভজনক ও উৎসাহিত করবে। বাজেট প্রায় ২.৯৫ লাখ কোটি টাকার হলেও তাতে সরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ ১.০৩ লাখ কোটি টাকার মতো। এ পরিমাণ বাংলাদেশের প্রয়োজনের তুলনায় মোটেও বেশি নয়, বরং এ অংক বাড়ানো গেলে ভালো হত।

কেন যে ঘোষিত বাজেটটি 'বড় বাজেট' আখ্যা দিয়ে এর বাস্তবায়ন অসম্ভব বলে সমালোচনা করা হচ্ছে সেটা ঠিক বোধগম্য নয়। কারণ অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা যখন শুরুতেই এ বাজেট বাস্তবায়ন-অযোগ্য আখ্যা দিয়ে দেন, তখন তা সরকারকে প্রকারান্তরে এক ধরনের দায়মুক্তি দিয়ে দেওয়ারই সমান। সরকারের পক্ষ থেকে তখন তারই ঘোষিত বাজেট বাস্তবায়নের জন্য আর শ্রমসাধ্য পদক্ষেপগুলো নেওয়ার খুব একটা উৎসাহ পরিলক্ষিত হয় না। সে জন্য জবাবদিহিতার কোনো জনচাপও সরকারের মোকাবিলা করতে হয় না। যেহেতু জ্ঞানী ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষকরা আগেই বলে দিয়েছেন যে, বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য নয়, সেহেতু সেটা বাস্তবায়ন না হওয়া জনগণ স্বাভাবিক বলেই ধরে নেয়; এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করে না।

২০১৪-১৫ অর্থবছরের সংশোধিত উন্নয়ন ব্যয়ের তুলনায় এ বছর তথা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ধার্যকৃত উন্নয়ন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২৭.৪ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬.২ শতাংশ; তার নিরিখে প্রকৃত উন্নয়ন বাজেট বেড়েছে প্রায় ২১.২ শতাংশ। এই উচ্চ হারে বৃদ্ধি পাওয়া উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মূল প্রতিবন্ধকতা দুটি। প্রথমটি হল, এ ব্যয়ের অর্থায়ন-সংক্রান্ত। আর দ্বিতীয়টি হল, অপচয় ও কাজের গুণগত মান ঠিক রেখে এ ব্যয়ের মাধ্যমে লক্ষ্য অনুযায়ী অর্থনৈতিক সক্ষমতা তৈরি করা। এই দুই প্রতিবন্ধকতা কীভাবে মোকাবেলা করা হবে সে বিষয়ে বাজেটে সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। বড় বাজেট নয়, বরং বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকাই এবারের বাজেটের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা।

সরকার যদি তার অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে সমর্থও হয়, তবু ঘোষিত বাজেট কোনো রকম কাটছাঁট না করে বাস্তবায়ন করতে গেলে প্রায় ৮৬ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকার ঘাটতি হবে। সরকার আশা করছে, এ ঘাটতির প্রায় ৩০ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা বা ৩.৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক উৎস থেকে যোগান দিবে। বাকি প্রায় ৫৬ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা অভ্যন্তরীন উৎস থেকে ঋণ হিসেবে সংগ্রহ করবে।

প্রথমে নজর দেওয়া যাক বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থসংগ্রহের উপর। ঋণ ও অনুদান হিসেবে বৈদেশিক উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থছাড়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলতে ও শর্তপূরণ করতে হয়। এসব নিয়ম কতটা যৌক্তিক ও অপরিহার্য তা ভিন্ন আলোচনা; কিন্ত বাস্তবতা হচ্ছে, এসব নিয়ম ও শর্তের বেড়াজালে পড়ে দাতাদের দেওয়া অর্থ অনেক সময় পাইপলাইনে আটকা পড়ে থাকে, প্রয়োজন এবং পরিকল্পনামাফিক ব্যবহার করা যায় না। অনেক সময় আবার দাতাদের প্রদেয় অর্থ ফেরতও যায়।
যেসব কারণে বৈদেশিক উৎস থেকে সংগৃহীত অর্থছাড়ে সমস্যা হয়, তা জিইয়ে রেখে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ অর্থ এ বছর কোন যাদুবলে পাওয়া যাবে তা স্পষ্ট নয়।

বৈদেশিক উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থের ব্যবহার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে সত্য। ক্রমাগত বেড়ে এ ব্যবহার ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সর্বোচ্চ পরিমাণে পৌছায় (২০১৪-১৫ অর্থবছরের উপাত্ত এখনও পাওয়া যায়নি)। যার পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। মাত্র দুই বছরের মাথায় কীভাবে তা প্রায় ৬২ শতাংশ বেড়ে ৩০ হাজার ১৩৪ কোটিতে পৌঁছাবে তা পরিস্কার নয়। বাংলাদেশকে প্রদেয় বিভিন্ন বৈদেশিক উৎস থেকে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের উপরে পাইপলাইনে আটকে আছে। সুতরাং ৩.৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার উন্নয়নকাজে খরচ খুব দুরুহ নয়। কিন্ত এ নিমিত্তে যা যা করণীয় তার কোনাঁ দিকনির্দেশনা অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় স্থান পায়নি।

বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থসংগ্রহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও দাতাদের উপর নির্ভরশীল। সে জন্য অনেক সময় তাকে মূল্যও দিতে হয়। শেষ অবধি বাংলাদেশ এবং কানাডায় অপ্রমাণিত কথিত 'দুর্নীতির অভিপ্রায়'এর অভিযোগ তুলে বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতু থেকে অর্থায়ন প্রত্যাহার না করলে তা এখন সমাপ্তির পর্যায়ে থাকত। শুধু অংকের হিসেবে নয়, মানসিক দৃঢ়তা এবং শক্ত মেরুদণ্ডের বিচারেও মধ্য আয়ের দেশ হতে হলে দাতাদের উপর নির্ভরশীলতা না বাড়িয়ে বরং কমাতে হবে। সে প্রক্রিয়া এখনই শুরু করা দরকার। এ কথা সত্য, বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য আমাদের বাইরে হাত পাততেই হবে। কিন্ত সে হাত শুধুমাত্র দাতাদের কপাটের দিকে বাদ দিয়ে অন্যান্য সম্ভাব্য উৎসের কাছেও প্রসারিত করা দরকার।

বাংলাদেশের যে সংখ্যক মানুষ উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ায় বাস করেন, বন্ড ইস্যু করে তাদের কাছ থেকেও সরকার উন্নয়ন ব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থসংগ্রহ করতে পারে। ঘানা ও নাইজেরিয়ার মতো দেশ যারা বিদেশে বসবাসরত নাগরিকের সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে, তারাও এ ধরনের বন্ড ইস্যু করে অর্থসংগ্রহ করে। ঘোষিত বাজেট পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করতে গেলে বাংলাদেশকেও সে পথেই হাঁটতে হবে, যার লক্ষণ এখনও দেখা যাচ্ছে না।

এবারে নজর দেওয়া যাক অভ্যন্তরীন উৎস থেকে সংগৃহীত অর্থের উপর। সরকার অভ্যন্তরীন উৎস থেকে প্রায় ৫৬ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, যার মধ্যে ব্যাংক থেকে ৩৮ হাজার ৫২৩ কোটি এবং ব্যাংকবর্হিভূত উৎস থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করবে। বিষয়টি এমন নয় যে, এ পরিমাণ টাকা অভ্যন্তরীন উৎস থেকে সংগ্রহ করা অসম্ভব, বরং সরকারেরই কিছু নীতিমালা এ কাজ দুঃসাধ্য করে তুলবে।

কিছুদিন আগে সরকার সেকেন্ডারি শেয়ার বাজার চাঙ্গা করার নিমিত্তে বিভিন্ন ঋণপত্রের উপর সুদের হার প্রায় দুই শতাংশ কমিয়েছে। মানুষের সঞ্চয় শেয়ার বাজারমুখী করার এ নীতি ব্যাংকবর্হিভূত উৎস থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং এ লক্ষ্য পূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। মনে রাখতে হবে, সরকার এখন পর্যন্ত ব্যাংকবর্হিভূত উৎস থেকে সর্বোচ্চ ১১ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করতে পেরেছিল যা সম্ভব হয়েছিল ২০১৩-১৪ অর্থবছরে।

সেকেন্ডারি শেয়ার বাজার এভাবে চাঙ্গা করার ফলে ভয় হয় যে মানুষের সঞ্চয় আমানত হিসেবে ব্যাংকে না গিয়ে শেয়ার বাজারে যাবে। তার ফলে ব্যাংকের কাছে ঋণ দেওয়ার মতো তহবিল কমে যাবে। তখন ব্যক্তিখাতে ঋণের প্রবাহ না কমিয়ে সরকারকে ৩৮ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া ব্যাংকিং খাতের পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে সরকারের জন্য কঠিন হয়ে যাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী উন্নয়ন ব্যয় মিটিয়ে বাজেট বাস্তবায়ন করা। সরকার কী বুঝে সেকেন্ডারি শেয়ার মার্কেট চাঙ্গা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে সেটা বোধগম্য না হলেও তার ফলে বাজেট বাস্তবায়ন যে হুমকির মুখে পড়বে সেটা সহজেই অনুমেয়।

ড. আবুল বাসার: গবেষক, বিআইডিএস এবং সাবেক অর্থনীতিবিদ, বিশ্ব ব্যাংক।