জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া জামায়াত নিষিদ্ধ সহজ নয়

জায়েদুল আহসান পিন্টু
Published : 9 June 2015, 11:21 AM
Updated : 9 June 2015, 11:21 AM

দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক চলছে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করার বিষয়টি নিয়ে । নানা জন নানা মত প্রকাশ করছেন পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনের টকশোতে। অধিকাংশই বলছেন দেরি না করে দলটি নিষিদ্ধ করতে। তাদের সহিংসতামূলক কর্মকাণ্ড দেখে এ দাবি জোরালো হয়েছে। আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ায় এবং ট্রাইব্যুনালের রায়ে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিযুক্ত হওয়ায় তাদের নিষিদ্ধ করার আইনি দাবি পোক্ত হয়েছে।

এরই মধ্যে গত সোমবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংসদে বলেছেন, সরকার যখন মনে করবে, তখনই জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করার বিল সংসদে উত্থাপন করা হবে। তিনি জানান, জামায়াত ও তার অঙ্গ সংগঠন নিষিদ্ধ করার জন্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট সংশোধনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা রয়েছে। সরকার যখন মনে করবে, বিলটি মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিয়ে তা পাসের জন্য সংসদে আনা হবে।

এর আগে, গত বছরের ৭ ডিসেম্বর আইনমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারি মাসের প্রথমদিকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে রাজনৈতিক দলের বিচারের বিধিসম্বলিত আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ পরিবর্তনের সংশোধনী মন্ত্রিসভায় উঠবে। নতুন বছরের প্রথম সংসদ অধিবেশনের শুরুতে রাষ্ট্রপতির ভাষণের পরই আইনটি পাস হবে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। এর আগে ও পরে বিভিন্ন সময় ‌আইনমন্ত্রী একই কথা বলেছেন। সম্ভবত আরও বলবেন। এতে বোঝা যাচ্ছে, জামায়াত নিষিদ্ধ প্রশ্নে সরকারের মধ্যে এক ধরনের ডিলেমা কাজ করছে।

যদিও ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। নিবন্ধন বাতিল মানেই রাজনীতি নিষিদ্ধ নয়। সাধারণের দাবি, স্বাধীনতাবিরোধী এই দলের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিতে হবে। কেন, কী কারণে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যাওয়ার দরকার আছে বলে মনে করি না। দেশবিরোধী, মানবতাবিরোধী অপরাধী একটি দল নিষিদ্ধ করার পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক করারই-বা কী আছে? নিষিদ্ধ করতে কোন আইন দরকার, আন্তর্জাতিক বিশ্বে এর উদাহাণ কী কী আছে সেটিও-বা খুঁজে বের করত হবে কেন?

আইন না থাকলে আইন করা যাবে। নিষিদ্ধ করতে হলে আইনকানুন ফ্যাক্টর নয়। আর তারা যে অপরাধ করেছে, এ জন্য নতুন কোনো যুক্তিও খুঁজে বের করতে হবে না। দরকার রাজনৈতিক ইচ্ছা ও সক্ষমতা। প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইচ্ছা থাকলেও তারা কি জামায়াত নিষিদ্ধ করতে রাজনৈতিকভাবে সক্ষম?

আমি ব্যক্তিগতভাবে জামায়াতের মতো সকল সন্ত্রাসী, স্বাধীনতাবিরোধী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের তৎপরতা নিষিদ্ধের দাবির সঙ্গে শতভাগ একমত হলেও এটা বিশ্বাস করি, এই 'মহান' দায়িত্ব আওয়ামী লীগের একার পক্ষে পালন করা সম্ভব নয়। ইচ্ছা থাকলেও এই মুহূর্তে তা করার রাজনৈতিক সক্ষমতা তাদের নেই। এ জন্য জাতীয় ঐকমত্য দরকার।

আওয়ামী লীগ ও তার বামপন্থী মিত্রদের প্রতি এদেশের কমবেশি ৪০ শতাংশ মানুষের সমর্থন রয়েছে। হতে পারে জামায়াতের সমর্থন ৫ শতাংশের বেশি নয়। কিন্তু জামায়াতের প্রতি সহানুভূতিশীল বিএনপি নেতৃত্ব যদি জামায়াত ছেড়ে না আসে তাহলে নিষিদ্ধ-পরবর্তী তৎপরতা আওয়ামী লীগের একার পক্ষে সামলানো সম্ভব হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। সারাদেশে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সেই যোগ্যতা এখন নেই। এ জন্যই বলছি, জামায়াত নিষিদ্ধের প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য দরকার।

কেউ কেউ যুক্তি দিতে পারেন, সংসদে আওয়ামী লীগের একক আধিপত্য থাকা সত্ত্বেও এবং সারাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে থাকলেও কেন তা সম্ভব নয়? এ কারণে যে, জামায়াতের পক্ষে বিএনপির মতো একটা শক্তিশালী দল রয়েছে যাকে এদেশের ৩৩-৩৫ শতাংশ মানুষ সমর্থন করে। কাগজে কলমে একে নিষিদ্ধ করা তো তো কয়েক মিনিটের ব্যাপার, একটি প্রজ্ঞাপনে সই করা বা একটি বিল পাস করতে যা সময় লাগে। অনেক আইন ও বিধান এখনই বিদ্যমান যা দিয়ে তা করা যায়। নতুন আইন পাস করতেও আওয়ামী লীগের পক্ষে একদিনই যথেষ্ট। কিন্তু নিষিদ্ধ করে কী হবে সেটিও ভাবতে হবে। জামায়াতি তাণ্ডব হয়তো পুলিশ, বিজিবি বা র‌্যাব দিয়ে সামলানো যাবে; কিছু প্রাণহানির ঘটনাও মেনে নেওয়া যাবে। এরপর কী হবে?

আবার আওয়ামী লীগ একা নিজেদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে কেন এটা করতে যাবে? তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল; স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী, ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার দল বলেই এ সিদ্ধান্ত নেবে? এ জন্য কি তারা বাড়তি সুবিধা পেয়েছে? আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিকে তো এদেশের জনগণ বারবার ক্ষমতায় এনেছে। জামায়াত-তোষণের কারণে তাদের বয়কট করা হয়নি। রাজাকার, আলবদর কমান্ডারদের মন্ত্রী বানানোর পরও এদেশের মানুষ প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়েনি। যুদ্ধাপরাধীরা দিব্যি পতাকা উড়িয়ে ৫ বছর ৩০ লাখ শহীদের রক্তের ওপর দাপিয়ে বেড়িয়েছে। কারণ তাদের সঙ্গে ছিল বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর সমর্থিত রাজনৈতিক দল। বিএনপি এ সমর্থন অব্যাহত রাখলে আওয়ামী লীগের পক্ষে জামায়াত নিষিদ্ধ করা কঠিনই বলব।

বাংলাদেশের নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যেসব নির্বাচনে জামায়াত আর বিএনপি জোটবদ্ধভাবে প্রার্থী দিয়েছে সেখানে বিএনপি-সমর্থকরা অনায়াসে জামায়াতের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে। বিএনপি নেতৃত্ব চেয়েছে, তাই সমর্থকরা যুদ্ধাপরাধীকেও ভোট দিতে দ্বিধা করেনি। একটি উদাহরণ এখানে যথেষ্ট মনে করছি।

১৯৯৬ সালে জামায়াত এককভাবে নির্বাচন করে। সেটিতে দলটির আমীর যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী তার আসনে পেয়েছিলেন ২৩ দশমিক ৯২ শতাংশ ভোট। আর বিএনপির প্রার্থী পেয়েছিলেন ৩৩ দশমিক ২০ শতাংশ (দুই দলের মিলে ৫৭ দশমিক ১২ শতাংশ)। আওয়ামী লীগের প্রার্থী ৪১ দশমিক ৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে এ আসনেই বিএনপি কোনো প্রার্থী না দিয়ে জামায়াতকে সমর্থন দেয়। তখন দেখা যায়, নিজামী ৫৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ ভোট পেয়েছেন আর আওয়ামী লীগের প্রার্থী পেয়েছেন ৪১ দশমিক ৬২ শতাংশ। অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াতের ভোটের সম্মিলিত ফলাফলে নিজামী বিজয়ী হয়ে মন্ত্রী হন। কিন্তু আওয়ামী লীগের ভোটে হেরফের হয়নি।

অর্থাৎ এ দেশের বিএনপি সমর্থকেরা নির্দ্বিধায় যুদ্ধাপরাধীকে ভোট দিচ্ছেন। জামায়াতকে সমর্থন দেওয়ায় কিন্তু তারা ভোটদানে বিরত থাকেননি। বিএনপি নেতৃত্ব তাদের ভোটারদেরকে যুদ্ধাপরাধীকে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এটা শুধু নিজামীর আসনেই নয়, যেসব আসনে বিএনপি প্রার্থী না দিয়ে জামায়াতকে সমর্থন দিয়েছে, সেখানে বিএনপি নেতারা জামায়াতকে ভোট দিতে বলেছেন।

তাই বলছি, বিএনপিকে সঙ্গে না নিয়ে জামায়াত নিষিদ্ধ করা আওয়ামী লীগের পক্ষে কঠিন। কেউ কেউ বলছেন, বিএনপি কখনও জামায়াত ছাড়বে না। তাদের কাছে ওই দল নিষিদ্ধের দাবি তোলা আর বাতাসের কাছে কিছু চাওয়া একই ব্যাপার। কিন্তু আমার ধারণা, জামায়াতবিরোধী আন্দোলন যদি এমন মাত্রায় নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে বিএনপিও বাধ্য হবে তাদের সঙ্গ ত্যাগ করতে। ইতোমধ্যে দেশে ও বিদেশিদের চাপে ওরা আপাতত জামায়াতকে বাদ দিয়েই তাদের কর্মসূচি চালাচ্ছে। এ চাপ অব্যাহত রাখতে পারলে স্থায়ীভাবে তাদের সঙ্গ ছাড়তে বাধ্য হবে বিএনপি।

এর আগে, ১৯৯১ সালে গোলাম আযমের সঙ্গে বৈঠক করে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে খালেদা জিয়া সরকার গঠন করলেও জনমতের চাপে সেই গোলাম আযমকেই রোজার মাসে কারাগারে পাঠাতে বাধ্য হয়েছিলেন। মওদুদ আহমদের লেখা 'বাংলাদেশ: আ স্টাডি অব দ্য ডেমোক্রেটিক রেজিমস'এর তথ্য অনুযায়ী, জামায়াতে ইসলামীর আমীর হিসেবে গোলাম আযমের নিয়োগ এবং তার নাগরিকত্ব ফেরতদানের শর্তে খালেদা জিয়াকে সরকার গঠনে সমর্থন দিয়েছিল জামায়াত। জনমতের চাপে পড়ে বিএনপি এ শর্তও মানেনি।

এছাড়া বিএনপির ভেতরেও জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার জন্য চাপ রয়েছে। সম্প্রতি দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের সঙ্গে ছাত্রদলের সাবেক নেতার কথোপকথনে শোনা গেছে, জামায়াত না ছাড়লে বিএনপির রাজনীতি টিকবে না বলে মন্তব্য করা হয়েছে। এটা পরিস্কার; কারণ বিএনপির ভেতরে জামায়াতবিরোধী একটা বড় অংশ রয়েছে। তবে খালেদা জিয়া, তারেক রহমান বা কিছু সুবিধাবাদী সামরিক শাসকদের বেনিফিসিয়ারি নেতা হয়তো চান না সেটা। চাপে ফেলতে পারলে ওই সুবিধাবাদী গোষ্ঠীও পিছু হটবে। তখন একটা জাতীয় ঐকমত্যের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।

যেমনটি হয়েছিল ১৯৯৩ সালে, পঞ্চম জাতীয় সংসদে। সংসদের কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, ওই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর পঞ্চম সংসদের একাদশ অধিবেশনের সপ্তম কার্যদিবসে জামায়াত নিষিদ্ধ প্রশ্নে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য আর বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা ঐকমত্যে পৌঁছেছিলেন।

এর আগে, ১৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র মৈত্রীর নেতা জোবায়ের চৌধুরী রিমুকে নির্মমভাবে হত্যা করে জামায়াত-শিবির। রিমুর মা ছিলেন সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির নেত্রী। এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে সেদিন সংসদে ক্ষমতাসীন বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোটের সব সদস্য জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন। সংসদে ভারপ্রাপ্ত বিরোধী দলীয় নেতা আওয়ামী লীগের আবদুস সামাদ আজাদ ধিকৃত রাজনীতির অনুসারী হিসেবে ওই দল নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে 'ধর্মের নামে ব্যবসা' বন্ধ করতে বলেছিলেন। সংসদ উপনেতা, বর্তমানে বিকল্প ধারার সভাপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী তাঁর সঙ্গে একমত হয়ে বলেছিলেন, ''সাংবিধানিক পদ্ধতিতে রাজনীতি করার অধিকার সবারই আছে। কিন্তু রগকাটা, হাতকাটা, জবাই করা সাংবিধানিক পদ্ধতি হতে পারে না। এ জন্য অনেক সদস্য জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি বন্ধ করার প্রস্তাব করেছেন। এ প্রস্তাব জনগণের ইচ্ছার প্রতিধ্বনি। সিদ্ধান্ত নিতে হবে এ রাজনীতি চলতে দেওয়া যায় কিনা।''

অধিবেশন বিএনপির আরও কয়েক জন সংসদ সদস্য জামায়াত সম্পর্কে যে সব মত দেন তা তুলে ধরছি। ওরা 'পাকিস্তানের রাজনীতি করে বলে' তা চিরতরে নিষিদ্ধ করতে আহবান জানান বিএনপির বর্তমানে ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) হাফিজউদ্দিন। মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) আখতারুজ্জামান বলেছিলেন, ''ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে হাত মেলাতে হয়। ক্ষমতার দারুণ মোহ, দারুণ নেশা। এখানে বিবেক বলে কিছু নেই। যারা স্বাধীনতার অস্তিত্ব স্বীকার করেনি তাদের সঙ্গে সামাজিক বন্ধন হতে পারে না।''

বিএনপির সংসদ সদস্য খায়রুল তাদের অস্ত্রের উৎস খুঁজে বের করে নিষিদ্ধ করতে দাবি জানান। জিয়াউল হক জিয়া বলেছিলেন, ''জোর করে আমাদের জামায়াতের সঙ্গে ঠেলে দেবেন না। স্বাধীনতার স্বার্থে ঐকমত্যে পৌঁছে সিদ্ধান্ত নিন।''

ওদিকে হুইপ শাহজাহান মিয়া সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে জামায়াত-শিবিরকে দাঁতভাঙা জবাব দিতে বলেন। আবদুল আলী আহ্বান জানান একাত্তরের মতো তাদের কবর রচনা করতে। মশিউর রহমান জামায়াতের পৈশাচিক রাজনীতি বন্ধ করতে বলেন। জাসদ নেতা ও পরে বিএনপিতে যোগদানকারী শাজাহান সিরাজ বলেন, ''গোলাম আযমের বংশধররা কী করতে পারে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বিএনপি গোলাম আযমকে দুধকলা দিয়ে পুষছে। আমরা যদি আমাদের সন্তানদের সত্যিই ভালোবাসি তাহলে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করতেই হবে।''

ওইদিন সংসদে বিএনপির যে কজন সদস্য বক্তব্য রেখেছিলেন তাদের সবাই জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে বলেন। বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধানও ওই আলোচনার সূত্র থেকে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। সংসদের ওই মতৈক্য মাথায় রেখে নতুন করে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির একটি উদ্যোগ নেওয়াই যেতে পারে। সেদিনের চেতনা নিশ্চয়ই বিএনপির অনেক নেতা এখনও ধারণ করেন। দলের সাধারণ কর্মীরাও স্বাধীনতাবিরোধী এ শক্তির সঙ্গে থাকতে চান না।

বাইশ বছরে বিএনপি আরও দেখেছে, পরগাছার মতো জামায়াত কীভাবে তাদের ঘাড়ে চেপে হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে। তখন ওই কাজ করতে যত সহজ হত এখন তত নয়। তাই চারদিক থেকে চাপ সৃষ্টি করে বিএনপি থেকে জামায়াতকে আলাদা করতে হবে। এরপর সকল দল মিলে তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করলে সেটি কার্যকর সহজ হবে।

পাশাপাশি আরও কিছু সিদ্ধান্ত জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নিতে হবে। জামায়াতের প্রত্যেক সদস্যের রাজনীতি করার অধিকার আজীবনের জন্য কেড়ে নেওয়া; তাদের কোনো দলে না-নেওয়া; ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করতে না-দেওয়া; নামে বেনামে তাদের কোনো সংগঠন করতে নিষেধাজ্ঞা এর মধ্যে জরুরি।

শুধু জামায়াত নির্মূলই নয়, তাদের আদর্শের কবর রচনাও করতে হবে। তাদের মতাদর্শ কোনোভাবেই প্রচার করা যাবে না। জামায়াত, এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটিগুলোতে যারা আছে তাদের ভোটাধিকারও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থগিত রাখতে হবে। মৌলিক অধিকারের কথা এখানে ভাবা যাবে না। কারণ, মানবতাবিরোধী ও রাষ্ট্রবিরোধীদের মৌলিক অধিকার থাকতে পারে না।

সে সঙ্গে, তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রের জিম্মায় নিয়ে আসতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা জামায়াতের মালিকানায় থাকা ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা, কেয়ারি ফুড, ইসলামী ব্যাংক চক্ষু হাসপাতাল, সান সিটি, দৈনিক সংগ্রাম, শতাব্দী প্রেস, আধুনিক প্রকাশনী প্রেস, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, সোনার বাংলা পত্রিকা, রাবেতা ইসলাম, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, ফুলকুড়ি, ফালাহ্ আম ট্রাস্টসহ যে ১০৯ প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে; এর সবগুলো বাজেয়াপ্ত করতে হবে। প্রশাসনের ভেতরে যেসব জামায়াতি কর্মকর্তা রয়েছে তাদের খুঁজে বের করে ছাঁটাই করা দরকার।

নতুন প্রজন্মের একজন শিশুও যেন স্বাধীনতাবিরোধীদের চেতনা নিয়ে বড় হতে না পাারে সে লক্ষ্যে পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাশপাশি একাত্তরে জামায়াতের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের ইতিহাসও তুলে ধরতে হবে। সংবিধান যুগোপযোগী করতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রধর্ম থাকতে পারে না। এখানে গোঁজামিল চলবে না। স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে এ ব্যাপারে। তাৎক্ষণিকভাবে এ দলের সহিংসতা রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি পাড়ায় পাড়ায় জামায়াতবিরোধী ব্রিগেড গঠন করে পাহারা বসাতে হবে।

কাজগুলো সহজ ভাবার কারণ নেই; কোনো একক দলের পক্ষে তা করাও নিঃসন্দেহে কঠিন। তবে হ্যাঁ, যদি কোনোদিন এদেশের ৮০-৯০ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগের পক্ষে আসে– যেমনটি এসেছিল সত্তরের নির্বাচনে, যে জন্য আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিতে পেরেছিল— তখন আওয়ামী লীগ একাই জামায়াতের রাজনীতি কবর দিতে পারবে– যেমন বাহাত্তরে সংবিধান প্রণয়ন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিল সেভাবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের পর তেতাল্লিশ বছরে এ দেশে যে বিভক্তি এসে গেছে তাতে এককভাবে কোনো দলের পক্ষে এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ন সহজ নয়।

যেহেতু একাত্তরের মতো কোনো দলের নব্বই শতাংশ মানুষের সমর্থন পাওয়ার বাস্তবতা দেখা যাচ্ছে না, তাই সব দল মিলেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আওয়ামী লীগ এককভাবে কাগজে কলমে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলেও তাদের বিষবাষ্প ছড়ানো বন্ধ করতে পারবে না।

৩ জুন, ২০১৫

জায়েদুল আহসান পিণ্টু: প্রধান বার্তা সম্পাদক, দেশ টিভি।