সেপ্টেম্বর এগার-পরবর্তী জনবিতর্ক ও বিশ্ব

রিফাত হাসান
Published : 8 Jan 2011, 05:53 PM
Updated : 16 May 2011, 01:45 PM

সেপ্টেম্বর ইতিহাসের ঘণ্টা দুলিয়ে দেওয়া মাস। কিন্তু এটি সেপ্টেম্বর নয়। অন্য কোনো দিন। তারপরও যেন সেপ্টেম্বরেই আছি। যখন বারাক হোসেন ওবামা নামের এক মুসলিম পিতার পরিবারে জন্ম নেওয়া কালো বংশোদ্ভূত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওসামা নামের আর এক মানুষকে নিরস্ত্র অবস্থায়, বিশেষ প্রশিক্ষিত বাহিনীর মাধ্যমে, গোপনে, অন্য রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে ঢুকে, খুন করার কথা ঘোষণা করলেন উদ্ধতভাবে: 'ওসামাকে আর কখনও পৃথিবীর বুকে হেঁটে যেতে দেখা যাবে না', তখন আমেরিকার গর্বিত 'গণতন্ত্র', 'স্বাধীনতা', বিশ্বব্যাপী সর্দারি ও অপ্রস্তুত জনগোষ্ঠীর উপর অনায্য হামলা ও হত্যালীলায় 'সুখী' সেইসব 'নিষ্পাপ' নাগরিকরাও (Good Americans) উল্লাস করেছেন।

বাবা ও পুত্র বুশ, ওবামা, হিলারি, ক্লিনটন, বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের অপরাপর শক্তিকেন্দ্রসমূহ, সেবাদাস রাষ্ট্রগুলোর সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো (বাংলাদেশের সরকারি ও বিরোধী দলসহ) স্বন্তি প্রকাশ ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। একই সঙ্গে ওসামা হত্যাকাণ্ডের মধ্যে নাইন ইলেভেনের পর 'সন্ত্রাসে'র বিরুদ্ধে যুদ্ধের অগ্রগতিকেও 'ন্যায়বিচার' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ওরা। যদিও, ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে নাইন ইলেভেনের হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ এখনও প্রমাণের অপেক্ষাতেই আছে, যা আর কখনও প্রমাণ হবার নয়। তার আগেই তার বিরুদ্ধে 'ন্যায়বিচার' প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল, ওবামার ভাষ্যমতে।

যদিও ইরাক, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তানের লক্ষ লক্ষ মৃত ও খুন হয়ে যাওয়া শিশু ও নাগরিকের পরিসংখ্যান, জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে আমেরিকার আণবিক বোমায় পুড়ে যাওয়া মানুষগুলোর ইতিবৃত্ত, আফ্রিকার কালো মানুষদের হারিয়ে যাওয়া জীবন ও দাসত্বের ইতিহাস যারা কোনো না কোনোভাবে কালো বারাক হোসেন ওবামারই পূর্বপুরুষ ছিল। আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের উপরে গণহত্যা, স্বভূমি থেকে বিতাড়ন ও নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টার যে অপরাধ– খোদ আমেরিকান পণ্ডিত ওয়ার্ড চার্চিলের মতে, তার তুলনায় নাইন ইলেভেনের এই পাল্টা ধাওয়া ছিল প্রকৃত ন্যায়বিচার ও প্রতিরোধের শুরু মাত্র।

এই প্রেক্ষিতে, এটি সেপ্টেম্বর এগার-পরবর্তী বিশ্বের জনবিতর্কসমূহ ও ইসলামি পুনরুত্থানবাদীদের ভাব-বিশ্লেষণ ও পুনঃপাঠের জন্য জরুরি সময় বটে।

মূলত দুই হাজার এক সালের সেপ্টেম্বরের এগার তারিখে আমেরিকার টুইন টাওয়ারে অজ্ঞাত আততায়ীদের মানব বোমা হামলা ও তৎপরবর্তী বিশ্ব এক নয়, পণ্ডিতগণ এমনই অনুমান করেছিলেন। এই অনুমান মিথ্যে নয়, এই হামলার এক যুগেরও বেশি সময় পরে তাই আলোচনার বিষয় হিসেবে নাইন ইলেভেনের হামলা বা তার প্রতীক হয়ে ওঠা ওসামা ও তার অনুসারীদের জেহাদটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। জাতিরাষ্ট্র, সার্বভৌমত্ব এবং তার অধীনে বেড়ে ওঠা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ধারণা ভঙ্গুর, ঠুনকো হয়ে গিয়েছে নাইন ইলেভেনের হামলায়। তার পরিবর্তে এখন দিন দিন ন্যাশনাল সিক্যুরিটি স্টেট তৈরি হচ্ছে, সব দিকে।

বাংলাদেশেও এই হাওয়ায় পাল লেগেছে: জনবিতর্ক ও বিরুদ্ধ মতের উপর স্পর্শকাতরতা, গোপনীয়তা, দমন-নিপীড়ন, নো টলারেন্স, সেফ হোম নামের টর্চার সেল, কল্পিত জাতীয় শত্রু, 'স্বাধীনতাবিরোধী' হিসেবে নির্ণয়, জাতিসংঘের শান্তি-ব্যবসায়ে ভাড়া-খাটা সেনাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ও নির্ণায়ক হয়ে ওঠা– এই বিষয়গুলো দ্রষ্টব্য। এই ন্যাশনাল সিক্যুরিটি স্টেট হল মূলত একটি হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রাষ্ট্রের প্রতিবিম্ব, যা আমেরিকা হয়ে উঠেছিল। আর এমন সুপার সিক্যুরিটি স্টেটের ধারণাবাহী নয়া সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার পোপ আমেরিকা শুরু করেছিল ইনফিনিট ওয়ার অ্যাগেইনস্ট টেরোরিজম।

এটা কেবল সেই ধরনের টেররিজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, যা বিশ্বব্যবস্থায় আমেরিকা ও তার বন্ধু ইসরায়েলের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা-বাসনা-স্বার্থ এবং বিশ্ব পূঁজিবাদী সভ্যতার স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় (দেখুন: Graham E. Fuller)। সেইসব ভায়োলেন্স, যা আমেরিকা-ইজরায়েল অক্ষের দুনিয়াব্যাপী বে-ইনসাফির সম্ভাব্য প্রতিবাদ। পণ্ডিতগণ বলছেন, সেপ্টেম্বর এগার-পরবর্তী পৃথিবীতে যাবতীয় ঘটনাপ্রবাহের ভাব বুঝার জন্য সেপ্টেম্বর এগারর বরাত নিতেই হবে। যদি না নেওয়া হয়– তাহলে তা হবে নিছক খণ্ডিত পাঠ। পণ্ডিত তালাল আসাদের অভিমত, 'পরাশক্তি নিয়ন্ত্রিত দুনিয়ায় সেপ্টেম্বর এগারর ট্র্যাজেডির তাৎপর্য নিয়ে কোনো টেকসই জনবিতর্ক হয়নি যা খুবই দরকারি'।

সন্ত্রাসবাদের গাল-গপ্পো, মডারেট ইসলাম, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারীমুক্তি, শুভ ও অশুভ, স্বাধীনতা, প্রগতি, সম্পদ, প্রযুক্তি, যুদ্ধ– এমন আরও অসংখ্য ডিসকোর্সকে সেপ্টেম্বর এগারর আয়নায় রেখে বাছ-বিচার করবার দায় থেকে যায় তাই।

২.

সেপ্টেম্বর এগার-পরবর্তী দুনিয়ায় বুদ্ধিবৃত্তির যে নয়া মোচড়, তার মধ্য দিয়ে চলমান বিতর্কগুলোর এক নতুন চেহারা পেয়েছে। এই বিতর্কের একপাশে রয়েছে পশ্চিম বা য়ুরোপ যা মার্কসবাদীদের কাছে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার আইকন হিসেবে অবশ্যপাঠ্য ছিল সব সময়। মূলত তিনটি পক্ষ রয়েছে এই আলোচনায়।

এক. পশ্চিমের নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া যা পশ্চিম ছাড়া অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতি তাদের আচরণে একটি ঐতিহাসিক হিস্টিরিয়ার জন্ম দিয়েছে।

দুই. পশ্চিমের সঙ্গে ইসলামের বোঝাপড়া যার প্রেক্ষিত মূলত জ্ঞানতাত্ত্বিক এবং ফলত ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিকও বটে।

তিন. ইসলাম এবং পশ্চিম উভয়ের সঙ্গে মার্কসবাদীদের নতুন বোঝাপড়ার প্রেক্ষিত। পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল সোসাইটিতে শ্রেণিসংগ্রাম এবং শ্রেণিসংগ্রামের ভিন্ন ভিন্ন রূপ-সম্পর্কিত নতুন জিজ্ঞাসার সঙ্গে বোঝাপড়া। এছাড়া লিবারাল এবং অ্যানার্কিস্ট গোষ্ঠীর কিছু বোঝাপড়া আছে– যাকে আলাদা ক্যাটাগরি হিসেবে আলোচনায় না আনলেও বিভিন্ন আলোচনায় তাদের বক্তব্যগুলি হাজির থাকে।

পশ্চিম কী ভাবছে? দৃশ্যপট দেখুন: সেপ্টেম্বর এগারর পর 'নারীমুক্তি', 'গণতন্ত্র', 'মানবাধিকার', 'সন্ত্রাসবাদ' ইত্যাকার কিছু ভূত বিশ্ববাসীকে ভয়ঙ্কর সন্ত্রস্ত করে তুলল। আফগানিস্তান 'নারী'র জন্য বোমা ও ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল, ইরাক 'গণতন্ত্র' ও 'মানবাধিকার'এর জন্য জনশূন্য হয়ে গেল, প্যালেস্টাইনসহ পুরো বিশ্ব পরিমণ্ডল 'সন্ত্রাসবাদ' এর আতংকে নীল। অথচ বিশ্বের তেলসমৃদ্ধ 'অসভ্য' মুসলিম দেশসমূহকে 'আলোকায়নে'র জন্য সেনা-অভিযান খুবই প্রয়োজনীয়। বিশ্বের মূল ভবিতব্য হল সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অনন্ত 'ক্রুসেড'। 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ– অনন্ত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে'।

আমেরিকার মিত্রশক্তি ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুর বচন: "যা কিছু পশ্চিম, ইজরায়েল, ইহুদি এবং খ্রিষ্চিয়ান ট্রেডিশন বা সভ্যতা এবং শুভর সঙ্গে শত্রু-ভাবাপন্ন তাই সন্ত্রাসবাদ।"

বলাবাহুল্য, এই ডিসকোর্স ঘোষণার পর পশ্চিমের যাবতীয় ভাবনা এবং তৎপরতায় ইসলাম এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি আচরণে এক ধরনের হিস্টিরিয়া, আতংক ও ঘৃণার প্রকাশ শুরু হয় অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভর লড়াই হিসেবে। বিশ্বসম্প্রদায়কে জড়ো করে এই কাল্পনিক অশুভর বিরুদ্ধে সংঘাতে লেলিয়ে দেয় ইরাক আফগানিস্তান প্যালেস্টাইন এমনকি যারা এই ডিসকোর্সের সঙ্গে একমত নয় তাদেরকেও অশুভ হিসেবে চিহ্ণিত করে।

নৃতাত্ত্বিক তালাল আসাদ আমেরিকান জাতির মুখপাত্রদের এই প্রবণতা উল্লেখ করে বলছেন, এটি এমন এক প্রবণতা যা সেপ্টেম্বর এগারর ট্র্যাজেডির পর নাটকীয়ভাবে নতুন করে হাজির হয়েছে, আমেরিকান জাতিকে 'শুভ' নাম দিয়ে বিপরীতে এর ভেতরের ও বাইরের শত্রুদের 'শয়তান' বা 'অশুভ' নাম দেওয়া। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত ইতিহাসবিদ এরিক ফনারের মতে–

"ধর্মীয় বিশ্বাসের চলমান উচ্চমাত্রা আমেরিকানদের নিজেদের প্রতিপক্ষকে শত্রু হিসেবে না দেখে শয়তান হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত করেছে। ফলত তাদের বিশ্বাস যে, দুনিয়ায় উদারনৈতিকতার সর্বশেষ আশা হলো আমেরিকা সুতরাং যারা আমেরিকার প্রতিপক্ষ হয় তারা উদারনৈতিকতার প্রতিপক্ষ হয়।"

ছোট বুশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছেন এভাবে:

"আমরা এবং তোমরা। হয় তোমরা আমাদের সঙ্গে, না হয় তোমরা ওদের পক্ষে- অতএব আমাদের দুশমন, সন্ত্রাসী।"

এভাবে সমস্ত বিশ্ববাসীকেই এই নতুন বিশ্বযুদ্ধে জড়াল– যার প্রতিপক্ষ বীজগণিতের মতো প্রথমে কাল্পনিক সংখ্যা দিয়েই শুরু হয়। অতঃপর অনির্দিষ্ট শত্রুর বিরুদ্ধে আমেরিকার 'সন্ত্রাসবিরোধী' ও 'আলো-জ্বালাতনী' বোমা পড়তে থাকে ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন এবং আরও অনির্দিষ্ট অসংখ্য লক্ষ্যবস্তুতে। এই যুদ্ধের পরিবর্তিত অফিসিয়াল নাম 'অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম', শুরুতে যার নাম দেওয়া হয়েছিল 'অপারেশন ইনফিনিট জাস্টিস'। যার লক্ষ্য, বিশ্লেষকদের মতে, সারা বিশ্বের উপর আমেরিকা– ইজরায়েল অক্ষের সামরিক-অর্থনৈতিক দখলদারিত্ব বজায় রাখা।

পশ্চিমের নিজেদের ভিতরকার প্রতিক্রিয়া জানতে, ভারতীয় লেখক পঙ্কজ মিশ্রর পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, সেপ্টেম্বর এগারর অমানুষিক ভূত পশ্চিমকে তাড়া করছে সব সময়। ফলত একটি ভয় এবং হিস্টিরিয়ার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। এর হালনাগাদ প্রকাশ ইওরোবিয়ার দুঃস্বপ্ন। এই দুঃস্বপ্নের মধ্যে আছে শুধু ইসলামপন্থী বিপ্লবীরাই নয় বরং দ্রুত বংশবিস্তাররত মুসলিমরাও ইওরোপকে 'ইওরোবিয়া'তে (ইওরোপ+অ্যারাবিয়া= ইওরোবিয়া) রূপান্তরিত করছে। 'একটি বিশ্বাসঘাতক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে লালন-পালন করার বেকুবিপনার জন্য ইওরোপের যে প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত', সে বিষয়ে মিশ্র কানাডার সাংবাদিক মার্ক স্টেয়েনের বাজার-পাওয়া বই আমেরিকা অ্যালোন: দি এন্ড অফ দি ওয়াল্ড অ্যাজ উই নো ইট এ দেওয়া ফতওয়ার উল্লেখ করেছেন:

"একটি গণতান্ত্রিক সময়ে গৃহযুদ্ধ ছাড়া আপনি কোনো জনগোষ্ঠীকে স্রেফ ছুঁড়ে ফেলতে পারেন না। সার্বরা অনেক চিন্তা করে এই ফায়সালা করে ফেলেছে– মহাদেশের অন্যান্যরা সামনের বছরগুলোতে যেমনটি করবে: আপনি যদি শত্রুর বংশবিস্তার রোধ করতে না পারেন তবে তাদের স্রেফ রোগাক্রান্ত মুরগীর মতো জবাই করে ফেলুন।"

ব্রিটেনের বর্ষীয়ান ও জনপ্রিয় লেখক মার্টিন অ্যামিস এই মার্ক স্টেয়েনকে 'অকথ্যের মহান কথক' (গ্রেট সেয়ার অব দ্য আনসেয়েবল) বলে প্রশংসা করেছেন। ফলত, ইওরোপ তার অধিবাসী মুসলিমদের দখলে গিয়ে আরাবিয়া হয়ে যাচ্ছে– এই ভয় সেপ্টেম্বর এগারর পর এক কিম্ভূত ইওরোবিয়া-ব্যবসা ছড়িয়েছে। মিশ্র সম্প্রতি ফ্রান্সের হিজাব-বিতর্ক সম্পর্কে সামাজিক নৃতাত্ত্বিক অর্জুন আপ্পাদুরাইএর ফিয়ার অব স্মল নাম্বারস: অ্যান এসে অন দি জিওগ্রাফি অব অ্যাংগার শীর্ষক প্রবন্ধের বরাত দিয়ে দাবি করেছেন যে, অল্পসংখ্যক শক্তিমান রাষ্ট্র, নিয়ন্ত্রণহীন অর্থনৈতিক প্রবাহ ও সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে আপসের এই দুনিয়ায় অনেক রাষ্ট্রেরই নিজস্ব লঘুত্ব ও প্রান্তিকতা (বাস্তব অথবা কল্পিত) সম্পর্কিত পেরেশানি আড়াল করার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।

সেই কারণেই, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাতেগোনা কিছু নারীর হেডস্কার্ফের প্রতি ফ্রান্সের অতিসক্রিয় রাষ্ট্রপতি নিকোলাস সারকোজির প্রবল হিংস্রতা ও উন্মত্ততা জাতি-রাষ্ট্রটির ভূ-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বহীনতাকে প্রতারণামূলকভাবে আড়াল করার চেষ্টা করে। বলাবাহুল্য, হিজাব, বোরকা এবং ফতওয়াকেন্দ্রিক পশ্চিমের এই জনপ্রিয় বিতর্ক বাংলাদেশেও এখন হাইকোর্টে মীমাংসার অপেক্ষায়।

পশ্চিমের ভিতরের গলিঘুপচির এই অবস্থা জানার পর এবার পশ্চিমের বাইরের তৎপরতা এবং অস্তিত্বগুলোর (কাল্পনিক এবং বাস্তবিক) দিকে মুখ ফেরানো যাক। প্রথমত আলোচনায় আনতে চেষ্টা করব এ বিষয়ে মার্কসবাদী মহলের নতুন বোঝাপড়ার চেষ্টাগুলোতে। মার্কসবাদী তত্ত্বানুযায়ী শ্রেণিসংগ্রাম সর্বক্ষেত্রে চলমান একটা বাস্তবতা। তবে একটি বিদ্যমান সমাজের লড়াই যখন ক্লাস ইন ইটসেলফ থেকে ক্লাস ফর ইটসেলফে উত্তরণ ঘটে তখন তাকে ইতিহাসে দ্বন্দ্ব নিরসনের অভিমুখে সামগ্রিক রূপান্তরের উদ্দ্যেশ্যে পরিচালিত বলে গণ্য করা হয়।

মার্কসবাদী মহলে ইতোপূর্বেই হাজির ছিল পোস্ট-ইন্ডাস্ট্রিয়াল সমাজে শ্রেণিসংগ্রামের রূপ কী হবে, তা নিয়ে নতুন চিন্তা-ভাবনা ও বিতর্ক। নতুন সমাজবাস্তবতা ও বিশ্বপরিস্থিতিতে শ্রম এবং শ্রমিকের রূপান্তর এই বিতর্কের উপজীব্য। প্রোগ্রামার, হ্যাকার, ওপেন সোর্স আন্দোলন ও অন্যান্য নিত্যনতুন অনুষঙ্গ এখন আমাদের মধ্যে হাজির আছে। এই নতুন ভার্চুয়াল সমাজে শ্রেণিসংগ্রাম এবং তার ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছিল মার্কসবাদীদেরকে।

সেই দিক থেকে, মার্কসবাদীদের রেডিক্যাল ও প্রগতিশীল অংশ সেপ্টেম্বর এগার-পরবর্তী ঘটনা ক্যাপিটেলের জায়গা থেকে এই সিভিলাইজেশনাল ট্রান্সশিপম্যান্টের নতুন ভাব তৈরির মুহূর্ত হিসেবে ভাবতে তৎপর। সেটি হল: শ্রেণিসংগ্রামের ভাষা। আফগান ভূখণ্ডে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের প্রতিবাদে তালেবানদের আল্লাহর নামে অস্ত্র হাতে জেহাদ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে শ্রেণিসংগ্রামের ভাষা নিয়ে বাংলাদেশের মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ফরহাদ মজহার তাঁর 'ক্রুসেড, জেহাদ ও শ্রেণিসংগ্রাম' শীর্ষক থিসিসে বলছেন:

"নিপীড়িত শ্রেণি নিশ্চয়ই সদাসর্বদা কার্ল মার্কস, লেনিন বা মাও জেদংএর ভাষায় কথা বলে না।"

তিনি মার্কস-লেনিনের অনুসারী বা কম্যুনিস্টদের শ্রেণিসংগ্রামের ভাষায় সবাইকেই কথা বলতে হবে– এমনতরো বাসনাকে রীতিমতো আবদার বলেছেন। তাঁর মতে, "মার্কসের নামে সংগ্রাম হলেই কি সেটা শ্রেণিসংগ্রাম হয়– নাকি যারা মার্কসের নাম শোনেনি তারা যদি আল্লাহর পথে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে ও অকাতরে প্রাণ দেয়, গরিবের পক্ষে ধনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয় সেটাও শ্রেণিসংগ্রামের আর একটা রূপ।"

ফরহাদ আরও একটুখানিক এগিয়ে বলছেন– "নিপীড়িত শ্রেণি বা জনগোষ্ঠী কখনও ধর্ম, কখনও ভক্তি, কখনও হিংসা, কখনও শান্তি কিম্বা কখনও নৈরাজ্য ইত্যাদি নানান ভাষায় কথা বলে।"

তবে, জ্ঞানতাত্ত্বিক জায়গায় পশ্চিমের বিষয়ে মার্কসবাদীদের বড় মাপের কোনো বিতর্ক নেই বললেই চলে। 'তৎপরতা ছাড়া চিন্তা বিশুদ্ধ পণ্ডিতি ব্যাপার।'

এবার মুসলিম বিশ্বে নাইন ইলেভেনের পর যেইসব মোচড় পরিলক্ষিত হয়েছে, তার কিছুটা আলোচনা করি। নাইন ইলেভেনের ঘটনায় পশ্চিমের বিহ্বলতা– প্রতিহিংসা এবং ক্রুসেড ঘোষণার সম্মুখীন হয়ে প্রথমত মুসলিম বিশ্বের একটি অংশে এপোলজিটিক অ্যাপ্রোচ তৈরি হয়েছে– যার কারণে অ্যাকটিভিস্টদের একটা গ্রুপ 'মডারেট ইসলাম'এর নামে ইসলাম 'টেররিজম' সমর্থন করে কিনা– এই বিতর্কে নিজেদের সঁপে দিয়েছে। এই অংশটি আগেই পশ্চিমা সভ্যতার জ্ঞান-কাণ্ডে মুগ্ধ এবং স্ট্রাকচারে নিমজ্জিত। জাতিরাষ্ট্র, গণতান্ত্রিক উপায়ে ইসলামি রাষ্ট্র ইত্যাকার ভাবধারায় আন্দোলিত এরা। ইসলামি গণতন্ত্র– ইসলামি পুঁজি– ইত্যাকার ভাবধারা ধারণ করে এরা। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী গোছের রাজনৈতিক দলগুলো এই ঘরানায় পড়ে।

উদারনৈতিক ভাবধারার আর একটি অংশ পশ্চিমের সঙ্গে সভ্যতা-বিষয়ক সংলাপের নতুন প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে– এটি সভ্যতার দ্বন্দ্ব-বিষয়ক তত্ত্বের বিরুদ্ধে একটি সমন্বয়মূলক স্কলারি কার্যক্রম পরিচালনা করে। ইসলামে একই সময়ে অ্যাকটিভিস্টদের অন্য আর একটি অংশ রেডিক্যাল বিপ্লবী ভাবধারার স্মরণ নিয়েছে। এ অংশটি সরাসরি জেহাদের কথা বলছে– সশস্ত্র জেহাদের মাধ্যমে ইনসাফ বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা বলছে। দেখা যাচ্ছে, সেপ্টেম্বরের এগার তারিখে পুঁজিবাদী বিশ্বের দুইটি প্রধান আইকনের উপর এই ইসলামি পুনরুত্থানবাদীদের হামলা হল– আর বাংলাদেশে জেএমবি নামক নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামি পুনরুত্থানবাদী সংগঠনও বোমা হামলা করল কোনো সাধারণ স্থাপনায় নয়– ওদের ভাষায়– সেই আদালতে, যে আদালত ন্যায়বিচার দিতে অক্ষম।

এরাই আবার 'তালেবান' হয়ে আফগান ভূখণ্ডে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন রুখছে– ফিলিস্তিনেদের আপন ভূখণ্ডে ফিরিয়ে আনার জন্য ইন্তিফাদায় যোগ দিচ্ছে– আত্মঘাতী বোমা হামলা চালাচ্ছে, আর ইরাকে আমেরিকান ও আন্তর্জাতিক লুটেরাদের তাড়ানোর জন্য জীবনবাজি রেখে জেহাদ করছে। এরা বলছে, এক্ষণে এটি প্রয়োজনীয় লড়াই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই পর্যায়ে এই পুনরুত্থানবাদীদের দমন-নিপীড়নের জন্য আমেরিকার ভাড়াটে হিসেবে কাজ করে কিছু মডারেট ইসলামিস্ট, যেমন, হামিদ কারজাই।

এ তো গেল পুরো মুসলিম বিশ্বের অ্যাকটিভিস্ট, একাডেমিশিয়ান এবং রেডিক্যাল পুনরুত্থানবাদীদের কথা। নাইন ইলেভেনের পর খোদ য়ুরোপে যে বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী অবস্থান করছে– তারা কী ভাবছেন?

পঙ্কজ মিশ্র আমাদের জানাচ্ছেন, পূর্ণ এবং সমমর্যাদার নাগরিকত্ব প্রত্যাশী এই মুসলিমদের সামনে সবচে জরুরি প্রশ্ন হল– ইওরোপীয় জাতিরাষ্ট্রের পুরনো ধাঁচের উদারনৈতিকতাবাদ (যা ঐতিহ্যগতভাবে সাংস্কৃতিক সমজাতীয়তা ধারণ করে বেড়ে উঠেছে) সংখ্যালঘুর পরিচয়সত্ত্বার জায়গা দিতে পারবে কি না এবং ইওরোপের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়সমূহ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যের আলামত সহ্য করতে পারবে কি না। ইওরোপের সেকুলার বুদ্ধিবৃত্তিক মুরব্বীদের একাংশের জবাব হচ্ছে– 'না'। তাদের দাবি হচ্ছে পুরোপুরি ইওরোপীয় হওয়ার লক্ষ্যে মুসলিমদের অবশ্যই তাদের ধর্মীয় সকল চিহ্ন ত্যাগ করতে হবে।

'আত্মপরিচয়ের আত্মহত্যা'র এই দাবির আরও নির্মম ইতিহাস ইওরোপে আছে। পঙ্কজ উদাহরণ দিচ্ছেন দার্শনিক ভলতেয়ারের– যিনি 'জাহেল' ও 'বর্বর' ইহুদিদের আক্রমণ করে যুক্তিবোধ ও সভ্যতার রক্ষক হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব আরও উজ্জ্বল করেছিলেন। তাঁর ভাষায়, এই ইহুদিরা তাদের খোদায়ী কিতাবের দাস এবং 'এরা সবাই তাদের অন্তরে প্রবল উন্মত্ততা নিয়ে জন্মেছে' (নাৎসিরা ইহুদিদের বিরুদ্ধে তাদের বক্তৃতাবাজিতে ভলতেয়ারের রচনাবলীর বিশাল অংশ ব্যবহার করেছিল)।

আজকের ফ্রান্সে মুসলিমরা নিজেদের নারীদের সঙ্গে অসদাচরণ ও দ্রুততার সঙ্গে বংশবৃদ্ধি করার যে বৈশিষ্টে চিহ্নিত এবং তারা নিজেদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক তল্পিতল্পা ছাড়তে যে যন্ত্রণাপূর্ণ তাগাদা মোকাবিলা করছে, এই একই রকমের 'সমন্বয় প্রক্রিয়া'র আরও চরমতম মূল্য দিতে হয়েছে ১৯ শতকের জার্মানির ইহুদিদের। মিশ্রর মতে, গ্লোবালাইজড এবং উঁচু মাত্রায় রাজনৈতিক প্রজন্ম থেকে আসা মুসলিমরা এখন তাদের জন্য উন্মুক্ত জনপরিসরে প্রবেশ করতে, অথবা উগ্রপন্থা গ্রহণ করতে, অথবা তাদের মাতাপিতার মতো পিছু হটে অপ্রতিরোধী অসন্তোষের মধ্যে জীবনযাপন করতে প্রস্তুত। মিশ্রর বলা এই ভবিতব্যের কোনটা এখন য়ুরোপের ভবিতব্য– তা ভবিষ্যতই বলবে।

তথ্যসূত্র

Talal Asad: Formations of the secular: Christianity, Islam, modernity এর ভূমিকা অংশ: "‌introduction: thinking about secularism"। এবং Pankaj Mishra: "A culture of fear", যুক্তরাজ্যের দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় ১৭ আগস্ট, ২০০৯ তারিখে প্রকাশিত।

উভয় লেখায় মোহাম্মদ আরজুর তরজমাকৃত ভার্সনের সাহায্য নেওয়া হয়েছে–

যা চিন্তা ডটকমে প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।

পঙ্কজ মিশ্রর মূল লেখাটির লিংক: http://bit.ly/MUjnx

আরজুর সংক্ষেপিত অনুবাদের লিংক:

আরজু কর্তৃক তালাল আসাদের অনুবাদের লিংক: