ধর্ষণ, পর্নোগ্রাফি এবং কুম্ভকর্ণ

Published : 27 May 2015, 02:49 PM
Updated : 27 May 2015, 02:49 PM

দেশে নারীনির্যাতনের উৎসব চলছে। বর্ষবরণে নারীর উপর যৌনহামলা ছিল 'দুষ্টুমি'! রাজধানীর স্কুলে শিশুকে ধর্ষণচেষ্টা ছিল 'গুজব'! মাইক্রোবাসে আদিবাসী নারীধর্ষণ তাহলে কতিপয় বখাটের 'ফুর্তি'! আর প্রতিদিন পত্রিকায় যে ধর্ষণ, নিপীড়ন, নির্যাতনের খবরগুলো ছাপা হচ্ছে তা হল, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর 'নিয়তি'।

বর্ষবরণের ঘটনাটির যদি দ্রুত বিচার হত, অপরাধীদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তি প্রদান করা যেত তাহলে সাম্প্রতিক নারীনির্যাতনের ঘটনাটি হয়তো ঘটত না। কোনো অপরাধ করে যখন মানুষ পার পেয়ে যায় তখন আরও অনেক অপরাধীর জন্ম হয়। কারণ সম্ভাব্য অপরাধীরা দেখে, 'কই, কিছুই তো হল না'। তারা নতুন নতুন অপরাধ করতে উৎসাহিত হয়। আজ যদি এই গারো তরুণীর ধর্ষকরা রেহাই পেয়ে যায় তাহলে নিঃসন্দেহে দেশে আরও অনেক ধর্ষণের ঘটনা ঘটবে, আরও অনেক অপরাধীর জন্ম হবে। আর পুলিশ-প্রধান নিজেই যখন কোনো গুরুতর অপরাধকে 'দুষ্টুমি' বলে মশকরা করেন তখন তো অপরাধীদের পোয়াবারো হবেই।

শুরুতেই বলে রাখা ভালো, এই লেখা কোনোভাবেই পুরুষের বিরুদ্ধে নয়। লেখাটি শুধুমাত্র সেই সব অপরাধীর বিরুদ্ধে যারা ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত। ধর্ষণ এমন একটি অপরাধ যার পক্ষে একটি যুক্তিও কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। মানসিকভাবে অসুস্থ কতিপয় ব্যক্তি যারা সুযোগ পেলে অপরাধী হয়ে উঠতে পারে তারাই একমাত্র এ ধরনের অপরাধ মনে মনে সমর্থন করে এবং একে লঘুভাবে দেখে। ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের বিরুদ্ধে সমাজের সব স্তরের, সব শ্রেণি, পেশা, দল, মতের মানুষের, নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। ধর্ষণের পক্ষে কোনো যুক্তি, তর্ক নয়। বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নয় ধর্ষকের পক্ষে। ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স' থাকতে হবে দলমতনির্বিশেষে।

রাজধানীতে মাইক্রোবাসে আদিবাসী নারীধর্ষণের ঘটনা গুরুতর সামাজিক অরাজকতার ইঙ্গিতবাহী। সেই সঙ্গে মানবতার জন্য অশনি-সংকেত। আরও বেশি অশনি-সংকেত হল এই অপরাধ করে যদি কেউ পার পেয়ে যায়।

হত্যা, ডাকাতি ও ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ বিশ্বের সব দেশেই কমবেশি ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো অনেক বেশি মাত্রায় ঘটতে পারে। কিন্তু পার্থক্য ঘটে অপরাধ সংঘটনের পরবর্তী ধাপে। উন্নত বিশ্বে এসব অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। এ ধরনের অপরাধ করে রেহাই পাবার কোনো পথ নেই। কিন্তু আমাদের দেশে নারীর বিরুদ্ধে যৌনঅপরাধ করে সহজেই পার পাওয়ার রাস্তা খোলা থাকে। বিশেষ করে অপরাধী যদি হয় প্রভাবশালী ও বিত্তশালী আর ভিকটিম দরিদ্র ও অসহায়, তাহলে ভিকটিমের ন্যায়বিচার পাবার দরজা প্রায় রুদ্ধই থাকে।

ধর্ষণের ক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যা হল, ভিকটিমের ডাক্তারি পরীক্ষা ও আইনগত লড়াই চালানোর প্রক্রিয়াসমূহ এত সময়সাপেক্ষ ও জটিল যে নারীর জন্য তা আরও অবমাননাকর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ডাক্তারি পরীক্ষার ক্ষেত্রে তা দ্বিতীয়বার নির্যাতনের সামিল হয়ে দাঁড়ায়। আইনের দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতেই কাঁদে। গোড়ায় গলদের মতো অপরাধী ধরার বেলায় আইনের রক্ষকদের উদাসীনতা, 'অন্য গুরুতর' কাজে ব্যস্ততা তো রয়েছেই। ভাবটা যেন, যে নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে, মূল দোষটা তো তারই। সে কেন নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি? আইনের রক্ষকদের এই উদাসীনতা অপরাধীকে নিত্যনতুন অপরাধ করতে উৎসাহিত করে। যদি প্রত্যেক ধর্ষকের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা যেত তাহলে এই অপরাধ কমতে বাধ্য হত।

বেইজিং, সিঙ্গাপুরের মতো বড় শহরে মধ্যরাতেও নিশ্চিন্তে চলাফেরা করেছি। কখনও মনে শঙ্কা জাগেনি। অথচ ঢাকার রাস্তায় সন্ধ্যার পরই মেয়েরা চলতে ভয় পায়। বাংলাদেশ ও ভারতে আরেকটি ভয়াবহ প্রবণতা সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে। দিল্লিতে চলন্ত বাসে নারীধর্ষণের ঘটনার পর যানবাহনে এই অপরাধ সংঘটনের হার বেড়েছে। মাইক্রোবাসে নারীধর্ষণের ঘটনার পরের দিনই ট্রাকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর আগে বাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে এক গৃহবধূ। গণপরিবহণগুলোতে এই ঘটনা ঘটতে থাকলে নারীর স্বাধীন চলাচল ব্যাহত হবে। শ্রমজীবী ও পেশাজীবী যে নারীরা কাজ সেরে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরবেন তাদের নিরাপত্তা কে দেবে?

ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধির পিছনে পর্নোগ্রাফিরও একটি বড় ভূমিকা রয়েছে এটা বলা যায়। কারণ এর মাধ্যমে নারীকে (অনেক ক্ষেত্রে শিশু-কিশোরদেরও) যৌনবস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এই ছবিগুলোতে নারী যেন শুধু বিকৃত যৌনতার সামগ্রী। তার কোনো মানবিক সত্তা নেই।

পাশের দেশ ভারতেও ব্যাপক মাত্রায় নারীনির্যাতন হচ্ছে। সেখানে পর্নোগ্রাফি ও মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির কিছু সাম্প্রতিক প্রবণতা এসব অপরাধপ্রবণদের উৎসাহিত করছে বললে ভুল হবে না। পর্নোগ্রাফির সঙ্গে সঙ্গে আইটেম গানের নামে হিন্দি সিনেমায় যা চলছে তাকে সুস্থ রুচির বিনোদন বলা চলে না কিছুতেই। 'আইটেম গান ধর্ষণ উসকে দেয়', কিছুদিন আগে বলিউডের প্রবীণ অভিনেতা ওমপুরী এমন মন্তব্যই করেছেন। আইটেম গানে প্রকৃতপক্ষে বিকৃত যৌনতার উপস্থাপন করা হয়।

দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে ভারতীয় চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে অবাধে এসব প্রচারিত হচ্ছে। শিশু, কিশোর, তরুণরা এগুলো দেখছে এবং বিকৃতির দীক্ষা পাচ্ছে। আমাদের গ্রামে-গঞ্জেও প্রযুক্তির ভালো দিকগুলোর বদলে খারাপ দিকগুলো বেশি ছড়িয়ে পড়ছে। মোবাইল ফোনে ধর্ষণের দৃশ্য ধারণ করে তা ছড়িয়ে দেওয়া এখন সহজ। এভাবেই প্রযুক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে নারীনির্যাতনের বড় হাতিয়ার। প্রযুক্তির এই অপব্যবহার রোধ করাও জরুরি।

চীনদেশে দেখেছি তারা পর্নোগ্রাফি কী কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। প্রতিটি পর্নোসাইট সেখানে 'লক' করা। ইংরেজি ও চীনা ভাষার প্রতিটি পর্নো-গন্ধী শব্দের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা আছে। সে দেশে বসে এমনকি বাংলাসহ অন্য যে কোনো ভাষায় কেউ যদি কোনো পর্নোসাইটে প্রবেশ করতে চায় তাহলে ট্রান্সলেটারের মাধ্যমে ওই শব্দের অটো-ট্রান্সলেশন হয়ে সেই সাইট বন্ধ হয়ে যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। আমাদের দেশেও এই প্রযুক্তি অবলম্বন করা প্রয়োজন যাতে কোনোভাবেই এ দেশের তরুণ প্রজন্ম পর্নোগ্রাফির ভয়াবহ গ্রাসে না পড়ে।

সিরিয়াল ও আইটেম গানের ভাইরাসবাহী ভারতীয় চ্যানেলগুলোর বিষয়েও সতর্কতা প্রয়োজন। অবাধে এগুলোর ছাড়পত্র দেওয়াটা কতটা যুক্তিযু্ক্ত হয়েছে তা ভেবে দেখার এখনই সময়।

সীতাকে অপহরণ করেছিল রাবণ। কুম্ভকর্ণ এর সঙ্গে জড়িত ছিল না। সে ঘুমাচ্ছিল শান্তিতে। লঙ্কা ছারখার হয়ে গেলেও তার ঘুম ভাঙেনি। যখন শেষ পর্যন্ত তাকে জাগানো হল ততদিনে সোনার লঙ্কা শ্মশান হয়ে গেছে। রাবণের পাপেই প্রাণ দিতে হল কুম্ভকর্ণকে। দেশে একের পর এক নারীনির্যাতনের ঘটনা ঘটছে আর সরকারি রক্ষকরা নাকে তেল দিয়ে কুম্ভকর্ণের মতোই সুখনিদ্রায় মগ্ন।

নারীর উপর নির্যাতনের দায় কিন্তু রাষ্ট্র কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। রাষ্ট্রের ও সরকারের আবশ্যিক কর্তব্য হল নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান। বেডরুমে অথবা রাজপথে যেখানেই হোক না কেন, নাগরিকদের নিরাপত্তা যখন বিঘ্নিত হয়, নাগরিকরা যখন দুর্বৃত্ত দ্বারা আক্রান্ত হয় তার দায় কিন্তু সরকারের উপরই বর্তায়। নাগরিকরা যেন নিরাপদে চলাচল করতে পারে তার দায়িত্ব সরকারের। ঘরে ফেরার পথে পোশাকশ্রমিক, বাসে গৃহবধূ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রী যখন ধর্ষিত হয় তখন তা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতাই প্রমাণ করে।

এদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। তারা যদি সব সময় ধর্ষণের শিকার হওয়ার ভয়ে ভীত থাকে তাহলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও যে বাধাগ্রস্ত হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে আতঙ্কিত রেখে দেশে উন্নয়ন কি সম্ভব? নারী যদি রাজধানী ঢাকার বুকেই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তাহলে সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর অবস্থা সহজেই অনুমেয়।

অনুমানের প্রয়োজন অবশ্য নেই। প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে সংবাদপত্রে প্রকাশিত ধর্ষণের ঘটনাসমূহ থেকেই। প্রমাণ মিলছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা পরিচালিত জরিপ থেকেও। কিন্তু কুম্ভকর্ণের ঘুম কি তাতে ভাঙছে?

আমরা আশা করি ভাঙবে। নইলে যে সোনার লঙ্কা ছারখার হয়ে যাবে।

শান্তা মারিয়া: সাংবাদিক।