শিক্ষাঙ্গনে শিশুর নিরাপত্তা

সীনা আক্তার
Published : 26 May 2015, 09:21 AM
Updated : 26 May 2015, 09:21 AM

অভিযোগ রাজধানীর মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি বালিকা বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী যৌননিপীড়নের শিকার হয়েছে। এ ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক চলছে। সময়ই বলে দেবে প্রকৃত ঘটনা কী এবং তা প্রকাশিত হবে নাকি পর্দার আড়ালে চাপা পড়বে।

যতটুকু জানা গেছে, অভিভাবকদের অভিযোগ ও আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে স্কুল কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত কর্মচারিদের বিরুদ্ধে এবং যৌননিপীড়ন রোধে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। এটা ইতিবাচক হলেও যথেষ্ট বলে মনে করি না। শিক্ষাঙ্গনে শিশুদের সব ধরনের আঘাত ও নিপীড়ন থেকে রক্ষায় প্রয়োজন সঠিক ব্যবস্থা এবং সকল স্কুল কর্তৃক সে ব্যবস্থা মেনে চলার বাধ্যবাধকতা। তদন্ত প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে স্কুল কর্তৃপক্ষ যৌননিপীড়নের ঘটনা অস্বীকার করলেও এক কর্মচারি কর্তৃক শিশুটির গলায় চাকু ধরার সত্যতা স্বীকার করেছেন। এমনভাবে বিষয়টি বলা হচ্ছে যেন গলায় চাকু ধরা যৌননিপীড়নের চেয়ে কম বিপজ্জনক!

নিপীড়ন অথবা গলায় চাকু ধরা, এতে একজন শিশু কতটা আতঙ্কিত হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। শিশুটির এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা শুনে মা-বাবার মনের অবস্থা কী হতে পারে তাও আমরা অনুমান করতে পারি। প্রত্যেক মা-বাবার কাছেই তাঁদের সন্তান মহামূল্যবান। শিক্ষাঙ্গনকে অভিভাবকরা শিশুদের জন্য নিরাপদ শিক্ষা পরিবেশ মনে করেন বিধায় সন্তানকে চোখের আড়াল করে বিদ্যালয়ে পাঠান। কিন্তু সেই আস্থাশীল পরিবেশে যখন কোনো শিশু যৌননিপীড়নের শিকার হয় তখন অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন ও ক্রুদ্ধ হবার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি থাকে।

যৌননিপীড়নের ঘটনা, অভিযোগ, আন্দোলন, তদন্ত– পুরো প্রক্রিয়ায় স্কুল কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে বৈকি। কারণ ৫ মে, ২০১৫ যে শিশুর ওপর যৌননিপীড়নের ঘটনাটি ঘটে, তাৎক্ষণিকভাবে তার মানসিক অবস্থা অনুধাবন করতে এবং তাকে প্রয়োজনীয় সাহায্য করতে স্কুলের কেউ তার পাশে ছিল না। ঘটনাটি জানার পর অভিভাবকরা স্কুল প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেছেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেননি। এটা ঠিক যে, এ ধরনের ঘটনা নিয়মিত ঘটে না। কিন্তু একটা ঘটনা বিচ্ছিন্ন বলে উপেক্ষা করা কখনও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ যৌননিপীড়নের ঘটনা যেখানেই ঘটুক তা আইনত শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কর্তৃপক্ষ সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিলে অর্থাৎ অপরাধীদের পুলিশে ধরিয়ে দিলে অভিভাবকদের আন্দোলন করার প্রয়োজন হত না।

অন্যদিকে, এ ধরনের কুৎসিত অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে একজন শিশুর শিক্ষা ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, ঘটনার নেতিবাচক প্রভাব তাকে বহন করতে হয় আজীবন। অপরাধীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে, অপরাধী শাস্তি না পেলে ভুক্তভোগী শিশু কী বার্তা পাবে? কোন শিক্ষা নিয়ে সে বড় হবে?

যৌননিপীড়ন বিতর্কের বাইরেও এটা স্পষ্ট যে, স্কুলটিতে শিশুদের জন্য সাধারণ নিরাপদ পরিবেশের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। স্কুলের দেওয়া তথ্য থেকেই জানা যায়, স্কুলের মধ্যে নির্মাণকাজ চলছিল এবং সেখানে বহিরাগত হিসেবে শ্রমিকদের আনাগোনা ছিল। নির্মাণ চলাকালীন শিশুরা আঘাতপ্রাপ্ত হবার সমূহ আশঙ্কা থাকে যা কর্তৃপক্ষ আমলে নেননি। অভিভাবকদের অভিযোগ, বিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোর। তার মানে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অবাধ প্রবেশাধিকার রয়েছে সেখানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বালিকা বিদ্যালয়ে এক ধরনের বহিরাগত। এছাড়া মারাত্মক বিষয় হচ্ছে শিশুর গলায় চাকু ধরা। এটা যে কারও জন্য চরম ভীতিকর একটি বিষয়।

শিক্ষাঙ্গনে শিশু যৌননির্যাতনের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগে আমরা সিদ্ধেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ের অনুরূপ ঘটনার কথা জেনেছি। অন্যান্য স্কুল, মাদ্রাসায় শিশু যৌননিপীড়নের ঘটনা মাঝে মাঝেই মিডিয়ায় সংবাদ হয়। লজ্জার বিষয় হল, প্রায় সকল ক্ষেত্রেই যৌননিপীড়ন, যৌনসহিংসতার ঘটনা আড়াল করা, ধামাচাপা দেওয়া বা ঘটনাপ্রবাহ অন্যদিকে প্রবাহিত করার কুসংস্কৃতি লক্ষণীয়। এসব ক্ষেত্রে তথাকথিত সুনাম রক্ষার কুযুক্তি দেখানো হয়। এর পাশাপাশি থাকে গুজব ছড়ানোর অভিযোগ। মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি বালিকা বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও এমনটা লক্ষ্যণীয়। এ ধরনের কূটকৌশল প্রকৃত ঘটনা আড়াল করার পরিবর্তে সন্দেহ ঘনীভূত করে।

যে কোনো ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সংবেদনশীলতা, আন্তরিকতা, ঘটনার স্বচ্ছতা এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণই কেবল অভিভাবকদের সন্দেহ দূর করতে বা গুজবে পানি দিতে পারে এবং এতেই প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত সুনাম নিশ্চিত হয়। যৌননিপীড়ন ঘটনায় উদ্ভূত পরিস্থিতি স্কুলের ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার ইঙ্গিত দেয়। কর্মচারিদের অব্যাহতি দেওয়া, স্কুল সাময়িক বন্ধ রাখা প্রকৃতপক্ষে সমস্যার স্থায়ী সমাধান দিতে পারে না। এর জন্য দরকার সঠিক পন্থায় কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ।

আলোচ্য ঘটনায় মনে হয়েছে, সরকারসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত কেউ শিশু যৌননিপীড়ন প্রতিরোধ ও প্রতিকারে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। একটা অপরাধের প্রতিকারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এত অনীহা থাকবে কেন? এতে সুনাম ক্ষুন্ন হবার জুজুর ভয়ই-বা কেন? আমি বিস্মিত যে, শিশু যৌননিপীড়নের এই দৃশ্যপটে সরকারের উল্লেখযোগ্য কোনো দায় দেখছি না। স্থানীয় শিক্ষা কর্মকর্তা অথবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কারও কোনো হস্তক্ষেপের কথা শোনা যায়নি। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয় বা অবহেলা করে সে দায় অবশ্যই শিক্ষা বিভাগের। কারণ এ ধরনের পরিস্থিতি শিক্ষা বিভাগের দায়িত্বে গাফিলতিরই ইঙ্গিত করে। তাহলে যৌননিপীড়নের ঘটনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উপেক্ষা করলে অভিভাবকরা কোথায় অভিযোগ করবেন?

২০০৯ সালে উচ্চ আদালত প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌননিপীড়ন প্রতিরোধে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই নির্দেশনা মানা হচ্ছে কি? আমার ধারণা, অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার প্রতিষ্ঠানগুলো এই নির্দেশনার বিষয়ে অবগত নয়। আমি মনে করি, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌননিপীড়ন প্রতিরোধ নীতিমালা নিশ্চিত করা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত উচ্চ আদালতের নির্দেশনার আলোকে যৌননিপীড়ন প্রতিরোধ ও প্রতিকার নীতিমালা বা সংবিধিবদ্ধ নির্দেশিকা প্রণয়ন করা এবং তা সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা। সেই সঙ্গে সংবিধিবদ্ধ নির্দেশিকা পালন করা হচ্ছে কি না সে বিষয়ে নজরদারি করা।

এই নির্দেশিকায় শিক্ষক, কর্মচারি নিয়োগের পূর্বে অপরাধ নিরীক্ষা বাধ্যতামূলক হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা অত্যাবশ্যক। যেমন, বিলাতে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও কলেজে সরকার প্রণীত Statutory guidance for schools and colleges on safeguarding children and safer recruitment মেনে চলা হয়।

শিশুরা হচ্ছে সবচেয়ে অসহায় জনগোষ্ঠী। তাই তারা নিপীড়নের ঝুঁকির মধ্যে থাকে। শিক্ষাঙ্গনগুলোতে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বাধ্যতামূলক করা এ জন্যই জরুরি। স্কুলে শিশুরা যৌননিপীড়নের শিকার হলে যাতে নির্ভয়ে শিক্ষককে বলতে পারে সে রকম শিশুবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব স্কুলের এবং তা তদারকি করবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সকল শিক্ষকের জন্য শিশুর নিরাপত্তা ও করণীয় বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা দরকার। শিশুদের নিরাপত্তা বিষয়ে তাদের প্রাথমিক ধারণা প্রদান জরুরি।

বাড়িতে শিশুকে নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন করার দায়িত্ব মা-বাবা বা অভিভাবকের। বিশেষ করে শিশুকে তার শরীর সম্পর্কে ধারণা দেওয়া এবং তার বিশেষ অঙ্গ যে নারী-পুরুষ কারও স্পর্শ করার অধিকার নেই সে বিষয়ে সচেতন করা, কেউ শরীর স্পর্শ করলে নির্ভয়ে অভিভাবককে অবগত করা ইত্যাদি তাকে শেখাতে হবে। Stranger Danger বা অচেনা মানুষ থেকে নিরাপদ দূরে থাকা, Hide & Seek বা লুকোচুরি ধরনের খেলা থেকে বিরত থাকা, স্কুলের কোনো নির্জন স্থানে না যাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে শিশুকে অবহিত করাও জরুরি।

স্কুল-অভিভাবকদের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক একজন শিশুর শিক্ষা ও মানস গঠনের জন্য জরুরি। এই আস্থার জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শিক্ষাঙ্গনে শিশুর নিরাপত্তা। প্রিপারেটরিতে যৌননিপীড়নের অভিযোগের সঠিক তদন্ত এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পদক্ষেপ নেবেন এবং ভবিষ্যতে শিক্ষাঙ্গনে শিশু যৌননিপীড়ন রোধে 'যৌননিপীড়ন প্রতিরোধ ও প্রতিকার' নীতিমালা বা সংবিধিবদ্ধ নির্দেশিকা প্রবর্তনে উদ্যোগী হবেন বলে আশা করি।

সীনা আক্তার: সমাজবিদ।