চাবুক আর চাপাতির যুগে নজরুল

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 25 May 2015, 07:45 AM
Updated : 25 May 2015, 07:45 AM

এ লেখা যখন বেরুবে তখন দেশে সাড়ম্বরে নজরুল জয়ন্তী উদযাপন চলবে। তাঁকে মনে রাখা আর ভালোবাসার কথা যতটা, ততটা না হলেও আবেগে ভাটা পড়বে না। সন্দেহ নেই, আমাদের জাতি ও রাষ্ট্রের ওপর অসামান্য প্রভাব এই কবির। তাই তাঁকে যারা পাঠ করেন বা জানেন তাদের কাছে তিনি একাধিক কারণে প্রণম্য। তবে এ লেখায় নজরুলকে নিয়ে একটু ভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণা করতে চাই।

বিদ্রোহী কবির তকমা লাগিয়ে নজরুলকে আগুনমুখী করার চেষ্টা চলছে অনেক কাল ধরে। প্রশ্ন করে দেখুন, কেন তিনি বিদ্রোহী বা কেন তাঁকে আমরা প্রথাবিরোধী ভাবছি, অনেকেই জবাব দিতে পারবেন না। এ দেশে যেটা চালু বা প্রচার পেয়ে যায় সেটাই হুজুগে সর্বজনীন হয়ে দাঁড়ায়। অথচ নজরুলের বিদ্রোহী ভাবের চেয়ে প্রেমিক বা আবেগঘন বাঙালি ইমেজ কম কিছু নয়। জীবন ও সমাজের যাবতীয় বিশৃঙ্খলা আর অনাচার চাবুক মেরে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কত কবিতা আর গানে যে সে চাবুক-মারা শেকল-ভাঙার কথা রয়েছে! সন্দেহ নেই, অনেক অনুষ্ঠানেই আমাদের প্রিয় নাচ নজরুলের এই গানের সঙ্গে, 'শিকল-পরা ছল, মোদের এই শিকল-পরা ছল, এই শিকল পরে শিকল তোদের করবে রে বিকল'– যে যখন গদিতে তখন তার শিকল ভাঙার জন্যই এ গানের ব্যবহার। অথচ কেমন করে যেন নতুন নতুন শেকলেই বাঁধা পড়ি আমরা! বুঝতে পেরেছি কি নিজেরাও?

নজরুলের জন্য মায়াকান্নার মানুষরাই এখন সমাজপতি। সিলেটে তারা মুক্তবুদ্ধির মানুষকে চাবকাতে চায়। আবার সে পূণ্যভূমিতেই রক্তেভাসা অনুজ জানায় স্বপ্নের কোনো মৃ্ত্যু নেই। এ কেমন দেশ? এ কেমনতর সমাজ? কাজী নজরুল এবং তাঁর প্রতি যে আগ্রহ ও উন্মাদনা, এর একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা থেকেই বোঝা যাবে কেন এসব ঘটে।

আগেই বলেছি, কোনো কোনো কবি কাব্য বা শিল্পের বাইরে ও সমান দীপ্র। এঁদের প্রভাব এত বেশি যে, সমাজে রাজনীতিবিদ বা অন্যান্য পেশার মানুষরাও এদের কাছে হার মানেন। নজরুল বিদ্রোহের নামে আমাদের যে অপধারা, অধর্ম, অপশাসন বা ব্যবস্থা ছিল তাতে আঘাত করতেন। তাই সেটা অনুপ্রেরণার। চাইলেই সবাই তা পারেন না। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও আমরা দেখেছি 'বিষাইছে বায়ু নিভাইছে তব আলো' বলে রোদন করেছেন। 'এ দুর্ভাগা দেশ হতে হে মঙ্গলময় দূর করে দাও তুমি সর্বতুচ্ছ ভয়' বলে প্রার্থনা করেছেন। কিন্তু নজরুল ছিলেন বলিষ্ঠ। তাঁর আকুতি প্রেমের জন্য ছিল, সমাজের জন্য ছিল না, সেখানে তিনি ভিন্ন– এ সমাজ ভেঙে নতুন এক অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতির জন্য লড়াইপ্রত্যাশী এক দ্রোহী।

আশ্চর্যজনকভাবে সে তিনিই এখন মৌলবাদী ও জাতীয়তাবাদীদের কথিত হাতিয়ার। যাদের জীবনে সব আদর্শ আর জীবনবোধ মূলত নজরুলবিরোধী, তাদের কাছে তিনি কখনও নিরাপদ নন। তাঁকে ঘিরে প্রথম যে রাজনৈতিক মাতম দেখি তার উদগাতা স্বয়ং জিয়াউর রহমান। আজকের তরুণ-তরুণীরা জানে না প্রয়াত জিয়ার আমলে একটি পোস্টারে দেশ ছেয়ে গিয়েছিল। জাতীয়তাবাদীরা এই পোস্টার দিয়ে দেশ ভরিয়ে এটাই প্রচার করতে চেয়েছিলেন যে, জিয়াই হচ্ছেন 'তখনকার নজরুল'। এই ঔদ্ধত্য সীমা ছাড়ায় পোস্টারটির ভাষায়। ছবিতে স্যান্ডো গেঞ্জি ও কাউবয় হ্যাট আর সালমান খান জাতীয় রোদচশমা-পরা জিয়াউর রহমানের বুকে ছোট আকারের নজরুল। তাতে লেখা, 'আমি যুগে যুগে আসিয়াছি হেথা মহাবিপ্লব হেতু'। সে বিপ্লব আর বৈপ্লবিক কাজগুলো যে কী তা এখন আর বলে বোঝাতে হয় না।

যে পাকিস্তানি ভাবধারায় নজরুল 'কাফের', তাঁর কবিতার চরণ 'সজীব করিব মহাশশ্মান' হয়ে যায় 'গোরস্থান'– সে ভাবধারার প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান হতে চাইলেন নজরুলের উত্তরাধিকারী। যে সব বুদ্ধিজীবী টক শো আর মিডিয়ায় জাতীয়তাবাদের লেজুড় বা তাদের জন্য মায়াকান্নায় ব্যস্ত, তাদের উন্মুক্ত চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলি, প্রমাণ করে দেখানো যাবে সে সময় থেকে ছাত্রদল আর নজরুলশক্তির অবমাননার শুরু।

বাংলাদেশে উগ্র জাতীয়তাবাদ যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িকতা আর সন্ত্রাসের কারণ হতে পারে, সে বিষয়ে নজরুল স্বয়ং সন্দেহ জানিয়ে সাবধান করে দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর লেখা বা জীবনাদর্শের একেবারে বিপরীত মেরুতে দাঁড়ানো বাংলাদেশি জেনারেলরা কোনো এক কারণে সৈনিক নজরুলকে তাদের আপনজন মনে করে অনর্থ বাধাতে ছাড়েননি।

এটাও আমাদের জাতীয় চরিত্রের এক ভয়াবহ দিক। সম্পূর্ণ কিছু জানা বা আত্মস্থ করার পরিবর্তে খাবলে খাবলে যা দরকার তা তুলে নেওয়া। কথায় বলে, অর্ধসত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়াবহ। জেনারেলরা ভাবলেন, সৈনিক নজরুল মানেই তাদের পূর্বসূরী। এভাবে নিজেদের নজরুলের সমগোত্রীয় করার হাস্যকর চেষ্টা এরশাদ আমলেও ছিল প্রবহমান। কামানের আগায় বসে বাঁশের বাঁশরী বাজানো ঘনশ্যাম ঝাঁকড়া চুলের কাজী কবিকে তারা এভাবেই ভুল ব্যাখ্যায় নিয়ে আমাদের সর্বনাশে মেতে উঠেছিলেন। একবারও ভাবেননি নজরুল জেনারেল হতে চাননি। তিনি জেনারেল পাবলিকের জন্যে আগ্রাসী যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে সৈনিকের মহান পেশাটি কিছুদিনের জন্য আপন করে নিয়েছিলেন। সেই মহান কবিকে এরা রাজনীতির ঘোলাজলে নামিয়ে এ দেশ ও কাব্যকলার পাশাপাশি রাজনীতির লোকসানের দিকটি ভারি করে বিদায় নিলেও তার জের থামেনি।

কোনো দেশ বা জাতি যদি শান্তিতে না থাকে, কী করে মাথা তুলে বাঁচবে সে জাতি? এভাবেই যদি সময় পার হয়, নজরুল কোনোদিনও তাঁর আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হতে পারবেন না। পারবেন না প্রেরণা বা ভরসা হতেও। একদিকে দম্ভ অহংকার আর 'আমাদের আমাদের' বলে তাঁকে আগলে রাখা, সীমাবদ্ধ করে তোলা– অন্যদিকে যথেচ্ছ আদর্শহীন কপট ব্যবহার। নজরুলের মতো আপোসহীন সংগ্রামী আর বালক কিশোর প্রেমিক বাউণ্ডুলে নমস্যকে আমরা যেন রাজনীতি ধেকে দূরে রাখতে পারি। তিনি রাজনীতিসচেতনও ছিলেন বটে, তবে সে জায়গা একেবারে অধরা। দেশ ও জাতির জীবনে তাঁর চিন্তা আর অসাম্প্রদায়িক চেতনার ব্যবহারের বিকল্প নেই। নজরুলের লেখায় যে মিলনকামনা, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে যে জেহাদ আর আকুতি, তার মর্মবাণী সরিয়ে তাঁকে দল বা সময়পোযোগী করার নিন্দনীয় দিকটি রুখতে হবে। মনে রাখা দরকার, তাঁর লেখা ও আদর্শ এ যুগের চাপাতির ওপর আরও বেশি খড়গহস্ত হত।

চাপাতি ও চাবুক উভয় অর্থে আমাদের সহায় আর ভরসা নজরুলকে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি। এ দেশ ও জাতির জন্যে তাঁর সঠিক মূল্যায়নই আজ বড় প্রয়োজন।