রবীন্দ্রনাথের তিন জন্মদিন

চঞ্চল আশরাফ
Published : 25 March 2010, 04:20 PM
Updated : 8 May 2011, 01:26 PM

দু'রকম বাংলা পঞ্জিকার কারণে রবীন্দ্রনাথের দেড় শ'তম জন্মবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে তিনটি ভিন্ন তারিখে : গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৭ মে এবং বাংলাদেশের বাংলা ও আদি পঞ্জিকার দু'টি ২৫ শে বৈশাখ ৮ ও ৯ মে। বেশ আগে থেকে এমনটি ঘটছে। পয়লা বৈশাখ বাংলাদেশে ১৪ এপ্রিল আর পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা সহ ভারতের অন্যান্য বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে তা ১৫ এপ্রিলে পালন করা হচ্ছে। বাংলাদেশে সরকারিভাবে ১৪০২ সালের আগে পর্যন্ত বাঙালির সর্বত্র পয়লা বৈশাখ পালন করা হতো একই দিন-তারিখে। কিন্তু ঘটনাটির সূত্রপাত আরও আগে, ১৯৬৬ সালে। কী সমস্যা তখন প্রচলিত বাংলা পঞ্জিকায় দেখা গেল যে, সেই বছর ড.  মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে প্রচলিত পঞ্জিকার বিপরীতে আরেকটি পঞ্জিকা তৈরি করে তা চালুর উদ্যোগ বাংলা একাডেমীকে নিতে হলো!

আ. জা. ম. তকীয়ূল্লাহ জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা বর্ষপঞ্জি খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সমন্বিত নয়। অন্যদিকে বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি 'বিভিন্ন বাংলা মাস ও ঋতুতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ সাংস্কৃতিক জীবনে কিছু সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা নির্ণয় করে সেগুলো হতে উত্তরণের' উদ্দেশ্যে 'সংশোধিত' নতুন বাংলা সন প্রবর্তনের প্রস্তাব দেয়। সরকারিভাবে এই সন চালু হলে তকীয়ূল্লাহ নতুন বর্ষপঞ্জি প্রকাশের ফলে পশ্চিমবঙ্গে প্রকাশিত বাংলা বর্ষপঞ্জির সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেলার শঙ্কাটি এড়িয়ে যেতে পারেননি এবং তা নিরসনের জন্যে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে 'প্রতিষঙ্গী' খ্রিস্টীয় তারিখগুলোর মুদ্রণ 'অত্যাবশ্যকীয়' বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গে প্রকাশিত বাংলা বর্ষপঞ্জি থেকে বাংলা পঞ্জিকাকে আলাদা করে চেনার একটা উপায় হিসেবে একে গণ্য করেছেন।

প্রশ্ন জাগে, এত দিন খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সমন্বয় ছাড়াই যে বাংলা বছরগুলো চলছিল, তাতে কী সমস্যা দেখা দিল? আর খ্রিস্টীয় বছরের দিনগুলোর হিসাব তো হয় ঘড়ি ধরে, যেখানে বাংলা বছরের দিনগুলো হয় সূর্যোদয়ে। আকবরের সময় হিজরির চাঁদের হিসাবে যখন কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা পেতে সমস্যা হচ্ছিল, তখন রাজস্ব আদায়ের স্বার্থেই একটা 'ফসলি' সনের দরকার পড়েছিল। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যদি নতুন বাংলা সনের প্রবর্তন করে আকবরের উত্তরসূরি হতে চান, কারও আপত্তি থাকার কথা নয়; কিন্তু তাতে কি বাংলা সন স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ কিছু হয়েছে? বরং তা জড়িয়ে গেছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সঙ্গে এবং বাংলা দিন-তারিখ নিয়ে একটা উৎপাত শুরু হয়েছে। কোনও জাতির বর্ষপঞ্জির অন্য কোনও ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সমন্বিত হওয়া বাধ্যতামূলক ও জরুরি নয়। যদি তা হয়, বুঝতে হবে, জিনিসটিতে গণ্ডগোল আছে অথবা 'সমন্বয়কামী'দের কোনও সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। ১৯৬৬ সালে খাজনা আদায়ে কি অসুবিধা হচ্ছিল? 'গ্রামীণ' মানুষের যে-'সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা' নির্ণয় তখন করা হয়েছিল, তা থেকে 'উত্তরণ' নতুন বাংলা সনের দিন গণনার এক দিনের হেরফেরে সম্ভব কি? যদি সম্ভব হয়ে থাকে, বাংলাদেশের বিপুল-অধিকাংশ গ্রামাঞ্চলের মানুষ আগের সেই তারিখে, অর্থাৎ ১৫ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালন করে কেন? ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখ পালন করে তো হাল ফ্যাশনের ফতুয়া-পাঞ্জাবি-পরা শহুরে এলিট শ্রেণী ও মধ্যবিত্তরা; তারা রমনা বটমূল সহ সেদিনের নানা 'ফেস্টিভ স্পটে' যায়, পান্তা-ইলিশ খাওয়ার জন্যে, বাঙালিত্ব জাহির করার জন্যে! আসলে এই বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রচলন আর কিছু নয়, বিপুল গ্রামীণ বাঙালির ওপর শহুরে এলিট ও মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক প্রভুত্ব কায়েমের একটা চক্রান্ত। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এতে রয়েছে বেশ আগে, ১৯৬৬ সাল থেকেই, ভারতীয় বাঙালি ও পাকিস্তানি বাঙালির মধ্যে একাট দেয়াল তুলে দেয়ার জন্যে। পরবর্তীকালে এটি কথিত 'বাংলাদেশী' জাতীয়তাবাদের প্রেরণা ও সহায়ক হয়েছে। এই তরঙ্গ উইকিপিডিয়ায়ও আছড়ে পড়েছে; তাতে রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তায় 'ইন্ডিয়ান' উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু যে কেউ এটা জানে এবং বোঝে যে, পৃথিবীতে 'ভারতীয়' বলে কোনও জাতি নেই, আছে নাগরিক; যেমন নেই 'বাংলাদেশী' নামের কোনও জাতি। তেমনি থাকতে পারে না বাংলাদেশি বাংলা বর্ষপঞ্জি এবং তা থাকা ঠিক নয়। আর পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক জনই আছেন এবং তাঁর পক্ষে একাধিক দিন-তারিখে জন্মগ্রহণ করা সম্ভব নয়। সেই দিনগুলো পালন তো পরের কথা।

তকীয়ূল্লাহ বলেছেন, 'বাংলা সন ১৪০২ থেকে বাংলাদেশ সরকার প্রবর্তিত যে বর্ষপঞ্জি বাংলাদেশে চালু আছে তা মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ সংস্কৃত নতুন নিয়মের 'শহীদুল্লাহ বর্ষপঞ্জি'। প্রশ্ন হলো, এটি চালু করার আগে অন্যান্য ভূখণ্ডের বাঙালি জনসমাজে একে গ্রহণযোগ্য করে তোলার প্রাতিষ্ঠানিক কোনও উদ্যোগ বাংলাদেশ সরকার নিয়েছিল কি-না; নিয়ে থাকলে এবং তা ব্যর্থ হলে কেবল বাংলাদেশে 'সংশোধিত' পঞ্জিকা প্রচলনের দরকার ছিল কি-না; না-কি সরকারের এই বোধই ছিল না যে, একটি জাতির দু'টি পঞ্জিকা থাকতে নেই, সেই জাতির মানুষ নানা দেশে বসবাস করলেও। যদি এমনটি ঘটে যায়, তবে সেই জনসমাজে বিভক্তি তৈরি হয়, একটা সাংস্কৃতিক অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং তা যুগ-যুগ ধরে চলতে থাকে। এই পরিবেশ সৃষ্টির অধিকার কারোরই নেই।

দেড় শ'তম রবীন্দ্রজন্মোৎসবে এই বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে। এত যে, কোনও কোনও অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্রে তারিখের জায়গায় মুদ্রিত হয়েছে '২৫ শে বৈশাখ ২০১১'! বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনধারা ইত্যাদি নিয়ে মোটামুটি হাস্যকর ও বেদনাদায়ক একটা তামাশা চলছে এখন। কিন্তু এই অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় কী?

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাঙালি যা করছে, তা বুদ্ধি ও সংযমের সীমা ছাড়িয়ে চলেছে। শেক্সপিয়রকে নিয়েও ইংরেজরা এত দিশেহারা হয় না। রবীন্দ্রনাথের হস্তরেখা, থুতনি, বসার ভঙ্গি ইত্যাদি সম্পর্কেও গবেষণা হচ্ছে এবং প্রণীত হচ্ছে পুস্তক। আবেগপ্রবণ বাঙালির এই আতিশয্যে 'শহীদুল্লাহ বর্ষপঞ্জি' যোগ হয়ে বাঙলার সাংস্কৃতিক পরিবেশকে বেশ জমজমাট করে তুলেছে। কিন্তু এটা উপাদেয় হলেও স্বাস্থ্যকর নয়।

রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন একটাই হওয়া উচিত। বিশ্বের জন্যে ৭ মে আর বাঙালির জন্যে ২৫ শে বৈশাখ। তার আগে সব বাঙালির কাছে গ্রহণযোগ্য একটি অভিন্ন বর্ষপঞ্জি চাই, যা খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সমন্বয়ের টেনশন থেকে মুক্ত। তা একান্তই বাঙালির সৌর বছরের পঞ্জিকা, চাঁদ কিংবা ঘড়ির সঙ্গে মিলিয়ে নেয়ার ভাবনা এতে যেন ব্যাঘাত না ঘটায়। সেই পঞ্জিকা মেনে ২৫ শে বৈশাখ বাঙালির সূর্যোদয়ের সঙ্গে-সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জন্মবর্ষ শুরু কিংবা শেষ হবে।

চঞ্চল আশরাফ : কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও সমালোচক।