অনন্ত, আমরা চুপ থাকব না

মো. আনোয়ার হোসেনমো. আনোয়ার হোসেন
Published : 17 May 2015, 12:32 PM
Updated : 17 May 2015, 12:32 PM

প্রকৃতিজগতের বিবর্তনবাদী ব্যাখ্যা বিজ্ঞানসম্মতভাবে হাজির করে চার্লস ডারউইন চিন্তার জগতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন, তারই সার্থক উত্তরসূরী ফ্রান্সিসকো জোসে আয়ালা। বলা হয়, বিবর্তনবাদী প্রাণবিজ্ঞানে রেনেসাঁর জন্ম দিয়েছেন তিনি। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই প্রাক্তন ছাত্র, অনন্ত বিজয় দাশ ও সিদ্ধার্থ ধর আয়ালার একটি বইয়ের বাংলা অনুবাদ করে। অনন্ত সমাজকর্ম বিভাগ থেকে মাস্টার্স করার পর সিলেটের একটি স্থানীয় ব্যাংকে কর্মজীবন শুরু করেছিল। বিজ্ঞানের ছাত্র সে নয়। কিন্তু বিবর্তনবাদী প্রাণবিজ্ঞানের জটিল বিষয়াদি অধ্যয়নই শুধু সে করেনি, ইংরেজি থেকে বাংলায় তা অনুবাদ করেছে সিদ্ধার্থের সঙ্গে মিলে। 'জীববিবর্তন সাধারণ পাঠ' বইটি পাঠক সমাদর পেয়েছিল।

ব্লগার রাসেল আল মাসুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে লিখেছে: ''সাস্ট ক্যাম্পাসে আয়োজিত বইমেলায় সবার আগে 'জীববিবর্তন সাধারণ পাঠ' বইটির সবগুলো কপি শেষ হয়ে যায়। এটাকে একটি শুভ বার্তা হিসেবেই সে দেখেছিল। বলেছে, 'বুঝলাম, আমার আশপাশের মানুষজন চিন্তাশীলতার দিকে ঝুঁকছে, বিজ্ঞানমনস্কতার দিকে ঝুঁকছে।'"

তারপর একেবারে দিনের আলোয় চাপাতির কোপে অনন্ত নিহত হবার পর রাসেল লিখেছে: "এটাও একটা ম্যাসেজ। আপনি চুপ থাকুন। আপনি যদি মুখ খোলেন, যদি চিন্তার কথা বলেন, বিজ্ঞানের কথা বলেন, মৌলবাদ আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বলেন, তবে আপনাকেও এই পরিণতি বহন করতে হবে। … যদি বাঁচতে চান, চুপ থাকুন। দরকার হলে নিজের টুঁটি নিজেই চেপে ধরে চুপ থাকুন। এই দেশে কোনো কথা বলা প্রাণির স্থান নেই।"

রাসেলের লেখার শুরুতে একটা ছবি আছে। প্রথম চিনতে পারিনি। শান্ত-সমাহিত এক তরুণ ঘুমিয়ে আছে। তার মুখটি শুধু খোলা। নিমীলিত চোখের উপর দুটো সবুজ পাতা। প্রকৃতির প্রতীক সবুজ পত্রাবলী। এ ধরিত্রীতে প্রাণ সৃষ্টির আগে সূর্যের আলো-তাপ শুধুই হারিয়ে যেত শূন্যতায়। বাড়াত এনট্রপি বা বিশৃঙ্খলা। সালোক-সংশ্লেষী উদ্ভিদ ও কিছু এককোষী প্রজাতি সূর্য আলোর সামান্য কিছু শক্তি হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করল। শৃঙ্খলা আনল এই পৃথিবীতে। সে জন্যেই মহাবিশ্বের এই গ্রহে প্রাণময়তা।

মাতা ধরিত্রীর সে সব শৃঙ্খলা জানতে চেয়েছিল অনন্ত বিজয় দাশ। তাই সমাজকর্ম পড়েও প্রকৃতিবিজ্ঞানের গভীরে সে প্রবেশ করেছিল। মানুষ মানুষকে কেন মেরে ফেলে? কেন প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধাচরণ করে প্রবুদ্ধ মানুষ? ধর্মের নামে সারা দুনিয়া জুড়ে কেন এত হত্যাকাণ্ড? কাফের আখ্যা মাথায় নিয়ে কেন ইবনে সিনাকে দেশান্তরী হতে হয়? আবার ভিন্ন সময়ে সেই ইবনে সিনাকে মহিমান্বিত করে ধর্মব্যবসায়ীরা। তাঁর নামে বানায় ইবনে সিনা ট্রাস্ট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সে সব কথা জানতে চেয়েছে, জানাতে চেয়েছে অনন্ত।

অনন্তকে চুপ করে থাকতে বলেছে সমাজ। 'অদ্ভুত আঁধারে' যে সব অন্ধ সবচেয়ে বেশি দেখে, তারা চুপ করে থাকতে বলেছে, মৃত্যুভয় দেখিয়েছে। অনন্ত চুপ থাকেনি। যেমন থাকেননি তার পূর্বসূরী হুমায়ুন আজাদ, রাজীব, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর বাবুর মতো অনেকেই। ঘাতকের চাপাতির আঘাতে তাই অনন্তের নিহত হওয়া। প্রকৃতির যে সবুজ থেকে অনন্তের আগমন, বন্ধ চোখের উপর সেই সবুজ পত্র ধারণ করে অনন্ত ফিরে যাচ্ছে প্রকৃতির অনন্তলোকে। যখন যাবার সময় হয়নি। বড় অসময়ে।

গুরুতর প্রশ্ন হচ্ছে এ সব মৃত্যুর কারণ কি শুধুমাত্র মৌলবাদী জঙ্গিদের চাপাতি? আর কারও কি দায় নেই? রাষ্ট্রের, রাজনীতিবিদের, সরকারপ্রধান বা ভবিষ্যৎ সরকারপ্রধানদের, এমনকি নাগরিক সমাজের?

এখন থেকে পঞ্চাশ বছর আগের সমাজটি কেমন ছিল? ফার্মগেটের কাছে একটি বাড়ির নাম মনে পড়ল। 'সংশয়' নামের এ বাড়ির মালিক সাইদুর রহমান আস্তিক নন। তাঁর সম্পর্কে নানা কথা শুনি। জগন্নাথ কলেজের এই আলোকিত অধ্যক্ষকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বললেন কলেজ ক্যাম্পাসে একটা মসজিদ বানাতে। উত্তরে সাইদুর রহমান বিনয়ের সঙ্গে জানালেন: ''যে পূণ্যবানেরা এই শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাঁরা তো এখানে মন্দির বানাননি। আমি তাদের দান করা এই জায়গাতে মসজিদ বানাতে পারব না।''

ইসলাম ধর্মে যার গভীর নিষ্ঠা, সেই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানের যুক্তি এক বাক্যে মেনে নিলেন। 'সংশয়' নামের বাড়িতে কখনও ঢিল পড়েনি, কেউ কালির পোঁচে ঢেকে দেয়নি নামফলকটি। ড. আহমেদ শরীফও আস্তিক ছিলেন না। ধর্ম তাঁর ছিল। তা মানবধর্ম। তার জন্য তাঁর প্রাতঃভ্রমণে কেউ বিঘ্ন ঘটায়নি। জীবননাশ তো নয়ই।

ড. অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে 'নিঃশব্দতার চাপাতি ও জীবন বাঁচাতে জীবন' শীর্ষক আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল ১০ মার্চ, ২০১৫ তারিখে। পরাধীন বাংলাদেশে ধর্মীয় গোঁড়ামি বিষয়ে সাধারণ মানুষ এবং বঙ্গবন্ধুর ভাব-মানসটি বোঝাতে সে প্রবন্ধের কিছু অংশ উল্লেখ করছি:

'৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের কথা বলছেন বঙ্গবন্ধু। গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের প্রার্থী ওয়াহিদুজ্জামান। বহু অর্থের মালিক তিনি। বঙ্গবন্ধু বলছেন, "বেশি টাকা খরচ করার সামর্থ্য আমার ছিল না।"

নিতান্ত গরিব জনসাধারণ ও ছাত্র ও যুবক কর্মীরা নিজেদের টাকা খরচ করে বঙ্গবন্ধুর জন্য কাজ শুরু করে।

"কয়েকটি সভায় বক্তৃতা করে বুঝতে পারলাম, ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করবেন। … জামান সাহেব ও মুসলিম লীগ যখন দেখতে পারলেন তাদের অবস্থা ভালো নয়, তখন এক দাবার ঘুঁটি চাললেন। অনেক বড় বড় আলেম, পীর ও মওলানা সাহেবদের হাজির করলেন। … 'আমাকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না, ধর্ম শেষ হয়ে যাবে।' শর্ষীনার পীর সাহেব, বরগুনার পীর সাহেব, শিবপুরের পীর সাহেব, রহমতপুরের শাহ সাহেব সকলেই আমার বিরুদ্ধে যত রকম ফতোয়া দেওয়া যায় তা দিতে কৃপণতা করলেন না।"

বঙ্গবন্ধু আরও জানান কীভাবে সরকারি প্রশাসন ও পুলিশ খোলাখুলি মুসলিম লীগ প্রার্থীর জন্য কাজ করেছিল। তারপরও ওয়াহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে ১০ হাজার ভোটের ব্যবধানে বঙ্গবন্ধু জয়ী হয়েছিলেন। নির্বাচনে পুরো পূর্ব পাকিস্তানের চিত্র ছিল একই। এ থেকে বঙ্গবন্ধু যে গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক শিক্ষাটি পেয়েছিলেন তা তিনি বিবৃত করেছেন এভাবে:

"এই নির্বাচনে একটা জিনিস লক্ষ্য করা গেছে যে, জনগণকে 'ইসলাম ও মুসলমানের নামে' স্লোগান দিয়ে ধোঁকা দেওয়া যায় না। ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমানরা তাদের ধর্মকে ভালবাসে; কিন্তু ধর্মের নামে ধোঁকা দিয়ে রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি করতে তারা দিবে না, এ ধারণা অনেকের হয়েছিল। জনসাধারণ চায় শোষণহীন সমাজ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি।"

[অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ২৫৫-২৫৮]

'৫৪ সালের এই অভিজ্ঞতার আরও উজ্জ্বল নিদর্শন '৭০এর নির্বাচন ও '৭১এর মুক্তিযুদ্ধ। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানের সেই সব গৌরবময় অতীত কী নির্দ্বিধায় আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক নেতারা ভুলে বসেছেন! বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কি ভুলে গেছেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ইসলামের নামে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দালালদের গণহত্যার বিরুদ্ধে জাতির পিতার আহ্বানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে সামিল হয়েছিল; বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতে তাঁর নামটি জপ করেই জীবন দিয়েছিল অকাতরে এবং স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল? 'আমরা সবাই এদেশের সন্তান', এই বিশ্বাসে একত্র হয়েছিল হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আদিবাসীরা। তারই ফসল আমাদের সংবিধান যাতে চার মৌলনীতির একটি ধর্মনিরপেক্ষতা।

কী দুর্ভাগ্য আমাদের! যেখানে মাত্র দুবছর আগে এদেশের নতুন প্রজন্ম জামায়াত-হেফাজত-বিএনপির ধর্মীয় উস্কানির বিরুদ্ধে সৃষ্টি করল জাতীয় পুর্নজাগরণের, যার ফলে টিকে থাকল শেখ হাসিনার সরকার, সেই দেশের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারী জাতির পিতার দৌহিত্র নতুন প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক সজীব ওয়াজেদ জয় রয়টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ কী কথা বললেন? উগ্রবাদী ধর্মীয় জঙ্গি যারা তাদের লিস্ট অনুযায়ী এক এক করে হত্যা করছে মুক্তমনা মানুষদের, তাদের তিনি তুষ্ট করতে বক্তব্য রাখলেন? কী ভেবেছেন তিনি? তার এই আপোসে এরা চাপাতি উঠিয়ে রাখবে?

তা যে নয়, তার প্রমাণ পেতে তো দুদিনের বেশি সময় গেল না। নিহত হল অনন্ত বিজয় দাশ। নতুন প্রজন্মকে কী উত্তর দেবেন জয়? কী উত্তর দেবেন যখন তাঁর দলের নবনির্বাচিত মেয়র হেফাজতের শফি হুজুরের কাছে দোয়া চাইতে যান? জয় কি ভুলে যাচ্ছেন, হেফাজতে ইসলাম হচ্ছে সেই সংগঠন যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে ৮৪ জন মুক্তমনা ব্লগারের তালিকা পেশ করেছিল তাদের শাস্তি দাবি করে? সে তালিকা ধরেই তো এক এক করে হত্যাকাণ্ড। আর হত্যাকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মানববন্ধনের ছবি দেখেছি। অধ্যাপক জাফর ইকবাল, তাঁর স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমিন হকসহ তিন শিক্ষক এবং তাদের সঙ্গে অল্প কিছুসংখ্যক ছাত্রছাত্রী। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র অনন্ত বিজয় দাশের করুণ মৃত্যুর বিরুদ্ধে এই মানববন্ধন। ইসলামি জঙ্গিদের হাতে নিহত হওয়ার আগে অনন্ত লিখেছিল অধ্যাপক জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে সংসদ সদস্য মাহমুদ-উস-সামাদ কয়েস চৌধুরীর শিষ্টাচারবিবর্জিত ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে। শুনেছি এই ব্যক্তিটি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার মনোনীত সিন্ডিকেট সদস্য। মুক্তিযুদ্ধকালে নূরপুর গ্রামের আলবদর সদস্য যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী ফিরুর পুত্র আওয়ামী লীগের সিলেট ৩ আসনের এই সংসদ সদস্য সিলেট শহরের কোর্ট পয়েন্টে 'সিলেটবিদ্বেষী' অধ্যাপক জাফর ইকবালকে চাবুকপেটা করার মহৎ ইচ্ছা প্রকাশ করেন, আর বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া আওয়ামী লীগের একজন নেতাকেও পাওয়া যায় না তার প্রতিবাদ করতে!

সিলেটের আবদুল মাল আবদুল মুহিতও নিরুত্তর থাকেন। নিশ্চুপ থাকেন সিলেটের আলোকিত মান্যজনেরা। প্রতিবাদ করে কথা বলতে হয় অনন্ত বিজয় দাশকে। তার দুদিনের মাথায় খুন হন তিনি। আগের হত্যাগুলো থেকে এটা অনেকটাই নিশ্চিত যে, জামায়াত জঙ্গিরাই অনন্তকে হত্যা করেছে তাদের লিস্ট ধরে। তারপরও এই হত্যাকাণ্ডে ওই সংসদ সদস্য মাহমুদ-উস-সামাদ কয়েস চৌধুরীর কি কোনো দায় নেই? আওয়ামী লীগ কি দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেবে না এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে?

অধ্যাপক জাফর ইকবাল, ২০০৭ সালে যখন আমি ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে জেলখানায় আটক, আপনি কলম ধরেছিলেন। আমি ও আমার পরিবার কৃতজ্ঞচিত্তে তা স্মরণ করি। আপনাকে যেভাবে হেয়-অপদস্থ করা হচ্ছে, তাতে লজ্জায় আমাদের মাথা হেট হয়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ ভুলে গিয়েছে এই অল্প কিছুদিন আগে বেগম খালেদা জিয়ার তিন মাসের অবরোধ-হরতাল-পেট্রোল বোমায় মানুষ পুড়িয়ে মারার বিরুদ্ধে আপনার কলম কত তীক্ষ্ণ হয়েছিল।

রয়টারকে দেওয়া জয়ের সাক্ষাৎকারের পর হাতেগোনা অল্প কয়েকজন মানুষ ছাড়া কেমন নিশ্চুপ হয়ে গেছে বাকি সকলে। 'নুরলদিনের সারাজীবন' কাব্যনাট্যের অমর রচয়িতা সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক সহস্র নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক। তাঁর কণ্ঠও নিশ্চুপ। কিন্তু এই সময়ে, এই দুঃসময়ে 'জাগো বাহে, কোনঠে সবাই' শুনতে চেয়েছে সবাই আপনার কণ্ঠে। এই কিছুদিন আগে সিলেটে সাংবাদিক আহমেদ নূর রচিত 'ওয়ান-ইলেভেন: কারারুদ্ধ দিনগুলো' পুস্তকের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সৈয়দ শামসুল হকসহ বহু আলোকিতজন সে অনুষ্ঠানে ছিলেন। শ্রদ্ধেয় সৈয়দ শামসুল হক, অনন্ত বিজয় দাশের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ করুন। নতুন প্রজন্মের সবচেয়ে অগ্রসর চিন্তার অধিকারী অংশের পাশে দাঁড়ান। সিলেটের আহমেদ নূর, আপনার শহরের আলোকিত মানুষদের নিয়ে একটি প্রতিবাদী অনুষ্ঠানের আয়োজন করুন। আমরা আপনাদের পাশে দাঁড়াব।

বাংলাদেশ এবং যথার্থ অর্থেই তার কাণ্ডারি শেখ হাসিনার বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। অন্যদিকে, বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে থাকবে কিনা তাই গুরুতর প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির হাত থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে একটি সম্ভাবনার দেশে পরিণত করার সংগ্রামে আমাদের যে ভরসা শেখ হাসিনা তা শুধু তাঁর দল আওয়ামী লীগ নয়, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে খাওয়া মানুষ বিশ্বাস করে। তাই আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতের লাগাতার ধ্বংসাত্মক অপতৎপরতায় তারা অংশ নেয় না। বরং তা অকার্যকর করে দেয়।

শত প্রতিকূলতার মুখেও তাই বাংলাদেশ বহু ক্ষেত্রে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। একচল্লিশ বছর পর মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি, যাকে বিএনপি গোলামির চুক্তি বলে এসেছে এতদিন, তার অন্যতম ধারা ছিটমহল মহল বিনিময় ভারতীয় পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। এর আগে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের ফলে বঙ্গোপসাগরের বিশাল সম্পদ কাজে লাগানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের ঋণের উপর নির্ভর না করে নিজস্ব উদ্যোগে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ করায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা বেড়েছে।

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মাথাপিছু আয়ের তাৎপর্যপূর্ণ বৃদ্ধি, সামাজিক নানা সূচকে পৃথিবীর বহু দেশকে পেছনে ফেলা, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করার বাস্তব সম্ভাবনা, মধ্যপ্রাচ্যে বিপুল শ্রমবাজার উন্মুক্ত হওয়া– এ সব কারণে অনেকেরই সুচিন্তিত ধারণা, বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক শক্তির এমন সুসময় আগে আর কখনও আসেনি।

এমন সবল অবস্থানে থেকে দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার শেকড় শক্ত মাটিতে প্রোথিত করার সুবর্ণ সুযোগ কেন হেলায় হারাবেন জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা ও তাঁর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়? এ কথা তো তাদের জানা যে জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে সকল মানুষের শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ বসবাসস্থল হিসেবেই সোনার বাংলার কল্পনা করেছেন জাতির জনক। তাঁর সেই স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জেগে ওঠা নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন। এখন শুধু প্রয়োজন সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া। সে কাজ তাঁরা করতে পারবেন, যেমনটি তাঁদের পূর্বসূরীরা করেছিলেন ১৯৫৫ সালে দলের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়ে?

তার জন্য প্রধানত রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ করণীয় আছে। সঙ্গে অবশ্যই প্রকৃত সুশীল সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। অতীতে দেশের দুঃসময়ে কি আমরা এগিয়ে আসিনি? সে জন্যই দেশ প্রতিকূল অবস্থা থেকে রক্ষা পেয়েছিল। এক এগারোর পরের কঠিন সময়ে কারাগারে থেকেও সিএমএম কোর্টে আমার জবানবন্দির কথা আমি স্মরণ করি। সে সময় কাণ্ডারীর ভূমিকায় থাকা শেখ হাসিনাকে অবিচল রাখতে, আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাহস জোগাতে সে জবানবন্দি ছোট হলেও ভূমিকা রেখেছিল।

আজ শেখ হাসিনা সরকারের সুসময়ে যখন মুক্তবুদ্ধির চর্চা চাপাতির নিচে, যখন নৈঃশব্দের ভয়াল চাপাতি আমাদের চোখ রাঙাচ্ছে, যখন স্তাবকেরা মুক্তকচ্ছ হয়ে শক্তিমানদের বন্দনায় মত্ত, যখন বিবেক নিজের টুঁটি চেপে চুপ থাকা বাঞ্ছনীয় মনে করছে, তখন সৈয়দ শামসুল হকের কণ্ঠ আমি নিজ কণ্ঠ করে উচ্চারণ করছি, 'জাগো বাহে, কোনঠে সবাই।' জানি সে ডাকে সাড়া দেবেন দেশের শুভশক্তি।

সে ডাকে সজীব ওয়াজেদ জয়কে সাড়া দিতেই হবে। তা না হলে জয় এক সময় নতুন প্রজন্মের সবচেয়ে অগ্রসর শক্তির আস্থা ও সমর্থন হারাবেন। এর ফলে এক অনন্যসাধারণ শক্তির ঐক্য বিনষ্ট হবে। সোনার বাংলা গড়ার জন্য এই ঐক্য যে অপরিহার্য, জয়কে তা অনুধাবন করতে হবে। এই ঐক্যে ফাটল ধরলে আমাদের সামনে সমূহ বিপদ, যা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

মনে পড়ল, অনন্ত নিহত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর একটি টিভি চ্যানেল থেকে একজন যোগাযোগ করে বললেন, রাতে এ হত্যাকাণ্ড বিষয়ে টকশোতে অংশ নিতে। সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হলাম। পাঁচ মিনিট গেল না। আবার ফোন এল। খুবই কুণ্ঠার সঙ্গে তিনি জানালেন অনুষ্ঠানে পরিবর্তনের কথা। ভূমিকম্প নিয়ে আলোচনা হবে। তবে আগামীকাল অনুষ্ঠানটি হবে।

সে আগামীকাল আর আসেনি। রাত পোহায়নি। ভয়টি সেখানে।

আমার প্রয়াত বড় ভাই কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমের কনিষ্ঠ পুত্র মিশু তার একটি রচনায় লিখেছিল: 'আকাশের তীরে ঠেকা চাঁদ, রাত সবে শুরু।' মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন শক্তি যদি নৈঃশব্দ থেকে বেরিয়ে না আসে, আত্মসমালোচনার অনুশীলনের অভাবে ইস্পাতকঠিন ঐক্য গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়, এই রাত আমরা কখনও পার করতে পারব না।

তবে মানবতা, যুক্তি, বিজ্ঞান এবং মূল্যবান জীবন বিপন্ন হতেই থাকবে। সোনার বাংলায় তা হবে না।