নিরপেক্ষ নাকি সঠিক পক্ষ

লীনা পারভীন
Published : 16 May 2015, 10:06 AM
Updated : 16 May 2015, 10:06 AM

'নিরপেক্ষ' শব্দটির অর্থ আমি ঠিক নির্ধারণ করতে পারি না। তবে সাদা চোখে যা বুঝি তা হচ্ছে, কোনো নির্দিষ্ট পক্ষ অবলম্বন না করে সঠিক বেঠিক বিবেচনা করা। আবার কারও কারও মতে, নিরপেক্ষতা হচ্ছে সত্যের পক্ষ নেওয়া। 'সত্য' শব্দটির নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। এটি খুবই আপেক্ষিক। একজনের কাছে যা সত্য অন্যজনের কাছে তা নাও হতে পারে। আবার আজকের দিনের জন্য যা সত্য আগামীতে তা পাল্টেও যেতে পারে। তাই সত্যের কোনো ইউনিভার্সাল সংজ্ঞা কেউ দিতে পেরেছেন কিনা জানি না।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, সর্বোপরি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে নিরপেক্ষ থাকার অবকাশ আছে বলে মনে করি না। বিশ্বের অন্য দেশগুলির ইতিহাস আর বাংলাদেশের ইতিহাসের একটা মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে, এই দেশটি অনেকগুলি রক্তক্ষয়ী লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। লড়াই করে পেয়েছে তার ভাষার অধিকার, লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে পেয়েছে তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌম পরিচয়। তাই এখানে আছে শত্রুমিত্রের লড়াই। বাইরের শত্রুকে পরাজিত করে দেশটি ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতা ও আত্মপরিচয়। কিন্তু রয়ে গেছে তার ভিতরের পরিচিত ও অপরিচিত শত্রু।

আর ঠিক এই ঐতিহাসিক কারণেই বাংলাদেশে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখা মানে একটি সুবিধাবাদী অবস্থান, একটি সুরক্ষিত আসন যেখানে আপনাকে কোনো পক্ষকেই অখুশি বা খুশি করার চিন্তা থাকে না, ক্ষমতার রদবদলে নিজের সুবিধাজনক অবস্থানের পরিবর্তনের ঝুঁকি থাকে না। তবে আমি মনে করি, এই মুহূর্তে ঠিক যখন বাংলাদেশ তার চিহ্নিত শত্রুদের বিরুদ্ধে একের পর এক বিচারকার্যক্রম শুরু করেছে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠেছে আমাদের পরিচয়ের একমাত্র মাপকাঠি, তখন কেমন করে একজন নাগরিক নিরপেক্ষ থাকতে পারে?

এই মুহূর্তে দেশ দুটি পক্ষে বিভক্ত এবং তা পরিষ্কার। এর মাঝে কোনো প্রকার 'যদি', 'কিন্তু' থাকতে পারে না। হয় আপনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আর না হয় দেশের শত্রুদের পক্ষে। এর মাঝে যারা থাকতে চায় তারাই হচ্ছে সেই তথাকথিত 'নিরপেক্ষ' লেবাসধারী গ্রুপ; অন্য কথায় বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা দল।

এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে একজন বাংলাদেশি সে যেই পেশাতেই থাকুন না কেন, তাকে নির্ধারণ করতে হবে তিনি কী চান এবং নিজের অবস্থান আসলে কী। আর এই সঠিক পক্ষটি নির্ধারণ করতে পারলেই, আমি মনে করি, এই বর্তমান বাস্তবতায় আপনি নির্ধারণ করতে পারবেন আপনার পেশাগত নৈতিকতা, বস্তুনিষ্ঠতা, জবাবদিহিতা এবং সার্বিক অর্থে নিরাপত্তা। আপনাকে নির্ধারণ করতে হবে আপনার কথা বা অংশীদারিত্বের মাধ্যমে আপনি কাকে শক্তিশালী করতে চান? আপনার এই সঠিক পক্ষটি বেছে নেওয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হবে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক অগ্রগতির সিদ্ধান্ত। সেই সঠিক পক্ষ হচ্ছে দেশের পক্ষ।

সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিলাম যেখানে আলোচ্য বিষয়ের মূল অংশ ছিল বস্তুনিষ্ঠতা, জেন্ডার সমতা ও নিরাপত্তা। মূল আলোচক তার কী পেপার উপস্থাপনের সময় যে দিকটিতে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তা হচ্ছে পেশাদারিত্বের জায়গায়, বিশেষ করে কেউ যখন এমন একটি পেশায় যুক্ত থাকেন যেখানে আপনার অবস্থান হতে হবে এমন যেন আপনার মতামত সেখানে প্রতিফলিত না হয়, খেয়াল রাখতে হবে আপনার সংবাদটি যেন কোনো বিশেষ পক্ষের দিকে চলে না যায়। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এ রকম অবস্থান কীভাবে আপনি রক্ষা করে চলবেন? তাত্ত্বিকভাবে হয়তো তিনি একদম সঠিকভাবেই বলেছেন অথবা বহির্বিশ্বের বিবেচনায় হয়তো তিনি ভুল কিছু বলেননি। কিন্তু এখানে এটিও দেখতে হবে বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে কি অন্য কোনো বাস্তবতা তুলনায় আসে? ঐ যে আমার লেখার প্রথমেই বলেছি, বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে একটি অনন্য দেশ যার একটি বিশাল লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে যেখানে এখনও বাংলাদেশের পক্ষ বিপক্ষ বলে দুটি গ্রুপ রয়েছে।

ধরে নিলাম, আপনি একজন সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতার দর্শন অনুযায়ী আপনাকে হতে হতে বস্তুনিষ্ঠ। তার মানে, আপনাকে হতে হবে সমাজের আয়না যেখানে আপনার নিজের রঙ লাগানোর সুযোগ থাকবে না। কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে, একটি দেশের নাগরিক হিসেবে আপনি কি কোনো না কোনো মতের বা পক্ষের নন? আপনি যখন ভোট দেন তখন কি নিরপেক্ষ বলে কোনো ব্যালট থাকে? থাকে না। তার মানে, আপনিও কোনো না কোনো মত ও পথের অনুসারী। আর একজন সামাজিক মানুষ হিসেবে আপনিও কিন্তু সমাজে ঘটে যাওয়া ঘটনায় ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ করেন; ভালোলাগা মন্দলাগা অন্যের সঙ্গে শেয়ার করতে পছন্দ করেন। আপনিও চান আপনি যে দর্শনে বিশ্বাস করেন সমাজে সেই দর্শনের অনুসারীর সংখ্যা বাড়ুক। আপনিও প্রভাবিত করতে চান।

আপনি চান আর না চান, আপনি কোনো না কোনো পক্ষ অবলম্বন করেই নিজেকে প্রকাশ করতে চান। বাংলাদেশের মতো দেশের নাগরিকদের কোনোভাবেই নিরপেক্ষ থাকার অবকাশ নেই। তবে হ্যাঁ, আপনাকে দেখতে হবে, আপনার মতের দ্বারা যেন সমাজে কোনো নেতিবাচক প্রভাব গড়ে না ওঠে, আপনি যে মতটি প্রকাশ করতে চাচ্ছেন তার দ্বারা সমাজে কোন ধারার শক্তিকে আপনি উৎসাহিত করছেন।

আপনি চাইলেই মনগড়া কোনো বক্তব্য রাখতে পারেন না বা ছড়িয়ে দিতে পারেন না; কারণ আপনার একটি দায়িত্বশীলতা অবশ্যই থাকতে হবে। বিশেষ করে আপনি যখন একটি বৃহত্তর গোষ্ঠীকে প্রভাবিত করে এমন কিছু করতে যাচ্ছেন, তখন অবশ্যই আপনাকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। একে বলে পেশাদারিত্ব বা জবাবদিহিতা। শব্দটি আপনাকে অনেক কিছু থেকে বেঁধে রাখে। জবাবদিহিতা থাকলে আপনি চাইলেই যা ইচ্ছা তা করে ফেলতে পারেন না।

অনেকে বলে থাকেন, আমি স্বাধীন নাগরিক, তাই চাইলেই আমার যে কোনো মত প্রকাশ করতে পারি, চাইলেই যা করলে আমি সুখ পাব তা করতে পারি। আর এখানেই প্রয়োজন জবাবদিহিতার। একটি ছোট শব্দ, কিন্তু ওজন অনেক বেশি। স্বাধীনতা মানে আমি যা চাইলাম তা করা নয়। স্বাধীনতা মানে দায়িত্বশীলভাবে নিজেকে প্রকাশ, অন্যের অধিকার হরণ না করে নিজের অধিকারের চর্চা। আজকের এই সময়ে আমাদের দেশে সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার খুব বেশি প্রয়োজন। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে বা সামনে যারা রাজনীতি করবেন বা করছেন তাদেরও এই ধারায় ফিরে আসতে হবে যার প্রমাণ কিন্তু আমরা সাম্প্রতিক সময়গুলিতে দেখেছি।

খুব সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, আমাদের দেশের রাজনীতিতে এক ধরনের গুণগত পরিবর্তন আসছে। রাজনীতিবিদরা এখন আর তাদের পেশিশক্তির বদৌলতে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, দিনশেষে তাকে জনতার আদালতে ধরা দিতে হচ্ছে। যিনিই রাজনীতিতে আসবেন বলে ভাবছেন তাকে প্রমাণ করতে হচ্ছে তিনি দেশকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, শুধু মুখে বললেই এখন আর জনগণকে যে কোনো কিছু তারা খাওয়াতে পারছেন না। সবার আগে তাকে নির্ধারণ করতে হচ্ছে, তিনি কি মুক্তিযুদ্ধের ধারার মানুষ নাকি বাংলাদেশের অস্তিত্ব তার কাছে বিপদজনক? কয়েক বছর আগেও এসব আমাদের চিন্তার বাইরে ছিল। কারণ আমাদের এই প্রজন্ম এখন অনেক বেশি সচেতন, দেশপ্রেমিক ও দেশের স্বার্থে আপোষহীন।

আজকে সময় এসেছে আমরা নাগরিকরা কোন পক্ষের হব তা ভাবার, আমি আমার মত কীভাবে প্রকাশ করব, কীভাবে আমি একটি সংবাদ প্রচার ও প্রসারে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিব। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে প্রয়োজন দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সঠিক পক্ষ অবলম্বনকারীদের যৌথ অবস্থান। নিরপেক্ষতার আড়ালে সুবিধাবাদীদের দলে নাম লিখানোর দিন মনে হয় আর নেই। সোজা লাইনে আসতে হবে আমাদের। মাঝামাঝির স্থান নেই।

তাই আসুন, নিরপেক্ষ নই, সঠিক পক্ষ বেছে নিই এবং সে পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাই। জয়ের ধারা বাঁচিয়ে রাখি নিরন্তর। জনতার জয় অনিবার্য।