বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের নতুন মাইলফলক

মোহাম্মদ সেলিম
Published : 14 May 2015, 05:29 PM
Updated : 14 May 2015, 05:29 PM

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও কিছু অমীমাংসিত ইস্যু বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে থেকে গেছিল। দীর্ঘ সময়ের প্রেক্ষাপটে এগুলো জটিল থেকে অধিকতর জটিলতার দিকে মোড় নিয়েছিল। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল দুদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বা জোটগুলোর রাজনৈতিক আদর্শ, নেতৃত্বের মানসতত্ত্ব, অভ্যন্তরীন রাজনীতির লাভ-ক্ষতির মতো নানা ধরনের বিষয়। বাস্তবতা হল এই যে, যে কোনো দুদেশের মধ্যে, বিশেষত দেশ দুটো যদি প্রতিবেশি হয়, তবে তাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস ও সৌহার্দ্য থাকা জরুরি।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে সীমান্ত-বিরোধই অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশেষ করে এই সীমান্ত-বিরোধ কেন্দ্র করে সীমান্ত-সংঘর্ষ, ছিটমহল সমস্যা, চোরাচালান ইত্যাদি দুদেশের রাজনৈতিক সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেছে।

ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর সরকার গঠনের পর থেকেই প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। নিকটতম প্রতিবেশি রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মনমোহন সিংয়ের গৃহীত নীতি তিনি অব্যাহত রেখেছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘ চার দশকের সীমান্ত-বিরোধ নিরসনে সম্প্রতি কার্যকর কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন মোদী। তাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি অনুমোদিত হয়। এ সংবাদে কিছুটা আলোর রেখা দেখা দিলেও, পুরো আঁধার এখনও কেটে যায়নি। দিল্লিতে কংগ্রেস বনাম বিজেপির প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অন্যদিকে প্রদেশ বনাম কেন্দ্রের দ্বন্দ্বে দ্বিপাক্ষিক ইস্যুগুলো ভোটের রাজনীতির পাঁকে জড়িয়ে যায়। কিংবা দলীয় স্বার্থ বা প্রাদেশিক রাজনীতির কাছে হার মেনে যায় জাতীয় স্বার্থ। কিন্তু এবার নতুন ইতিহাস গড়ল ভারতীয় পার্লামেন্ট।

দুদেশেই সীমান্ত সমস্যার রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। এর ফলে জটিলতা দিন দিন বেড়েছে বৈ কমেনি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত হল বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম সীমান্ত। বাংলাদেশের তিন দিকে ভারতের পাঁচটি রাজ্যের সঙ্গে রয়েছে ৪,০৯৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ২,২১৬ কিলোমিটার, ত্রিপুরার সঙ্গে ৮৫৬ কিলোমিটার, মেঘালয়ের সঙ্গে ৪৪৩ কিলোমিটার, মিজোরামের সঙ্গে ৩১৮ কিলোমিটার এবং আসামের সঙ্গে ২৬২ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যে কোনো রাষ্ট্রের জন্যই বড় চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত নিয়ে বিরোধের শুরু ১৯৪৭ সালে, যখন মানচিত্রের ওপর রেখা টেনে সীমানা চিহ্নিত করা হত। সরেজমিনে সীমান্তের প্রতিটি স্থান সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশ করা হয়নি। ফলে সীমান্ত এলাকার জনগণের জীবনে নেমে আসে নানা বিপত্তি; তাদের প্রাত্যহিক জীবন-জীবিকার চিরায়ত উৎসে সৃষ্টি হয় প্রতিবন্ধকতা। পাকিস্তান আমলে সীমান্ত সমস্যা সমাধানে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। স্বাধীনতার পর দুদেশের মধ্যে অভূতপূর্ব বন্ধুত্ব, সম্প্রীতি ও আস্থার সম্পর্কের প্রেক্ষিতে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি স্বাক্ষর হয় ১৬ মে, ১৯৭৪। বিভিন্ন সময় নানা রাজনৈতিক ও আইনি জটিলতা এবং অনীহার কারণে এ চুক্তির বাস্তবায়ন হয়নি। ১৯৯২ সালের ২৬ জুন বাংলাদেশের কাছে ভারতের তিন বিঘা করিডোর হস্তান্তর ছাড়া সীমান্ত ইস্যুতে কোনো অগ্রগতি ছিল না।

মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির দীর্ঘ সাঁইত্রিশ বছর পর হাসিনা-মনমোহন ২০১১ সালে সীমান্ত সংক্রান্ত প্রটোকলে স্বাক্ষর করেন। এর আগে দুদেশের যৌথ জরিপ দল বিরোধপূর্ণ এলাকায় গিয়ে গুচ্ছ মানচিত্র তৈরি করেন। এই মানচিত্র দুদেশের মধ্যে স্বাক্ষর ও হস্তান্তর সম্পন্ন হয়। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে মনমোহন সিং সরকার ২০১৩ সালে সংবিধান সংশোধনের জন্য সীমান্ত বিল রাজ্যসভায় পেশ করে। কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরীন রাজনীতির টানাপড়েনে সে বিল পাস দূরে থাক, উত্থাপন করতে গিয়েই কংগ্রেস সরকার বিরোধীদের প্রচণ্ড বাধার মুখে পড়ে। মূলত ভারতীয় জনতা পার্টি, আসাম গণপরিষদ ও তৃণমূল কংগ্রেস এর বিরোধিতা করে।

সীমান্ত সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতে অপরাজনীতি কম হয়নি। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নিন্দিত হয়েছে ব্যাপকভাবে। অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে 'ভারতবিরোধী' প্রচারণা চালানো হয় তখন। বেরুবাড়ি বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ দাবি করে মওলানা ভাসানী 'মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে করিমগঞ্জ ও মুর্শিদাবাদসহ পশ্চিমবঙ্গের ১৪টি জেলা বাংলাদেশের ভেতর অন্তর্ভুক্তির দাবি' জানান। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সহসভাপতি বিধান কৃষ্ণ সেন ও যুগ্ম সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ সীমান্ত চুক্তিটি বাংলাদেশের পক্ষে 'অত্যন্ত অসম ও অসম্মানজনক' বলে বিবৃতি দেন। তাদের ভাষায়, এটা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যের মাধ্যমে বাংলাদেশকে নয়া উপনিবেশে পরিণত করার ভারতীয় চক্রান্ত বাস্তবায়নের পক্ষে সুম্পষ্ট পদক্ষেপ। ভাসানী ন্যাপের ভাইস চেয়ারম্যান ড. আলীম আল রাজি চুক্তিটির সমালোচনা করে বলেন, সরকার অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশকে ভারতের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল করে তোলার পাঁয়তারা করছে।

লক্ষ্যণীয়, দেশি বিদেশি বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, এই চুক্তির শর্তাবলী অনেক বেশি বাংলাদেশের অনুকূলে ছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর গভীর আন্তরিকতা এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্ব ও বিশেষ কূটনৈতিক দক্ষতার ফলে ওই চুক্তি স্বাক্ষর সম্ভব হয়েছিল।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে 'ভারতবিরোধিতা' প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। সে সময় উগ্র ভারতবিরোধিতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সামরিক সরকারগুলো জনমত নিজেদের অনুকূলে নেবার চেষ্টা করেছে। তবে দ্বিপাক্ষিক এসব ইস্যুর আন্তর্জাতিকীকরণের প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। পরিণতিতে দুদেশের মধ্যে অনাস্থা, তিক্ততা ও দূরত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।

আবার ভারতের রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পর্কের প্রভাব পড়েছে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ওপর। বাংলাদেশের সঙ্গে যেহেতু ভারতের পাঁচটি রাজ্যের সীমান্ত বিদ্যমান, তাই দ্বিপাক্ষিক ইস্যুতে রাজ্য সরকারগুলোর মনোভাব সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তার করবে এটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে সীমান্ত ইস্যুতে রাজ্য সরকারগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফরওয়ার্ড ব্লক, তৃণমূল কংগ্রেস, অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন, আসাম গণপরিষদ বিভিন্ন সময় সীমান্ত চুক্তির বিরোধিতা করে আন্দোলন করে। ভারতের গত সাধারণ নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টিও সীমান্ত চুক্তির বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের পর বিজেপি সীমান্ত ইস্যুতে ইতিবাচক অবস্থান নেয়।

ওদিকে আসাম রাজ্য বিজেপির তীব্র বিরোধিতার মুখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সীমান্ত চুক্তি থেকে আসামকে বাদ দেওয়ার বিষয় বিবেচনা করেছিলেন। এরপর আসামের মূখ্যমন্ত্রী ও প্রবীণ কংগ্রেস নেতা তরুণ গগৈ সীমান্ত চুক্তি থেকে আসামকে বাদ না দেওয়ার অনুরোধ করেন। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস দৃঢ় অবস্থান নিয়ে জানিয়ে দেয় যে, আসামকে বাদ দিয়ে সীমান্ত চুক্তি উত্থাপন করা হলে তারা তাতে সমর্থন দেবে না এবং কংগ্রেসের সমর্থন ব্যতীত রাজ্যসভায় এই বিল বিজেপি পাশও করাতে পারবে না। এমন পরিস্থিতিতে মোদী আসামকে সীমান্ত চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করে রাষ্ট্রনায়কসুলভ প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টির স্বাক্ষর রেখেছেন।

মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ভারতীয় সংবিধানের ১১৯তম সংশোধনী বিল রাজ্যসভা ও লোকসভায় সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়েছে। রাজ্যসভায় উপস্থিত ১৮১ সদস্য এবং লোকসভায় উপস্থিত ৩৩১ সদস্য প্রত্যেকে বিলের পক্ষে ভোট প্রদান করেন। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি স্বাক্ষরের একচল্লিশ বছর পর ৫ মে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় বিল অনুমোদন, ৬ মে রাজ্যসভায়, ৭ মে লোকসভায় বিল পাস হয়। রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল এই বিল নজিরবিহীন দ্রততায় পাস হওয়া সত্যিই বিস্ময়কর।

লোকসভায় বিল পাসের পর পরই মোদী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোনে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, "১৯৭৪ সালের ১৬ মে আপনার পিতা বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে এ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। আজ আপনার সরকারের সময় সেই মে মাসেই বিলটি পাস হল।"

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও মোদীকে ধন্যবাদ জানিয়ে ভারতকে বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু বলে অভিহিত করেন।

রাজ্যসভা ও লোকসভায় সীমান্ত বিল নিয়ে আলোচনাকালে প্রায় সকল সদস্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু, ইন্দিরা গান্ধী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতার প্রশংসা করেছেন। সব দলের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রতি প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার, সীমান্তবর্তী রাজ্য সরকারসমূহ, ছোটবড় সকল রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ সুপ্রতিবেশিসুলভ সম্প্রীতির নীতি গ্রহণ করেছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর এমন ঘটনা আর ঘটেনি।

আবারও প্রমাণ হল, বন্ধুত্ব, সহযোগিতা, আস্থা ছাড়া দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বড় কোনো অর্জন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বৈরিতা ও বিদ্বেষ যে কোনো মহৎ অর্জনের পথে বড় অন্তরায়। আরেকটি বিষয়। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে নিজের সাফল্যের ঝুড়িতে নতুন নতুন পালক যুক্ত করছেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর সময়ে যে সব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল, তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে তাঁর কন্যাই সেগুলো সাফল্যের সঙ্গে সমাপ্ত করেছেন। ইতোপূর্বে মায়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর স্থলসীমান্তের বাধা অপসারণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র সম্পূর্ণ হল।

একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানচিত্রের রাজনৈতিক সীমা চূড়ান্তভাবে নিস্পন্ন ও দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই শুভক্ষণে ভারতের জনগণ ও সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। কূটনৈতিক সাফল্যের জন্য অভিনন্দন প্রাপ্য শেখ হাসিনার।


মোহাম্মদ সেলিম:
অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।