লাদেনের মৃত্যুই শেষ নয়

আমজাদ হোসেন
Published : 4 May 2011, 03:36 PM
Updated : 4 May 2011, 03:36 PM

এই ভাষ্যটি এখন সর্বাধিক প্রচারিত যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করেছে। এই সংবাদ নিশ্চিত করেছেন স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা। এর আগে পাশ্চাত্য গণমাধ্যম সাতবার তার মৃত্যু সংবাদ প্রচার করেছে। তাকে 'টেররিস্ট' বলা হয়েছে। তিনি ছিলেন পাশ্চাত্যের কাছে 'মোস্ট ওয়ান্টেড' ব্যক্তি। গত ১০ বছর সি আই এ, পেন্টাগণ তাকে খুঁজে পায়নি। তাকে জীবিত বা মৃত ধরার জন্য আড়াই কোটি ডলার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছিল যে, ০৯/১১-তে আমেরিকার গর্ব টুইন টাওয়ার ধ্বংস করার পিছনে লাদেনের সক্রিয় হাত আছে। কিন্তু লাদেনের সাক্ষাৎকার ও বিভিন্ন বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, তিনি টুইন টাওয়ার ধ্বংসে মোটেই জড়িত ছিলেন না, তবে ঘটনাকে তিনি সমর্থন করেন। তার চিন্তা ছিলঃ টুইন টাওয়ার ধ্বংসের অর্থ হচ্ছে মার্কিনের গর্ব ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া। যারা বিশ্বের দেশে দেশে বহু মানুষ, লোকালয় ও অবকাঠামো ধ্বংস করেছে, সেই আমেরিকার গর্বকেও ধ্বসিয়ে দেওয়া সম্ভব। এজন্য লাদেন টুইন টাওয়ার ধ্বংসের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। তবে এটা সত্য যে, টুইন টাওয়ার ধ্বংসে লাদেনের হাত আছে এটা আমেরিকা কখনই প্রমাণ করতে পারে নি। তখন লাদেন আফগানিস্তানের পাহাড়ী অঞ্চলে অবস্থান করছিলেন। তার পক্ষে টুইন টাওয়ার গুড়িয়ে দেওয়া ও পেন্টাগণের ওপর বিমান হামলা করার ক্ষমতাও ছিল না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আসল উদ্দেশ্য ছিল তেল ও অন্যান্য সম্পদপূর্ণ আফগানিস্তান দখল করার। ৯/১১-র ঘটনায় লাদেন জড়িত এই মিথ্যা প্রচারণাকে আমেরিকা অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করার মোক্ষম সুযোগ পায়। এখনও পর্যন্ত অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, ৯/১১-র ঘটনায় আসলে ইহুদিদের ইন্ধন আছে। কিন্তু এনিয়ে তেমন কোন আলোচনা হয় না।

তদানীন্তন মার্কিন সরকার আফগান শাসক মোল্লা ওমরকে বলেছিলো লাদেনকে তাদের হাতে সমর্পণ করতে। মোল্লা ওমর মার্কিন কর্তৃপক্ষকে জানান যে, লাদেন যে ৯/১১-র ঘটনায় জড়িত আপনারা তার প্রমাণ দিন। প্রমাণ যথার্থ হলে আমরা লাদেনকে আপনাদের হাতে তুলে দিতে রাজি আছি। লাদেন আমাদের অতিথি। আমেরিকা সে কথায় কর্ণপাত করেনি। তারা আফগানিস্তান আক্রমণ ও দখল করে সেখানে এক পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় বসায়। মার্কিন ও ন্যাটো তথা পাশ্চাত্যের উদ্দেশ্য সফল হয়। এরপর ঘটে ইরাক আক্রমণ। অজুহাত যাই থাকুক উদ্দেশ্য একই: সাম্রাজ্য বিস্তার, নিয়ন্ত্রণ ও লুট।

বিন লাদেন চেয়েছিলেন মার্কিন তথা পাশ্চাত্য প্রভাবমুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম এক মধ্যপ্রাচ্য। যেখানে আমেরিকার কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে আরব দেশগুলো টিকে থাকবে। আরবের তেল ও অন্যান্য সম্পদের উপর আরববাসীদের অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কর্তৃত্ব থাকবে। এই উদ্দেশ্য অবশ্যই মহৎ ও সমর্থনযোগ্য। কিন্তু এজন্য তিনি যে পথ বেছে নিলেন সেটা ছিল ভ্রান্ত। তিনি ভ্রান্ত পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন মার্কিন আধিপত্যবাদ ও পাশ্চাত্যবিরোধী। মার্কিন ও ন্যাটো দেশগুলোর বুকে তিনি কাঁপন ধরিয়েছিলেন। একথা সত্য যে, আল কায়েদাকে আমেরিকাই সৃষ্টি করেছিল অর্থ, সম্পদ ও প্রশিক্ষণ ইত্যাদি দিয়ে। তাকে ব্যবহার করেছিল আফগানিস্তান থেকে রাশিয়াকে বিতাড়িত করার জন্য। রাশিয়া আফগানিস্তান থেকে বিতাড়িত হয়। পরে লাদেন ও মোল্লা ওমর মার্কিন স্বার্থে কাজ করতে রাজি হননি। তারা আফগানিস্তানের সম্পদের ওপর মার্কিনের নিয়ন্ত্রণ মেনে নিতে চাননি। তখনই শুরু হয় শত্রুতা। যার পরিণতি আফগানিস্তান দখল ও বিন লাদেনকে হত্যা। তবে মার্কিনের নানা ধূম্রজাল সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমার কাছে যে অনুমানটি গাঢ় হয়ে আছে তা হলো লাদেন আত্মহত্যা করেছেন নিজের মাথায় গুলি চালিয়ে। মার্কিনীদের গুলিতে তিনি নিহত হননি।

বিন লাদেনের লাশ কাউকে দেখতে দেওয়া হয়নি। ওবামা বলেছেন, তার মৃতদেহ আমাদের হাতে আছে। আবার পাশ্চাত্যের অন্য সূত্রগুলো বলেছে যে, তার মৃতদেহ সাগরে নিক্ষেপ করা হয়েছে। ইসলামী নিয়মানুযায়ী যথাযথভাবে দাফনও করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য এখনো জানা যায়নি। ভবিষ্যতে হয়তো প্রকৃত সত্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো না কোনো তথ্য মাধ্যম থেকে একদিন বেরিয়ে পড়বে।

যাহোক এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, লাদেনের মৃত্যু মানে 'সন্ত্রাস' শেষ হয়ে যাওয়া নয়। আরো লাদেনের জন্ম হবে। যতদিন মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার উপস্থিতি বজায় থাকবে ততদিন আমেরিকার ওপর আঘাত চলতেই থাকবে; তা কখনো থামবে না। কারণ একটি সন্ত্রাস আরেকটি সন্ত্রাসকে উস্কে দেয়। ফলে আল কায়েদা কখনো পিছু হটবে কখনো এগিয়ে যাবে। এ পদ্ধতিতে তাদের কার্যক্রম চলতেই থাকবে। এটা অনুমান করা কষ্টকর নয়।

আর একটি কথা, আমেরিকা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব লংঘন করে ওসামাকে হত্যা করতে সফল হয়েছে। ওবামা বলেছেন, তাঁর নির্দেশেই মার্কিন সৈন্যরা পাকিস্তানেই হত্যা করেছে লাদেনকে এবং এটা তার ভাষায় 'ন্যায় বিচার'। তাঁর মতে, লাদেনকে হত্যা করে 'ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত' হয়েছে এবং তারা যা চায় তা তারা করতে পারে। এটা যে ঔদ্বত্যপূর্ণ কথা তাতে সন্দেহ নেই। একথা বিশ্ববাসী জানে যে, লাদেন যদি সন্ত্রাসী হন তাহলে ওবামাও তার চেয়ে কম যান না। আন্তর্জাতিক নিয়ম নীতি লঙ্ঘণ, নৃশংসতা, বর্বরতা আর বিপুল হত্যাযজ্ঞে বরং লাদেনের চেয়ে বড় এই ওবামা এবং আমেরিকা । ওবামাদের হাতেই আফগানিস্তান ও ইরাকের লাখ লাখ লোক নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা অনেক। ইরাক আফগানিস্তান, কিংবা লিবিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধ করতে বা কোনোরূপ আক্রমণ করতে যায়নি, বরং আমেরিকা ও ন্যাটোর বাহিনী ইরাক আফগানিস্তান সর্বশেষ লিবিয়া আক্রমণ করেছে। মার্কিন ও ন্যাটোর যুদ্ধ বিমানের আঘাতে লিবিয়ায় হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে এবং অবকাঠামো ধ্বংস হচ্ছে অথচ সাম্রাজ্যবাদী প্রোপাগান্ডা দোষ দিচ্ছে গাদ্দাফিকে। গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে আজ যে সংকট চলছে, এর মূলে রয়েছে আমেরিকা ও ন্যাটো। লাদেনের থেকে অনেক বড় সন্ত্রাসীরাই এখন মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে।

সুতরাং লাদেনের মৃত্যুতে সন্ত্রাস শেষ হয়ে যাবে না। যতদিন মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার উপস্থিতি ও তাদের শোষণ লুটপাট অব্যাহত থাকবে ততদিন সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না, মার্কিন বিরোধী লড়াই সে অঞ্চলে অব্যাহত থাকবে তা সন্ত্রাসের পথে হোক কিংবা শাস্তিপূর্ণ পথেই হোক।

৪ এপ্রিল ২০১১