ভূমিকম্প! ভূমিকম্প!!

Published : 8 May 2015, 06:34 AM
Updated : 8 May 2015, 06:34 AM

১.

সেদিন একজন এসে আমাকে জানাল ভূমিকম্প নিয়ে নাকি ফেসবুকে তুলকালাম কাণ্ড হচ্ছে। ফেসবুকের কাণ্ডকারখানা নিয়ে আমি খুব বেশি মাথা ঘামাই না, তবুও জানতে চাইলাম তুলকালাম কাণ্ডটা কী রকম। যে খবর এনেছে সে আমাকে জানাল, নেপালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের পরেই আলোচনা হচ্ছে যে ভূমিকম্পটা নাকি বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসছে। শিলিগুড়ি হয়ে সেটা নাকি যে কোনো সময়ে বাংলাদেশে ঢুকে দেশটাকে তছনছ করে দেবে। আলাপ আলোচনায় শুধু আতংক আর আতংক।

শুনে আমার মনে হল ভূমিকম্প নিয়ে আমার কিছু একটা লেখা উচিৎ। আমি ভূমিকম্পের বিশেষজ্ঞ নই, কিন্তু আমি প্রায় পাঁচ বছর ভূমিকম্প এলাকায় ছিলাম। ছোট-বড়-মাঝারি অসংখ্য ভূমিকম্পের মাঝে টিকে থাকতে হয়েছে, তখন যে বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলো হয়েছে সেটা এখনো আমার কাজে লাগে।

পিএইচডি শেষ করে আমি যখন পোস্টডক করার জন্যে লস এঞ্জেলস শহরের কাছে ক্যালটেকে যোগ দিয়েছি তখন প্রথমেই আমাকে জানিয়ে দেয়া হল এটা ভূমিকম্প এলাকা। খুব কাছে দিয়ে বিখ্যাত (কিংবা কুখ্যাত!) সান এন্ড্রিয়াস ফল্ট লাইন গিয়েছে সেখানে যে কোনো মূহূর্ত্তে রিখটার স্কেলে আট মাত্রা থেকে বড় একটা ভূমিকম্প হয়ে, কাজেই সব সময় সতর্ক থাকা ভালো। আমার ল্যাবরেটরির সামনেই আটতলা মিলিক্যান লাইব্রেরী, বিল্ডিংটা তৈরী করে সেটাকে নাকি ডানে বামে সামনে পিছনে দুলিয়ে দেখা হয়েছে আট মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করতে পারে কী না! পৃথিবীর সবাই ভূমিকম্পের মাত্রা মাপার রিখটার স্কেলের নাম শুনেছে সেই স্কেলের নাম করণ হয়েছে ক্যালটেকের প্রফেসর রিখটারের নামে।

ভূমিকম্প নিয়ে কী কী সতর্কতা নেয়া উচিৎ শুনতে শুনতে আমিও সতর্ক থাকা শিখে গেলাম। বড় ভূমিকম্পে বিল্ডিং ধ্বসে তার নিচে চাপা পড়ে মারা যাবার যেটুকু আশংকা তার থেকে হাজার গুন বেশী আশংকা আচমকা কোনো ছোট খাট ভূমিকম্পে উপর থেকে কোনো ভারী জিনিষ মাথার উপর পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলা। তাই দেখতে দেখতে আমি সতর্ক থাকা অভ্যাস করে ফেললাম। মাথার উপরে কিছু রাখি না, ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি দেয়ালে হুক দিয়ে বেঁধে রাখি। তখন একটা টাইম ্রজেকশান চেম্বার তৈরী করছিলাম, তার ভেতরে বিশেষ আইসোটপের যে গদাস তার দাম দুইশ পঞ্চাশ হাজার ডলার, ভূমিকম্পে চেম্বার উল্টে পড়ে গ্যাস বের হয়ে গেল সুইসাইড করতে হবে, তাই উপর থেকে ক্রেন দিয়ে চেম্বারকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখি।

আমার পুত্র সন্তানের বয়স তখন দুই বছর, সে বাসায় ঘুরে বেড়ায়। আচমকা ভূমিকম্পে তার উপর শেলফ, আলমারী কিংবা টেলিভিশন পড়ে যেন না যায় সে জন্যে সবকিছু দেওয়ালের সাথে বাঁধা।

আমার এত সতর্কতা গেল না, হঠাৎ একদিন ভোর বেলা রিখটার স্কেলে ছয় মাত্রার ভূমিকম্প হানা দিল, ভূমিকম্পের হিসেবে সেটা মাঝারী, কিন্তু তার কেন্দ্র (এপিসেন্টার) ছিল খুব কাছে তাই আমরা সেটা খুব ভালোভাবে টের পেলাম। ছোট ছেলেকে বগলে নিয়ে সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে ধরে দোতলা থেকে নেমে ছুটতে ছুটতে বাইরে এসে দাড়িয়েছি। বাড়ী ঘর কাঁপছে, মাটি যাচ্ছে, সব মিলিয়ে অতি বিচিত্র একটা অভিজ্ঞতা! আমি যথেষ্ট বিচলিত কিন্তু স্থানীয় মানুষেরা সেটাকে বেশী গুরুত্ব দিল না। আমাদের গ্রুপের ইঞ্জিনিয়ার বলল, "কাজে আসছি, হঠাৎ মনে হল গাড়ীর টায়ারটা ফেটে গেছে। নূতন গাড়ী মুডটা অফ হয়ে গেল। পরে দেখি একটা ফালতু ভূমিকম্প!" এই হচ্ছে তাদের প্রতিক্রিয়া।

বড় ভূমিকম্প হলে পরের কয়েকদিন নিচে মাটি ক্রমাগত কাপঁছে। কাঠের বাসা, যত ছোট ভূমিকম্পই হোক সেটা গুটুর গুটুর শব্দ করে জানান দেয়। আমার দুই বছরের ছেলেটির তাতে মহাআনন্দ, সে উল্লসিত মুখে ছুটে এসে আমাকে জানায় "গুডু গুডু! গুডু গুডু!" আমি তার আনন্দে অংশ নিতে পারি না। মনে মনে শুধু হিসেব করি, এটি ছিল রিখটার স্কেলের মাত্র ছয় মাত্রার ভূমিকম্প, এটাতেই এই অবস্থা। লস এঞ্জেলসের বড় ভূমিকম্পটা হবে কমপক্ষে আট মাত্রার, অর্থাৎ এক হাজার গুন বেশী শক্তিশালী, সেটা যদি আসে তাহলে কী অবস্থা হবে? রিখটার স্কেলে এক মাত্রা বড় হওয়া মানে প্রায় ত্রিশ গুণ বড় হওয়ার। কাজেই দ্ইু মাত্রা হচ্ছে এক হাজার। আমি রাতে ঘুমাতে পারি না নিদ্রাহীন চোখে বাসার ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকি। ছোট বড় আফটার শকের গুটুর গুটুর শব্দ শুনি।

তখন ইন্টারনেট ছিল না (গুজব এবং আতংক ছাড়ানোর জন্যে ফেসবুকও ছিল না)। তাই আমি একদিন ক্যালটেকের বুক স্টোর থেকে ভূমিকম্পের উপর লেখা একটা বই কিনে আনলাম। মানুষ যেভাবে ডিটেকটিভ উপন্যাস কিংবা ভূতের গল্প পড়ে আমিও বইটা সমান আগ্রহে শেষ করলাম। এজানা অচেনা রহস্যময় ভূমিকম্প নিয়ে আমার ভিতরে যে আতংক ছিল সেটা দূর হয়ে গেল। আমি আবার নাক ডেকে ঘুমাতে শুরু করলাম। ভালো ঘুমের জন্যে জ্ঞান থেকে বেশী কার্যকর আর কিছু হতে পারে না।

২.

ভূমিকম্পের বই পড়ে আমি প্রথম যে বিষয়টা জানতে পারলাম সেটি হচ্ছে আট মাত্রার ভূমিকম্প ছয় মাত্রার ভূমিকম্প থেকে এক হাজার গুণ বেশী শক্তিশালী। তার অর্থ এই নয় যে, সেই ভূমিকম্পটির তীব্রতা, কম্পন বা ঝাকুনি এক হাজার গুণ বেশী! তার অর্থ ছয় মাত্রার ভূমিকম্প হয় অল্প জায়গা জুড়ে, আট মাত্রার ভূমিকম্প হয় অনেক বেশী জায়গা জুড়ে। আমাদের পায়ের নিচে শক্ত মাটি দেখে আমরা ধরে নিই ভূমি হচ্ছে স্থির! আসলে ভূমি স্থির নয়, সেগুলো নানা ভাগে বিভক্ত এবং সেগুলো এদিক সেদিক নড়ছে।

আমরা যে ভূমিকম্পের ওপর আছি তার নাম ইন্ডিয়ান প্লেট। সেটা বছরে দুই ইঞ্চি করে উত্তর দিকে এগুচ্ছে এবং উত্তরে ইউরেশিয়ান প্লেটকে ধাক্কা দিচ্ছে। সেই ধাক্কায় মাটি উপরে উঠতে উঠতে হিমালয় পর্যন্ত তৈরী হয়ে গেছে! সব প্লেটেরই একটা পরিসীমা বা বাউন্ডারী থাকে, এই বাউন্ডারীতে ধাক্কাধাক্কি চলতে থাকে। তাই নিয়মিতভাবে এই বাউন্ডারীতে ভূমিকম্প হতে থাকে! সেই ভূমিকম্প এতই নিয়মিত যে, বিজ্ঞানীরা আজকাল মোটামুটি আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেন যে, রিখটার স্কেলে নয় মাত্রার ভূমিকম্প হয় আনুমানিক দশ বছরে একবার। আট মাত্রায় ভূমিকম্প হয় আরো বেশী, আনুমানিক প্রতি বছরে একবার।

হিসাবটি মনে রাখা বেশ সোজা, ভূমিকম্পের মাত্রা এক কমে গেলে তার সংখ্যা বেড়ে যায় দশ গুণ। অর্থাৎ সাত মাত্রায় ভূমিকম্প বছরে দশটি, ছয় মাত্রার ভূমিকম্প বছরে একশটি, পাঁচ মাত্রার ভূমিকম্প বছরে প্রায় এক হাজার, চার মাত্রার ভূমিকম্প বছরে দশ হাজার। এর চাইতে ছোট ভূমিকম্পের হিসেব নিয়ে লাভ নেই, সেগুলো ঘটলেও আমরা টের পাই না! কাজেই আসল কথাটা হচ্ছে বছরে সারা পৃথিবীতে ছোট বড় হাজার হাজার ভূমিকম্প হচ্ছে এবং সেগুলোর প্রায় বেশীরভাগ হয় পৃথিবী পৃষ্ঠের সঞ্চারণশীল ভূখণ্ড বা টেকটোনিক প্লেটের পরিসীমা বা বাউন্ডারিতে। সেজন্যে নেপাল সিকিম ভূটানে এত ঘন ঘন ভূমিকম্প হয়।

আমাদের ভূখণ্ডের পরিসীমা বা ফল্টলাইনটা এই দেশগুলোর ভেতর দিয়ে গিয়েছে। আমাদের কপাল অনেক ভালো যে সেই ফল্টলাইন খুব যত্ন করে বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে মায়ানমারের ভেতর দিয়ে নিচে নেমে গেছে। বড় ফল্টলাইনটা বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে না গেলেও উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড়, তেঁতুলিয়ার খুব কাছে দিয়ে গিয়েছে দূরত্ব পঞ্চাশ কিলোমিটার থেকে কম। তাই যখন এই ফল্ট লাইনে ভূমিকম্প হয় বাংলাদেশের অন্য জায়গা থেকে সেভাবে টের না পেলেও উত্তরবঙ্গের মানুষেরা ভালোই টের পায়। বড় ফল্টলাইন থেকে ছোট অনেক শাখা প্রশাখা বের হয়, এবং আমাদের দেশে এ রকম কিছু ফল্ট লাইন থাকতে পারে, সেখান থেকে ভূমিকম্প হতেও পারে।

ভূমিকম্পটি এমন একটি ব্যাপার যে কোথায় হবে এবং কোথায় হবে না সেটি কেউ কখনো জোর দিয়ে বলতে পারবে না। আমি গত পঁয়তাল্লিশ বছরে আমাদের দেশের কাছাকাছি যে ভূমিকম্পগুলো হয়েছে সেটি ভালো করে লক্ষ্য করেছি, ইচ্ছে করলে পাঠকেরাও এই ছবিটা দেখতে পারে।

এই ছবিটা এক নজর দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবে যে আমাদের দেশের ভেতরে ভূমিকম্প হওয়ার থেকে অনেক বেশী আশংকা আশেপাশের দেশগুলোতে ভূমিকম্প হওয়া। (তবে বিশেষজ্ঞরা অবশ্যি ভয় দেখাতে ভালোবাসেন, তারা সব সময় বলছেন, আমরা খুব ঝুঁকির মাঝে আছি! আমি বিশেষজ্ঞ নই, তাই আমার কথা বিশ্বাস করার কোনো প্রয়োজন নেই, শুধু ছবিটি এক নজর দেখলেই হবে।)

তবে যে ঝুঁকিটির কথা কেউ অস্বীকার করবে না সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের কাছাকাছি যে বড় ফল্ট লাইন আছে সেখানকার বড় বড় ভূমিকম্পগুলোর ধাক্কা সামলানো। দূরত্বের সাথে সাথে কম্পনের তীব্রতা কমে আসে। দ্বিগুণ দূরত্বে গেলে চার গুণ কম্পন কমে আসে, দশগুণ দূরত্বে গেলে একশ গুণ কম্পন কমে আসে, সেটা হচ্ছে আমাদের ভরসা। নেপালের ভূমিকম্পটি বাংলাদেশ থেকে যথেষ্ট দূরে ছিল। তারপরেও আমরা সেটা খুব ভালোভাবে টের পেয়েছি যদি এটা আরো কাছাকাছি কোথাও হত, যেমন ভূটানের দক্ষিণে কিংবা আসামে, তাহলে দেশে অনেক বড় অঘটন ঘটানোর মতো তীব্রতা হতেই পারত।

(তবে ভূমিকম্পটি থেকে দূরে সরে গেলেই যে বিপনের আশংকা কমে যায় তা নয়, ১৯৮৫ সালে মেক্সিকো সিটিতে ভূমিকম্প প্রায় ৬৪ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল, যদিও এপিসেন্টারটি ছিল প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দূরে। তবে এটি অবশ্য সেখানকার খুবই চিবিত্র এক ধরনের ভূখণ্ডের কারণে, আমি যতদূর জানি আমাদের দেশের ভূপ্রকৃতি মেক্সিকোর মতো নয়।)

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পটি হয়েছিল চিলিতে ১৯৬০ সালে। রিখটার স্কেলে সেটি ছিল বিস্ময়কর ৯.৫। সেই ভূকম্পনে প্রায় ছয় হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। দেশটি তখন রীতিমতো পরিকল্পনা করে তাদের দেশের বিল্ডিংএর নিয়ম মেনে ভূমিকম্প সহনীয়ভাবে তৈরী করতে শুরু করে। ২০১৪ সালে তাদের দেশে যখন ভয়ংকর ৮.২ মাত্রায় একটা ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে তখন তাদের দেশে মানুষ মারা গিয়েছে মাত্র ছয় জন! নিয়ম মেনে বিল্ডিং তৈরী করলে কী লাভ হয় এটি তার একটা চমৎকার উদাহরণ। এর থেকে প্রায় ষাট গুণ ছোট ৭ মাত্রায় একটা ভূমিকম্পের কারণে ২০১০ সালে হাইতিতে মানুষ মারা গিয়েছে প্রায় তিন লক্ষ। দরিদ্র দেশে নিয়ম-নীতি না মেনে মিগজ বাক্সের মতো দুর্বল বিল্ডিং তৈরী করলে তার ফলাফল কী হতে পারে এটা তার একটা খুব করুণ উদাহরণ। কাজেই ভূমিকম্প নিয়ে কেউ যদি আমাকে একটা মাত্র মন্তব্যও করতে বলে তাহলে কোনো রকম বিশেষজ্ঞ না হয়েও আমি খুব জোর গলায় বলতে পারব যে, ঘনবসতি এলাকাগুলোতে আমাদের বিল্ডিংগুলো নিয়ম নীতি মেনে তৈরী করতে হবে।

৩.

ঠিক কী কারণ জানা নেই ভূমিকম্প নিয়ে মানুষের ভেতরে এক ধরনের রহস্যময় আতংক কাজ করে। ভূমিকম্প শুরু হলেই মানুষ পাগলের মতো ছোটাছুটি শুরু করে। ২৮ এপ্রিল নেপালের ভূমিকম্পটির কারণে আমরা দেশে যে কম্পন অনুভব করেছি, সেই কম্পনে দেশের অনেক মানুষ দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছোটাছুটি করে আহত হয়েছে, কেউ কেউ মারাও গেছে।

ভূমিকম্পর খুঁটিনাটি জানার আগে আমি নিজেও একে যথেষ্ট ভয় পেতাম, এখন ভয় কমে গেছে কৌতূহল বেড়েছে অনেক বেশি। দেশের সবার অন্তত দুটি জিনিস জানা উচিৎ; একটি হচ্ছে, যখন এখানে ভূমিকম্প হয় তখন সবারই ধারণা হয় তাদের পায়ের নিচে যে মাটি সেই মাটিতে ভয়ংকর অশুভ একটা কিছু শুরু হয়েছে, এর থেকে বুঝি আর কোনো রক্ষা নেই! মূল ব্যাপারটা মোটেও সে রকম নয়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই ভূমিকম্পের কেন্দ্রটি বহু দূরে, সেখানকার ভূমিকম্পের ছোট একটা রেশ আমরা অনুভব করছি। ভয় না পেয়ে ঠাণ্ডা মাথায় এটা ঘটে যেতে দিলে কিছুক্ষণের মাঝেই থেমে যাবে।

আজকাল তথ্যপ্রযুক্তির যুগ, কিছুক্ষণের মাঝেই ভূমিকম্পটির নাড়িনক্ষত্র ইন্টারনেটে চলে আসবে। ইউএসজিএসএর একটা অসাধারণ ওয়েব সাইট রয়েছে (earthquake.u5gs.gov); সেখানে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে যে কোনো ভূমিকম্প হলেই তার তথ্য কয়েক মিনিটেই চলে আসে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইউএসজিএসএর এই ওয়েবসাই খুলে বসে থাকলে কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা যাবে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও একটা ভূমিকম্প হয়েছে। আমরা যদি নিজের চোখে দেখি, সারা পৃথিবীতে হাজার হাজার ছোট বড় ভূমিকম্প হচ্ছে এবং পৃথিবীর মানুষ এর মাঝেই শান্তিতে দিন কাটাচ্ছে। তাহলে আমার ধারণা, আমাদের এই যুক্তিহীন ভয়টা অনেক কমে আসবে। ভূমিকম্প হলে কী করা উচিৎ তার কিছু নিয়মকানুনও ঠিক করা আছে; সেগুলো জানা থাকলেও ভালো। আর কিছুু না হোক সেগুলো করার চেষ্টা করে একটু ব্যস্ত থাকা যায়।

ভূমিকম্প নিয়ে দ্বিতীয় আরেকটা বিষয় আমরা একটু চিন্তা করে দেখতে পারি। সেটি হচ্ছে এই দেশে ভূমিকম্প মারা পড়ার থেকে গাড়ী চাপা পড়ে মারা যাওয়ার আশংকা অনেক বেশী। গাড়ী চাপা পড়ে বছরে চার হাজার থেকে বেশী মানুষ মারা যায়, ভূমিকম্পের কারণে বছরে চার জন মানুষও মারা যায় কী না সন্দেহ। তারপরেও ভূমিকম্পকে আমরা অসম্ভব ভয় পাই কিন্তু গাড়ীতে উঠতে বা রাস্তায় হাঁটাচলা করতে একটুও ভয় পাই না! শুধু গাড়ী এক্সিডেন্ট নয়, বন্যা ঘুর্ণিঝড়, এমনকি বজ্রপাতেও এই দেশে অনেক মানুষ মারা যায়, সেগুলো নিয়েও আমাদের কারো ভেতরে এতটুকু ভীতি নেই কিন্তু ভূমিকম্প নিয়ে আমাদের অনেক ভয়!

এই ভয়টি যুক্তিহীন, এটাকে লালন করে মনের শান্তি নষ্ট করার কোনো অর্থ নেই। পৃথিবীর সবাই জানে লস এঞ্জেলস এলাকায় যে কোনো মুহুর্তে একটা ভয়ংকর (প্রায় আট মাত্রার ) ভূমিকম্প হবে। আমি যখন লস এঞ্জেলস এলাকায় ছিলাম প্রায় প্রতিটি মুহূর্ত সেটার জন্যে অপেক্ষা করেছি। তারপর পঁচিশ বছর প্রায় হয়ে গেছে, এখনো সেই ভূমিকম্পটি ঘটেনি। কবে ঘটবে কেউ জানে না। কাজেই ভূমিকম্পকে ভয় পেয়ে কোনো লাভ আছে?

বরং এটাকে নিয়ে গবেষণা করে অনেক লাভ আছে। আমার ছাত্রছাত্রীরা তাদের আন্ডার গ্রাজুয়েট প্রজেক্ট হিসেবে ভূমিকম্প মাপার সিসমোগ্রাফ বানিয়েছে। অনেকগুলো বানিয়ে পুরো দেশে ছড়িয়ে ছিটিতে দিয়ে আমরা ইচ্ছে করলে সারা দেশকে চোখে চোখে রাখতে পারি। আমাদের দেশের ভেতরে কোথায় কোথায় ফল্টলাইন আছে সেগুলো খুঁজে বের করতে পারি। ভূমিকম্পের আগে, ভূমিকম্প চলার সময় এবং ভূমিকম্প শেষে কী কী করতে হবে সেই বিষয়গুলো স্কুল কলেজের সব ছেলেমেয়েদের শেখাতে পারি। (সিলেট শহরের কেন্দ্রস্থলে এর উপরে বিশাল একটা বিল বোর্ড ছিল। হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা সেটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিয়েছে। কারণ সেই বিলবোর্ডটিতে আমার একটা বিশাল ছবি ছিল।)

এই দেশে ভূমিকম্প নিয়ে অনেক গবেষণা করা সম্ভব, সত্যি কথা বলতে কী, কোনো রকম যন্ত্রপাতি ছাড়াই সিলেটে আমার ঘরে বসে একবার আমি খুব চমকপ্রদ একটা এক্সপেরিমেন্ট করে ফেলেছিলাম। পদ্ধতিটা জানা থাকলে অন্যেরাও সেটা চেষ্টা করে দেখতে পারে।

ভূমিকম্প হলে তার কেন্দ্র থেকে দুই ধরনের তরঙ্গ বের হয়। একটা তরঙ্গ শব্দের মতো, মাটির ভেতর দিয়ে সেটা দ্রুত চলে আসে, এটার নাম প্রাইমারী বা সংক্ষেপে পিওয়েভ। দ্বিতীয়টি হচ্ছে সেকেন্ডারী বা এসওয়েভ, এটা হচ্ছে সত্যিকারের কাঁপুনি যেটা আমরা অনুভব করি। এর গতিবেগ পিওয়েভ থেকে সেকেন্ডে প্রায় দশ কিলোমিটার কম।

কাজেই দূরে যদি কোথাও ভূমিকম্প হয় তাহলে প্রথমে পিওয়েভ এসে একটা ছোট ধাক্কা দেয় এবং সেকেন্ডে প্রায় দশ কিলোমিটার পিছিয়ে থাকা এস ওয়েভ একটু পরে এসে ঝাকাঝাকি কাঁপাকাপি শুরু করে দেয়। কাজেই পিওয়েভ আসার কতো সেকেন্ড পর এসওয়েভ এসে আসল ঝাঁকুনি শুরু করে সেটা জানলেই আমরা ভূমিকম্পের কেন্দ্রটি কতদূরে সেটা বের করে ফেলতে পারি। যত সেকেন্ড পার্থক্য তাকে দশ দিয়ে গুণ করলেই দুরত্ব বের হয়ে যায়।

আমি একদিন আমার অভ্যাস অনুযায়ী মেঝেতে বসে সোফায় হেলান দিয়ে কাজ করছি, হঠাৎ একটা ছোট ঝাঁকুনি টের পেলাম। আমার মনে হল এটা সম্ভবত কোনো একটা ভূমিকম্পের পিওয়েভ। আমি সাথে সাথে ঘড়ি দেখা শুরু করলাম। প্রায় তিরিশ সেকেন্ড পার হবার পর যখন কিছুই হচ্ছে না এবং আমি প্রায় হাল ছেলে দিয়েছি তখন হঠাৎ করে এসওয়েব এসে মূল ভূমিকম্প শুরু করে দিল। যখন আশেপাশের ফ্ল্যাটের মানুষজন আতংকে চিৎকার করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নামছে, তখন আমি ঘরের ভেতরে বসে আনন্দে চিৎকার করে বলছি, 'কোনো ভয় নেই! এই ভূমিকম্পের এপিসেন্টার তিনশ কিলোমিটার দূরে।"

বলাই বাহুল্য, নিজের আবিষ্কারে আমি নিজেই মোহিত।

ভূমিকম্প নিয়ে এখনো অনেক রহস্য অজানা। ভয় পেয়ে সেই রহস্যকে দূরে সরিয়ে না রেখে সবাই মিলে তার রহস্য ভেদ করাটাই কি বেশী অর্থপূর্ণ কাজ নয়? বাংলাদেশের মানুষ সব রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামলে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পারে, এই ভূমিকম্পকে কেন শুধু শুধু ভয় পাব? প্রয়োজনে অবশ্যই আমরা এর মুখোমুখি হতে পারব।