শ্রমঅভিবাসন: সংখ্যার চেয়ে মানসম্মত উদ্যোগ জরুরি

ফরহাদ আল করিম
Published : 1 May 2015, 12:17 PM
Updated : 1 May 2015, 12:17 PM

>সরকারি তথ্যমতে, ২০০৮ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ডসংখ্যক শ্রমিক, আনুমানিক প্রায় ৯ লাখ, কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে গেছেন। কিন্তু সে তুলনায় ২০১৪ সালে মাত্র ৩ লাখ ৭৮ হাজার শ্রমঅভিবাসন হয়েছে। বিদেশে শ্রমিকের কর্মসংস্থান নিয়ে ভাবা জরুরি। কারণ তাদের পাঠানো রেমিটেন্স দেশের জন্য বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাঝে সুখবরটি হল, শ্রমিক অভিবাসন কমে গেলেও সর্বশেষ অর্থবছরে আমরা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ পরিমাণ রেমিটেন্স আহরণ করেছি।

নানা কারণে গত কয়েক বছর আমাদের শ্রমঅভিবাসনে বেশ ভাটা পড়েছে। তবে চলতি বছরে এ সূচক উর্ধ্বমুখী হতে পারে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে আমরা সবাই জেনে গেছি যে, প্রায় ৭ বছর পর এ বছরের শুরুতে সউদি আরবে শ্রমিক পাঠানো নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চুক্তি সই করে ওই দেশের সরকার। চুক্তি অনুসারে নারী ও পুরুষ শ্রমিক পাঠানোর কথা। তবে প্রাথমিক ধাপে গৃহস্থাালির কাজের ভিসায় নারী শ্রমিকরা এখন সউদি আরবে যাওয়ার প্রয়োজনীয় প্রস্ততি নিচ্ছেন। অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, এ চুক্তির ফলে আমাদের সবচেয়ে বড় এই শ্রমবাজারে অতীতের মতো প্রচুর সংখ্যক শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হতে পারে।

ওদিকে, ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ কাতারে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বলে দেশটিতে স্টেডিয়ামসহ অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শুরু হয়ে গেছে। ওখানকার বেশিরভাগ নির্মাণকাজ প্রবাসী শ্রমনির্ভর। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, সেখানেও আমাদের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হল। সরকারের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে যে, তারা ইতোমধ্যে কাতারে শ্রমিক পাঠানো নিয়ে একটি চাহিদাপত্র পেয়েছেন। আশা করা যাচ্ছে, খুব শিগগির আমাদের শ্রমিকদের বিশাল একটি অংশ কাতারের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাবেন। এছাড়া বিভিন্ন সরকারি সূত্রে জানা গেছে, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শ্রমিক গ্রহণকারী দেশেও জনশক্তি পাঠানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা চলছে।

শ্রমিকদের অধিক হারে অভিবাসনের বিষযটি সরকারি প্রচারযন্ত্রে তাদের কূটনৈতিক সফলতা হিসেবে দেখানোর প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। আবার এ হার কমতে থাকলে অন্যরা বিষয়টি সরকারি ব্যর্থতা হিসেবে দেখতে চান। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দাজনিত কারণে বিদেশে শ্রমিকের চাহিদা না থাকা, কোম্পানিতে ছাঁটাই বা কাজের চুক্তির মেয়াদ শেষে শ্রমিকদের একটি সময় দেশে ফিরে আসা ইত্যাদি বাস্তবতা আমলে নিতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে, শুধুমাত্র যুদ্ধের কারণে ২০১১ সালের শুরুতে কোনো নোটিশ ছাড়া প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক লিবিয়া থেকে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন। তবে এটিও ঠিক যে, সময়োপযোগী সরকারি উদ্যোগ ও কার্যকরী শ্রমব্যবস্থাপনা অধিক সংখ্যক শ্রমিকের বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে ইতিবাচক প্রভাব রাখবে।

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা ও তথাকথিত আরব বসন্তের কারণে হঠাৎ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অভিবাসন কমে যায়। কিন্তু কোথাও কোথাও আমাদের নিজদের সৃষ্ট কারণও এ জন্য দায়ী। শ্রমিকদের অন্যায় কর্মকাণ্ড ও অপেশাদার আচরণের কারণে মাঝে মাঝে তাদের ফেরত পাঠানো হয়। এর বড় উদাহরণ মালয়েশিয়া। সেখানে শ্রমিক প্রেরণে অনিয়ম ও বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিভিন্ন অন্যায় আচরণের কারণে অসংখ্য শ্রমিককে বিভিন্ন সময়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে সীমিত সংখ্যক শ্রমিক নতুনভাবে মালয়েশিয়াতে যাচ্ছেন। তবে তাদের জন্য দেশটির সরকার বেশকিছু কড়াকড়ি নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন।

আরেকটি বাস্তবতা হল, আমাদের দেশের শ্রমিকদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরিকল্পিতভাবে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। অনেকে লাভ-ক্ষতি বিশ্লেষণ না করে বিদেশে যেতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। ফলে দালালের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হয়ে ভিটেবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হন। পর্যাপ্ত তথ্য জেনে সঠিক প্রস্তুতি গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঙ্গে নিয়ে বৈধ মাধ্যমে বিদেশে গেলে সফলকাম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

শ্রম অভিবাসন নিয়ে কাজ করে এমন একটি বেসরকারি সংস্থার পরিচালিত জরিপে দেখা যায় যে, আমাদের দেশ থেকে বিদেশ যেতে গিয়ে প্রতি চার জনের একজন প্রতারিত হন। তাছাড়া গ্রাম পর্যায়ে বিদেশগমন বিষয়ক সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও তথ্যপ্রবাহের ঘাটতিও তাদের নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের আলসেমি ও অব্যবস্থাপনাও শ্রমিকের বিদেশে যাওয়ার পথে বাধার দেয়াল তৈরি করে। আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাবে দালালদের মিথ্যা প্রলোভনে পড়ে সরল বিদেশগামীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সম্ভাব্য শ্রমবাজারের খোঁজ সম্পর্কে সরকারের অতীতের উদাসীনতাও শ্রমঅভিবাসন এক প্রকার রুদ্ধ করে রেখেছিল।

বাংলাদেশের মতো অধিক জনসম্পদের দেশের নাগরিকদের জন্য বিদেশে কর্মস্থান যেমন ভালো একটি সুযোগ, তার চেয়ে বেশি জরুরি হল নিয়ম মেনে প্রয়োজনীয় প্রস্ততি নিয়ে বৈধপথে বিদেশে পাঠানো। এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে যে, সঠিক নিয়মে শ্রমিকরা বিদেশে গেলে যেমন সকল প্রকার হয়রানি থেকে রেহাই পেতে পারেন, তেমনি তাদের আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ব্যতিক্রম হলে পদে পদে নির্যাতন, অসম্মান, আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও কখনও কখনও হত্যার শিকার বা মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়। সম্প্রতি মানবপাচারকারীর খপ্পরে পড়ে কক্সবাজার থেকে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় মুক্তিপণ দিয়ে পৌঁছানো এবং নৌকাডুবিতে নিরীহ শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা আমরা সবাই জানি।

যেহেতু বর্তমানে নারী-পুরুষভেদে বিভিন্ন পেশায় বিদেশে শ্রমিকের নতুন নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে, তাই বিষয়টি সামনে নিয়ে পূর্বপ্রস্তুতি রাখা বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ দেবে। বর্তমানে যে যে ধরনের চাহিদা তৈরি হচ্ছে সে বিষয়ে পূর্বানুমান করে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা গেলে যে কোনো শ্রমিক প্রেরণকারী দেশ লাভবান হতে পারে। বিদেশে চাহিদা রয়েছে এমন কাজের উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশে গেলে শ্রমিকের পক্ষে মানসম্মত চাকরি ও ভালো বেতনের সুযোগ থেকে যায়।

সরকার বিদেশগামীদের দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে 'জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো'এর অধীনে দেশে বেশ কিছু কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছেন। নামমাত্র খরচে পরিচালিত এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বছরে আনুমানিক প্রায় দেড় লাখ প্রশিক্ষণার্থী বিভিন্ন ট্রেডে কোর্স সম্পন্ন করতে পারেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের খেয়াল রাখা উচিত যে, এসব প্রশিক্ষণে সার্টিফিকেট প্রদানের চেয়ে কোর্সের গুণগতমান রক্ষার প্রতি জোর দেওয়া দরকার। তাহলে প্রশিক্ষণ শেষে বিদেশে যেতে না পারলেও প্রশিক্ষণার্থীরা দেশে স্বকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবেন।

কাজের দক্ষতা অর্জন ছাড়াও বিদেশি ভাষাজ্ঞান থাকা জরুরি। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধুমাত্র গন্তব্য দেশের ভাষা না জানার কারণে যে কোনো বিপদ বা নির্যাতনের ঘটনায় শ্রমিক সাহায্য চাইতে পারেন না। তাছাড়া জীবন দক্ষতার প্রশিক্ষণ থাকলে নারী শ্রমিকরা আত্মরক্ষা ও পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেন।

বিভিন্ন সময় দেখা যায়, বিদেশি কোম্পানির ডেলিগেটরা সরাসরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের শিক্ষার্থীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন। সরকারের একমাত্র রিক্রুটিং এজেন্সি বোয়েসেলও প্রশিক্ষণার্থীদের সরাসরি বিদেশে যেতে ভিসা দিয়ে সহযোগিতা করে। আগে খোঁজ নিয়ে সব সময় সরকারের তালিকাভুক্ত বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। বর্তমানে অবশ্য বেশকিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিরাপদে বিদেশ যাওয়া বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা দিচ্ছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২ মিলিয়নের বেশি শ্রমশক্তি বাজারে যুক্ত হচ্ছে যা উদ্বেগজনক। এদের মাত্র ২ থেকে ৩ লাখের জন্য মানসম্মত অভ্যন্তরীন সুযোগ থাকলেও বাকি বিপুলসংখ্যকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সরকার দিতে পারে না। তবে প্রতি বছর যে সংখ্যক জনশক্তি কাজের উদ্দেশে বিদেশে যাচ্ছেন সেটি দেশের মোট অভ্যন্তরীন কর্মসংস্থানের ২ থেকে ৩ গুণ।

সুখবর হল, সরকার ইতোমধ্যে 'জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি-২০১১' প্রণয়ন করেছেন। যেহেতু বিদেশে নতুন নতুন কাজের সুযোগ আবার তৈরি হতে হচ্ছে, তাই এখনই প্রয়োজন চাহিদা অনুযায়ী মানবসম্পদ উন্নয়নে সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন। সরকার যদি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়মিত যোগাযোগ ও পর্যবেক্ষণ করে নতুন নতুন শ্রমবাজার খোঁজার প্রতি জোর দেয়, তাহলে দক্ষ র বিদেশে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। তবে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর জন্য যে কোনো নতুন চুক্তি করার আগে সরকারের উচিত শ্রমিকের মানবাধিকারের খুঁটিনাটি ভালো করে ভেবে দেখা।

বিদেশে শ্রমিক পাঠালেই দায়ভার শেষ হয়ে যায় না। সকল অভিবাসী শ্রমিকের মর্যাদা, নিরাপত্তা ও স্বার্থরক্ষার প্রতি সব সময় নজর দেওয়া জরুরি। বিশেষ করে বিদেশস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস ও লেবার উইংগুলো আরও আন্তরিক হয়ে সেবার হাত প্রসারিত করতে পারে। তাছাড়া তৃণমূল পর্যায়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দপ্তর ও লোকবল বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিলে দেশের সকল প্রান্তের আগ্রহী বিদেশগামী সমান সুযোগ পাবেন।

নানাবিধ সরকারি প্রচারণা সত্ত্বেও দেশ থেকে মাত্র তিন হাজারের মতো আগ্রহী নারী সউদি আরবে যেতে নাম নিবন্ধন করেছেন। একে সরকারি ব্যর্থতা বলে মনে করেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। আন্তর্জাতিক শ্রম বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিদেশের কর্মক্ষেত্রে নারীদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব, শ্রম শোষণ ও প্রস্তাবিত ভিসায় বেতনের অংক কম হওয়ার কারণে গৃহীত এ সরকারি উদ্যোগে নারীদের মধ্যে তেমন সাড়া নেই।

সার্বিক পরিস্থিতি যাই হোক, আমরা চাই দেশের সকল কর্মক্ষম শ্রমিক নিজ যোগ্যতায় অধিক হারে বিদেশে গিয়ে মর্যাদাকর কর্মসংস্থানে নিজেকে সম্পৃক্ত করবেন, অর্থ পাঠিয়ে দেশকে সমৃদ্ধ করবেন। তবে কোনোভাবেই যেন প্রক্রিয়াটি তার জন্য অলাভজনক ও অনিরাপদ উপায়ে না ঘটে সেটি দেখার দায়িত্ব সকলের। মনে রাখতে হবে, সংখ্যার চেয়ে গুণগতমান রক্ষা বেশি জরুরি, যেখানে বিদেশে দেশের ভাবমূর্তিসহ শ্রমিকের অধিকার, মর্যাদা ও সমৃদ্ধির বিষয়টি বরাবরই জড়িত।