সিটি করপোরেশন নির্বাচন: প্রতিবন্ধী মানুষের স্বপ্ন-বঞ্চনা

সাবরিনা সুলতানাসাবরিনা সুলতানা
Published : 27 April 2015, 06:17 PM
Updated : 27 April 2015, 06:17 PM

বিভিন্ন মতবিনিময় সভা-সমাবেশে সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘিরে নিজ নিজ নগরী নিয়ে প্রত্যেকেই যখন স্বপ্নে মাতোয়ারা, তখন প্রতিবন্ধী মানুষেরাও স্বপ্ন দেখেছেন তাদের বাসযোগ্য ব্যবস্থাগুলো নির্মাণে নবনির্বাচিত নগরপিতার দায়িত্বে ঘাটতি থাকবে না। ভোট দিতে যাবেন, কাকে নির্বাচিত করবেন, কেমন হবে স্বপ্নের শহর এই সব ভাবনায় বিভোর আর সবার মতো তারাও। ধাক্কাটা তখনই এল যখন জানা গেল, বেশিরভাগ ভোট কেন্দ্র দোতলায় বা তিনতলায় এবং রূঢ় বাস্তবতা হল সেখানে লিফটের ব্যবস্থা নেই। যারা হুইলচেয়ার বা ক্র্যাচ ব্যবহার করেন সেই সব মানুষের মাথায় হাত।

যার সঙ্গেই যোগাযোগ হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি, সকল ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষেরাই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী। কিন্তু বেশিরভাগের অভিযোগ, মাঝারি থেকে গুরুতর মাত্রার প্রতিবন্ধী মানুষেরা যারা 'অ্যাসিস্টিভ ডিভাইস' বা সহায়ক উপকরণের সাহায্যে চলাফেরা করেন তাদের ভোট প্রদানের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের আলাদা ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন ছিল। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির নাগরিক সংগঠনের পরিষদ (পিএনএসপি) নামের একটি নেটওয়ার্ক সংস্থা প্রতিবন্ধী মানুষের অভিযোগের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন অফিসে ফোনে এবং পরবর্তীতে লিখিতভাবে চিঠি দিয়ে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু নির্বাচনে শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ভোটাররা কীভাবে ভোট দেবেন এ বিষয়ে উদ্যোগ বা আলাদা করে তাদের নিচতলায় ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা এ বিষয়ে সদুত্তর দেননি কর্তৃপক্ষ।

ভোট কেন্দ্রে স্থান সঙ্কুলান আছে তা আমরা জানি, কিন্তু সেখানে নিচতলায় এই মানুষদের ভোট গ্রহণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা দরকার বলে মনে করছি। পাশাপাশি বলব, প্রতিবন্ধী মানুষেরও উচিত হবে দোতলা বা তিন তলায় ভোট কেন্দ্র জেনে পিছিয়ে যাবার পরিবর্তে কেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোটাধিকারের বিষয়ে জানান দিতে, যেহেতু ভোট প্রদান প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার।

এবারের ব্যবস্থাটি এখনও অস্পষ্ট হলেও আগামীতে প্রতিবন্ধী মানুষদের ভোটাধিকার ক্ষুণ্ন না করতে নির্বাচনকালীন কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। কথা হচ্ছিল মেজর মোহাম্মদ জহিরুল ইসলামের সঙ্গে যিনি ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের তত্বাবধায়নে পরিচালিত জর্জিয়ার অবজার্ভ মিশনে দায়িত্বপালনকালে ক্রমাগত ব্রাশ ফায়ার ও গ্রেনেড হামলার কবলে পড়ে স্পাইনাল কর্ড ইনজুরির শিকার হন। একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী হিসেবে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক যথাযথ ভোটপদ্ধতি গ্রহণে একটি নীতিমালা দ্রুত প্রণয়নের জন্য অনুরোধ জানান তিনি যা তার অনুমতিসাপেক্ষে তুলে ধরছি:

ক. ভোট কেন্দ্রে প্রতিবন্ধী মানুষের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে প্রতিবন্ধী ভোটারদের বহনকারী যানবাহন চলাচলের অনুমতি প্রদান।

খ. ভোটের দিন প্রতিবন্ধী ভোটারদের আলাদা সারির ব্যবস্থাকরণ, যাতে তারা স্বল্প সময়ে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে ভোট দিতে পারেন।

গ. ভোট কেন্দ্রে প্রতিবন্ধী মানুষদের বিশেষত শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য নিচতলায় বিশেষ বুথ স্থাপনের ব্যবস্থাকরণ এবং তাদের সুবিধার্থে ভোট কেন্দ্রে র‌্যাম্প স্থাপন।

ঘ. দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ব্রেইল বা ট্রেইল ব্যালট পেপারের ব্যবস্থাকরণ এবং তাদের পছন্দমতো সহযোগী নেওয়ার অনুমতি প্রদান।

ঙ. গুরুতর মাত্রার প্রতিবন্ধী ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভোট প্রদানের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ।

চ. নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে ভোটের দিন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ।

ছ. ভোটের দিন নির্বাচন কেন্দ্রের সহিংসতা থেকে রক্ষায় নিরাপত্তা প্রদানের ব্যবস্থাকরণ।

জ. প্রতিটি কেন্দ্রে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক ব্যানার, পোস্টার সর্বসাধারনের জন্য টানানোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সেখানে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালানো।

ঝ. প্রতিটি কেন্দ্রের পোলিং অফিসার তথা রিটার্নিং অফিসারকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণকে ভোট প্রদানে সার্বিক সহায়তা প্রদানের জন্য বিশেষ নির্দেশনা প্রদান।

এবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী সম্ভাব্য নগরপিতাদের উদ্দেশে কিছু বলতে চাই। দেশে হাজারো সমস্যা রয়েছে যা রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইস্যু হয় এবং তা উত্তরণে তারা কাজ করে যান। এই হাজারো সমস্যার মাঝে প্রতিবন্ধী মানুষের সহায়ক চাহিদাসম্পন্ন এই ব্যবস্থাগুলো খুব কি অবাস্তব ভেবে উড়িয়ে দেবেন ভাবছেন?

বাস্তবতা আসলেই ভিন্ন। আপনি হয়তো তাদের কথা খুব কমই জানেন। কারণ তাদের কাছ থেকে দেখার সুযোগ আপনার হয় না। তাদের চলার পথটুকু মসৃণ করার পরিবর্তে চার দেয়ালের গণ্ডিতে তাদের বন্দি রাখতেই অভ্যস্ত এ সমাজ। কিন্তু ষোল কোটি মানুষের এ দেশে প্রায় দুই থেকে আড়াই কোটি মানুষ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধিতার সম্মুখীন। তারা এ দেশেই রয়েছেন, নাগরিক অধিকারবঞ্চিত হবার দরুন অনেকটা সমাজবিচ্ছিন্নও তারা। আপনার জন্য যা অবাস্তব তা বিপুল এই জনগোষ্ঠীর জীবনের নির্মম এক দুঃস্বপ্ন। কারণ তাদের নাগরিক অধিকারগুলো পদে পদে হয় বঞ্চিত, অবহেলিত। অন্ধকারাচ্ছন্ন কালকুঠুরিতে আবদ্ধ তাদের স্বপ্নগুলো ধূলিসাৎ হয় শুধুমাত্র সমাজের এই অবজ্ঞামূলক মনোভাবের কারণেই।

আমার প্রশ্ন, সিঁড়ি যদি হয় আপনার অধিকার, তবে কেন র‌্যাম্প, ব্রেইল ও ইশারা ভাষা ইত্যাদি বিভিন্ন চাহিদার কথা আলাদা করে বলতে হচ্ছে? প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাহিদাগুলো পূরণ করা হলে তারাও সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন। কিন্তু নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বড় বড় ফাইলে লাল ফিতায় বাক্সবন্দি হয়ে আছে তাদের চাহিদা। আর নির্বাচনী ইশতেহার বা রাজনৈতিক ইস্যুতেও বিপুল এই জনগোষ্ঠীর সমস্যা নিয়ে আলোচনা নেই তেমন। দুঃখজনক সত্য, দেশের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এইসব সমস্যা প্রাধান্য পায়নি এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারণাতেও।

কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোকে জানতে হবে, জানাতেও হবে তাদের, আমাদের এই দাবি এবং চাহিদাগুলোর কথা। একজন নগরপিতার কাছে প্রতিবন্ধী মানুষ হিসেবে আমরা প্রধানত যা চাই:

ক. সিটি করপোরেশনের সকল উন্নয়ন পরিকল্পনায় (সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পরিবীক্ষণ ও পর্যালোচনা) প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব ব্যবস্থা নেওয়া এবং তাদের সম্পৃক্ত করেই কাজ করার পাশাপাশি তা বাস্তবায়নের সময় এ বিষয়ে কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

খ. প্রতিবন্ধী নাগরিকদের জন্য র‌্যাম্পযুক্ত গণপরিবহন চালু হলে যারা চার দেয়ালে আবদ্ধ হয়ে আছেন তাদের চলাচল আরও বৃদ্ধি পাবে। আমাদের দেশের হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী মানুষের কাছে র‌্যাম্পযুক্ত কিছু বাসের চাহিদা ভীষণ রকমের।

গ. জাতীয় ইমারত বিধিমালা আইন ২০০৮এর সর্বজনীন প্রবেশগম্যতা অংশটি মাথায় রেখে সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন সকল বাস টার্মিনাল, স্থাপনা বা ভবনসমূহ করতে হবে।

ঘ. প্রতিবন্ধী নাগরিকদের জন্য সমান্তরাল ফুটপাত দরকার। তাতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের জন্য ল্যান্ডমার্ক দিতে হবে এবং ফুটপাতের শুরু ও শেষে (ইমারত বিধি আইন অনুযায়ী) ১২ ইঞ্চির জন্য ১ ইঞ্চি অনুপাতে ঢাল দিতে হবে যেন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীরা নির্বিঘ্নে ফুটপাতের ওপর দিয়ে চলাচল করতে পারেন।

ঙ. সিটি কর্পোরেশেনের সকল উন্নয়ন বাজেটে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখা অত্যন্ত জরুরি। সকল গণটয়লেট প্রতিবন্ধী নাগরিকের প্রবেশোপযোগী করে তৈরি বা সংস্কার করা প্রয়োজন।

চ. মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একীভূত শিক্ষা নিশ্চিত করা দরকার।

ছ. প্রতিবন্ধী নাগরিকদের দ্বারা পরিচালিত সংগঠনগুলোকে (ডিপিও) সহজ উপায়ে সরাসরি অনুদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

জ. নারী প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণসহ ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে।

চ. সর্বোপরি সিটি কর্পোরেশেন এলাকাগুলোকে প্রতিবন্ধী নাগরিকদের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে।

আরও অনেক কিছু জানানোর আছে। আশা করি, নতুন নগরপিতারা এবং রাজনৈতিক দলগুলো এই চাহিদা পূরণে নিশ্চয়ই কাজ করবেন এবং প্রতিবন্ধী মানুষকে তাদের দ্বারা পরিচালিত সংগঠনগুলোতে সম্পৃক্ত করে নিবেন। যা খুব কঠিন কিছু নয়, অথচ যার বাস্তবায়ন হলে প্রতিবন্ধী মানুষেরা নির্বিঘ্নে বাধাহীনভাবে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় মুক্ত চলাচলের স্বাধীনতা পাবেন। ইচ্ছের ডানা মেলে র‌্যাম্পযুক্ত যানবাহনে বেড়িয়ে পড়বেন যেখানে সেখানে। তাদের জন্য থাকবে নির্দিষ্ট থামার জায়গা। দুপাশের ফুটপাত হবে ঢালু। শিক্ষালয়ে থাকবে তাদের উপযোগী পরিবেশ।

আমাদের নগরপিতারাও যদি বিশ্বাস করেন যে, প্রতিবন্ধিতার সম্মুখীন বিশাল জনগোষ্ঠীর মাঝে রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা, তাহলে তাদের নিয়ে কাজ করতে গেলে কেউ আর বলবে না যে, সিটি করপোরেশন প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ করেনি।


সাবরিনা সুলতানা:
সভাপতি, বি-স্ক্যান।