দুঃশাসন, ভুভুজেলা ও বৈশাখে নারীনিগ্রহ

Published : 18 July 2011, 09:19 AM
Updated : 23 April 2015, 07:30 AM

মহাভারতে পড়েছি দুর্যোধনের প্ররোচনায় দুঃশাসন যখন প্রকাশ্য সভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করছিল, তখন কর্ণ ও শকুনি তাকে উৎসাহ দিচ্ছিল এবং অধোবদনে নিশ্চেষ্ট বসেছিলেন ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্যর মতো প্রবীণ বীরপুরুষেরা। সেই সভায় উপস্থিত কেউ এগিয়ে আসেননি দ্রৌপদীকে রক্ষা করতে। বিপন্ন নারীর আকুতিতে বা আর্তনাদে কোনো বীরপুরুষের পৌরুষ জেগে ওঠেনি। সকলেই যেন অসহায়ভাবে দৃশ্য্যটি দেখছিলেন। দ্রৌপদীকে সমর্থন করেছিলেন একমাত্র বালক বিকর্ণ। আর শ্রীকৃষ্ণ রক্ষা করেছিলেন তাকে চরম লাঞ্ছনা থেকে। মহাভারতের যুগ থেকে আমরা এখন পৌছেছি একুশ শতকে। কিন্তু বিকৃত রুচির দুঃশাসনদের প্রবৃত্তির খুব একটা রদবদল ঘটেনি। পহেলা বৈশাখের দিনে আবার যেন সে নাটকেরই পুনরাভিনয় হল।

পহেলা বৈশাখ আমাদের সবচেয়ে বড় জাতীয় উৎসব। এ দিনে ধর্মসম্প্রদায়নির্বিশেষে এদেশের জনগোষ্ঠী মেতে ওঠে আনন্দে। একমাত্র এই একটি উৎসবে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, পাহাড়ি, সমতলবাসী, বাঙালি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির মানুষরা মিলতে পারে এক রঙে। এমন একটি পবিত্র দিনে যে কুৎসিত ঘটনাগুলো ঘটল তা কলংকজনক। একদল নরপিশাচ ভিড়ের সুযোগ নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে নারীদের নিপীড়ন করার পৈশাচিক উল্লাসে মেতেছিল। এটি কোনোভাবেই আকস্মিক বা নিছক বিকৃতি নয়। একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে, পহেলা বৈশাখের উৎসবকে নারীর এবং সকলের জন্যই ভীতিকর করে তোলার জন্য এ অপরাধ ঘটানো হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ। এত বড় একটি জনসমাগম যেখানে হচ্ছে সেখানে পুলিশ সতর্ক ছিল না কেন? তারা কি ভাবেনি যে এমন ঘটনা ঘটতে পারে? নাকি তারা নারীর নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তাই করেনি? এমনকি ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি লিটন নন্দী এবং অন্য কয়েকজন কর্মী যখন এক-দুজনকে ধরে পুলিশের কাছে দিলেন, তখনও তাদের ছেড়ে দেওয়া হল কেন? শুধু তাই নয়, পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এমন কোনো গুরুতর ঘটনা ঘটেনি। প্রশ্ন করতে চাই, নারী আর কতটুকু নিগৃহিত হলে সেটা গুরুত্ব পাবে? পুলিশ কি আশা করেছিল সেখানে ধর্ষণ ঘটবে? পহেলা বৈশাখের আগে পুলিশের তরফ থেকে এত যে তিন স্তর, চার স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তা বলয়ের গল্প শোনানো হল, কাজের বেলায় তার তো কিছুই দেখা গেল না।

অপরাধ সংঘটনের পর সপ্তাহ পার হয়ে গেল। তবু একজন অপরাধীও ধরা পড়ল না সেটাই-বা কেমন কথা? ভিডিও ফুটেজ দেখে কি কাউকেই শনাক্ত করা গেল না? এই পিশাচগুলো তো মঙ্গলগ্রহ থেকে আসেনি। এরা সমাজের ভিতরেই বাস করে। এদের চেনা-পরিচিত, আত্মীয়-স্বজন প্রত্যেকের কাছে খোঁজ করা কি পুলিশের পক্ষে এতই অসম্ভব? পাড়া-মহল্লায় যদি এদের ছবি দিয়ে পোস্টারিং করা হয়, প্রতিটি থানায় এদের ছবি দিয়ে খুঁজে বের করতে বলা হয় তাহলে এদের চেনা বা গ্রেপ্তার করা যাবে না কেন?

আসল কথা হল, পুলিশ বা সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল ঘটনাটি কতখানি গুরুত্ববহ মনে করছে। তাদের কি মনে হয়েছে যে, এত বড় জনসমাগম, এখানে তো নারীনিগ্রহের ঘটনা ঘটবেই, এটা আর এমন কী দোষের হল? বিকৃত রুচির মানুষ কিন্তু সব দেশেই কমবেশি রয়েছে। পাশ্চাত্যেও কখনও সখনও এমন ঘটনা ঘটে। কিন্তু সেসব দেশে এসব ঘটার পর অপরাধী শনাক্ত করার জন্য তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। টি আই প্যারেড, আইডি ম্যাচিং, পোস্টারিং, টিভি অ্যানাউন্সমেন্টসহ সম্ভবপর সব উপায়ে তাদের খুঁজে বের করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, একবার এ ধরনের অপরাধে দণ্ডিত হলে বা গ্রেপ্তার হলে পুলিশের খাতায় তার নাম উঠে যায়। ফলে সেই ব্যক্তি আর কখনও কোনো চাকরি পায় না, তার জীবন বরবাদ হয়ে যায়।

বাংলাদেশে যদি সত্যিকারভাবে আইনের শাসন থাকত তাহলে এমন কাজ করার কথা এই বিকৃত লোকগুলো চিন্তাই করতে পারত না। এই অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রয়োজন। কারণ এ ধরনের অপরাধ সমাজের অনেক মানুষকে একসঙ্গে আহত করে, সমাজে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে এবং জাতি হিসেবে আমাদের সম্মান ক্ষুণ্ন করে। এ ধরনের অপরাধ করে যদি অপরাধী ধরা না পড়ে বা রেহাই পেয়ে যায় কিংবা ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে যায় তাহলে বিকৃতমনষ্ক অন্য মানুষরাও এই অপরাধ করতে উৎসাহিত হয়। ধরা না পড়লে অপরাধী যেমন বিকৃত আনন্দ অনুভব করে, তেমনি আরও সম্ভাব্য অপরাধীর জন্ম হয়। তারা ভাবে, 'কই, কিছুই তো হল না'।

এমন ঘটনায় ভিকটিম যেমন হতাশায় আক্রান্ত হয়, তেমনি অন্য সাধারণ মানুষও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। সে কারণেই এসব অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন যাতে অন্য কোনো লোক আর এই অপরাধ করতে সাহসী না হয় এবং জনমনে আইনের শাসনের প্রতি আস্থা সৃষ্টি হয়।

অনলাইনগুলোতে যে সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে তার নিচের কমেন্ট আমি বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মন্তব্যকারী বলেছে 'নারীরা কেন অশালীন পোশাক পরে বা এইভাবে ঘুরে বেড়ায়' ইত্যাদি। যারা এমন মন্তব্য করতে পারে, ভিড়ের মধ্যে অনুকূল পরিবেশে এরাও কিন্তু একেকজন হিংস্র পিশাচ হয়ে উঠতে পারে। এমন ভয়াবহ মনোবৃত্তি নিয়ে এক শ্রেণির তরুণ বড় হচ্ছে; টাইম বোমার মতোই বিপজ্জনক এরা। এরা মনে মনে প্রত্যেকেই অপরাধী। সময় সুযোগ পেলে এরাও নারীনিগ্রহ করতে পিছপা হবে না। এরা এমন এক পরিবেশে ও পরিবারে বেড়ে ওঠে যেখানে মনে করা হয় নারী কেন সন্ধ্যার পর বের হবে, নারী কেন উৎসবে সবার সঙ্গে অংশ নেবে? নারী থাকবে ঘরের ভিতর। যে নারীরা ঘরের বাইরে বের হয়েছে তাদের নিগ্রহ করা জায়েজ!

লিটন নন্দী এবং কয়েকজনের কথায় জানা যায় এই ঘটনাগুলো ঘটানোর সময় অপরাধীরা ভুভুজেলা বাজাচ্ছিল যার আওয়াজে নারীদের আর্তনাদ চাপা পড়ে যায়। পহেলা বৈশাখের দিন সকাল থেকেই দেখা গেছে ভুভুজেলার দৌরাত্ম্য। বিশেষ করে একশ্রেণির বখাটে এই যন্ত্রটি বাজাচ্ছিল। আমি বাংলা একাডেমির মেলায় এবং দোয়েল চত্বর থেকে শাহবাগ পর্যন্ত সমস্ত পথ লক্ষ করেছি যখনি কোনো মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে বখাটেরা ভুভুজেলা বাজাচ্ছে। এই বিরক্তিকর শব্দকারী যন্ত্রটি নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। এটি শব্দদূষণ ঘটাচ্ছে প্রবলভাবে।

আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, নারীনিগ্রহের ঘটনা যখন ঘটছিল তখন পুরো পথ ছিল লোকে লোকারণ্য। সেখানে উপস্থিত নারী-পুরুষরা যদি একযোগে প্রতিরোধে এগিয়ে আসতেন তাহলে অপরাধীরা পালাতে পথ পেত না। আর মহাভারতের দ্রোনাচার্যের মতো সে সময় নিশ্চেষ্ট না থেকে প্রক্টর ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি ঘটনা জেনে ত্বরিৎ ব্যবস্থা নিতেন বা পুলিশের সহযোগিতা চাইতেন তবে আমাদের আস্থার জায়গাটি বিনষ্ট হত না। শ্রদ্ধা জানাই লিটন নন্দীকে। তার মতো মানুষ আমাদের দেশের গৌরব।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীম যেমন দুঃশাসনের রক্তপান করে তার বিনাশসাধন করেছিলেন তেমনি সচেতন মানুষের হাতে ভবিষ্যতে এই বিকৃতরুচির নরপিশাচদেরও বিনাশ আসন্ন।

শান্তা মারিয়া: সাংবাদিক।