একজন মোজাফফর আহমদ: নির্মোহ মানুষের প্রতিকৃতি

জায়েদুল আহসান পিন্টু
Published : 19 April 2015, 06:58 PM
Updated : 19 April 2015, 06:58 PM

অভিনন্দন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। পয়লা বৈশাখ আপনার ৯৪তম জন্মদিন গেল। আপনার সমসাময়িক কোনো রাজনীতিবিদ আর বেঁচে নেই। ৭৮ বছর আগে ব্রিটিশ আমলে রাজনীতিতে আপনার হাতেখড়ি হয়। সেই ১৯৩৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যও নীতি থেকে সরে আসনেনি; তাই আপনাকে স্যালুট অধ্যাপক মোজাফফর।

রাজনীতিকে আপনি সংজ্ঞায়িত করেছেন কোনো পেশা বা ব্যবসা হিসেবে নয়, রাজনীতি একটা ব্রত আপনার কাছে। রাজনীতির মূল লক্ষ দেশপ্রেম, জনসেবা। এই ব্রত নিয়ে এখনও আপনি আছেন। ব্যাপকভাবে জনগণকে সংগঠিত করতে পারেননি বলে রাজনীতিতে 'সফল' হতে পারেননি, যদি সেই সফলতার সংজ্ঞা হয় রাষ্ট্রক্ষতায় গিয়ে জনগণের সেবা। কিন্তু যে সততার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তার বিন্দুপাঠও যদি আজকের রাজনীতিবিদরা করতেন তাহলে জনগণের ভাগ্যের কিছুটা পরিবর্তন হত।

অধ্যাপক মোজাফফর, আপনাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়নি। সেই স্কুলজীবনে একবার দেখেছি নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে। সম্ভবত ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করেছিলেন আপনি। 'আমার নাম মোজাফফর, মার্কা আমার কুঁড়েঘর', এই শ্লোগান আমার শৈশবের অন্যতম স্মৃতি। সাধারণ মানুষের মতো রাস্তায় রাস্তায় ভোট চেয়েছিলেন। আমার মতো কিশোর তখন রাষ্ট্রপতি শব্দটির মানে বুঝে গেছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি হতে চান এমন একজন মানুষ কীভাবে এত সহজে ভোট চান সেটা আমার কচি মনে দাগ কেটেছিল।

সাংবাদিকতা করছি ছাব্বিশ বছর ধরে। কত নেতার বক্তৃতা কাভার করার সুযোগ হয়েছে, কিন্তু আপনার বক্তৃতা কাভার করার সুযোগ খুব বেশি হয়নি। যতদূর মনে পড়ে, আপনি বক্তৃতা দিতেন খোলামেলা ও সহজ সরল ভাষায়। ঢাকার মানুষের কথ্যভাষায় বলতেন সব সময়। আপনার জীবনযাপন নিয়ে আগ্রহ ছিল অনেক। তবু খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। যেমন এই রাষ্ট্রও নেয়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধে আপনার ভূমিকা জেনে ইচ্ছে ছিল দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়ার। সেটিও পারিনি। রাষ্ট্রের মতো আমিও ব্যর্থ।

আপনার কিছু লেখা ও বই পড়ে যৎকিঞ্চিত জেনেছি আপনার সম্পর্কে। আজ এই হানাহানি, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার আর ধর্মের নামে মুক্তচিন্তার মানুষ হত্যার উৎসবের সময় আপনার মতো রাজনীতিবিদদের বড় দরকার। কারণ আপনি যেমন সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তেমনি বিশ্বাসী আল্লাহ-রসুলের ওপর।

মোজাফফর আহমদ, আপনার জন্ম ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ এমএ পাস করার পর ইউনেসকো ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর যোগ দেন অধ্যাপনায়। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৫২ সালের ২৪ অক্টোবর আমিনা আহমেদকে বিয়ে করেন। আর ১৯৫৫ সালে আপনাদের একমাত্র মেয়ে আইভির জন্ম হয়।

১৯৩৭ সালে ছাত্ররাজনীতিতে হাতেখড়ি আপনার। মহাত্মা গান্ধী কুমিল্লার চান্দিনায় আসবেন শুনে বাড়ি থেকে হেঁটে ওদিকে যাত্রা করেন। পথেই জানতে পারেন, গান্ধী এসেছিলেন; আর বলে গেছেন, 'হিন্দু-মুসলমান এক হও, ব্রিটিশদের এ দেশ থেকে খেদাও'; তারপর আবার সামনের দিকে রওনা করেছিলেন। আপনি তখন বছর পনেরোর কিশোর। অন্যদের কাছে জানতে চান, গান্ধী আর কী কী বললেন? সবাই জানাল, তিনি বক্তব্য দেননি, বাণী দিয়েছেন। আর আপনি খুঁজে পেলেন মনের মতো নেতা। মনে করলেন, যিনি কথা কম বলে মানুষকে বক্তব্য নয়, বাণী দেন, তাঁর মতো নেতা দরকার। সেদিন থেকে আপনি গান্ধীর ভক্ত।

আমিও আপনাকে দেখেছিলাম কিশোর বয়সে, কত-না সহজভাবে রাষ্ট্রপতির পদে ভোট চেয়েছেন। দোকানিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বলেছেন, 'আমার নাম মোজাফফর…।' সেদিন থেকে আমিও আপনার ভক্ত, তবে আপনার রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী হতে পারিনি এটাও সত্য।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের শুরুতে আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। থাকতেন আজিমপুরে। আপনার স্ত্রী জানালেন, সেই বাসাতেই ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করার প্রথম ঘরোয়া বৈঠকটি হয়। আপনি মহান ভাষাসৈনিক। ১৯৫৪ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিলেন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হয়ে কুমিল্লার দেবীদ্বার থেকে প্রভাবশালী মুসলিম লীগ প্রার্থী ও তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী মফিজুল ইসলামকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করলেন। ঘুরে গেল জীবনের মোড়। শিক্ষক থেকে হয়ে উঠেন পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ। কখনও রাজপথে, কখনও কারাগারে, কখনও আত্মগোপনে– এই তো জীবন।

এ জীবন বেছে নেওয়ার পেছনে বঙ্গবন্ধুর উৎসাহের কথাও বলেছিলেন আপনি। 'কিছু কথা' নামের বইতে লিখেছেন, ১৯৩৭ সালে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও বিভিন্ন কারণে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারেননি। তার জন্য বঙ্গবন্ধুই আপনাকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করতেন।

১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের ঐতিহাসিক প্রস্তাব উত্থাপন করলেন আপনি। প্রস্তাবটি নিয়ে আওয়ামী লীগে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হল। তখন শেখ মুজিবুর রহমান আপনাকে সমর্থন দিয়ে আরেক ঐতিহাসিক নজির সৃষ্টি করলেন। সেদিনের ঘটনা নিয়ে প্রয়াত রাজনীতিবিদ পীর হাবিবুর রহমান এভাবে লিখেছেন–

''আইনসভায় 'ন্যাপ'এর এমপিএ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ শুধু দেশরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি ও মুদ্রা, এই তিন বিষয় কেন্দ্রের হাতে রেখে বাদবাকি যাবতীয় ক্ষমতা প্রদেশের হাতে অর্পণের ভিত্তিতে '৫৬ সালের শাসনতন্ত্র সংশোধনের জন্য পাকিস্তান পার্লামেন্টের প্রতি আহ্বান জানিয়ে একটি জরুরি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। আইনসভায় স্পিকার আবদুল হাকিম খান ঐ প্রস্তাব আলোচনার জন্য একটি নির্দিষ্ট তারিখ ধার্য করেন। জগন্নাথ হলে পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের বৈঠক চলছে। সেদিন জোহরের নামাজের বিরতি একটু আগেভাগেই হয়ে গেল। ১২ টায় বিরতি হল। আর সান্ধ্যকালীন অধিবেশনের সময় বিকেল তিনটায় ধার্য হল। দীর্ঘ বিরতির কারণ ঐ দিন দ্বিতীয় অধিবেশনেই অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের স্বায়ত্তশাসন সম্বলিত প্রস্তাবের উপর আলোচনা হবে।

আমি মূখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমানের কামরায় বসেছিলাম। জনাব আবুল মনসুর আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমানসহ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ একে একে আসন গ্রহণ করলেন। মূখ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বৈঠক শুরু হল। আমি বিরোধী দলের সদস্য হলেও কেউ ভ্রুক্ষেপ করেননি। তাই আমার উপস্থিতিতেই আলোচনা শুরু হল। বিষয়বস্তু ৩টার অধিবেশনে আলোচ্য অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ উত্থাপিত স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব। প্রথমে জনাব আবুল মনসুর আহমদ এ বিষয়ে বিশদ বক্তব্য হাজির করেন। তাঁর বক্তব্যের সারমর্ম হল, এই প্রস্তাব হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সেনসার করার, জনসমক্ষে তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার একটি কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র বৈ আর কিছু নয়। কাজেই সর্বশক্তিতে আমাদের এই ষড়যন্ত্র ঘায়েল করতে হবে।

… শেখ মুজিব পার্টির সেক্রেটারি, কেবিনেট মিনিস্টার। কোনো কথা বলছিলেন না। আতাউর রহমান সেটা দেখে তাঁর মতামত জানতে চাইলেন। মুখ খুললেন মুজিব। তাঁর কথায় ছিল আগুন আর আগুন। বৈঠকে মুজিব বললেন, আমি মুজিবুর রহমান, বঙ্গভূমির একজন ঘুমন্ত সুসন্তানের দাবিদার। মোজাফফর যে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আইন পরিষদে প্রস্তাব এনেছে, আমি তা একবার আওয়ামী লিগের ৪২ দফা মেনিফেস্টোতে আর একবার ২১ দফা কর্মসূচিতে সেই স্বায়ত্তশাসনের দাবির জন্য সংগ্রামের ওয়াদা করে বসে আছি। আপনারা কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র রুখতে আর লিডারের ইমেজ বাঁচাতে যা ইচ্ছা করতে পারেন। আমি মুজিবুর রহমান, দেশের ৬ কোটি মানুষের কাছে যে ওয়াদা করেছি তা থেকে এক ইঞ্চিও হয়তো নড়বড় করতে পারব না। আমার গলায় যদি কেউ ছুরিও চালায় তাতেও আমাকে স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে সরাতে পারবে না। আমি ওই প্রস্তাবের পক্ষেই ভোট দিব।

এসব বক্তব্যের পর সভা শেষ করে সবাই আইনসভার হলে প্রবেশ করলেন। পূর্ব পাকিস্তান আইনসভায় অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ উত্থাপিত স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব সেদিন সরকারি দল ও বিরোধী দলের সর্বসম্মত সমর্থনে পাস হল।''

১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করা হয়। সামরিক জান্তা আইয়ুবের সরকার আপনার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে। আপনাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। আত্মগোপনে চলে যান আপনি। নতুন এক অভিজ্ঞতা। আত্মগোপন অবস্থায় দলের হয়ে কাজ করেন। জেনারেল আইয়ুবের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেন। আটটি বছর আত্মগোপনে থাকার পর ১৯৬৬ সালে প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার পক্ষে অবস্থান নেন। যেমনটি ১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধু আপনার স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব পাস করিয়েছিলেন সংসদে। ৬ দফার ঘোর সমর্থক হয়ে যান আপনি।

১৯৬৮ সালে বিশ্বব্যাপী কমিউনিজমের বিভক্তির কারণে মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে আপনার মতবিরোধ হয়। চীন না মস্কো, কোনদিকে কে যাবে এ নিয়ে সারাবিশ্বেই চলে আলোচনা। বিভক্তি হয়ে পড়ে অনিবার্য। আপনার আদর্শ পরিবর্তন করতে পারেননি। আলাদা হয়ে ন্যাপ গঠন করেন। ভাসানী চীনপন্থী আর আপনি মস্কোপন্থী। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ন্যাপ মোজাফফরের সভাপতিই আছেন। ১৯৬৯এ আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সময় আপনাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আইয়ুব খান আহূত রাওয়ালপিণ্ডির গোলটেবিল বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বও করেন আপনি।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার কাকরাইলে আপনার বাবার বাড়ি লক্ষ্য করে গোলাগুলি শুরু হলে বাসা থেকে বেরিয়ে যান। এরপর এক মাস ঢাকায় আত্মগোপনে থাকেন। পাকসেনাদের অত্যাচার নিজের চোখে দেখেন। বর্বর পাকিস্তানি সৈনিকরা আপনার পাশের বস্তিতে একজন নারীকে ধর্ষণ করার সময় দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছেন আপনি। মেয়েটির কান্না আজও আপনাকে কাঁদায়। এরপর সীমান্ত পেরিয়ে চলে যান ভারতের আগরতলায়। তাজউদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলী গঠন করা হয়। আপনি হন সেই কমিটির সদস্য। আপনিই এখন মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের একমাত্র জীবিত সদস্য। আপনি চলমান ইতিহাস।

ন্যাপ, কমিউনিস্ট পাটি আর ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের নিয়ে একাত্তরের মে মাসে ১৯ হাজার সদস্যের যে বিশাল মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা বাহিনী গঠন করা হয়, তারও নেতৃত্ব দিয়েছেন আপনি। গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় পাকসেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। সেই মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি নিয়ে এখনও আমরা রাজনীতি করি।

যুদ্ধের ময়দানের বাইরে কূটনৈতিক তৎপরতায়ও আপনি ছিলেন সফল। 'আমাদের মুক্তিযুদ্ধ' শিরোনামের বইয়ে আপনি বলেছেন:

''মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে মার্কিন সামাজ্যবাদ, আরব মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ প্রত্যক্ষভাবে এবং গণচীন পরোক্ষভাবে অবস্থান নিয়েছিল। এই নাজুক পরিস্থিতিতে পরাশক্তির অন্যতম সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এই বাস্তবতা থেকে আমি এবং কমিউনিস্ট পার্টির অবিসংবাদিত নেতা কমরেড মণি সিং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি এবং তাঁকে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের চাপের ভয়বহতা ও সাম্রাজ্যবাদী হুমকির পরিণতির যথার্থতা বুঝিয়ে আন্তর্জাতিক সহায়তা, বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সহায়তা লাভে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানোর জন্য রাজি করাতে সক্ষম হই। বিশ্বের স্বাধীনতা, মুক্তি ও শান্তিকামী মানুষের সমর্থন বাংলাদেশের পক্ষে আনার জন্য সেদিন বিশ্ব শান্তি পরিষদের সম্মেলনে যে প্রতিনিধি দল গিয়েছিল, তার অন্যতম সদস্য ছিলেন ন্যাপ নেতা দেওয়ান মাহবুব আলী। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষে আমি (মোজাফফর) উপস্থিত ছিলাম।''

এরপর স্বাধীন বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু তাঁর পুরানো বন্ধুকে খুঁজে বের করেন। আপনার সঙ্গে ছিল তাঁর 'তুমি তুমি' সম্পর্ক। আপনাকে অনুরোধ করেন তাঁর মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে। প্রস্তাবটি সবিনয়ে প্রত্যাখান করেন আপনি। যা কেবল আপনার পক্ষেই সম্ভব। বিরোধী দলেই থাকতে চান আপনি। সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়া যে মন্ত্রিত্বের চেয়ে বড় কাজ, দেশগঠনে এর চেয়ে বড় বাণী আর কী হতে পারে?

এরপর ১৯৭৫। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড। আবারও আত্মগোপনে যেতে হল আপনাকে। 'কিছু কথা' বইয়ে লিখলেন:

''আগের অভিজ্ঞতায় গা-ঢাকা দিলাম। পকেটে রিকশা ভাড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একটা টুপিও সঙ্গে নিলাম। আত্মগোপন করলাম। খন্দকার মোশতাকের অপসারণ পর্যন্ত আত্মগোপন অবস্থায় থাকলাম। অনেক কিছু দেখলাম। … অনেক কিছু বুঝলাম…। অভ্যুত্থান-ষড়যন্ত্র করে সমাজতন্ত্র তো দূরের কথা, আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাও সম্ভব নয়।''

চল্লিশ বছর আগে যা দেখেছেন দেশে আজও সেই অবস্থাই আছে। জেনারেল জিয়ার শাসনামালে ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে আপনি প্রার্থী হলেন। কুমিল্লা-৪ (দেবীদ্বার) আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে ন্যাপ-সিপিবিসহ সব প্রগতিশীল শক্তির প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন। সে নির্বাচনে আপনি প্রদত্ত ভোটের এক শতাংশ পেলেন মাত্র।

১৯৮২ সাল। আবার সামরিক শাসন। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে নামেন আপনি। আবারও কারাবরণ করতে হয় আপনাকে। এরপর ধীর ধীরে আপনার দলের ক্ষয় শুরু করে। তাই আপনি উদ্যোগ নেন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক কর্মী সৃষ্টির। যার বড় অভাব এদেশে। নারায়ণগঞ্জের মদনপুরে 'সামাজিক বিজ্ঞান পরিষদ' নামে একটি রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু আপনাকে বলেছিলেন, 'তুমি কর্মী ধরে রাখ আদর্শ দিয়ে, আর আমাকে কর্মী ধরে রাখতে হয় পারমিট দিয়ে।' আদর্শ দিয়ে শেষ পর্যন্ত আপনিও কর্মী ধরে রাখতে পারেননি।

কিন্তু যে আদর্শ নিয়ে অবিচল আছেন তা অনুসরণীয়। সততা, নিষ্ঠা আর দেশপ্রেম– কোথাও আপোষ নেই। আপনার পথচলা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কোথাও কখনও মুহূর্তের জন্য হলেও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। বাংলাদেশের জন্মের পর, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সামরিক শাসকরা রাজনীতিবিদদের চরিত্রহননের যে প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, তাতে দেশের প্রায় সব কমিউনিস্ট নেতা যোগ দিয়েছেন। সারাজীবন জেল-জুলুম আর হুলিয়া মাথায় নিয়ে জীবন পার করে দিয়ে শেষ মুহূর্তে তারা মন্ত্রিত্বের লোভ সামলাতে পারেননি। সেখানে পাহাড়ের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন আপনি। আপনাকে টলানো যায়নি। 'ধর্মকর্ম সমাজতন্ত্র' এই শ্লোগান দিয়ে আপনি অবিচল।

এ অবস্থান চুরানব্বই বছর বয়সে এসেও দেখাতে ভুল করেননি। দেশের সর্বোচ্চ বেসমারিক সম্মাননা স্বাধীনতা পদক প্রত্যাখ্যান করার মতো নৈতিক অবস্থানের যে দৃঢ়তা দেখিয়েছেন তা কেবল আপনার পক্ষেই সম্ভব। আপনি বলেছেন,

''পদক নিলেই সম্মানিত হয়, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি বিশ্বাসী নই। দেশপ্রেম ও মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি রাজনীতিতে এসেছিলাম, কোনো পদক বা পদ-পদবি আমাকে উদ্বুদ্ধ করেনি। সত্যিকার অর্থে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন,জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তাঁরা কেউই কোনো প্রাপ্তির আশা করেন না। পদ বা পদকের জন্য কখনও রাজনীতি করিনি। রাজনীতির অর্থ দেশসেবা, মানুষের সেবা। শেখ মুজিব আমাকে অনেক কিছু বানানোর চেষ্টা করেছিলেন, আমি হইনি। আমি মহাত্মা গান্ধী, মাওলানা ভাসানীর অনুসারী।''

স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর শহীদদের স্মরণে স্বাধীনতা দিবসে এ পদক প্রদান করা হয়। জাতীয় জীবনে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বিভিন্ন ক্ষেত্রে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশের নাগরিকদের দেওয়া হয় (যদিও চিহ্নিত রাজাকার শর্ষীণার পীর ১৯৮০ সালে এই পদকে ভূষিত হয়েছেন)। পঁয়তাল্লিশ বছর পর নিশ্চয়ই অধ্যাপক মোজাফফরের ও রকম স্বীকৃতির দরকার নেই। আপনি এর অনেক উর্ধ্বে।

১৯৩৭ সালে যে আদর্শ নিয়ে রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছিল আজ ৭৮ বছর পরও আপনি সেই আদর্শ ধারণ করেন বলেই লেলিনকে উদ্ধৃত করে বলে যেতে পারেন:

''আমার সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেছি পৃথিবীর সুন্দরতম আদর্শ সমাজতন্ত্রের জন্য।''

চুরানব্বই বছরে পা দেওয়া অধ্যাপক মোজাফফরকে আবারও অভিনন্দন।

১৪ এপিল, ২০১৫

জায়েদুল আহসান পিণ্টু: প্রধান বার্তা সম্পাদক, দেশ টিভি।