মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেবেই নারী

নুজহাত চৌধুরী
Published : 15 April 2015, 07:09 PM
Updated : 15 April 2015, 07:09 PM

খবরটা সকালে ভাসা ভাসা একবার শুনলাম, ঠিক ধরতে পারিনি। সারাদিন প্রায় বাইরে বাইরে থাকায় খবরটা ঠিক খুঁজে পড়ার ফুরসত পাইনি। কিছুক্ষণ আগে বিশদ পড়লাম বিভিন্ন জনের পোস্টে; অনলাইন পত্রিকায়। আমার নিজের এ দুদিনের বর্ষবরণের অনুষ্ঠানমালার সব আনন্দ নিমেষেই মাটি হয়ে গেল। তীব্র ঘৃণা, সীমাহীন অসহায়ত্ব অবশ করে দিচ্ছে বোধশক্তি। এ কী শুনি! এ আমার দেশ? এ আমার মাতৃভূমি? এই দেশ, এই তারুণ্য ঘিরে আমার কী বিপুল ভালবাসা! সব আশা, সব গর্ব যেন চুরমার হয়ে যাচ্ছে আমার চারপাশে।

বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে গত রাতে এক দল জানোয়ারের দ্বারা কয়েকজন নারী যৌনহয়রানির শিকার হয়েছেন, এ ঘটনা জেনে মন বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। যে দামাল বাঙালি ছেলেরা মা-বোনের ইজ্জতরক্ষার জন্য অকাতরে প্রাণ দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে– কী করে এরা তাদের সন্তান হয়? এ তবে কেমন দেশ আমার? যে দেশে মেয়েরা নিরাপদ নয়– সে দেশের আর কোন উন্নতি নিয়ে গর্ব করব?

প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে চরম অপছন্দের বিষয় বাঙালি সংস্কৃতির সবচেয়ে দৃপ্ত উচ্চারণ এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। তারা কি তবে ভীতি সৃষ্টির জন্য এটা করল? দিনে দিনে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয়ে উঠছে বাঙালির আত্মপরিচয় খুঁজে পাওয়ার ঠিকানা। জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে সকলের বাঙালি পরিচয়ের স্পষ্ট প্রকাশ। একে ধ্বংস করতে চাইবে তারা তাদের ধর্মান্ধ, মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল আদর্শের উত্থানের জন্য– এটা আর এমন কী কঠিন বোঝা? বোমা মেরে হোক, নারী নির্যাতন করে হোক– ভয়-ভীতি-ত্রাস সৃষ্টি করে জনগণকে, বিশেষ করে নারীদের আটকে রাখার এটি নিগূঢ় চক্রান্ত কিনা তা ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুকে বহিরাগতরা এসে এত বড় অপরাধ করে যাবে, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? অভিজিতকে যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হল, তখন এমন কথা শুনেছিলাম যে, আশেপাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো শিবিরের কর্মীতে ভরে গেছে। যার ফলে খুনিরা এত সহজে পালিয়ে বা অন্ধকারে মিশে যেতে সুযোগ পেয়েছে। সত্যাসত্য খুঁজে বের করা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব।

আর যদি তা না হয়, যদি এরা তথাকথিত শিক্ষিত, প্রগতিশীল শ্রেণির বা ছাত্রদের কেউ হয়, তবে আরও কঠোর হতে হবে এদের প্রতি। তার মানে শিক্ষা, আদর্শ, মানবতা– সবই শ্লোগান; অন্তরে আর মস্তিষ্কে তার বাস নেই! তাহলে আর কোন তরুণদের নিয়ে আশা করব? কাদের নিয়ে এত গর্ব করব?

বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের বলছি, তোমরা খুঁজে বের কর কারা এরা। নিজেদের সম্মান পুনরুদ্ধার কর। এদের খুঁজে বের করতেই হবে। মানবতার স্বার্থে, ন্যায়বিচারের স্বার্থে, এদের ধরে বের করে কঠিন শাস্তি দিতে হবে; খুব দ্রুত। এরা যে রাজনৈতিক দলেরই হোক না কেন– হোক এরা বহিরাগত, ছাত্র বা কোনো নেতা– ক্ষমা করা যাবে না কাউকেই। এ কাজ সরকারকেই করতে হবে এবং তা করতে হবে অতিদ্রুত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতার পাল্লা ভারি হতে হতে ছিঁড়েই যাবে বোধহয়। বই মেলা, বর্ষবরণ স্থলে সকলের নিরাপত্তা দিতে পারতে হবে। সে জন্যই আপনাদের ওই বড় বড় পদে বসানো হয়েছে। পুলিশেরও এবার জনগণের কাছে স্পষ্ট জবাবদিহি করার সময় এসেছে। খুব তলিয়ে দেখা দরকার সমস্যাটা কোথায়? আপনারা ঘটনাস্থলে তালগাছের মতো নিরবে দাঁড়িয়ে থাকেন কেন? সন্ত্রাসীদের ধরতে পারছেন না কেন? রাজনৈতিক চাপ? নাম বলুন। কারা আপনাদের এ কুলাঙ্গারদের রক্ষা করতে বলে? কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব?

রাজনীতিবিদদের বলব, অল্পকিছু বিপথগামী নষ্ট ছেলের জন্য সব তরুণের বদনাম হতে দেবেন না। নিজেদের দলের তাতে উপকার তো হবেই না, বরং ক্ষতি হবে, নিন্দা হবে। এগুলো ঝেড়ে ফেলে দিন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিন। তাতে বরং দলের উপকার হবে, সুনাম বাড়বে।

এভাবে অপরের সম্মান, অপরের স্বাধীনতায় আঘাত করতে দেখেও যদি চুপ করে থাকি, তবে সামনে সবার জন্যই ভয়ঙ্কর দিন অপেক্ষা করছে। আজ হয়তো আমরা দূরে আছি। কাল সেই অপশক্তি আমাদের দিকেই আঘাত হানবে। তাই এদের এখনই রুখতে হবে। মনে রাখতে হবে, নারীর অসম্মান– তা সে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতেই হোক কী বাঙালির হাতে– একই রকম অন্যায় ও অপরাধ। এ জন্য অপরাধীদের এমন কঠিন শাস্তি দেখতে চাই যেন আর কোনো নপুংসক নারীকে অসম্মান করার চিন্তাও করতেও সাহস না পায়।

তবে আবারও বলছি, অভিজিতকে হত্যা করে এত সহজে পালিয়ে যাওয়ার মাঝে, বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে নারীকে অসম্মানের মাঝে, আমি আমাদের প্রগতির পথে এগিয়ে যাবার চেষ্টার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছি। একটি সর্বজনীন অসাম্প্রদায়িক জাতীয় উৎসব থেকে সবাইকে, বিশেষত নারীদের দূরে রাখতে এই হীন কাজ হচ্ছে বলে মনে করলে ভুল হবে না। এ জন্যই বই মেলায় অভিজিৎ নিহত হয়; এ জন্যই রমনা বটমূলে বোমা হামলা হয়। তবু যখন বাঙালিকে দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না, তখন সেই একাত্তরের কায়দায় নারীকে আক্রমণ– কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে নৃশংসতাটা।

যারা চায় না মুক্তবুদ্ধির চর্চা হোক, যারা চায় না নারী মুক্ত বাতাসে স্বাধীনভাবে চলুক– এটা তাদের কাজ– তা সে এখন যে দলেই ঘাঁপটি মেরে থাকুক না কেন, তারা একই গোত্রের। এই অশুভের বিরুদ্ধেই শুভবুদ্ধির যুদ্ধ চিরকাল। চার লাখ মা বোনকে ধর্ষণের পরও বাঙালি মায়েরা দেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম থেকে পিছপা হননি। রমনা বটমূলে যে বার বোমা হামলা হয়, রমনার পাশেই ছিলাম আমি। বোমা হামলার পরের বছর আমার স্বামী ও ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে– তখন মেয়ে ছিল ছবছরের– বটমূলে গিয়েছিলাম। আমার ছেলেটি তখন আমার ভিতর বেড়ে উঠছে; মাতৃগর্ভে চলছে তার অষ্টম মাসটি। তবু আমরা ছিলাম নিঃশঙ্ক চিত্ত।

যে যত চেষ্টাই করুক না কেন, জাতির পিতা বলে গেছেন, 'বাঙালিকে দাবায়ে রাখতে পারবা না'– আমরা আবারও আসব আগামী শত-সহস্র বছর রমনা বটমূলে, চারুকলায়, টিএসসিতে বর্ষবরণ করতে। নিশ্চয়ই আসব। সাহসী শত সহস্র বাঙালি নারী– আমরা আসব বারবার– আমাদের কেউ 'দাবায়ে রাখতে পারবা না'।