একাত্তরের একটি মিছিলের গল্প

দিলীপ কুমার বসু
Published : 12 April 2015, 08:00 PM
Updated : 12 April 2015, 08:00 PM

১১ এপ্রিলের সূত্রে মনে পড়ে গেল একাত্তরের সেই ভয়াল দিনগুলির কথা। বিভাগোত্তর উপমহাদেশের রাজনীতির কারণে তখন আমি জন্মভূমি বাংলাদেশ থেকে দূরে। কিন্তু যত দূরেই থাকি না কেন, জন্মভূমির প্রতি টান ভালোবাসা কখনও হারিয়ে যায় না। বরং কখনো কখনো সেই টান আরও তীব্র হয়ে ওঠার সুযোগ পায়।

তারিখটা মনে নেই, তবে মার্চ মাসের ঘটনাই হবে এতে সন্দেহ নেই। আমি তখন দিল্লিতে পড়াই, নাটকের দল 'নাট্যকাল' তৈরি হয়েছে, অবিবাহিত, কাকার ভাড়া করা বাড়িতে করোলবাগে থাকি। কাকা সেই একতলা বাড়ির সবচেয়ে বড় ঘরটা আমাকেই ব্যবহার করতে দিতেন– যদিও সেটা 'বসার ঘর' বলে, একটু দূরের অতিথি এলে তাঁদের সেখানে বসানো হত। ঐ ঘরে নাট্যকাল-এর নানা আড্ডা, কাজ অনেক সময় হত সেসব দিনে।

এক দুপুরে সেবাব্রত চৌধুরী, নাট্যকাল-এর চিরস্থায়ী প্রেসিডেন্ট, অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে সেই ঘরে হাজির। 'বাচ্চু, (আমার ডাকনাম), কিছু করবে না? আমরা কি চুপ করে বসে থাকব? ইত্যাদি ইত্যাদি।' বাংলাদেশে, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে, তখন ভয়ানক কাণ্ড শুরু হয়ে গেছে বলে খবর পাচ্ছি পত্রিকা মারফত। সেবাব্রত ঢাকার ছাত্র, শ্রীহট্টের মানুষ; অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, কবর নাটকের লেখক, তাঁর খোঁজ নেই বলে সেবাব্রত জেনেছেন। হায়াৎ মামুদ, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, সেবাব্রতরা যখন তরুণ বয়সে ঢাকায় সাহিত্য আন্দোলন করতেন, সে সময়ে সেবাব্রতর শিক্ষক চৌধুরী সাহেব এবং সে সময়ের বন্ধুরা নিশ্চয় অনেকেই বিপন্ন বলে সেবাব্রত স্বভাবতই আশঙ্কা করছেন।

আমরা তৎক্ষণাৎ কাজে লেগে গেলাম। সন্ধ্যার মধ্যে শুরু হয়ে গেল বাঙালি-সমাজের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা। সেদিন ও তার পরের দিন আমরা নিউদিল্লি কালীবাড়ি বেঙ্গলি ক্লাব, করোলবাগ বঙ্গীয় সংসদ ও কাশ্মীরি গেট বেঙ্গলি ক্লাব– এই তিনটি প্রধান বাঙালি সংস্থার তদানীন্তন কর্ণধার সমিতির সঙ্গে দেখা করে শুধু হতাশই হলাম। মধ্যবিত্ত মানুষ সাধারণত ভীরুপ্রকৃতির হন– নানা কারণে এ সত্যটি আমাদের অল্পবয়সের অভিজ্ঞতায় আবার যাচাই হল। সকলেই যা বললেন তার নির্গলিতার্থ যে, সরকারি চাকুরি করার ফলে তাঁরা আমাদের প্রস্তাবিত পাক হাই-কমিশনারের সামনে গিয়ে প্রতিবাদ-মিছিলে যোগ দিতে পারছেন না।

আমাদের রাগ-দুঃখ-ক্ষোভ তুঙ্গে পৌঁছেছিল। মিছিলে এইসব মানুষ তখন বা তার পরেও হয়তো কখনও হাঁটেননি, কিন্তু আমরা যারা তখন উদ্যোগী তাদের বোধহয় প্রায় সকলেই সে-সময়ে কোনো মিছিলে হাঁটিনি– অন্তত আমি তো না। নাটকে মিছিল দেখিয়েছি শুধু। কিন্তু, এটা তো বুঝতেই পারছিলাম যে মিছিলের লোকসংখ্যা খুব কমে যাচ্ছে! করোলবাগে ফিরে (আমরা, মূল উদ্যোগীরা প্রায় সবাই করোলবাগে থাকি) পোস্টার আর প্ল্যাকার্ড নির্মাণের কাজে আরও অল্পবয়সীদেরও উদ্বুদ্ধ করা হল, নিজেরাও কিছু বানালাম এবং কিছু কিছু জায়গায় সাঁটলাম।

পরের দিন মিছিল রওয়ানা হবে, দুপুর আড়াইটা নাগাদ বোধহয় পাক-হাইকমিশনে পৌঁছোব, সকাল থেকে করোলবাগের নানা জায়গায় দেখলাম পোস্টারে পোস্টারে সয়লাব, জানিও না, কারা সেটা করেছে এবং কিছু অত্যুৎসাহী মানুষ নকশালবাড়ি আন্দোলনের পোস্টারও তার সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে! অসুবিধা, পুলিশি আপত্তি-আক্রমণের কিছু সম্ভাবনার কথা তাতে মনে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তাত্ত্বিক আপত্তি অনুভব করিনি, ছবিতে দেখা যাবে 'জয় বাংলা'র পাশাপাশি Long Live People's War প্ল্যাকার্ডও মিছিলের মানুষদের বুকে সাঁটা। ইতিহাসের একটা পরিহাস এই যে চৌ-এন-লাইয়ের লিখিত মন্তব্যে, পরে জানা যায়, বাংলাদেশের মানুষের এই যুদ্ধকে উনি বা চীন সরকার People's war ভাবেননি, বরং উল্টোটাই ভেবেছেন।

আমাদের করোলবাগ হতে রওয়ানা হওয়া দলটা আরেকটু বেশি মানুষের একটি দলের সঙ্গে নিউ দিল্লি কালীবাড়ির কাছে গিয়ে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী মিলিত হয়। আমি বা আমরা অনেকেই, যারা এই প্রথম মিছিলে হাঁটল, জানতাম না যে পুলিশকে আগে এই মিছিল সম্পর্কে খবর দিয়ে রাখতে হয়। আমি ছোটবেলায় দিল্লিতেই স্কুলে পড়েছি, সেই স্কুলের পুরোনো এক ছাত্র, যিনি বয়সে ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় বড়, সেই বঙ্কিমদা বোধ হয় এসব কাজ অনেকের অজ্ঞাতেই করে রেখেছিলেন বলে পরে শুনেছি– ওনাকে আমাদের সঙ্গে মিছিলে দেখে যুগপৎ অবাক ও খুশি হই।

মোটামুটি ১২ কিলোমিটারের মতন রাস্তা হাঁটি আমরা মিছিলে, কনট প্লেস, ইন্ডিয়া গেট ইত্যাদি হয়ে, দিল্লির মানুষকে সচেতন করার আকুতি আমাদের চোখে-মুখে, স্লোগানের উচ্চারণে প্রকট ছিল সেই নবীনদের মিছিলে। কতটুকু কতজনের মনে সেই গুটি পঞ্চাশেক মানুষের কাতরতা ও কন্ঠস্বর পৌঁছে দিয়েছিল জানি না। যেটা জানি তা হল তিন-চারদিনের মধ্যেই বোঝা গেল ইন্দিরা গান্ধী তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী এই রকম সব কার্যকলাপই চাইছেন নিজের হাত শক্ত করতে; যাতে, ভারতীয় সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে পাঠানো যে জনতার উত্তাল সমর্থনে হচ্ছে সেটির প্রমাণ থাকে। তখন, দিল্লির সরকারি চাকুরীজীবীদের সেই প্রতিনিধিরা, যারা আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, মিছিলকে এক হাজার লোকের মিছিল করতে সহায়তা করেননি, তাদের ভোল গেল পাল্টে। করোলবাগের তদানীন্তন প্রবীণরা বঙ্গীয় সংসদের হয়ে বাসে করে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর বাড়িতে আবেদন জানিয়ে এলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যাতে উনি সাহায্য পাঠান– তাঁর নামে একটি স্তবগানও রচনা করে পাঠ করা হয়েছিল বলে শুনেছি।

আমরা ইন্দিরাজীর দেশের ভিতরের কার্যকলাপে মুগ্ধ ছিলাম না। আমরা যেদিন মিছিল নিয়ে গেছিলাম, হাই কমিশনের লোকেরা বাইরে বেরুননি। প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয়েছিল। সেটার গতি কী হল জানি না। ভারতীয় পুলিশের দল যারা পাহারায় ছিল, তাদের আচরণে সৌজন্য ও সমবেদনা ছিল। শুনেছিলাম, আমাদের আধঘন্টা আগে CPI-এর একটি মিছিলও সেখানে পৌঁছেছিল, এ ধরনের সেটা প্রথম মিছিল।

অনেক, অনেক দিন তারপর নানা সংবাদ-গুজব– ভয়ের, বিবমিষার, আনন্দের, গর্বের, উদ্দীপনার, সব রকমেরই– শুনেছি। উৎকন্ঠায় দিন গেছে। মুজিব কেমন আছেন সেসব চিন্তা, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর কোনো খবর আজও পাওয়া যায়নি। আরও অনেকের। অনেক মানুষের আত্মত্যাগের খবরে মানুষ হিসেবে, বাঙালি হিসেবে গর্ব হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনন্দও স্বাভাবিকভাবেই।

দিলীপ কুমার বসু: শিক্ষক, কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও অভিনেতা।