যেখানে সরকারি দল ও বিরোধী দল মিলেমিশে একাকার

রুমানা হাশেম
Published : 12 April 2015, 08:37 AM
Updated : 12 April 2015, 08:37 AM

মুক্তমনা ব্লগার ওয়াশিকুর রাহমান বাবু হত্যাকাণ্ডের সপ্তাহ দুয়েক পার হয়ে গেল। আর খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ও লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের দেড় মাসেরও বেশি। এখনও সরকারপক্ষ থেকে পরিস্কার কোনো বার্তা আসেনি যে, বাবু ও অভিজিতকে যারা কুপিয়ে মারল তাদের চক্রটিকে সরকার ধরতে চায় কিনা। অনেকের মনেই প্রশ্ন, বাংলাদেশে বুঝি এখন থেকে এটাই নাস্তিকদের নিয়তিতে পরিণত হল। সরকার ও বিরোধী দলের নেতাদের এ নিয়ে কথা বলার সময় নেই। সিটি কর্পোরেশনেরর নির্বাচন এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সব দলের কাছেই। তবু কদিন আগে 'চ্যানেল আই'এ বিবিসি সংলাপ দেখে মনে হল, কিছু না লিখলেই নয়।

|| এক ||

বিবিসির ওই সংলাপে চার আলোচকের মাঝে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা ছাড়া একজন সমাজ বিজ্ঞানী ও একজন আইনজীবী ছিলেন। আলোচনায় দুটো হত্যাকাণ্ড নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন ছিল। আলোচকদের অবস্থা দেখে মনে হল যেন সবাই ধর্মভীরুদের সান্তনা দিতেই বেশি ব্যস্ত। যারা মরছে আর সমানে মার খাচ্ছে সেই মুক্তমনা মানুষদের জন্য পরিস্কার কোনো বক্তব্য বিএনপি নেতা হান্নান শাহ ও আওয়ামী লীগের মন্ত্রী শাজাহান খানের কাছে ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা ওয়াহিদার কাছেও পাওয়া যায়নি কিছু। একমাত্র আইনজীবী সারা হোসেনকে মনে হল তিনি কিছু পরিস্কার সমাধান খুঁজছেন।

রাজনীতিক ও মন্ত্রীরা যে ভোটের জন্য উদ্ভট স্বরে কথা বলবেন এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই। তবে ধর্মের নামে মানুষকে জবাই হতে দেখেও যাদের হৃদয় এতটুকু কাঁদে না তাদের নিয়ে কী করা? ব্লগাররা ইসলামবিরোধী কথাবার্তা লিখে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে কিনা এ প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী কিছুক্ষণ আজেবাজে বকলেন। তারপর প্রশ্নকারী হুজুরকে সান্তনা দেবার ভঙ্গিতে বললেন যে, ধর্মের শরীরে আঘাত লাগে এমন মন্তব্য করলে তাকে আদালতে নিয়ে শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে। সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিলেন নির্বাচিত সাংসদ ও সাবেক মন্ত্রী সিদ্দিকীর ক্ষেত্রে কী করা হয়েছে সে কথা। ব্লগ লিখলে যে কারও দেহে আঘাত লাগে না সেটি কিন্তু তিনি বললেন না। বরং মনে করিয়ে দিলেন যে, ধর্ম নিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি খুব সুবিধের নয়।

একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলছেন, অন্যদিকে ধর্মের সমালোচনা করার দায়ে নির্বাচিত সাংসদকে তার পদ থেকে বহিস্কার করে ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন, এর ফল হিসেবেই আজ ধর্মান্ধরা দিনেদুপুরে মানুষ খুনের মহড়ায় নেমেছে। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিতে; সেখানে আজ 'মুক্তমনা' শব্দটি অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠেছে। ধর্মান্ধের দল সমাজে যে শুধু বিশৃঙ্খলা নয়, চরম আতঙ্ক সৃষ্টি করছে– দেশকে বর্বরতা ও অমানবিকতার চরমে নিয়ে যাচ্ছে– সে কথা চেপে গেলেন মন্ত্রী মহোদয়।

||| দুই ||

এবার একজন রাজনীতিক-সমাজ বিজ্ঞানী হিসেবে অধ্যাপক জিনাত হুদা ওয়াহিদার সচেতন আলোচনা শুনি। মুক্তমনা ব্লগাররা ইসলামবিরোধী কথাবার্তা লিখে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে বলে দাবি করলেন যে হুজুর, তাকে সান্তনা দেবার ভঙ্গিতে তিনি বললেন, ভিন্নমতাবলম্বীরা সভ্যতার সব যুগেই ছিলেন। প্রথমে শুনে বেশ যুক্তিসঙ্গত মনে হল। তবে পরের বাক্যগুলো লক্ষণীয়। সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়েই অধ্যাপক জানালেন যে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজেও একজন ভিন্নমতাদর্শী মানুষ ছিলেন। তিনি আল্লাহ তাআলার দূত হিসেবে এসেছিলেন। ফলে আমাদেরকে ভিন্নমত মেনে নেওয়ার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হতে হবে।

কথাগুলো জিনাত হয়তো মুসল্লিদের সান্তনা দেবার জন্য বলেছেন। তবে বলবার সময় তিনি সমাজ বিজ্ঞানের উপর দায় চাপালেন কেন বোঝা মুশকিল। সমাজ বিজ্ঞানে কি ধর্মযাজকদের সমাজ সংস্কারক হিসেবে কখনও আখ্যা দেওয়া হয়েছে? নাকি ভিন্নমতাবলম্বীরা ধর্মযাজক হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে কোনো সমাজে? আর সামাজিক অস্থিরতা, অমানবিকতা, বর্বরতা এবং নৃশংসতা কি ধর্ম নিয়ে রাজনীতির ফলে সৃষ্টি হয়নি?

যে হুজুর মানুষের খুন হবার কারণ হিসেবে কলমের আঁচড়ের ওপর দায় চাপাচ্ছেন, সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপক ওয়াহিদার শক্ত করে বলা প্রয়োজন ছিল যে, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণেই বহু যুগ ধরে সমাজে অমানবিকতা ও অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে। সোশিওলোজি অব রিলিজিয়নের গবেষকরা এটি একবার নয় বহুবার প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। সর্বশেষ, ২০১২ সালে লন্ডনের গোল্ডস্মিথ ইউনিভার্সিটি থেকে সম্পাদিত পিএইচডিতে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত নারীবাদী সমাজ বিজ্ঞানী সুখুয়ান্থ ডালিওয়ালি প্রমাণ করেছেন যে, আজ ব্রিটেনের সমাজে অস্থিরতার মূলে রয়েছে ধর্ম।

অধ্যাপক ওয়াহিদার কাছে সঠিক উত্তর জানা ছিল এ ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ। তবু তিনি এমন সব উদাহরণ দিলেন যেন কোনো মুসলমান শিক্ষার্থী তার উপর নারাজ না হয়। ইসলামি জঙ্গিদের হাতে মানুষ মরলে তার বিরুদ্ধে কী করা দরকার সে প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ হারিয়ে গেল এ আলোচনায়।

|| তিন ||

সংলাপের শেষের দিকে বাবু ও অভিজিতের হত্যাকাণ্ড নিয়ে দুজন সাহসী দর্শক প্রশ্ন রাখলেন। তারা দুজনেই নারী। তাদের প্রশ্ন হচ্ছে, জিহাদিরা যে এভাবে মানুষকে কুপিয়ে মারছে, তাহলে আমাদের জীবনের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত হবে? এর উত্তর সারা হোসেন ছাড়া আর কেউ আন্তরিকভাবে দিতে চাননি। আবদুল হান্নান প্রশ্নটি নিয়ে হাসলেন, যেন এটি একটি মশকরার বিষয়। আর মাননীয় মন্ত্রী দ্রুত সারা হোসেনের প্রস্তাবিত বিশেষ বাহিনী গড়ার ধারণা সম্পূর্ণ বাতিল করে দিলেন। জিনাত পরিস্কার করে কিছু না বলে শুধু সহনশীল হবার পরামর্শ দিলেন। স্বীকার করলেন যে, নিরাপত্তা বলে কিছু নেই আমাদের দেশে।

এতে শেষের প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া গেল না। প্রশ্নকারী নিজেই ধরিয়ে দিলেন যে, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ড সরকারের তথাকথিত নিরাপত্তা বাহিনীর চোখের সামনেই ঘটেছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, কার ইশারায় এবং কাদের মদদে এ খুন সম্ভব হয়েছে? এক মাস ধরে খুনিদের ধরা গেল না কেন তা কেউ বলতে চান না। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বিচারকাজ শুরু হচ্ছে না কেন? কেউ মন্তব্য করতে নারাজ। এমনকি সুচিন্তিত ও মুক্তবুদ্ধির সমাজ বিজ্ঞানীও পুরো সত্য সাহসের সঙ্গে উচ্চারণ করলেন না।

বিবিসির সংলাপ শেষ হলে আমার পাশে বসে থাকা ইংরেজভাষী ইতিহাসবিদ পোল ডাডমেন হেসে বললেন, "ধর্মের জাল থেকে বেরিয়ে আসা বড় কঠিন। তবে সমাজ বিজ্ঞানী ও আইনজীবীদের তা পারতেই হবে। তারা তথ্য এড়িয়ে গেলে গোটা বাংলাদেশ হেরে যাবে।"

মনে পড়ল, সেদিন ট্রাফেলগার স্কয়ারে 'আমিই অভিজিৎ' প্রদীপ মিছিলে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের উদ্দেশ্য শুধু অভিজিতের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোই ছিল না, বরং সমস্ত মুক্তমনা ব্লগার ও লেখকদের হত্যার বিরুদ্ধে অনড় প্রতিরোধ গড়তে চেয়েছিল মানুষ। প্রগতিশীল চিন্তায় উজ্জীবিত মানুষের মিছিলটি বরফঠাণ্ডা বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়া উপেক্ষা করে গেয়েছিল, 'আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে'। ভেবেছিল, এবার সরকার কিছু একটা করবে। জঙ্গিদের বিচার হবে। কিন্তু বিবিসি সংলাপে ব্লগারদের প্রতি মন্ত্রীর হুঁশিয়ারি শুনে নতুন সন্ত্রাসের আতঙ্ক ছাড়া কিছুই মনে আসছে না।

সরকারি দল ও বিরোধী দলের রাজনীতিবিদদের মধ্যে অন্য সব বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও একটি বিষয়ে এক অবস্থানে রয়েছেন। এখন সমাজ বিজ্ঞানী আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাই পারেন মানুষকে বোঝাতে; সমাজে প্রগতি ও শান্তির সুবাতাস বইয়ে দিতে।

ড. রুমানা হাশেম: যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট লন্ডনের সেন্টার ফর মাইগ্রেশন, রিফ্যুজি ও বিলংগিংএর শিক্ষক।