হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ও আমাদের সামাজিক বাস্তবতা

দেবপ্রসাদ দেবু
Published : 4 April 2015, 09:50 AM
Updated : 4 April 2015, 09:50 AM

অভিজিৎ হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। হওয়ারই কথা। কেননা একটি সুনির্দিষ্ট মতাদর্শের লোকের কাছে অভিজিৎ নিতান্তই নাস্তিক ব্লগার হলেও বৃহৎ পরিসরে অভিজিৎ বিজ্ঞানের জনপ্রিয় লেখক, গবেষক, পেশাদার প্রকৌশলী ও মুক্তমনা ব্লগার হিসেবে আদৃত। লেখক হিসেবে তিনি বহুমাত্রিকতার পরিচয় রেখেছেন তাঁর প্রকাশিত বইগুলোতেই। প্রচলিত সমাজে 'অস্পৃশ্য' বিষয় সমকামিতা নিয়ে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর 'সমকামিতা: বৈজ্ঞানিক ও সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান' বইতে। তাঁর লেখা নিখাদ বিজ্ঞানের বই 'শূন্য থেকে মহাবিশ্ব'; এ রকম আরও বই আছে। 'ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে' তাঁর একটি গবেষণাধর্মী বই। জানামতে, আমেরিকাতে দুটি প্যাটেন্ট রয়েছে অভিজিতের।

বহুমাত্রিকতার পরও স্থবির মস্তিষ্কের মানুষের কাছে অভিজিৎ কেবলই একজন হার্ডকোর নাস্তিক, ধর্ম অবমাননাকারী। প্রচণ্ড 'অনুভূতিসম্পন্ন' ধর্মান্ধরা তাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাঁর অসাধারণ সৃষ্টিশীল মস্তকটি দাবিয়ে দিতে। পেরেছেও। কিন্তু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা তাঁর বইগুলো? এগুলো দাবিয়ে দিবেন কীভাবে? আধুনিক বিজ্ঞানের এই সময়ে কোনো কিছুই ইরেজেবল নয়। চিন্তার মৃত্যু নেই, সম্ভবও নয়। তাই বাজার থেকে 'উঠিয়ে' নেওয়ার পরও বিপুল বেগে ছড়িয়ে পড়ে আলি দস্তির লেখা মুহাম্মদ (স.)এর জীবনীগ্রন্থের অনুবাদ; তাঁর মৃত্যুর বত্রিশ বছর পরও।

অভিজিতের এসব সৃষ্টিকর্ম নিয়ে অনেকেই লিখেছেন। বহুমুখী বক্তব্যও এসেছে তাঁর দর্শন, লেখনী কতটুকু গ্রহণযোগ্য বা নয় এসব নিয়ে। যদি-কিন্তু-তবে করে করেও কম আলোচনা হয়নি হত্যাকাণ্ড ঘিরে। আমার ফোকাসটা অন্য জায়গায়। ভিত্তিটা বন্যা আহমেদের প্রথম অফিসিয়াল স্টেটমেন্টের একটি বাক্যে। রাফিদা আহমেদ বন্যা বলেছেন: ''বইমেলা থেকে টিএসসির মোড় পর্যন্ত এতটুকু পথে এত মানুষ, এত পুলিশের মধ্যে এ রকম একটি হামলা হতে পারে এটি কল্পনার বাইরে।''

কল্পনার বাইরের এই মৃত্যুকুপ কেন তৈরি হলো, কীভাবে তৈরি হল? যারা হামলায় অংশ নিয়েছে তাদের কথা ভিন্ন। উগ্রতা এদের মস্তিষ্ক বিকল করে ফেলেছে। 'নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম' নামক প্যারাসাইটআক্রান্ত ঘাসফড়িং যেমন অকারণে পানিতে ঝাঁপ দেয়, ঠিক একইভাবে এই প্যারাসাইটিক মস্তিষ্কগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ফলে চরম নৃশংসতা চালাতেও এরা দ্বিতীয়বার ভাবে না। কিন্তু সেদিন কেন এগিয়ে এল না আশপাশের শত শত মানুষ কিংবা পুলিশ? কেন রিঅ্যাক্ট করল না?

পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যানুসারে হত্যাকারীদের সংশ্লিষ্ট লোকজন টার্গেট প্লেসের আশেপাশে ছিল মূল হত্যাকারীদের পালিয়ে যাবার রাস্তা তৈরি করে দিতে। হতেই পারে। পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডে একটি খুবই সম্ভব। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সেখানে অন্য কেউ ছিল না। ছিল, কিন্তু এগিয়ে যায়নি। একজন নারী রক্তবন্যায় ভাসতে ভাসতে সাহায্যের জন্য আকুতি করছেন, যার মাথা থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্তস্রোত, গড়িয়ে পড়ছে হাত থেকেও। পাশে পড়ে আছেন আরেক জন, যাঁর মাথার খুলি ফুঁড়ে মগজ বেরিয়ে পড়েছে– এ রকম একটি নৃশংস পরিস্থিতিতে মানুষ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, পকেট থেকে মোবাইল বের করে ছবি তুলছে, কোনো সাহায্যের উদ্যোগ নেই, পুলিশ নির্বিকার! কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন একে?

ব্যবহারিক সমস্যার কথা চিন্তা করে মানুষের এই 'ঝামেলা' এড়িয়ে চলা বা নিজেকে ঘটনার সঙ্গে সঠিক সময়ে সংযুক্ত না করার বিষয়টি সামাজিক মনোবিজ্ঞানে Bystander Effect (বাইস্ট্যান্ডার এফেক্ট) নামে পরিচিত। বিষয়টা প্রথম সামনে আসে মার্কিন নাগরিক কিট্টি জেনোভেস (Kitty Genovese) হত্যাকাণ্ডের পর। যেটি সংঘটিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে, নিউ ইয়র্কে তাঁর নিজের বাসভবনে। হত্যাকাণ্ডটি আশপাশের মানুষ রিকগনাইজ করার পরও প্রথম তিরিশ মিনিট কেউ এগিয়ে আসেনি। এটি কেস স্টাডি আকারে টেক্সট বইতে সংযুক্ত হয়েছিল পরে এবং এ বিষয়ে ব্যাপক গবেষণাও হয়েছে।

ওই গবেষণা থেকে জানা যায় যে, এ ধরনের কোনো ঘটনাস্থলে অনেক মানুষ উপস্থিত থাকলেও, সেখানে একে অন্যের সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করে– শুরুতেই নিজেকে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত না করে। অর্থাৎ অনেকের সমন্বিত দায় নিজের দায় কমিয়ে দেয় মনোজাগতিকভাবে। এছাড়া এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলাপরবর্তী সহযোগিতায় এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে কিছু ইস্যু প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। যেমন, সচেতনতা, দায়িত্ববোধ, আত্মবিশ্বাস, ঘটনার প্রকৃতি বুঝা, সাহায্য পরবর্তী সময়ে ব্যক্তিগত বা ব্যবহারিক জটিলতায় জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা, রাষ্ট্রীয় আচরণ, সামাজিক বাস্তবতা ইত্যাদি।

এখানে প্রথম তিনটি ছাড়া শেষদিকে যে বিষয়গুলো সংযুক্ত করেছি, সেগুলো বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে অধিকাংশ মানুষের মাঝেই নেতিবাচকভাবে কাজ করে।

২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ আক্রান্ত হলে সেখানে প্রথমে এগিয়ে গিয়েছিলেন শরিফুল হাসান নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের একজন ছাত্র। তাকে এ নিয়ে ভোগান্তিও পোহাতে হয়েছে ঢের। হুমায়ুন আজাদকে উদ্ধারের সময়কার একটি ছবি কেন্দ্র করে তাকেই অনেকে অভিযুক্তও করতে চেয়েছিলেন। তাকে গ্রেপ্তারেরও একটি নির্দেশ ছিল বলে পুলিশ কর্মকর্তারা পরে তাকে জানিয়েছিলেন। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রদের কাছে চাপাতি, পিস্তল, ছুরি এগুলো থাকা সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তঃদলীয় কোন্দলে এগুলো অহরহ ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে এটি বোঝা সম্ভব নয় যে, এটি রাজনৈতিক ঘটনা নয় এবং এতে সরকার দলীয়রা যুক্ত নয়।

'বাইস্ট্যান্ডার এফেক্ট' মনে রাখলে বোঝা যাবে যে, আলোচিত আরেকটি হত্যাকাণ্ড, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর শত শত লোক প্রত্যক্ষদর্শী থাকলেও কেউ এগিয়ে যায়নি ঘটনাপরবর্তী ব্যবহারিক জটিলতার কথা ভেবেই। এটি আমাদের সামাজিক বাস্তবতা। ফলে মানুষ না পেরেছে ঘটনার প্রকৃতি বুঝতে, না দূর হয়েছে জটিলতায় জড়িয়ে পড়ার ভয়। ফলে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়ে খুনি সটকে পড়েছে।

ফটো সাংবাদিক জীবন আহমেদ এসে সাহায্যের হাত বাড়ানোর মাঝখানে ১০ মিনিট সময় পার হয়ে গিয়েছে (বিবিসি বাংলার রিপোর্ট অনুসারে)। ফলে রক্তক্ষরণ দীর্ঘায়িত হয়েছে, ঘটনার আকস্মিকতায় সিএনজি ঢুকে পড়েছে বাংলা একাডেমীর রাস্তায়। অথচ ডাসের পাশ ঘেঁষে গেলে আরও কিছুটা সময় বাঁচানো যেত।

বাইস্ট্যান্ডার এফেক্ট তত্ত্বানুসারে, এখানেও সবাই অপেক্ষা করেছে 'কেউ একজন' এসে সহযোগিতা করবে এবং সবাই অপেক্ষা করেছে সেই কেউ একজনের পদক্ষেপের জন্য। ওই তত্ত্বানুসারে, মানুষ তখনই সহযোগিতার জন্য তৈরি হয় যখন সে জানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা যথাসময়ে পাওয়া যাবে। কিন্তু বাংলাদেশে এটি সোনার হরিণ। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ যখন সহযোগিতার হাত গুটিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, তখন সাধারণ মানুষের রিঅ্যাক্ট করার সম্ভাবনা কমে যায় অবধারিতভাবেই। অজয় রায় স্যার ঠিকই বলেছেন, সঠিক সময়ে পুলিশ তৎপর হলে ঘটনা হয়তো থামানো যেত না, কিন্তু খুনিদের পালিয়ে যাওয়া রোধ করা যেত অনায়াসেই।

লেখাটি শেষ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে পাঠাতে গিয়ে জানা গেল, ঢাকার রাস্তায় রক্ত ঝরেছে আরও এক ব্লগারের। তিনি বয়সে তরুণ, ওয়াশিকুর রহমান বাবু। অভিজিৎ রায় যখন হামলার শিকার হন তখন চারপাশে অনেক মানুষ ছিলেন, কিন্তু ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে হত্যার সময় দুজন তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি ঘটনাটি ঘটতে দেখেন এবং রিঅ্যাক্ট করেন। ফলে খুনিদের মাঝে দুজনকে আটক করা গিয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে। যা বাইস্ট্যান্ডার এফেক্ট তত্ত্বের ভিত্তি অনুমোদন করে। আমরা চাই, এভাবেই প্রত্যক্ষদর্শীরা এগিয়ে আসুন। তাহলে আজ কেউ কেউ খুন করে পালানোর সময় ধরা পড়েছে; কাল হয়তো খুন করার আগেই ধরা পড়বে খুনিরা।

মনে রাখতে হবে যে, সাধারণ জনগণের সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টি অনেকটা ঐচ্ছিক। যাদের এটি দায়িত্বের মধ্যে পড়ে সেই পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, নির্লিপ্ততা, অপেশাদার ভূমিকা সাধারণ জনগণের মাঝে উদ্বেগের সৃষ্টি করে। ফলস্বরূপ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রের ভূমিকা। একটি প্রতিরোধযোগ্য এবং দৃশ্যমান হত্যাকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ব্যর্থতা; সেই সঙ্গে অতীতের হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া আরেকটি হত্যাকাণ্ডের পটভূমি তৈরিতে সহায়তা করে। তাই রাষ্ট্রের দায় সবার আগে। রাষ্ট্র উদ্যোগী হলে সাধারণ জনগণের মাঝেও বাইস্ট্যান্ডার এফেক্টের বর্তমান নেতিবাচক প্রভাবকগুলো ইতিবাচক হতে শুরু করবে।

পাশাপাশি, এটাও রাষ্ট্রের জনা জরুরি যে, ধর্মীয় সংবেদনশীলতার বিষয়টি সমীহ করতে গিয়ে উগ্রতা যেন কোনোভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি না পায়, যে আলামত ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে– যার নির্মম বলি হলেন হুমায়ূন আজাদ, অভিজিৎ রায়ের মতো বহুমুখী প্রতিভাবানরা।

দেব প্রসাদ দেবু: কলামিস্ট; ছাত্রআন্দোলনের সাবেক কর্মী।