একের পর এক হত্যাকাণ্ড অতঃপর মুক্তমতের প্রকাশ

ফরিদ আহমেদ
Published : 31 March 2015, 06:08 AM
Updated : 31 March 2015, 06:08 AM

ফোনটা আসে ঠিক দুপুরের দিকে, ভয়ংকর এক অশুভ সংকেত হয়ে। ফোনের স্ক্রিনে নাম্বার দেখেই টের পাই যে বাংলাদেশ থেকে এসেছে। হ্যালো বলতেই, ওপাশ থেকে ভেসে আসে শ্যালক রানার কণ্ঠ: "মিলটন ভাই, আপনার জন্য একটা খারাপ খবর আছে। আপনার বন্ধু অভিজিৎ রায় খুন হয়েছেন। তাঁর ওয়াইফও আহত।''

ওর সঙ্গে আমার আর কী কী কথা হয়েছে কিছুই মনে নেই এখন। ফোনটা রেখেই ত্বরিৎগতিতে 'প্রথম আলো' খুলি। মন বলছে, এ সবের কিছুই সত্যি নয়। কিন্তু খুলে দেখি সত্যি সত্যিই ঘটেছে এটি। অভি নিহত, চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে তাকে। বন্যাও গুরুতরভাবে আহত।

স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি আমি। গত এক দশকের কত স্মৃতি, কত হাস্য-রসিকতা, কত স্বপ্ন, কত পরিকল্পনা, কত কিছু দুজনে একসঙ্গে। দুজনে বললেও ভুল হবে, আমার আসলে বলা উচিত, তিনজনে মিলে। বন্যাও জড়িত থাকত প্রায় সবকিছুর সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে। দশ বছরে আমাদের সামনাসামনি দেখা হয়েছে মাত্র একবার। কিন্তু প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে যোগাযোগ হয়েছে আমাদের, হয়েছে চিন্তার আদান-প্রদান। সেই অভি আর নেই।

শুধুমাত্র মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা ছিলো না সে, বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধির যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল অনলাইনে তার পুরোধা ছিল সে। যুগে যুগে তাকে স্মরণ করা হবে তার এই ভূমিকার জন্য। বিজ্ঞান লেখক হিসাবেও সে অনন্য। সাহিত্যসমৃদ্ধ সুললিত ভাষায় বিজ্ঞানের একেবারে সর্বশেষ ও প্রান্তিক বিষয়গুলো নিয়ে এমন সুখপাঠ্য বই আর কেউ লেখেনি কখনও। জনপ্রিয়তা সব সময় শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয়, কিন্তু অভির ক্ষেত্রে এই দুইয়ের সমন্বয় ঘটেছিল অসাধারণভাবে।

চৌদ্দ বছর আগে দেশ ছেড়েছিলাম। শ্বেতশুভ্র বরফের দেশ কানাডায় এই আমি তখন ক্ষ্যাপার মতো ঘোরাফেরা করি আর সব কিছুতেই খুঁজে বেড়াই স্বদেশের পরিচিত আদরমাখা সুশীতল পরশ। প্রতিদিন বেশ খানিকটা সময় ব্যয় হয়ে যেত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাংলাদেশের দৈনিক আর সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো ইন্টারনেটে পড়ার কারণে।

একদিন 'যায় যায় দিন' পত্রিকায় কুদ্দুস খানের একটা লেখা থেকে পেয়ে যাই 'ভিন্নমত' নামের একটি ওয়েবসাইটের ঠিকানা। দেখি অসাধারণ আর বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে রংবেরংএর অসংখ্য প্রবন্ধ দিয়ে ভরপুর ওয়েবসাইটটি। সে সমস্ত প্রবন্ধের আবার বিরাট একটা অংশ জুড়েই ছিল পুরোপুরি প্রথাবিরুদ্ধ লেখা।

আমার দৃষ্টি বিশেষভাবে কেড়ে নিল এক অকুতোভয় তরুণের লেখা। খাপখোলা তলোয়ারের মতো তীক্ষ্ণ শাণিত যুক্তি, ঝরঝরে প্রাঞ্জল ভাষা, তত্ত্ব আর তথ্যের সুসংবদ্ধ উপস্থাপনা এবং বিতর্কের এক অত্যাধুনিক স্টাইলে একের পর এক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে যাচ্ছিল সে।

সেই তরুণের ক্ষুরধার বুদ্ধি, জ্ঞানের অতলস্পর্শী গভীরতা, চিন্তার আধুনিকতা এবং ভাষার সাবলীলতা দেখে তার ভক্ত হয়ে যাই। অজানা, অচেনা এক তরুণ বেশ বড়সড় একটা জায়গা করে নেয় মনের মণিকোঠায়। গভীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতাম তার পরবর্তী লেখা পাওয়ার আশায়।

এরই মধ্যে একদিন দেখলাম, সেই তরুণ নিজেই খুলে ফেলেছে দারুণ ঝকঝকে, তকতকে, স্মার্ট এবং ব্যতিক্রমী একটি ওয়েবসাইট। সেই তরুণটি আর কেউ নয়, সে আমাদের সকলের প্রিয় অভিজিৎ রায়। সেই ওয়েবসাইট হল আমাদের সবার প্রিয়, সবার ভালবাসায় সিক্ত, 'মুক্তমনা'।

তখন ২০০১ সাল। মূলত অভিজিৎ এককভাবেই এর প্রতিষ্ঠাতা। আরও কেউ কেউ যে ছিলেন না এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেটা বলছি না। আসলে একটি আলোচনাচক্রের মাধ্যমে এর জন্ম। কিন্তু জন্মসময় এবং জন্মের পরে এর বিকাশে অভিজিতের একক অবদান অনেক বেশি প্রত্যক্ষ, প্রাচুর্যময় এবং প্রধানতর। মানবমনের বৌদ্ধিক বিকাশে যুক্তি, বুদ্ধি এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনার গুরুত্ব বৃদ্ধিই ছিল এর মূল কাজ।

মুক্তমনার বিরুদ্ধে গুরুতর একটি অভিযোগ হচ্ছে যে, এটি ধর্মবিরোধী, বিশেষ করে ইসলামবিরোধী। মুক্তমনা অবশ্যই ধর্মবিরোধী, এতে লুকোছাপার কিছু নেই। কিন্তু এখানে কোনো ধর্মের প্রতি বিশেষ পক্ষপাত নেই। ইসলাম নিয়ে লেখা বেশি আসে মুক্তমনায় শুধুমাত্র এ কারণেই যে, এর বেশিরভাগ সদস্যই মুসলিম পরিবার থেকে এসেছেন; তাঁদের জন্য ইসলাম নিয়ে লেখা যতটা সহজতর, অন্য ধর্ম নিয়ে ততটা নয়। তবে সংখ্যায় কম হলেও, অন্য ধর্মগুলোর তীব্র সমালোচনা করতে মুক্তমনা কখনও দ্বিধা করেনি।

শুধুমাত্র ধর্মের সমালোচনা করার মতো সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকার জন্য মুক্তমনার জন্ম হয়নি। একে একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছি আমরা। আলাপ, আলোচনা আর তর্কবিতর্কের মাধ্যমেই সেটা সম্ভব। মানুষ যখন এগুলো সম্পর্কে সচেতন হবে, তখন আপনাআপনি ভ্রান্ত বিশ্বাসের কবল থেকে বের হয়ে আসা তাদের পক্ষে সহজ হবে।

নিরন্তর এই লড়াইয়ের পাশাপাশি মানবতা ও ন্যায়ের পক্ষেও কাজ করে যাচ্ছে মুক্তমনা। যেখানেই মানবতা লঙ্ঘিত হচ্ছে, সেখানেই মুক্তমনা তার সামর্থের শেষ বিন্দু দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। হোক না তা বাংলাদেশে, ভারতে, ফিলিস্তিনে বা ইরাকে। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও মুক্তমনা সোচ্চার কণ্ঠ।

বই মেলায় গিয়েছিল বন্যা আর অভিজিৎ সেদিন। বই মেলাকে সবাই বলে প্রাণের মেলা। অভিজিতের মতো পড়ুয়া একজন মানুষের জন্য এটা আরও বেশি কিছু। এবার অবশ্য অন্য তাগিদ ছিল বেশি। অভিজিতের দুটো বই প্রকাশিত হয়েছে এই মেলায়– 'শূন্য থেকে মহাবিশ্ব', 'ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে'। দুটোই অসাধারণ মানের বই। মেলার প্রথম দিন থেকেই বিক্রি হচ্ছে দুরন্ত গতিতে।

আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকে ভাবা হত বাংলাদেশের সবচেয়ে মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন এলাকা। মাত্র বিশ বছরের ব্যাবধানে সেই ক্যাম্পাস এখন পরিণত হয়েছে দুর্বৃত্তদের পদচারণায় মুখর।

মুক্তমনার শুরুর দিক থেকেই আমরা নানা ধরনের হুমকি পেতাম, শুনতাম অশ্লীল খিস্তিখেউড়। আমি পেতাম কম, অভিজিৎ অনেক বেশি। এসব হুমকির বেশিরভাগই আসত ইমেইলে। নানা ধরনের গালিগালাজসমৃদ্ধ ছিল সে সব হুমকি। আমরা এগুলো পাত্তাও দিতাম না। বরং নানা সময়ে রসিকতাই করেছি এ নিয়ে। এগুলো সিরিয়াসলি না নেবার পিছনে অবশ্য তখন যুক্তিও ছিল আমাদের কাছে। সে সময় মূলত ব্লগেই লিখতাম আমরা। সেখানে আমাদের ছবি ছিল না, পরিচিতিও নয়। কোথা থেকে লিখছি সেটা নিজে না বলে দিলে কারও পক্ষেই অনুমান করা সম্ভব ছিল না। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র উপায় ছিল ইমেইল।

কিন্তু ফেসবুকে আমরা সক্রিয় হবার পর পরিস্থিতি রাতারাতি পালটে গেল। এখন অনেকেই আমাদের চেহারায় চেনে। অভিজিতের জন্য কাল হল আর বেশি। সে ফেসবুকে অনেক বেশি সক্রিয়, অনেক বন্ধু তার। এ সময় থেকেই আসলে হুমকিগুলো সিরিয়াস দিকে টার্ন নিতে থাকে। নানাজন তাকে হুমকি দিতে থাকে।

এর মধ্যে বহুল প্রচারিত হুমকিটি ছিল ফারাবির। রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডের পর তার জানাযা পড়িয়েছিলেন যে ইমাম তাকে হত্যার হুমকি দেওয়ার মধ্য দিয়ে লাইমলাইটে আসে সে। এর পরপরই তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু বেশিদিন আটকে রাখেনি। এই আটক হওয়াটাই ফারাবিকে উচ্চতর অবস্থানে নিয়ে যায়। অসংখ্য গুণমুগ্ধ অনুসারী জুটে যায় তার। আর এর প্রভাবেই একে-ওকে-তাকে অহর্নিশ মৃত্যুর হুমকি দিতে থাকে সে।

অভিজিতের সঙ্গে তার প্রথম ঝামেলা শুরু হয় অভিজিতের একটা লেখা কেন্দ্র করে। সেটির শিরোনাম, 'বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের নতুন সংযোজন 'ধর্ম ও নৈতিকতা' নিয়ে কিছু কথা'। লেখায় অভিজিৎ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের নতুন প্রস্তাবিত 'ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা' বইগুলোর কিছু সমালোচনা করেছিল। সে রেফারেন্স দিয়েই ধর্মের অনৈতিক বিষয়গুলো তুলে ধরেছিল। কিন্তু লেখাটি পড়ে গভীরভাবে গোস্বা করে ফারাবি। অভিজিতকে হত্যার ফতোয়া জারি করে সে। অভিজিৎ একা নয়, মুক্তমনার সকল নাস্তিক ব্লগারদের পাথর ছুঁড়ে হত্যা করার হুমকিও দেয় সে।

আগে যে সমস্ত হুমকি ছিল কাগজেকলমে সীমাবদ্ধ, সেগুলোই গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে ২০১৩ সালে রাজীব হায়দারের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর থেকে। ২০১৪ সালে গলা কেটে হত্যা করা হয় মাওলানা ফারুকীকে, তাঁর নিজের বাসায়। তিনি উদারপন্থী বলে পরিচিত ছিলেন। বোঝা যায় যে, অন্তর্জালে যুক্তিবাদ এবং নাস্তিকতার যে চর্চা চলছে, তাকে সশস্ত্র আক্রমণ করেই নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে ধর্মীয় মৌলবাদীরা। এর মধ্যে ফারাবি গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে অভিজিত হত্যার পরিকল্পনার ঘোষণা দেয়।

এ সমস্ত হুমকিতে অভিজিৎ ভয় পায়নি, কিন্তু সতর্ক যে ছিল না, সেটা বলা যাবে না। দেশে গেলে সমস্যা হতে পারে, সে আশংকাও ছিল তার মনে। কিন্তু সেই অভিজিতই দেশে যাবার পর বই মেলার টানে নিজের সফরটা লো লেভেলে রাখতে পারেনি। রাখতে পারার কথাও নয়। নিজস্ব গুণে সে পরিণত হয়েছিল সেলিব্রিটিতে। বইয়ের মোড়ক উদ্বোধন করেছে সে; নিজের বইয়ের অটোগ্রাফ দিয়েছে; পাঠকদের সঙ্গে ছবি তুলেছে; সমমনা লেখক, পাঠক, গুণগ্রাহীদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছে; আড্ডা দিয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ সংগঠনের মানুষজনদের সঙ্গেও। আর এর মাধ্যমে নিজেকে পরিণত করেছে মৌলবাদীদের সহজতর শিকারে।

প্রতিটা যুগেই মুক্তচিন্তা যাঁরা করেছেন, সমাজকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন সামনের দিকে, গাঢ় অন্ধকার দূর করতে চেয়েছেন প্রদীপ জ্বেলে– প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থপর গোষ্ঠী তাঁদের সহ্য করতে পারেনি। নৃশংসভাবে হামলে পড়েছে মুক্তবুদ্ধি, মুক্তকচিন্তা রুদ্ধ করতে। ভয়ানক আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আলোর মশাল নিভিয়ে দিতে। তাঁদের এই আক্রোশে, নৃশংস হামলায় রক্ত ঝরেছে মুক্তচিন্তকদের। তাঁদের শরীর থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়েছে রুক্ষ মাটিতে। বন্ধ্যা মাটি সেই রক্তে হয়ে উঠেছে উর্বর। মুক্তচিন্তকদের রক্তবীজ থেকে বের হয়ে এসেছে আরও অসংখ্য মুক্তচিন্তার মানুষ।

অদ্ভুত এক আঁধার নেমে এসেছে আজ বাংলাদেশে। এখানে মুক্তবুদ্ধির চর্চা আর কোনোভাবে নিরাপদ নয়। অসহিষ্ণুতা এমনই সর্বব্যাপী যে, বিপরীত চিন্তা, বিশেষ করে ধর্মের সমালোচনাবিষয়ক কোনো কিছু সহ্য করতে পারছে না কেউ। সমাজটাও হয়ে উঠেছে ধর্মাচ্ছন্ন। দিকে দিকে শুধু ধর্মানুভূতি আহত হবার জিগির। এ আঘাতে আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি তখন মরিয়া হয়ে ঘুরে বেড়ায় রক্তের নেশায়। সে উত্তেজনা ও ক্ষিপ্ততায় এখন বাংলাদেশও কাঁপছে। মুক্তচিন্তার লেখকদের জান হাতে রেখে লেখালেখি করতে হয়। অসীমসাহসী না হলে নিজের নামে আর লিখছে না কেউ।

আরেকটি মর্মান্তিক খবর এল। ৩০ মার্চ বাংলাদেশ সময় সকাল পৌনে ১০টার দিকে বাসার কাছেই রাস্তার মধ্যে তিনজন চাপাতি নিয়ে ব্লগার ওয়াশিকুরের ওপর হামলা চালায়। তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি বিভিন্ন ব্লগে নিয়মিত লেখালেখি করতেন। এ কারণে তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।

দেশের বাইরে যাঁরা আছেন তাঁরাও যে নিরাপদ নয়, সেটা অভিজিৎ রায় এবং বন্যা আহমেদকে দেখেই বোঝা গেছে। বিদেশে থাকি আর যেখানেই থাকি না কেন, আমাদের সবার শিকড় তো পোঁতা রয়েছে বাংলাদেশেই। কোনো না কোনো প্রয়োজনে ফিরতেই হয় সেখানে।

অভিজিৎ হত্যার এক মাস পার হয়ে যাবার পরও তদন্তে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। খুনি বা খুনিদের ধরা তো দূরের কথা, কে তাকে খুন করতে পারে, সে সম্পর্কেই পুলিশের ধারণা নেই। সেই শুরুতে তারা যেখানে ছিল, সেখানেই পড়ে আছে আজকেও। ২২শে মার্চ মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন যে, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ড 'ক্লু-লেস' হওয়ায় এর সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনিরুল যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে প্রবলভাবে শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। প্রকাশ্য রাজপথে অসংখ্য মানুষের সামনে সংঘটিত খুনের 'ক্লু' যদি পুলিশ ঘটনার এক মাস পরও বের না করতে পারে, তবে সে খুনের তদন্তে কী ফলাফল বেরিয়ে আসবে, সেটি সহজেই অনুমেয়।

ব্লগার রাজীব হায়দারের খুনিদের অবশ্য পুলিশ ধরতে পেরেছে। তারা পাঁচজনই এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়ার কথা স্বীকার করেছে। ঘটনা এ পর্যন্তই। এদের কবে বিচার হবে, কবে সাজা হবে, আদৌ হবে কিনা, তার আমরা কিছুই জানি না।

বাংলাদেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সেটাই হত্যাকারীদের উৎসাহ দিয়ে চলেছে অবিরাম। এখানে অপরাধ ঘটানো সুলভ, বিচার পাওয়াটা দুর্লভ। তাই তো অভিজিৎ হত্যার এক মাস পর বন্যা আহমেদকে বিবৃতি দিতে হয় সুষ্ঠু তদন্ত আর ন্যায়বিচার চেয়ে। বিচারের জন্য কেন রাষ্ট্রের কাছে কাকুতি-মিনতি করতে হবে? কেন ভিক্ষা চাইতে হবে? রাষ্ট্রের তো স্বাভাবিক দায়িত্ব অপরাধীদের ধরা, তাদের সাজা দেওয়া। সেই স্বাভাবিক আচরণটা করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে রাষ্ট্র।

অভিজিতকে অকালে, অকস্মাৎভাবে হারানোটা মুক্তমনাদের জন্য বিশাল বড় একটা ধাক্কা। বিপুলভাবে বিচলিত আমরা শুরুতে থমকে গিয়েছি, সংশয়ে পড়েছি, দ্বিধাগ্রস্ত আচরণও করেছি কেউ কেউ। এতে দোষের কিছু নেই। অভিজিৎ এককভাবে বিশাল এক ছাদ হয়ে সবাইকে ছায়া দিয়ে গিয়েছে এতদিন। শুরুর বিচলিত অবস্থা দ্রুত সামলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে মুক্তমনারা। অসুরবধ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। দ্রোহের আগুনে পুড়িয়ে দেব ঘরদোর।

আমাদের চারপাশে জমে থাকা সহস্রাব্দের অন্তহীন আঁধার দূরে সরিয়ে জানি একদিন ভোর হবে। দিগন্তের কাছে ক্ষীণ অস্পষ্ট যে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে, তার আড়ালেই তো লুকিয়ে আছে অনাগত সূর্যের উজ্জ্বল হাসি।

ফরিদ আহমেদ: মডারেটর, 'মুক্তমনা'।